জহির রায়হান : গুমনাম আত্মার সতীর্থ / কথোপকথনগদ্য || বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও ইমরান ফিরদাউস

জহির রায়হান : গুমনাম আত্মার সতীর্থ / কথোপকথনগদ্য || বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও ইমরান ফিরদাউস

শেয়ার করুন:

উপক্রমণিকা 

জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২?) বাঙলা দেশের সিনেমার অন্যতম জরুরি নাম। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংগঠক পরিচিতি ছাপিয়ে যিনি সিনেমাকারিগর হিসেবে সমধিক পরিচিতি নিয়ে হাজির আছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরিসরে। সিনেমাকে ব্যবহার করতে শিখেছিলেন অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে। ইমেজের গায়ে ইমেজ গেঁথে গড়ে তুলতে জানতেন জায়মান বাস্তবতার অন্তর্লীন বয়ান। সমসাময়িক বাস্তবতার লেন্সে চোখ রেখে নির্মাণ করেছেন নতুন দিনের স্বপ্নদর্শী দিনমালা। উনিশশো একাত্তর সনে ক্যামেরাকে বানিয়েছিলেন রাইফেল। আর ১৯৭২-এ পয়লা মাসের আখেরি দিনে সরকারি প্রেসনোটে হয়ে গেলেন নিখোঁজ/গুম।

বাংলা সিনেমার (ব্যর্থ) ঈশ্বর জহির রায়হান সিনেমাটাকে শুধু ফ্যাশন হিসেবে নেন নাই, তিনি করেছিলেন জীবনের অংশ, যাপনের হেতু। তার সিনেমা মানুষের জীবন থেকে কখনোই মুখ ফিরিয়ে নেয় নাই, লার্জার দ্যান লাইফের স্বপন দেখাতে গিয়ে দর্শকের চোখে-মুখে গুঁজে দেয় নাই মিথ্যার অলীক পৃথিবী। বরং বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন তাদের, যারা সিনেমাকে ব্যবহার করে গেছে জীবনের নামে এবং যারা মানুষবিরোধী সিনেমা, কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল।

জহির রায়হান জীবনকে-মানুষকে ভালোবেসেছেন সংবেদনশীলতার আদর দিয়ে, জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন আবেগের চাদর দিয়ে; তবে, কখনো জীবন নিয়ে দ্বিধা রাখেন নাই বা নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে হিপোক্রেসি বা মোনাফেকির মলম বেচতে চান নাই। শুধু এই একটা কারণেই বারবার বা আবার আমি/আপনে/আমরা দেখব, ফিরে যাব তাঁর সিনেমার কাছে।

আর এই ফিরে যাওয়ার পথে দেখা হবে, আলাপ হবে আপনার বন্ধু(দে)র সাথে। যেমনটা জেনে নেবার সুযোগ ঘটেছে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের (জ. ১৯৩৬) স্মৃতির রোজনামচা থেকে। কবি, শিক্ষাবিদ, তাত্ত্বিক, শিল্পবেত্তা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বাঙলা সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি নিরীক্ষণ পরিসরের অন্যতম জরুরি মানুষ। তাঁর সাথে জহির রায়হান ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন ১৯৫২তে, ১৯৭১এ। একাত্তর সনে যখন রায়হান স্টপ জেনোসাইড  বানাচ্ছেন কোনোরকম সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই, তখন সমাজসচেতন, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বোরাহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখছেন বাংলাদেশের রূপরেখা ।

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাবনাগ্রামের মেঠোপথের ইশারা ধরে নিখোঁজ জহির রায়হানের সন্ধানকরণ, একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ, যেখানে জহির রায়হান বিষয়ে মাননীয় গণমাধ্যমের সম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিপক্ষে মানবীয় গুজবের যোগাযোগীয় উপযোগিতার মূল্যায়ন নিরিখ করা হয়ে থাকবে।

জহির রায়হান গুমনাম আত্মা হোক চলতি বিকৃত-মুখস্থ ইতিহাসের পৃথিবীকে উলটো করে সিধে করে পড়বার অনুপ্রেরণা।

“ভালোমন্দের বিচারে সময় শ্রেষ্ঠ বিচারক।
আজকের ভালো কালকে মন্দ।
কালকের মন্দ পরশুর ভালো।

তুমি আমার ভাই। তাই সে ভালো। সে আমার শত্রু। তাই সে খারাপ। তার ভালোটাও মন্দ। তার পূণ্যেও আমি পাপ দেখি। পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতির সদস্য আমরা। আমাদের বিচারক্ষমতা তাই সংকীর্ণ মনোবৃত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই সময়ের বিচারে অর্থহীন আমি সাধক নই।” ~ জহির রায়হান

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সাথে ইমরান ফিরদাউসের আলাপচারিতা

ইমরান ফিরদাউস : শিল্প-চিত্রকলা-সিনেমা বিষয়ে আপনার নিজস্ব দেখনদারি ও সমঝদারি চর্চা ও ভাবনার উৎসবিন্দু সম্বন্ধে জানতে চাই। আরো, জানতে চাইব তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) আমলে শিল্পসম্ভাবনা সৃষ্টিতে জহির রায়হানের ভূমিকা কী ছিল?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : চিত্রকলা বা শিল্প যা-ই বলি না কেন…এগুলো সম্বন্ধে পাকিস্তান আমল থেকেই আমার উৎসাহ ছিল। এবং যাদের নাম আমরা জানি জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান, এস এম সুলতান—এদের সকলেই তখন বেশ বড় হয়ে গেছেন। তাদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতন ক্ষমতা কিংবা দক্ষতা তখন আর কারো ছিল না। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তো ছিলই না আর এখানকার কথা তো বাদই দিলাম। অথচ তাঁরা শিল্পকে যেভাবে দেখেছেন ঠিক সেভাবে তখনকার বাংলাদেশে কেউ সেভাবে দেখেননি। আর যা(দে)র কথা জিজ্ঞেস করছেন, বলা যায় তারা তখন নাবালক ছিলেন। অবিভক্ত ভারতে সিনেমাকে অন্যতম প্রধান শিল্পক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হতো। আর এ অংশে পাকিস্তান আমলে লাহোরে সিনেমার সূত্রপাত হয়েছিল। শুরু থেকেই উভয় নগরে উর্দু ভাষার পরিচিতি ও চারিত্রিক সাদৃশ্য থাকার দরুণ লাহোর এবং বোম্বের (এখন মুম্বাইয়ের) মধ্যে বেশ একটা যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে, বোম্বের সাথে লাহোরভিত্তিক নির্মাতা-কলাকুশলীদের নিয়মিত আলাপ হতো। এখন বলতে পারেন—চিত্রকলার ক্ষেত্রে এ-রকম ব্যাপার ঘটল না কেন? তার কারণটা হচ্ছে যারা ছবি এঁকেছেন যেমন ধরুন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান—এঁরা সবাই কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র এবং কলকাতা আর্ট স্কুল যে-অর্থে যে-ভাবে ছবি আঁকা শেখাত সেটি কিন্তু রেস্ট অফ ইন্ডিয়াতে গ্রহণযোগ্য ছিল না; মানে মাদ্রাজে বা বোম্বেতে সে-শৈলীর চর্চা করা হতো তার সাথে কোনো মিল ছিল না। এ বাদে আরেকটি সমস্যা ছিল সেটা হচ্ছে যারাই কলকাতায় ছবি এঁকেছেন যাদের নাম আমরা সবাই জানি, বড় মাপের শিল্পী যেমন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায় বা নন্দলাল বসু—যাদের নাম নিতেই হয় এঁরা প্রধানত হিন্দু মাইথোলিজিক্যাল ছবিটা বেশি এঁকেছেন। এর সঙ্গে যাকে আমরা বলি বর্তমান বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এর ফলে আমরা বুঝতে পারি যে (যা আবার অনেকে বুঝতে পেরেও বুঝতে চান না), উনিশশো তেতাল্লিশ সনে যখন দুর্ভিক্ষ হলো…সেই দুর্ভিক্ষের সময় যারা মারা গেলেন তাদের শুধু বাংলার সাধারণ মানুষ বলে চিহ্নিত করলেই হবে না…ভালো করে দেখুন তাদের চেহারা, বেশভূষা, তাদের চোখ দেখে মনে হয় এদের সবাই কৃষক, বাংলাদেশের কৃষক এবং কৃষক অর্থে মুসলমান কৃষক। সে-সময় যারা দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন যেমন—সোমনাথ হোড়, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়—এদের ছবিতে দুর্ভিক্ষটা কী, দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিকতাটা কত তীব্র…সে-বিষয়টা জয়নুলের ছবিতে যেভাবে ধরা পড়ে ঠিক সেভাবে কিন্তু ওনাদের ছবিতে পাওয়া যায় না…যেটা ওরা বুঝেও বুঝতে চান না। এর মানেটা হচ্ছে এঁরা ছবি এঁকেছেন এবং সে-ছবির মধ্যে ভারতীয় পুরাণের উপাদান প্রবেশ করেছিল। এটা যে তারা ইচ্ছে করে করেছেন তা নয়, তাদের চিত্রকলার জগতটাই তৈরি করা হয়েছিল ওভাবে। যেটাকে আমরা বলছি মিথ…মুসলমান সমাজের মিথ সেগুলোর প্রভাব কিন্তু জয়নুল আবেদিনের কাজে দেখা যায় না। যা আছে সবটাই হচ্ছে কৃষকদের মিথ এবং বঙ্গীয় মুসলমান কৃষকদের মিথ। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং অধিকাংশই কলকাতা শহরে না-খেয়ে মারা গেছেন। দুর্ভিক্ষের এই পরিস্থিতিতে সোমনাথ হোড়ের কাজ দেখুন ঠিক মেলানো যায় না জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে। কোথায় এই পার্থক্যটা এবং কেন এই পার্থক্যটা—এইটুকুই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা অনেকদূর পৌঁছে যেতে পারি। পার্টিশনের পর জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিনরা ঢাকায় চলে এলেন এবং ঢাকাতে আর্ট স্কুল খুলবার জন্য লড়াই ও আন্দোলন শুরু করলেন, তখনও দেখবেন এঁরা যা ছবি এঁকেছেন তার সবই এখানকার মানুষের চেহারা, অবয়ব নিয়ে। এই মানুষগুলো (কারা)—হাড়হাভাতে, না-খাওয়া বঙ্গীয় মুসলমান কৃষক। এখানে আমি হিন্দু-মুসলমান বিভেদ টানছি না, আমি বলছি সমস্যটার কথা। এইসব চিহ্নের ইশারায় আপনি যদি পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করেন তাহলে এই সমস্যার কারণের মূলটা খুঁজে পাবেন। এখন এর সাথে যদি সিনেমার প্রসঙ্গটা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন যে—লাহোর যেভাবে সাপোর্ট পেয়েছে তার কিছুমাত্র ঢাকা পায়নি। বরং, ঢাকায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চর্চা শুরু করার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। তথাপি, বঙ্গীয় মুসলমানরা যখন কলকাতায় বা বোম্বেতে কাজ করতে গেছে তখন তাদের স্ব-নাম গোপন রেখে হিন্দু নাম গ্রহণ করতে হয়েছে (যারা হিন্দুয়ানি নাম গ্রহণ করেছিলেন তারা যে সাম্প্রদায়িক ছিলেন তাও নয়), এমনকি ‘দিলীপ কুমার’ বলে আমরা যাকে চিনি-দেখি কিন্তু আমরা কি জানি তাঁর আসল নাম-পরিচয় কী! এমনকি নজরুলের গান মুসলমান যারা গেয়েছেন তাদেরকেও ছদ্মনামের রাজনীতির আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। আমি এর ভালো-মন্দের মধ্যে যাচ্ছি না, একটা ঐতিহাসিক কারণে তাদের এই কাজটি করতে হয়েছিলো। তবে, এই সমস্যাটা যে ছিল তা ইগনোর করার অবকাশ নেই। এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে, বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে কারণটা; এগুলো বাদ দিয়ে আমরা সামনের দিকে আসলে এগোতে পারব না। আমি সেইজন্যই বড় পার্সপেক্টিভে সমস্যাগুলিকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এই পরিসরেই জহিরকে বিচার করতে হবে। জহিরের ঐতিহাসিক সমস্যাটা বুঝতে হবে এবং রাজনৈতিক সমস্যটাও বুঝতে হবে। ভুলে যাবেন না জহির বেহুলাকে নিয়ে প্রথম ছবি করেছিলো।

এখন, জহিরের অনেকগুলো গুণ ছিল। যার মধ্যে একটা বড় গুণ ছিল তাঁর ভাই (শহীদুল্লা কায়সার)-এর কাছ থেকে সাম্যবাদী ধারণাটা গ্রহণ করা। কমিউনিস্ট ধারণাটা গ্রহণ করা। শহীদুল্লা কায়সারের নামটা সবাই জানে পরন্তু শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে জহির রায়হানের যে রক্তের সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা আছে তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আরো একটা ব্যাপার ছিল সেটা হচ্ছে জহির সিনেমা করছেন বা শুরু করবেন—এই সময় তিনি সাংবাদিকতার জগতে, লেখালেখির জগতে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছিলেন; তাঁর ঐ-সময়কার গল্প, উপন্যাস যারা পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন সৃজনশীল মাধ্যমে জহির কী করতে চেয়েছেন। জহিরের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস যারা পড়েছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন—নোয়াখালীর একটা গণ্ডগ্রামকে কেন্দ্র করেও এ-ধরনের উপন্যাস লেখা যায়। যার প্রেক্ষাপট আপনি মিলিয়ে নিতে পারেন (নিয়মতান্ত্রিক) যে-কোনো দেশ-রাষ্ট্র-সরকারের সঙ্গে যেখানে গণমানুষের অধিকার, চাহিদার স্পন্দনবিরোধী বৈষম্য ও ক্ষমতা অপব্যবহার তথা সর্বোপরি, মানুষবিরোধী আচরণ করে থাকে। জহিরের উপন্যাসের এই থিম বা ন্যারেটিভ বা প্লট কিন্তু ধার করা নয়, কারো কাছ থেকে কল্পনা ধার করে তিনি এটা লিখেননি। যা লিখেছেন তা একদম চোখের দেখা বাস্তবতা থেকে…এদিকে শহীদুল্লা কায়সার ‘সংশপ্তক’ উপন্যাস লিখেছেন…এর সাথে ‘হাজার বছর ধরে’-র তুলনা করে দেখুন, দেখবেন আকাশপাতাল তফাৎ। আমি এখানে সাহিত্যকর্মদুটির মাঝে ছোট-বড় ভেদের কথা বলছি না কিন্তু। জহিরের ‘আরেক ফাল্গুনে’-র কথা স্মরণ করুন বা পড়ুন তাহলে বুঝতে পারবেন জহিরের রক্তে, মাংসে, আত্মায় ওই ধারণাটা…কমিউনিস্ট ধারণাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। লেখালেখির সেই সময় থেকেই জহির যা-কিছু লিখেছে, গল্প বা উপন্যাস সবকিছুর ভেতরে সাম্যবাদী ধারণার মননশীল প্রকাশ জারি ছিল।

যে-অর্থে শহীদুল্লা কায়সার পার্টিপলিটিক্সের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ঠিক সে-অর্থে জহির সক্রিয় ছিলেন না তবে নিজের দিকে থেকে পার্টিপলিটিক্সে প্রবেশ করেছিলেন। আর এভাবেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-মানবিক সমস্যাগুলোকে নিজের মতো করে বুঝতে চেয়েছেন। পূর্বপাকিস্তান যখন হয়েছে সেখানে হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ তিনি দেখেছেন আবার মুসলমান কৃষকদের সাথে মুসলমান জোতদারদের যে বিরোধ আছে সেটাও তিনি দেখেছেন—তাঁর চোখে কোনোটাই কিন্তু বাদ পড়েনি। এবং এই বিষয়গুলোকেই তিনি তাঁর লেখার মধ্যে সজ্ঞানে আমদানি করেছেন। আবার অন্যভাবে ভেবে দেখুন জহির সম্বন্ধে অনেকেই জানেন না যে তাদের বাবা প্রচণ্ড ধার্মিক মানুষ ছিলেন, আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। কিন্তু, তাঁর পিতার কোনো প্রভাব ঐ অর্থে জহিরের উপর নেই। তিনি সাম্প্রদায়িক চিন্তার উর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি যখন শিল্পকলার চর্চা/কাজ শুরু করলেন (এক্ষেত্রে সাংবাদিকতাকেও আমি শিল্পকলার পরিধির ভেতরে ধরব), উপন্যাস লিখছেন কিংবা হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার কথা বুঝবার চেষ্টা করছেন কমিউনিস্ট বোঝাপড়ার আলোকে, তখনও কিন্তু আমি তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র পাইনি। তিনি আজীবন মানে যতদিন পর্যন্ত নিখোঁজ হয়ে যাননি…ততদিন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছেন। এই লড়াইটা তাঁকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি, তিনি নিজের থেকেই এই লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন।

তারপরে, জহির যখন সিনেমায় ঢুকলেন নির্মাণকর্মীরূপে তখনও কিন্তু নিজের ভাবনার অনুবেদনের চর্চার কোনো তৈরি জমিন পাননি। জায়গাটা পেলেন যখন তিনি নিজে সিনেমা করা শুরু করলেন। তখন দেখা যায় জহির নিজের একটা ধারা তৈরি করবার চেষ্টা করছেন। যেমন—বেহুলার কথা চিন্তা করেন…জহিরের অন স্ক্রিন অ্যাডাপটেশনে কিন্তু হিন্দুয়ানি ব্যাপারটা নেই। তিনি এই কাজটার মধ্যে দিয়ে একটা জিনিস ধরবার চেষ্টা করেছেন; সেটা হলো মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে তাহলে মৃত্যুর কাছ থেকেও তাকে ফিরিয়ে আনা যায়। বেহুলা-লখিন্দর সংক্রান্ত মাইথোলজির একটা অন্যতর ব্যাখ্যা সে হাজির করেছে। একটা সাদামাটা গল্পের মধ্যেও প্রাণের জোয়ার এনেছে। এইটা কিন্তু মূল বেহুলার মধ্যে নেই। কিংবা কাচের দেয়াল সেখানে কিন্তু একটা সাইকোলজিক্যাল মুভ বা মুক্তির কথা বলেছেন যা তখনকার সিনেমা চর্চায় ছিল অভিনব। এই জিনিসগুলো ভাববার বিষয়। কিংবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ক্যামেরা নিয়ে নিজেকে যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত করলেন। এখানে মনে রাখতে হবে তিনি শিল্পী, মনে রাখতে হবে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন, মনে রাখতে হবে তাঁর উপন্যাসরচয়িতার পরিচয়টিকেও। শিল্পের এতগুলো শাখায় জহির রায়হানের যে ভাবমূর্তি আমরা দেখি তার মাঝ থেকে একটিমাত্র যন্ত্র নিয়ে তিনি যুদ্ধে প্রবেশ করলেন আর সেটি হচ্ছে ক্যামেরা। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি শামিল হলেন তাঁর অস্ত্রটা নিয়ে—ক্যামেরা! তাঁর ঐ সময়কার চলচ্চিত্রকর্ম ও উদ্যোগ থেকে বোঝা যায় তাঁর ভাবনার রেখাগুলো।

ইমরান ফিরদাউস : জহির রায়হানের এই স্পিরিটটা কিভাবে ডেভেলপ হলো মানে তাঁর ছবির যে জায়মান চেতনা বা সেখানে বাংলাদেশকে আমরা যেভাবে পাই তাকে কিন্তু প্রচলিত অর্থে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ঘেরাটোপে সিদ্ধ করা যায় না। আমি বলতে চাইছি যে, তাঁর ছবিতে আমরা যে-দেশাত্মবোধের যে-দৃশ্যকাব্য দেখি-শুনি, এই ভূ-অঞ্চলের শোষণ-বঞ্চনার যে খেরোলিপি পাই তা একই সাথে বিশ্বময়তার বার্তা ধারণ করে…যা তখনকার সময়ে প্রায় অনুপস্থিত থাকতে দেখেছি এই অঞ্চলের সিনেমায়। এই চৈতন্যের উৎসধারা কোথায়?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : অনেকগুলো জায়গা থেকেই তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বিশেষ করে সিনেমার ক্ষেত্রে যে ধারাটা তাকে ছুঁইয়ে গিয়েছিল সেটি হলো সোভিয়েত সিনেমা। অ্যামেরিকান ফিল্ম নয়, ব্রিটিশ ফিল্ম নয়, ফরাশি ফিল্ম নয়…সোভিয়েত ফিল্ম কিন্তু একটা নতুনধারা তৈরি করেছিল। জহিরের কাছে ঐ ছবিরগুলির অন্যরকম একটা অর্থ ছিল, জহির সেখান থেকে অনেককিছু শিখেছেন। সেই ধারা থেকে জহির অনেককিছু গ্রহণ করেছেন, যেটা আমরা স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১-এর মধ্যে দেখতে পাই। যেটা আর কেউ শেখেননি সে-সময়। আপনি স্টপ জেনোসাইড  ছবিটি যখন দেখেন তখন আপনে বুঝতে পারেন, পারবেন, আপনার বোঝা উচিত জহির কিভাবে মানুষের সংগ্রামটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। একই মলাটে তিনি দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষগুলোর খালি হাতে লড়াই করার বাস্তবাটি, কন্ঠের স্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে অগ্নিঝরা দিনগুলো পাড়ি দেবার আখ্যানটি। এই ঘটনাটা কিন্তু সে-সময় প্রথম ঘটাননি তিনি। মানে, স্লোগানের উত্তাপ, প্রতিবাদের দুর্বার বচনকে সিনেমার শিরায়-ধমণীতে বইয়ে দেবার কাজটি তিনি অসম্ভব স্পিরিটের সাথে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর অসম্পূর্ণ/অসমাপ্ত সিনেমা লেট দেয়ার বি লাইট-এ। এই সিনেমাটি যদি তিনি শেষ করে যেতে পারতেন তবে আমি বলব বাংলা সিনেমায় জহিরের একটা ধারা তৈরি হতো।

ইমরান ফিরদাউস : তবে, জহির রায়হান তাঁর চলচ্চিত্রচর্চার মধ্য দিয়ে আত্মসমালোচনার পাশাপাশি (অ)শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের (শুধু) সময়ের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায়মুক্তির চোরাকারবারের যে নগ্ন চেহারা তুলে ধরেছেন—সেসব মোটিফও তো আমরা পরবর্তীকালে সিনেমামহলে দেখতে পেলাম না। পার্টিজান না-অর্থে ট্রু পলিটিক্যাল স্যোওল, লিবারেটেড আত্মার একটা চেহারা আমদানি করেছিলেন তাঁর সিনেমাতন্ত্রে। পর্দায় স্বাধিকারের আলাপ করার যে পদ্ধতি আমরা নতুন দেশে করতে পারতাম তাঁর থেকে নিয়ে…সেইটি যখন গরহাজির দেখি এই সেলফি-আক্রান্ত সময়ে…তখন কী আমরা বুঝে নেব জহির রায়হান এই সময়ে অপাঙক্তেয়?
বোরাহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আমি মনে করি, জহির রায়হান অপাঙক্তেয় নন। যারা এই সিনেমার মধ্যে থাকলেন নতুন দেশে তারা একটা সহজ ধারাবাহিতকতার মধ্যে কাজ করবার চেষ্টা করলেন। জহিররে ধারাটা কিন্তু জটিল। তাঁর কিছু কিছু ফিল্ম জটিল কিন্তু! বাংলাদেশে যারা ফিল্ম করেছেন তাদের অনেকেই ভালো ভালো ছবি করেছেন কিন্তু এই ধারার ছায়া মাড়াননি। এখন, এই সহজের পথে আমরা কেন গেলাম বা যাই!? এই পথে গেলে পরে খুব দ্রুত একটা গন্তব্যে পৌঁছানো যায়…হোক না তা জানা গন্তব্য। যেহেতু, আমি সহজভাবে এগিয়ে যেতে পারি…তো, এই পথই শ্রেয়। একই পথে সহজভাবে মিলে যেতে পারে নানা ধরনের সম্মান। বা, আমি সারাদুনিয়ার মানুষকে সহজভাবে বোঝাতে পারি এই হলো ‘বাংলাদেশ’! কিন্তু, জহিরের ছবিগুলো ঐ অর্থে বাংলাদেশ না! বাংলাদেশকে যতভাবে দেখানো যায়, যতরকম করে রিপ্রেজেন্ট করা যায় প্রায় সবরকমই তিনি করেছেন। এও একটা কারণ…যে কারণে, আমি বলব যে—জহিরের কোনো অনুসারী নেই। এই হচ্ছে ব্যাপারটা আর কি…!

ইমরান ফিরদাউস : জহির রায়হানের সিনেমার ব্যাকড্রপে কী দেখা যায়?
বোরাহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : জহির রায়হান কী নিয়ে সিনেমাগুলো করেছেন? তাঁর কিছু সিনেমা উপন্যাস নিয়ে লেখা, আবার কিছু সিনেমা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তোলা, সাহিত্য থেকে নয়। এখন যখন তিনি উপন্যাস থেকে আখ্যান নির্মাণ করছেন তখন তিনি কী করেছেন…কোনো সুন্দরী নারীকে খুঁজেছেন, তা কিন্তু নয়! তিনি একটি গ্রাম খুঁজেছেন যেখানে বহু তালগাছ পাওয়া যায়, তিনি একটি নদী খুঁজেছেন যে-নদী প্রমত্তা মেঘনা নয়…যে নদী শুকিয়ে গেছে (বাংলাদেশের গ্রামে এমন অনেক নদী আছে)। আর তিনি সিনেমায় সেসব নারীর চরিত্র এনেছেন যারা (গ্রামে) শাড়ি হাঁটুর উপরে তুলে দৌড়ায়। এগুলোকে আমি বলবো সাহস! এই ধারাটা পরে আমরা ব্যবহার করি নাই।

ইমরান ফিরদাউস : জীবন থেকে নেয়া  (১৯৭০) থেকে আমরা কতটুকু নিলাম…
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : আজকের আলাপে আমি ইচ্ছে করেই ‘জীবন থেকে নেয়া’-র প্রসঙ্গে গেলাম না। ‘জীবন থেকে নেয়া’-র অনেক উপাদান ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ আছে। জীবন থেকে নেয়ার অনেক উপাদান বেহুলার মধ্যে আছে, কিছু উপাদান ‘কাচের দেয়াল’-এর মধ্যে আছে। আপনি ভেবে দেখেন, আপনি নিজেই মেলাতে পারবেন। তার মানে হচ্ছে জহির যতদিন পর্যন্ত নিখোঁজ না হয়েছেন, তিনি ততদিন পর্যন্ত একটা ফিল্ম তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, একটা মহৎ ফিল্ম তৈরি করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পারেননি…সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কেউ কি ভেবেছিল ‘জীবন থেকে নেয়া’-র মতন একটা ফিল্ম তৈরি করা যায়? এটা একটা রাজনৈতিক ফিল্ম আবার অন্য অর্থে রাজনৈতিক ফিল্মও নয়। তিনি একটা মধ্যবিত্ত পরিবারকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন একটা অভাবের মধ্যে, সংসারের অনটনের মধ্যে অথচ যে-পরিবারটার মধ্যে শিল্পের বোধও আছে। কিন্তু সেটাকে কাজে পরিণত করতে হলে যে-পরিমাণ আর্থিক স্বাচ্ছল্য থাকা দরকার সেটা আবার তাদের নেই। এই ছবির মধ্যে বহুতর স্রোত এবং কাউন্টারস্রোত রয়েছে। জহিরের এই ছবির আখ্যানের সাথে যদি শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক-এর তুলনা করেন তাহলে দেখবেন সংশপ্তকের কাহিনি বেশ একরোখা…একটি নির্দিষ্ট সময়পরিক্রম ধরে এগিয়ে গেছে…সেখানে ‘জীবন থেকে নেয়া’-য় আমরা দেখতে পাই কালের অগণন মুহূর্তের দৃশ্যমানতা।

ইমরান ফিরদাউস : জহির রায়হানের কাজে-কথায় আমরা একজন ভিশনারির প্রজ্ঞার রূপ দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই—১৯৬৯ সনে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’-তে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সম্মান পেয়েছে। যদিও সিনেমায় ব্যবহৃত সংস্করণটি আমরা গ্রহণ করিনি। 
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : দেখুন…এগুলো তখন খুব সহজ ছিল। আমরা পরে বদল করলাম সুরটি, যা আসলে উচিত ছিল না। অ্যানিওয়ে, যে-কথাটা বলতে চাইছিলাম—জহির রায়হান যখন সিনেমা করছেন, সাংবাদিকতা করছেন কিংবা লিখছেন তখন সিক্সটিজের মুভমেন্ট বাংলাদেশে দানা বাঁধছে, জহির রায়হান সরাসরি এইসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। আমি ওখানে ছিলাম, দেখেছি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রথম যে-দশজন ১৪৪ ধারা ব্রেক করল সেই প্রথম দশজনের একজন হচ্ছেন জহির। আরেকজন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ যার কথা আমরা এখন ভুলে গেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছতলায় জোরেশোরে মিটিং হচ্ছে এবং মিটিংয়ে দু’ভাগ হয়ে গেছে—এক গ্রুপ হচ্ছে ১৪৪ ব্রেক করার, আরেক গ্রুপ ১৪৪ ব্রেক না-করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার। তখন ঠিক হলো যে দশজন দশজন করে আমরা ১৪৪ ব্রেক করব। সেই প্রথম দশজনের মধ্যে একজন ছিলেন জহির রায়হান। মানে, আন্দোলন করবার জন্যে একজন বড় নেতা হতে হবে তা নয় বিষয়টি। এভাবেই ব্যাপারগুলো ঘটেছে। একজন সাধারণ মানুষ, একজন ছাত্রীও এইধরনের আন্দোলনের মধ্যে যুক্ত হতে পারে—যাদের মধ্যে মমত্ববোধ আছে ভাষার প্রতি। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ বা সক্রিয়তার আরেকটি নমুনা তাঁর ‘আরেক ফাল্গুনে’ উপন্যাসটি।

ইমরান ফিরদাউস : এতসব ব্যস্ততা ও কর্মচঞ্চলতার মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী জহির রায়হানের অবস্থানটা কী ছিল?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : যদি বলেন লেখাপড়া করা বা আমরা লেখাপড়া বলতে যা বুঝি…তার মধ্যে ও কখনো ছিল না। ওঁর মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করত। এই ডিপার্টমেন্ট থেকে ঐ ডিপার্টমেন্ট—এইভাবে ঘুরে বেড়াত। শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনেছে। সর্বক্ষণ বিভাগীয় ক্লাস করা ওঁর মধ্যে ছিল না। ও নিজের মতন করে জীবনটাকে বুঝবার চেষ্টা করেছে। যখন এগুলো করছে তখন (অনেকেই জানেন না) জহির রায়হান কম্যুনিস্ট পার্টির কুরিয়ার হিসেবেও কাজ করেছে। খুব গোপনে কাজ করত…কেউ জানত না। তখন কুরিয়ার হওয়াটা খুব রিস্কি ছিল। ওঁর ‘সাহস’ শ্রদ্ধার দাবিদার। আর সেসব গোপন নথিপত্র আমরা কোথায় বসে পড়তাম জানেন—কার্জন হলের সিঁড়িতে বসে। আর কোনো জায়গা আমাদের ছিল না। এভাবেই তো আন্দোলনগুলো দানা বেঁধেছে।

ইমরান ফিরদাউস : জহির রায়হানের উর্দু ছবি করা প্রসঙ্গে কী বলবেন…
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : উর্দু ছবি তিনি করতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ টাকাপয়সা তাঁর দরকার ছিল। ওই সময় তাকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন সংবাদের জহুরভাই। পাকিস্তানের প্রথম কালার ছবি, প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি উর্দুতে করলেও আসলে ও এসবের মধ্যে ছিল না। জহিরের প্রচেষ্টা ছিল অন্য ধরনের ছবি করার। ঐ ধারার শেষ সম্পূর্ণ ছবিটা হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’। মুক্তিযুদ্ধের আগে জহির রায়হানের শুরু-করা শেষ ছবিটা ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তো আর সম্পন্ন করে যেতে পারল না…

ইমরান ফিরদাউস : জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া যাবে কীভাবে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : কোনো একটি অনালোচিত সত্যকে উদ্ধার বা উদ্ঘাটন করতে হলে অনেকগুলো মিথ ভাঙতে হয়। ভুলে যাবেন না এই মানুষগুলোই আজকের এই বাংলাদেশকে তৈরি করেছে। তাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বা অনালোচিত হয়ে থাকার দায় তো আমাদেরই। আমরা সবাই জানি যে—ভাই(শহীদুল্লা কায়সার)কে খুঁজতে গিয়ে জহির হারিয়ে গেছে। কিন্তু, আসলে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে সে হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যারা প্রথম ঢাকায় ঢুকেছিলেন তাদের একজন কিন্তু জহির রায়হান। তিনি ঢাকার মিরপুরে যে অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন তার একটা বড় ধারণা ছিল বিহারিদের কতল করা শুরু হয়েছিল। জহির রায়হান সেটাকে রোধ করতে চেয়েছিলেন। এখন বিহারিরাও তাকে ভুল বুঝেছে, ইন্ডিয়ান আর্মিও তাকে ভুল বুঝেছে, বাংলাদেশ আর্মি তাকে ভুল বুঝেছে—সবাই তাকে ভুল বুঝেছে। ও কিন্তু মানুষগুলোকে বাঁচাতে চেয়েছিল। ও মানুষগুলোকে বাঁচাতে যদি না-ই চাইত…তাহলে কোন বোধ থেকে জহির ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ করে। মানুষ(গুলো)কে বাঁচানোর বোধটা তাঁর নিজের মধ্যে কাজ করেছে। দেখুন, জহির যখন হারিয়ে গেল তখন তাঁর পার্টি পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে বেশি কিছু বলেনি…তাঁর মানে কী…সত্যটা আসলে কী!?

জহির রায়হান প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করেছেন। তখন হাজং বিদ্রোহ হচ্ছিল, তেভাগা আন্দোলন হচ্ছিল। তেভাগা আন্দোলনের পরপরই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়—সে-কথা কিন্তু এখন মানুষ ভুলে গেছে। ভাষা আন্দোলন শুরু হবার কিছু আগে বা পরেই তেভাগা আন্দোলন থেমে গেল। তেভাগা আন্দোলনটা ছিল কৃষকের জমির উপর অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আর ভাষা আন্দোলনটা ছিল মানুষের জ্ঞানের উপর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। আরেক ফাল্গুনে  ভালো করে পড়ে দেখেন, দেখবেন এই ইঙ্গিতগুলো সেখানে দেয়া আছে।

কাউকে ছোট বা বড় করা নয় বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতার রসায়ন বোঝার ব্যাপারে ক্রিয়াশীল ছিলেন জহির রায়হান। চেষ্টা থাকলে জহির রায়হানকে খুঁজে না পাবার কোন কারণ নেই..। জানেন তো, পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যেই কিন্তু একটা পলিটিক্স থাকে আর সেই পলিটিক্সের একটা অংশে পরিণত হয়েছে আমাদের এখানকার শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারগুলো। ঐরকম যোগাযোগ চিত্রকলার ক্ষেত্রে ঘটেনি। এগুলো মনে না রাখলে জহির রায়হান বা তার সিনেমাচেতনা অথবা সৃজন-মনন-দর্শন নিয়ে কথা এগোনো যাবে না।

তামাম শুদ।


ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : প্রস্থান ও পদাবলি
গানপারে জহির রায়হান
গানপার সাক্ষাৎকার

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you