বইটি বেশ অনেকদিন আগে সিরাজুদ দাহার খান (দাহারভাই) গিফট করেছিলেন, তখন পড়া হয়নি চোখের একটা সমস্যা থাকার কারণে। পরে বেশ কয়েকবার পড়া শুরু করে, কয়েকটি গল্প পড়ার পর আবার রেখে দিয়েছি। মনে হলো, বইটি একটানা পড়তে পারলে ভালো হবে। এটা তো কোনো প্রবন্ধের বই না যে একটা-একটা করে আস্তেধীরে পড়লাম। এই বইটাকে আমার ‘জীবনভ্রমণ’ মনে হয়েছে, ফলে একটানা পড়তে চেয়ে একটু দেরি হলো। গত দু-দিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে একবারে পড়ে শেষ করলাম।
বইটির মাধ্যমে লেখক পাঠককে একটা পুরো জীবন ভ্রমণ করিয়ে এনেছেন অত্যন্ত কৌশলে, যদিও খণ্ডজীবন বলা হয়েছে। একজীবনের খণ্ড অংশ বটে, কিন্তু জীবনের কোনো একটা অংশের সম্পূর্ণ না, ফলে খণ্ড খণ্ড করে যাপিত জীবনের ভ্রমণ বলা যেতে পারে একে। সে-অর্থে বইয়ের নামকরণ খুব যথার্থ বলেই মনে হয়েছে। বইটিতে ২৯টি গল্পের মাধ্যমে লেখকের ‘জীবন’ ভ্রমণ করিয়েছেন পাঠককে সিরাজুদ দাহার খান।
লেখক অর্থাৎ দাহারভাইকে যেহেতু দীর্ঘদিন থেকেই চিনি, পরিচয়টা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে চরফ্যাশন ভোলায় একটা পিআরএ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আমি তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে মাত্র একবছর ধরে চাকুরিজীবনে প্রবেশ করেছি। প্রথম প্রশিক্ষণেই তার ভক্ত হয়ে গেলাম যেমনটা মিসেস খান ‘জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর’ গল্পে নিজের ছেলেকে বলেন, “কেন তুই নিজে দেখিস না, তোর বাবার ট্রেনিং পেয়ে কতজন তাকে গুরু মানে? তোর বাবার কত নামডাক দেখিস না!” নিখাদ একটি সত্য কথা, সেই ১৯৯৮ সাল থেকে আমি তার ভক্ত, বলা যায় আমি দাহারভাইকে আমার গুরু/ওস্তাদ হিসেবেই মানি। তার কাছ থেকেই আমার ফ্যাসিলিটেশনবিদ্যা শেখা। তারপর একসময় অ্যাকশন-এইডে সহকর্মী হিসেবেও কাজ করেছিলাম কিছু বছর।
বইটিকে কেউ বলেছেন আত্মজীবনী, কেউ বলেছেন জীবনের গল্প; আমি বলি, এটা একটি উঁচু মানের ‘ডায়েরি সাহিত্য’। আমি অনেক আত্মজীবনী পড়েছি, আত্মজীবনী পড়া আমার এক ধরনের নেশা। কিন্তু সেই আত্মজীবনীগুলোতেও এক ধরনের কৃত্রিমতা থাকে, সাজিয়েগুছিয়ে নিজেকে, নিজের কাজকে উপস্থাপন করার একটা প্রচেষ্টা থাকে; কিন্তু এই বইটি একবারেই নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি বলেই মনে হয়েছে, ডায়েরি লেখার মতো করেই গল্পগুলো বলা। বইটি পড়তে গিয়ে দুটো বিষয় বেশ উপভোগ্য ছিলো আমার কাছে :
১। গল্পগুলো এমনভাবে বলা হয়েছে যেন চোখের সামনে সেই সময়ের ছবিগুলো ভেসে যাচ্ছে
২। লেখককে যেহেতু আগে থেকেই চিনি ফলে তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, তার গোঁফের ফাঁক দিয়ে সাদা দাঁত সহ হাসি, প্রশিক্ষণে যেমনটা সবসময় দেখি, ঠিক সেই ছবিটাই গল্পগুলো পড়ার সময় চোখে ভাসছিল। মাঝে মাঝে মনের অজান্তে নিজেও হেসে উঠছিলাম। এত প্রাণবন্ত করে লেখা হয়েছে গল্পগুলো
বইয়ের “পূর্বাভাস” আমার দারুণ লেগেছে, অল্প পরিসরে এত চমৎকার করে লেখা যে পাঠককে ভেতরে টেনে নিয়ে যাবেই। পূর্বাভাস দিয়েই অনেক কথা বলা হয়েছে, পুরো জীবনের গল্পগুলো মূলত যার ভাবসপ্রসারণ।
প্রথম চারটি গল্প অর্থাৎ ‘হোয়াট এ শট’ থেকে ‘খানসাহেবের ঈদের প্ল্যান’ পর্যন্ত খুব হাস্যরসের মধ্য দিয়েই যাচ্ছিলাম, পরের গল্পের জন্য পাঠক হিসেবে আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। পরের ৪-৫টি গল্প বেশ সিরিয়াস টাইপের গল্প, রাজনৈতিক দর্শন এবং লেখকের বোহেমিয়ান জীবনের মর্মস্পর্শী একটা নাটকীয় মোড়। পরে ভেবে দেখলাম, এটা লেখকের একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য এবং কৌশল, শুরুটা বেশ হালকা রসিকতা দিয়েই শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে গভীরে, আরো গভীরে প্রবেশ করেন, এখানেও তিনি পাঠককে জীবনের গভীরে প্রবেশ করিয়েছেন নিজস্ব স্টাইলেই। তবে ‘মাদুলি বিক্রেতা’ থেকে ‘সাপুড়ে জীবন-৩’ পর্যন্ত গল্পগুলো কখনো কখনো মনে হয়েছে টেনেহিঁচড়ে লম্বা করার একটা প্রবণতা যা পাঠক হিসেবে আমার ভাবনার স্বাভাবিক গতিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটিয়েছে।
পুরো ২৯টি গল্পের বিন্যাস যেভাবে করেছেন, আমার মনে হয়েছে লেখক খুব ভেবেচিন্তে বিন্যাস করেছেন, একেবারেই পারফেক্ট। তবে আমার নিজের ভাবনায়, বইটা ‘পার্থক্য বিষয়ক জটিলতা’ দিয়ে শেষ করলে বেশি ভালো হতো। পাঠক লেখকের পুরো জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ পড়ে একটা জীবনদর্শন দিয়ে শেষ করতে পারতেন যার আবেশ তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হতো না। যদিও ‘আয়নায় ৬২ বছর’ এক ধরনের জীবন-অ্যাকাউন্টস বলা যায়, সেটা ঠিক শেষের আগে হলে বেশি ভালো হতো।
খণ্ডজীবনের কয়েকটি গল্প তো অসাধারণ ছিল : ‘জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর’, ‘খান সাহেব ও খুদে বন্ধুরা’, ‘বিবাহ সমাচার’, ‘জ্যোতিষী আঙ্কেল’ ইত্যাদি।
নদীর যেমন নানা বাঁক থাকে, মানুষের জীবনেও নানা বাঁক থাকে। যে-বিষয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, সেখানে গবেষণাপদ্ধতি হিসেবে যখন কেসস্টাডি করা হয় তখন জীবনের এই বাঁক বা টার্নিং পয়েন্টগুলো যথেষ্ট সাবধানতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং সেখানেই লুকিয়ে থাকে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য।
‘খানসাহেবের খণ্ডজীবন’ বইয়ে নানা বাঁকের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। লেখককে আমি ২২ বছর ধরে চিনি কিন্তু এই বাঁকগুলো সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। বইটি পড়ে আমি কিছুক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই স্তব্ধ হয়েছিলাম!
একজীবনে কত ঘাত-প্রতিঘাত, কত বঞ্চনা, কত সংগ্রাম, কত স্বপ্ন, কত সফলতা আর ব্যর্থতা লুকিয়ে থাকে, লেখক অসাধারণ এক পারদর্শিতায় তা খুব অল্প পরিসরে তুলে এনেছেন। অনেকদিন পর একটা বেশ ভালো বই পড়লাম এবং গত দু-দিন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যেই কেটে গেল।
লেখক সিরাজুদ দাহার খানের (আমাদের দাহারভাইয়ের) কাছে প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল, ‘খানসাহেবের খণ্ডজীবন’ অন্যান্য গল্প দিয়ে আরো কয়েক খণ্ড বের হবে এই প্রত্যাশা রইল।
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS