স্বর, সুর, শব্দ ও সংগীত

স্বর, সুর, শব্দ ও সংগীত

টেলিভিশনস্ক্রিনে আবদুশ শাকুর নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে বেশকিছু প্রোগ্র্যামে স্বকণ্ঠে গান গাইতে শুরু করেন, মূলত রবীন্দ্রসংগীত হলেও পঞ্চগীতিকবিরই গান উনার গলায় শোনা হয় এবং অ্যালবামও বেরোয় অব্যবহিত পরেই তিন-চারটে একলগে, ভয়াল সেই শ্রবণাভিজ্ঞতা! যারা সেই দৃশ্য ও শ্রুতির শিকার, তারা জানবেন এবং আশা করি বলবেনও যে রাগরাগিণী নিয়া শাকুরের ব্যাপক আগ্রহ ও জ্ঞানগম্যি থাকলেও উনারে আল্লা গাইবার গলাটা একদমই দেন নাই। বিস্তর বাতাস উনার গালের ভিতরে পাম্প করে নিয়ে সেই বাতাসটা গাল চুপসায়ে বা গাল ফুলায়ে যখন ছাড়তেন তখন কৌতুককর একটা আওয়াজ হতো, ভুতুড়ে একটা আওয়াজাবহ, ওইটাই ছিল উচ্চপদস্থ আমলা আবদুশ শাকুরের গলায় গান। তবু অবসরপ্রাপ্ত ও উচ্চপদে দীর্ঘদিন আসীন থেকে রোজগার/সঞ্চয়-করা আমলাদের খেয়াল বলে কথা। চার-পাঁচখানা কম্প্যাক্ট ডিস্ক উনি মার্কেটে ছেড়ে গেছেন মৃত্যুকালে। যেমন বাংলার সব আমলারই তিরিশ-বত্রিশখানা বালাম থাকে কবিতার বা প্রবন্ধের বা গালগল্পের, নিদেন আত্মজীবনী তো হরেদরে প্রত্যেকেরই এক-দুইখানা, তাদের মৃত্যুকালে। শাকুর এমনিতেই কথাসাহিত্যিক হিশেবে বিশিষ্ট গণ্য ছিলেন, আমলা সাহিত্যিকদের মধ্যে এই জিনিশটা আজও বিরল। উনার প্রবন্ধগদ্য পড়ে বোঝার জো নাই যে উনি বিদঘুটে আমলা আছিলেন, শুধু উনার গানটা ঘাপলা পাকায়। শাকুরের স্বকণ্ঠ সংগীতবাদ্য শুনলে যে-কেউ বুঝে ফেলে ইনি নিশ্চয় ছিলেন আমলা, না-হয়ে পারেনই না, আর অত্যন্ত পদস্থই ছিলেন উচ্চতায় তা-ও উনার গানের কসরত শুনেই বোঝা যায়। ব্যাপক অপদস্থ অবস্থা হয় খালি লিস্নারদেরই, উনার গান শোনার আনফর্চুনেইট অভিজ্ঞতা হলে।

এত কথা বলবার কারণ একটাই, সেইটা হচ্ছে প্যাশন। শাকুরের সংগীতে, মানে সংগীত জিনিশটা বিষয়ে,  প্যাশন ছিল অবসেশনেরই পর্যায়ে। সংগীত নিয়া মানুষটা অবসেসডই ছিলেন আন্দাজ করি। তাই তো প্রৌঢ়বেলায় চাইর-পাঁচটা সিডিভাসানো গলায় হাওয়া পাম্পানো। তবে একটা লাভের লাভ হয়েছে এ-ই যে, এমনটা হাবাগোবা ফ্যাসিনেশনের কারণে উনার কলমে কৃত সংগীতের ইন্টার্প্রিটেশনগুলো হয়েছে বেশ অন্য আদলের উপভোগ্য। কম বই তো উনি করেন নাই, মিউজিক রিলেটেড উনার সবগুলো বই এবং লেখাপত্র হয়েছে পাঠোপভোগ্য; কথাটা আদৌ অস্বীকারের উপায় নাই। শাকুরের সংগীতগ্রন্থগুলো উপভোগ্য গদ্যেরও নমুনা।

আর এর ফলে শাকুরের করা সাংগীতিক আলোচনাগুলোতে সংগীত জিনিশটা আরও বেশি অনুভবনীয়, দর্শনীয় ও স্পর্শনীয় হয়ে উঠতে পেরেছে যেন। ‘স্বর, সুর, শব্দ ও সংগীত’ শীর্ষক উনার বইটায় আগের বইগুলোর মতোই তিনি সংগীতবীক্ষক হিশেবে রেপ্যুটেশন বজায় রেখে যেতে পেরেছেন। অনিবার্য বলতে হয় আবারও যে এই বইটাতেও প্রমাণ পাওয়া যায় মিউজিক-ফ্যাসিনেইটেড শাকুরের শোনাজানার পরিধির। ভারতীয়/উপমহাদেশীয় রাগসংগীতের উপর উনার ব্যাপক পঠনপাঠনজাত দখল। তদুপরি নিজে নিজে একটা গাইবার চেষ্টা সারাজীবন ধরে, এইটাও ধর্তব্য। সংগীতপ্রবন্ধগুলোয় তিনি মিশিয়ে দিতে পেরেছেন নিজের সাহিত্যবোধ। এইটা ভ্যালু অ্যাড করেছে লেখাগুলোয়।

লিখেছেন সংগীত নিয়াই বিস্তর বড়সড় কলেবরের প্রবন্ধ। বৈচিত্র্যেও উল্লেখযোগ্য সমস্ত শাকুররচনা। কর্ণাটকি মিউজিক, হিন্দুস্তানি মিউজিক, রবীন্দ্রস্যংস্ ও মিউজিক, নজরুলমিউজিক, লোকমিউজিক, কলের গান, মুক্তির গান প্রভৃতি বিচিত্রকৌণিক সংগীতবিষয়ক রচনা তার। লিখেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, ভি. বালসারা, বিসমিল্লা খান, শচীন দেব বর্মণ, নওশাদ আলী, বিলায়েত খাঁ প্রমুখের মতো সংগীতসরোবরের স্মরেণ্য ও বরেণ্য ব্যক্তিদেরে নিয়া শাকুরের রয়েছে লেখাপত্র অনেক। সব ধরনধারনের লেখাগুলোর মধ্য থেকে একটি সিলেক্টেড সংগ্রহ এই বই। সংগীতসমুজদারেরা, বাংলায় মিউজিকবিষয়ক রচনাপাঠের সন্ধানী রিডার-অথার সকলেই, আবদুশ শাকুরের এই বইটির কদর করবেন সন্দেহ রাখি না।

প্রতিবেদন / আতোয়ার কারিম

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you