সিদ্ধার্থপূর্ণিমা

সিদ্ধার্থপূর্ণিমা

পায়রাপালকবিধৌত জ্যোৎস্না ঝরছে। পাতা-বুজে-থাকা রেইনট্রি, নির্বাতাস নারকৈল, আবেদনময়ী আমগাছ — সকলেই গোসল সারছে ঝরা জ্যোৎস্নাজলে। বেবাক দুনিয়া আজি উড়ন্ত বলাকার শাদারঙা পাখা। আজ এই রাতে। আজ জ্যোৎস্নারাতে কারা গেল বনের দিকে হেঁটে? আমার তেমন ইচ্ছেটি করছে না, ঠাকুরের করেছিল, বনের দিকে যেতে আমার ইচ্ছেটি করছে না। কিচ্ছুটি করতে আমার ইচ্ছেটি করছে না। এইখানে, এই বারান্দায়, এই দুর্বৃত্ত বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলার ফাঁকে নেহাৎ লেখার স্বার্থে, এই নিবন্ধভুক্তিটি লেখার স্বার্থে এই বারান্দায় আধখানি মোম জ্বালিয়ে বসে থাকতেই ভালো লাগছে আমার। কতিপয় খুব জনতোষিত লেখকের মধ্যে জুলজুলে চোখে আহা-উহু জ্যোৎস্না দেখার ব্যাপার ও বিবরণ পাওয়া যায়। এবং এই জ্যোৎস্না, আশ্চর্য ও অতিব্যক্ত কিংবদন্তি এক, প্রকৃতি ও নিসর্গের অন্য আর-সমস্তের থেকে বেশি মনোযোগ পায় সকলের। পাগল, ব্যর্থ লেখক, প্রেমিক, প্রেমে বিফল-মনোরথ ভগ্ন বিরহী কবি, নববিবাহিত গণিতের অধ্যাপক পর্যন্ত কেউ বাকি নেই জ্যোৎস্নাকে একেবারে নিজের জায়া মনে করেননি জীবনে একবার। যার ফলে, প্রকৃতির/নিসর্গের সমস্ত নিয়ামকের প্রতি প্রেম রেখেই বলছি, জ্যোৎস্নাকে বেশ বাজারি-বিষয় আর শস্তা বলে মনে হয় আমার; আর প্রোক্ত পাইকারি জ্যোৎস্নাভোক্তাদের মনে হয় ন্যাকা। এ নিয়ে অধিক বাক্যব্যয় করাটা আমার কাছে সবসময় আদিখ্যেতা/আদেখলামো মনে হয়। যেমন এ-মুহূর্তে আমি যেইটা করছি : বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা!

ঠাকুরের মশহুর সেই গানটায় তিনি অবশ্য বনে যান নাই নিজে, গেছিল অন্য সবাই, এবং ওইটা ছিল অন্য জ্যোৎস্না। ২২ চৈত্র ১৩২০, তথা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে, রচিত হয়েছে এই গান; গীতবিতানের তথ্য বলছে, তার মানে একশদুই বছর হয়ে গেল ওই জ্যোৎস্নারাতের! মাতাল সমীরণ ছিল বসন্তের, স্পষ্টত গানের কথাভাগে বলা আছে, এবং সবাই বসন্তরজনীবিহারে বাইরে গেলেও ‘রইনু পড়ে ঘরের মাঝে’ রবি নিজে ধ্যানে রইছেন অন্য জ্যোৎস্নার, গানে যদিও বলছেন এইভাবে যে “আমার এ ঘর বহু যতন করে / ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে” এবং আরও বলছেন যে কে-একজন আসবে তাই তিনি জেগে রইবেন, কেননা “কী জানি সে আসবে কবে / যদি আমায় পড়ে তাহার মনে / বসন্তের এই মাতাল সমীরণে” ইত্যাদি। বিরহ এবং পূজা — এই দুই বিভাগেই গানটা গাঁথানো রয়েছে দেখা যায়। অ্যানিওয়ে। বসন্তজ্যোৎস্না আর সিদ্ধার্থজ্যোৎস্না দুইটা নিশ্চয় দুই জিনিশ! সত্যি কি তা-ই? একই জিনিশের দুই রকম উৎসারণ নয়?

জবরদস্ত, বাপ রে বাপ, জ্যোৎস্নাযাম! বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার পরিচালকেরা যদি জেগে থাকে এখন, আমার মনে হচ্ছে, তারা এমনি-এমনি বসে থাকবে না ঠুঁটো জগন্নাথের মতন। জেগে যদি থাকে এবং মাল খেয়ে টাল না-থাকে যদি, তবে, নায়ক-নায়িকাকে ঘুম থেকে হাঁকিয়ে-ডাকিয়ে জাগিয়ে ক্যামেরা-অ্যাকশান্-কাট শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। আর-কিছু না-হোক, এতে করে বেশ মোটা অঙ্কের আলোখর্চা বেঁচে যাবে বেচারা ছায়াছবিডিরেক্টরের। আলাদা আলো ফেলে নায়িকার নখরামো ফোটানোর কসরত করতে হবে না তাকে। এ এমন আলো, বেঢপ-বদখত নায়িকাকেও এইক্ষণে এ-আলোয় দেখাবে অতি খুবসুরত লাবণ্যসিঞ্চিতা। ন্যাকা নায়কেরও জেল্লা কম বাড়বে না। বরং স্ট্রিটবয়-মার্কা অ্যাক্টর ব্যাটাকেও দিব্যি উত্তমকুমার মনে হবে; উত্তম কুমার — পৃথিবীর সেরা রোম্যান্টিক-রূপবান নায়কদের মধ্যে শীর্ষ একজন; বাঙালির মহানায়ক — কথাটি অতিরাঙানো নয়, অ্যাট লিস্ট, তার ক্ষেত্রে।

এই মুহূর্তে কেন জানি মনে পড়ছে রাজন সিদ্ধার্থ ওর্ফে গৌতম বুদ্ধের কথা। আমার মনে হতেছে এখন এ-মুহূর্তে : সিদ্ধার্থ মশাই জীবনে ওই একবারই জ্যোৎস্না দেখেছিলেন, দেখে গৃহত্যাগী হয়ে গেছিলেন। অতঃপর তিনি অন্ধ হয়ে গেছিলেন আসলে। জ্যোৎস্নান্ধ। দ্বিতীয়বার জ্যোৎস্না দেখলে তার আবার সংসারে ফিরতে ইচ্ছে করত। রগরগে রতিরক্তময় সংসারে। কামনা-বাসনা জাগত তার, জাগতিক বোধ-ভাবনায় জুলজুল করে উঠত তার সুখ্যাত সেই নির্বাণলাভের সাধনায় সুপ্ত চক্ষুযুগল। যেমন এই মুহূর্তে এই নিবন্ধের নায়কের, — লেখকের নয় কিন্তু! — খুব লোনলি লাগছে। বেচারির খুব সঙ্গ ইচ্ছে করছে। বেচারি ভারি সঙ্গ মাগিছে কায়মনোবাক্য। জ্যোৎস্নাসঙ্গ। আহা! বেচারা বুদ্ধ! অকালে নির্বাণের নাড়ুর লোভে গেল চলে তিব্বতের কোন গুহায়, নিষ্কাম নিরক্ত সাধনায় ভুগে মর্ত্যধাম থেকে তুলে নিল দেহ। হায়! দ্বিতীয় জ্যোৎস্না দেখলে অমনটি হতো না আলবৎ।

আমারও, বর্তমান নিবন্ধকারের, টেবিলে মোম নিভে আসছে। টেবিলকাঠ ছুঁয়ে-ফেলছে-প্রায় মধুচন্দ্রা মোমগুড়ি। উঠোনে জ্যোৎস্না যেন ভরপুর পুকুর। আমার কিছু অশান্তি অচিন্তা-কুচিন্তা এই রাতে থিতু হলো খানিক। আমার ভালো লাগছে সব। কিছুই তবু লাগছে না ভালো। নিরর্থ-নিদান-নির্মম লাগছে সমস্ত জগৎটা। না, জ্যোৎস্নায় আমার অমন নির্বাণাকাঙ্ক্ষা জাগে না কখনো। বোধিবৃক্ষতলে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে আসন নিতে ইচ্ছে জাগেনাকো। জগতের শোক-তাপ-জরা নিয়া ভাবতে বা ভাবিত হতে ভাল্লাগে না মোটে। জ্যোৎস্নায় আমার খুব কামনা-বাসনা জাগে। যমুনা-মেঘনা জাগে। জ্যোৎস্নায় আমার ভেতর জাগে জাগুয়ার। জাগে জলের জোয়ার। জ্যোৎস্নায় আমি আজকাল — অদ্ভুত! — ভালুক দেখতে পাই! আমার প্রিয় সে-ভালুক! প্রিয় সে সবুজ ফল … ! আমি বলি, সমাদরে বলি : তুলতুল ভালুক! এসো করি দোঁহে মিলে গানে ও জ্যোৎস্নাস্নানে রতিসিক্ত রাত্রি গুজরান! বলি : “প্রিয় হে, সবুজ ফল, তোমাকে কঠিন হতে দেবো না, সবুজ ফল, আমাদের স্বীয় ভবিষ্যতে দেখা হবে সে-রকম কথা নেই। দূরে সূর্য ও আঁধার একইসঙ্গে দেখা যায় — যেন উপাসনা ভেঙে দিয়ে ডেকে ওঠে কাক, প্রিয়, সর্বস্বতার কিছু আজ পড়ে নেই, শৃঙ্খল ছাড়া, ঐ অস্থিগুলি ছাড়া আজ কিছু আর পড়ে নেই, ফল, প্রিয় হে, সবুজ তুমি কীটে নষ্ট হও তবু তোমাকে কঠিন হতে দেবো না আমার প্রতারণা এই” … না, উপমান ও উপমেয়র মধ্যবর্তী ব্যবধান তবু থেকে গেল বিস্তর। উৎপলকুমারের কথা দিয়া তো বর্তমান নিবন্ধে অঙ্কিত প্রধান চরিত্রের, এবং এই নিবন্ধপ্রণেতার, কিংবা কারোরই ভিন্ন ভিন্ন মনোবাস্তবতা ধরা যায় না। আসলে তার সাদৃশ্য অনেকটা পান্ডার সঙ্গেই। আমার দেখা সবচে মায়াকাড়া নরম-তুলতুলা আর শিশুদৃষ্টিস্নিগ্ধ সুন্দর প্রাণী এই নিভৃত নির্জন পান্ডা। গাওগেরামে লোকে তারে জ্যোৎস্না নামেই ডাকে। গাত্রধর্ম ও চরিত্রচলনে সে অমনটাই সুসহনীয়, সুমমতাময়ী। সিমি গারোয়ালের সঙ্গে এই ম্যুনলাইট স্যোন্যাটাকে গুলায়ে ফেললে হবে না। নাইন্টিনসেভেন্টিটু রিলিজড ‘সিদ্ধার্থ’ ম্যুভিতে, কনরাড রুক্স পরিচালিত, সুদৃশ্য ফোটোগ্র্যাফি ছাড়া গারোয়াল আর শশি কাপুরের নগ্নতা আছে সিনেমাটায়। আননেসেসারিলি লিঙ্গার করা হয়েছে ক্যাথার্সিস্ এবং বিউটি ভিশ্যুয়্যালাইজেশন্ ছাড়া আর-তেমনকিছুই নাই মনে হয়েছে। এমনকি হের্মান্ হেস্ এই জ্যোৎস্না আঁকতে পারেন নাই তার আখ্যানভাগে। এইটা আঁকার অপেক্ষায়। এই অপেক্ষাও জ্যোৎস্নাগাম্ভীর্যপূর্ণ। অনেকটা আবহমান এই অপেক্ষা। কাতরতা নাই, কিন্তু উদার আয়ত নয়ন রয়েছে আগাগোড়া। আজীবন। আমৃত্যু।

প্রতিবেদন রচনা : জাহেদ আহমদ ।। প্রচ্ছদচিত্রকর্ম : সত্যজিৎ রাজন

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you