প্রিন্স, মার্চেন্ট, পোয়েট

প্রিন্স, মার্চেন্ট, পোয়েট

সেও তো একটা শ্বাস যার বেঁচে থাকবার জন্যে প্রতি মুহূর্তে পরবর্তী শ্বাসকে দরকার [জয় গোস্বামী ।। হরিণের জন্য একক]

সক্কলেরই চাই। সকলের প্রত্যেকের চাই। চাই তার পরবর্তী শ্বাসবায়ু। চাই প্রতি মুহূর্তের পরবর্তী শ্বাসকে। কিন্তু সক্কলেই কি পায়? সকলে প্রত্যেকে পায় নাকি তার নাগাল? তার পরিসংখ্যাতীত প্রার্থনার ধন পরবর্তী শ্বাসকে, প্রিয় শ্বাসবায়ুটিকে? অথচ সক্কলের দরকার। সকলের প্রত্যেকের দরকার। প্রতি-এক শ্বাস চায় তার পরবর্তী শ্বাস। প্রতি-একটা শ্বাস কান্দে তার পরবর্তী শ্বাসের লাগিয়া। চায় পরবর্তিনীকে। চায় চায় চায় …

সত্যি কি চায় সক্কলে সকলে প্রত্যেকে সবে? সত্যি-সত্যি সততায় চায়? সনাক্ত করতে পারে সক্কলে-সকলে-প্রত্যেকে-সবে তার প্রতিমুহূর্তের-পরবর্তী শ্বাস যে, তাকে? নাকি স্রেফ শ্বাস হয়ে বেঁচে থাকে? পরবর্তী-মুহূর্তের পরিণামহীন, পরবর্তিহীন শ্বাস হয়ে, বেঁচে থাকা শুধু? কে তাহারে চিনতে পারে আজকের এই গতিগ্রস্ত দিনে! আজকের এই জৌলুসঝরা রঙ্গজগতে তুমি কি পেরেছ তাকে চিনে নিতে সম্যক, তোমার প্রতিমুহূর্তের-পরবর্তী প্রিয় শ্বাস-মানুষটিকে?

ওই পঙক্তিটি, অনতিপূর্বে উৎকলিত ওই শ্বাসবাক্যটি, লিখেছেন জয়। লিখেছেন কোন জয়? প্রিন্স জয়? মার্চেন্ট জয়? না পোয়েট জয়? ম্যাকিয়াভিলি জানেন। তবে এপিগ্র্যাফের পঙক্তিটি লিখেছেন জয় গোস্বামী। লিখেছেন গোসাঁই। বিশাল হরফে উৎকীর্ণ রয়েছে ‘হরিণের জন্য একক’ কবিতাগ্রন্থের সূচনাপাতায়। বইটি বিশেষ আকৃতিতে ছাপানো, সচিত্র, দুর্দান্ত সব অঙ্কনে শিল্পিত। এ-ধরন রাজকীয় চেহারায় ছাপা-হওয়া বই বিদেশে সুলভ হলেও, আমাদের ভাষাদেশে তেমনটা অ্যাভেইলেবল্ না এখনও, অধুনা মুদ্রণপ্রযুক্তি ও প্রকাশনামান আধুনিকায়নের ফলে অমন সেলিব্রিটি-সুরতের বই বাংলাতেও বেরোচ্ছে আজকাল। বিদেশে ওই-রকম বইকে বলে কফিটেবিল-বুক, ড্রয়িংরুমে কফিটেবিলে অভ্যাগতরা নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে আপ্যায়নের জন্য অথবা গৃহকর্তার জন্য অপেক্ষা করেন; আপ্যায়িত হয়ে, গৃহকর্তার সনে অভিপ্রেত আলাপ সেরে, বইটির স্মিত সৌন্দর্যে স্নিগ্ধস্নাত হয়ে প্রীতচিত্তে তারা বিদায় নেন। এ-রকম দুয়ের অধিক বই বেরিয়েছে জয়ের। ‘হরিণের জন্য একক’ ছাড়াও যেমন : ‘সন্ধ্যাফেরি’, ‘মৌতাত মহেশ্বর’ প্রভৃতি। ঈর্ষণীয় উৎপাদনমান! শেষোক্তটিতে জয়ের আদি ও আসল অকৃত্রিম আখর/আমেজ পাওয়া গেল অনেকদিন পর। ‘হরিণের জন্য একক’-ও ও-রকম, জয়-জয়কার। ‘সন্ধ্যাফেরি’ মূলত ৪টি কাহিনিকবিতা নিয়ে নির্মিত, বর্ণিল ও চিত্রশোভিত। বিশেষ ভালো লাগেনি লেখা, তবে কাহিনিরেখাগুলো কিঞ্চিৎ হৃদি-চিনচিন-করা। সেইসূত্রে বলতে হয়, অমন হৃদি-চিনচিন কাহিনি কেবল কবিই পারেন ফাঁদতে। জয় কবি। প্রিন্স নন, মার্চেন্টও নন।

তবে কবিদের মধ্যে সওদাগরবৃত্তি ইদানীং ক্রমবর্ধমান। প্রিন্সটেন্ডেন্সি চিরকালই ছিল লক্ষ করা যাবে। এলিয়টকথিত অ্যাটেন্ডেন্ট টু লর্ড কবিতে দেশকাল সয়লাব হয়ে আছে। টেন্ডেন্সিটা নানাভাবেই দৃশ্যমান কবিদের ফোটোগ্র্যাফে, জেশ্চারে, চলনবলনকেতায়। ভিক্টোরিয়্যান্ পিরিয়ডের আংরেজ কবিদের আলোকচিত্রিত অথবা পেইন্টারপ্রণীত প্রতিকৃতি বিশেষভাবেই দ্রষ্টব্য। জুলফি, হেয়ারকাট এবং কুর্তার উঁচানো কলার ইত্যাদি মিলিয়ে একটা রাজাপ্রতিম পোজের পোর্ট্রেইট। সম্প্রতি সিনেসেলেব্রেটিদিগের অনুসৃতিও গোচরে এসেছে। কবিরা নায়কোচিত ফোটো উঁচিয়ে ধরছেন মহাকালে। ব্যাপারটা কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরেই গিয়েছিল শুরু হয়ে। এই সবকিছুই কবিতার অগ্রগতিধারা আমাদের চোখের সামনে এনে দেখায় ক্লিয়ার অক্ষরে। দেখায় কি? নিশ্চয় দেখায়।

কেবল একটা ব্যাপারেই কিছু খটকা থাকিয়া যায়। মার্চেন্ট কবিরা, যেমন ধরো জয় গোস্বামী, পাঠকের জেবের ভেতরকার রেস্ত সংক্রান্ত খোঁজপাত্তা রাখেন না আদৌ। সহস্র আশ্রফির হাদিয়াযুক্ত কবিতাবই কিনবে যে-পাঠক, সে থাকে কোথায়? মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত গৌতম চ্যাটার্জির গানে এই পাঠকের ঠিকানাসাকিন পাওয়া যাবে, সেই দিব্য মুখোপাধ্যায় সৃজিত কথায় ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ অ্যালবামের গানে, ‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি দেখা যায় তোমাদের বাড়ি’ ইত্যাদি লিরিক্সঘনিষ্ঠ কথাভাগে। এর চাক্ষুষ প্রভাবে বাংলা কবিতা, বাংলাদেশস্থ ও অন্যান্য ভূখণ্ডস্থ, হাতির দাঁতের মতো অমূল্য ও জ্যোৎস্নাশাদা নান্দনিক হয়ে উঠছে দিন-কে-দিন। গজদন্তমিনারটা বাংলা কবিতার করতলগত হলো জয় ও অন্যান্য অপরাজেয় অকুতোভয় উন্নত ঝকমকা ঝাকানাকা-ঝাকানাকা কাব্যগ্রন্থাদির মহামূল্য অবিস্মরণীয় অবদানের ফলে। এই বাগানে সবই আছে, কেবল নাই শ্বাসটা।

আমরা তেনাদের ভুলব না, আমরা তেনাদের ভুলব না …

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you