ছোটবেলায় নিমাই সন্ন্যাসীর গল্প শুনেছি, কিছু গানও শুনেছি ইয়াদ হয় আবছায়া। গানগুলোর কথাভাগ মোটেও মনে নাই; কিন্তু ওই টাইমে এতদঞ্চলে যে-মালজোড়া গানের চল ছিল, শুকনার সিজনে ন্যাড়া মাঠে ম্যারাপ বেঁধে যে-মেইফেল চলত রাতভর কুয়াশায় মাফলার-তহবনমুড়ি দিয়া, ‘লাড়াই’ লাগত দুই/দুইদল গাইয়ে-বাজিয়ের মধ্যে, সেই মালজোড়া লাড়াইয়ের কোনো শ্রোতা নিশ্চয় গানগুলো মনে রেখেছেন। তখন অন্য কোনো উপায় ছিল না গানবাদ্য শোনার, বেতারে গানশ্রবণের নসিবও সবার ছিল না, আজকের ন্যায় বিনোদনহাতছানি ছিল না হাজার কিসিমের। ঘরবাড়ির পুরুষেরা তা-ও জলসায় যেতেন, নানাবিধ গানের আসরে যেতেন, মালজোড়ায় যেতেন, সিনেমাহ্যলে বা ভাড়ায়-আনা পাড়ার ভিসিয়ার দেখে এসে নয়া নয়া গান গুনগুনাইতেন। মহলে যারা থাকতেন তাদের কয়েকটা কমন উপায় ছিল নয়া নয়া গান গলায় তোলার, এর মধ্যে একটা হচ্ছে লেইসফিতা বা শাড়ি-থানকাপড়-বেচতে ফেরিওয়ালারা বা শায়া-ব্রা-কানপাশা-পাউডার-স্নো-বেচতে বেদেনিরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মনোহারী জিনিশ বেচাবিকির সময় যে-গান গাইত সেইগুলা আমাদের আম্মা-চাচিআম্মা-ফুপুরা রাখতেন গলায় তুলে এবং দুপুরঝিমানো অলস বিশ্রম্ভালাপের ফুরসতে গাইতেন। উনাদের কোলের কাছে বসে হা হয়ে সেইসব গানবাদ্য শুনেছি। বিয়াশাদিতে মেয়েলি গীতের একটা বড় ভাণ্ডার ছিল মহিলামহলের অধিগত, যা তাদের মধ্যে এক্সচেঞ্জ হতো হরহামেশা। বাড়িতে নয়ানতুন বউ সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন তার বাপের বাড়ির দিককার অন্তত দুই-চাইরটা আনকোরা গাউয়ালি গীত বা গীতের ভার্শন; মুখে মুখে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ত। ক্বচিৎ কারো ঘরে রেডিয়ো-টেলিভিশন ছিল, নব্বইয়ের দিকে টেপরেকর্ডার অ্যাভেইলেবল হবার পরে গানশ্রবণের নতুন সুবিধা হয়েছিল অবশ্য। মোটামুটি ডিশঅ্যান্টেনা আসার আগ অব্দি বিনোদনব্যবস্থা ছিল মনুষ্যমুখবাহিত প্রধানত।
চৈতন্যদেব সম্পর্কিত গল্পগাছা জানা হয়েছে মালজোড়া-আসরফেরত কোনো কাকাস্থানীয় লোকের মুখমারফতে। এইটা আন্দাজ করছি যে, সেই-সময় কিছু লোক্যাল রেকর্ডিংহাউস ছিল যারা স্থানীয় মালজোড়াশিল্পীদের গান ধারাবাহিকভাবে ক্যাসেটে রেকর্ড করে ছেড়েছিল মার্কেটে; — সেই সুবাদেও শুনে থাকতে পারি নিমাই ওর্ফে চৈতন্য সম্পর্কিত গল্পকাহিনি। কিংবা তারচেয়েও বড় একটা উৎস হচ্ছে, এই নিবন্ধকারের মামাবাড়ি আর চৈতন্যদেবের পিতামহধাম একই এলাকায়। সেহেতু মামাদের মুখে, এবং স্পষ্টত আম্মার মুখে, এতদসম্পর্কিত কথাবার্তা-গানকলি শুনে এসেছি। কিছুটা বুঝতে শিখেছি যখন, চৈতন্য সম্পর্কিত বইপত্র তথা বাংলার ভাবধারা নিয়া নানান নিবন্ধপ্রবন্ধ চোখের সামনে এসেছে এবং সেসব জায়গায় নিমাইয়ের দেখা মিলেছে। একটু ক্রিটিক্যালি ল্যুক-ব্যাক করে দেখতে পাই, যে-গানগুলো শুনেছি সেসবই ছিল চৈতন্যসম্পর্কিত, চৈতন্যরচিত নয়। নিজে কি চৈতন্য রচেছিলেন গান কিংবা সুর? গবেষকের কায়দায় না-হলেও মনে মনে খুঁজেছি ব্যাপারটা, পাইনি সদুত্তর। তবে এইটা তো জানি যে চৈতন্য গানে গানে বাংলা মাতোয়ারা করেছিলেন। বৈষ্ণব ধারার প্রবর্তক বলা হয় তাকে। এইখানে অনুমান হয়, যে-গানগুলো চৈতন্য গেয়েছিলেন সেসবই ছিল হরিকৃষ্ণনামকীর্তন। জপমালা বা জিকির। তখন সনাতনী হিন্দুধর্ম অত্যধিক অনুশাসনের নিগড়ে টোলো পণ্ডিত ছাড়া সাধারণ মানুষের আচরিত ধর্মের জায়গাটা হারাচ্ছিল। প্রচুর বিভাজন, অন্তর্কলহ ও গোত্রকোন্দল, অনুশাসন নিয়া ফ্যাসাদ ইত্যাদি চলছিল। ব্রাহ্মণ্য ডোমিন্যান্স, ধর্মগোত্রপতিদের আধিপত্য, ভয়াবহ রূপ ধরে এগোচ্ছিল। চৈতন্য ওই সময়েরই উদ্ধারকর্তা। গানের সুরে তিনি ধর্ম প্রচার করেন। ধর্মাধিকারিকদের হাজার বায়নাক্কা হটিয়ে একটা নাটশেলে পুরে দেন ধর্মটাকে। কৃষ্ণনাম নাও, দুনিয়াবি কাজকাম করে বেড়াও, স্বর্গে যাও। ননি-মাখন-ছানা আর পাঁঠাবলি দিয়া খালি ধর্ম করে বেড়াতে হবে, নেভার। সুরে ফেরাও, সুরে ফেরো, সুরের নামই ধর্ম। অসুর অধর্ম। অসুর অরাজক। চৈতন্য সংক্ষেপে এ-ই।
নিমাইয়ের গল্পগুলো ধর্মীয় ভক্তিপ্রকাশ থেকে একভাবে প্রচারিত হয়, কালচারাল ঘটনা হিশেবে ব্যাপারটা যার যার মতো করে দেখবার এবং দেখাবার পথে তেমন বাধা বোধহয় নাই। নিবন্ধটা ড্রাফ্ট করার সময় একটা দ্বিধা কাজ করেছে এইটা ভাবতে ভাবতে যে, চৈতন্যদেবের মহাবোধি সম্পর্কে কিচ্ছুটি না-জেনে কিচ্ছুটি না-বলে এইভাবে এগোনো উচিত হচ্ছে কি না। তারপর ভেবেছি, হতেই পারে; লেখা তো বহু রকমেই হতে পারে; স্রেফ চৈতন্য-কোমেমোরেইটিং লেখা কি হতে পারে না? আর, তলোয়ার বা ত্রিশূল-কৃপাণ হাতে কেউ যদি আগাইয়া আসে তবে অ্যাপোলোজি প্রকাশের টাইমটাও পাবো না। তা, মুখে কুলুপ এঁটে বেডরুমে সেঁধিয়ে থেকেও তো সেইফটি মিলছে না। আচ্ছা, তাইলে দেখা যাক, আসলে এইটা চৈতন্যের খোঁজে একটা ক্রমশ-নির্মীয়মাণ রচনা। নাথিং কমপ্লিটেড। অন্য একটা সাইটেও একই নিবন্ধকারের বান্নিমেলাকেন্দ্রী নিবন্ধপ্রতিবেদন রয়েছে প্রকাশিত। কয়েক বছর আগে ফেসবুকে বেশ-কয়েকটা নোটস্ লেখা হয়েছিল, সেইগুলোই একত্রে সেঁটে এই নিবন্ধ। চৈত্র মাসে চৈতন্যের পিতামহধাম ঢাকাদক্ষিণে মাসব্যাপী স্মৃতিমেলা হয়, কাজেই নিবন্ধটা ঢাকাদক্ষিণের সেই বারুনির মেলা বা বান্নিমেলা সামনে রেখে প্রচারিত হলো।
কৌপিন, করঙ্গ, তপোবন ও মনের মানুষ
মহাপ্রভুর সেই তিন বাঞ্ছার কথা ভাবছিলাম। আমরা তো মহাপ্রভুর পিতামহের দেশের লোক। অত্র অঞ্চলের বর্তমান ঢাকাদক্ষিণ উপজেলায় তিনি জিন্দেগির কিছুটা সময় যাপন করেছেন বলিয়াই হিস্ট্রি আছে। তার পিতামহের বসতভিটা আজও বহাল রয়েছে, কালের চিহ্ন বহন করে, এবং প্রতিবছর চৈত্র মাসের সব-কয়টা রবিবার জুড়ে এখানে মেলা হয় বিশাল আয়তনের, বারুনির মেলা, লোক্যাল্ লোকজন সেই মেলাকে বলেন বান্নি, দেশের অসংখ্য এমনকি বিদেশের তথা ইন্ডিয়ারও অনেক মহাপ্রভুভক্ত-আশেকান জমায়েত হন চৈত্ররবিবারগুলোতে এই ঢাকাদক্ষিণে অবস্থিত চৈতন্য মহাপ্রভুর পিতামহগৃহ ‘ঠাকুরের পুকুর’ নামের দিঘি-টিলাবেষ্টিত অঞ্চলে। এই নিবন্ধকার/নোটকের মাতুলালয়ও ওইদিকটাতেই তথা মহাপ্রভুপিতামহভিটার কয়েক মাইলের মধ্যেই। কিন্তু নোটক তো নোটকই, নিবন্ধকার বড়জোর বলা যায়, চৈতন্যমহান কোনো গুণ অথবা গান উহার অধিকারে নাই। নিজে তো চৈতন্যদেব গান গেয়েই বাংলা মাতিয়ে রেখেছিলেন, ওই ইতিহাস অত দূরের নয় এখনো, মজিয়েছিলেন ভাবের ঘোরে। এইসব কিছু কারণে, কেবল উভয়ের শৈশবস্মৃতিবিজড়িত পিতামহভিটা আর মাতুলালয় সমীপবর্তী হওয়ার কারণটাই মুখ্য নয়, ছেলেবেলা থেকেই আমি কিঞ্চিৎ চৈতন্যাগ্রহী। এবং ফলে এই-রকম মাঝেমধ্যে মহাপ্রভুর কথা মনে পড়ে, তেমন গভীরতর কোনো ষড়যন্ত্রমূলক মনেপড়াপড়ি নয়, এমনি এমনি স্মরণ ও স্মৃতিচারণ। তাছাড়া এইটা এখন চৈত্র মাস, কাজেই, যা-হোক। তবে একটা কারণে মহাপ্রভুর বিশেষভাবেই বিখ্যাত সেই বাঞ্ছাত্রয়ী মনে পড়ছিল। ঘটনা খুলিয়া বলা আদৌ দরকারি না, খালি ইশারাটুকু টুকিয়া রাখা ছাড়া, নিজের জন্যই ইশারা টুকিয়া রাখা। তার আগে বাঞ্ছা তিনটার উল্লেখ করা যাক।
মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের তিন বাঞ্ছা : ওরে আমি কটিতে কৌপিন পরবো, করেতে করঙ্গ নেব, এবং, মনের মানুষ মনে রাখব। কথা আমাদের তৃতীয় তথা শেষোল্লেখকৃত বাঞ্ছা নিয়া। ঘাপলাটা লাগতে দেখি, বা লাগাইতে দেখি, হামেশাই। সাপোজ্ আপনি কোনো অনুষ্ঠানে একজন-কোনো মনের মানুষ, তথা যারে আপনি দীর্ঘদিন ধরে মনে মনে ভালো বলিয়া ধরিয়া নিয়া খানিক শ্রদ্ধাট্রদ্ধাও করিয়া আসছিলেন, উনারে অন্যতম বিশেষ বা প্রধান অতিথি হিশেবে নিয়া আসার জন্য অনুষ্ঠানসূচি নির্মাণ করিলেন। সত্যি সত্যি নিয়া আইলেন কি না তা আদৌ ধর্তব্য নয়, এই নিবন্ধে, মনে মনে ধরে নিতে বলা হচ্ছে শুধু। তো, মনে করুন, গোলটা বাঁধল যখন আপনি নিমন্ত্রণপত্র ছাপাইলেন। ওমা! আপনার শ্রদ্ধামানুষ, যারে আপনি ‘মনের মানুষ’ সাব্যস্ত করিয়া কাল-কালান্তর ধরিয়া হ্যাপি ছিলেন, উনি তিফিল বাছুরের ন্যায় গোঁ ধরিলেন, গোস্বা করিয়া বসিলেন, উনার নাম কেন জনৈক-অন্য তমুকের নামের তলে দেওয়া হইল! ও মোর জ্বালা! সামলাও হালুয়া এইবার! অথবা আপনি কোনো কবিতা-গালগল্পভিত্তিক পত্রিকা বার করবার ইন্তিজাম-আঞ্জাম করিলেন ‘মনের মানুষ’ কয়জন প্রৌঢ়বুড়া-বাল-বৃদ্ধবৃদ্ধা সাহিত্যিক-কবি ইত্যাদি নিয়া। তা, তখন দেখবেন, মনের মানুষ দুই-তিনজন লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছেন তেনার বা তেনাদের নাম কেন অমুকের-তমুকের তলে রেখে সূচি সাজানো হইল। গোষ্পদগোষ্ঠীকে এইভাবে এতটা লাই দিয়া আমরা সামাজিক ইক্যুয়িলিব্রিয়াম্ বহু আগেই দিয়াছি বরবাদ করে। এখন তো ফল ভুগিতে হইবেক।
পথিমধ্যে একটা বাজে-ইঙ্গিতের কথা ফাঁস করিয়া মাঝখানে বেশ-একটু পরিবেশ ফর্শা করিয়া গেল বন্ধুবর আমাদের, আড্ডায় যে অনিয়মিতভাবেই নিয়মিত, নাম-প্রকাশে-অনিচ্ছুক, বলিল সে, এইসব মুদির ভাইরা তাদিগের রাত্রিজীবনে বেজায় নিষ্করুণরকমে ব্যর্থ এবং এরা তাদের নাইট-পার্টনারের উতলা নিম্নধরণীতলে ভ্যাদামাছের ন্যায় নিস্তেজ পড়িয়া থাকে কার্যকালে, কাজেই এরা নাম-ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্নস্থান বরাদ্দকরণটাকে ইন্সাল্টিং মনে করিয়া থাকে ন্যাচারালি। কিন্তু মুখপোড়া বান্দর-হনুমান বকা দিয়া আমরা সেই ভীমগদা বন্ধুটাকে আড্ডা হইতে তাড়িয়ে দেই বটে, এবং পরিস্থিতি কিছুটা গাম্ভীর্যপূর্ণ করিয়া রাখিবারে করি মরিয়া চেষ্টাও; তবু কথাটা আমাদের কান থেকে, এমনকি মন থেকে, তাড়াতে পারি না। তা, খারাপ তো বলে নাই। কিন্তু মূল সমস্যাটা হয়েছে মনের মানুষ বাইরে বের করিয়া আনায়, এইটা আমাদের কারো-কারো মনে হইলেও ওই আড্ডায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু চৈতন্যবাণী বিতরণ করবার সাহস পাই না।
যা-হোক, কথাটা যেভাবেই ভাবা হোক, মন্দ নয় কিন্তু! মনের মানুষ বনে বের করিয়া আনবেন তো মরবেন। মনের মানুষ মঁসিয়ে তখন বন অধিকার করিবার চাইবেন নির্ঘাৎ, অথবা চাইবেন শুইতে, শুয়ে দেড়-মিনিটের মাথায় হাঁপানো ব্যতিরেকে প্রেমের প্রেম কিছুই তো করবার মুরদ নাই, কিন্তু শীৎকারে খাটের তিনটা পায়া ভাঙিয়া ফেলিবেন ততক্ষণে এবং এন্ড্ অফ দ্য নাইট আপনার নিজের হাতেরেই জগন্নাথ বানানো ছাড়া দেখবেন কোনো উপায় থাকছে না আর। মনের মানুষ মনে রেখে দিলে কিন্তু ঘটনাটা অতটা প্যাঁচ খাইত না, বা জগৎ অত দুঃখেরও হইত না। তা, কথা ঠিক, মহাপ্রভুর কথা বাসি হইলেও খুশবু জব্বর!
চৈতন্য ও শৈশবখণ্ড
আমার শৈশবের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অংশের মধ্যে একটি হচ্ছে এই বান্নি। স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় কিতাবপুস্তকে লেখা হয় বারুনি। বান্নি বলি আমরা। বাংলা চৈত্রমাসের সব-কয়টি রবিবার জুড়ে এই বান্নির মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে যুগ-যুগ ধরে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো-কোনো বছরে পাঁচটা বান্নিও অনুষ্ঠিত হয়, যে-বছর চৈত্রমাসে পাঁচটা রবিবার পড়ে যায়, নিদেনপক্ষে চারটে মেলা তো হয়ই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আর্বান ট্রেইড ফেয়ার ছাড়া গ্রামীণ মেলার দেখা পাওয়া ভার। বছরভর নানান কিসিম বাণিজ্যমেলায় ছাওয়া আজকাল বাংলাদেশভূখণ্ড। বছরের বিশেষ কিছু সময়ে জেলায় জেলায় হয় বইমেলাও। তবু যে-কয়টা আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহ্যপ্রবাহক মেলা আছে এখনও ধুঁকে ধুঁকে টিকে, এর মধ্যে ঢাকাদক্ষিণের বান্নি সম্ভবত লোকসমাগম ও আয়তন বিবেচনায় শীর্ষ। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় এখন যদিও, শৈশবের সেই শান-শওকাত এখন আর দেখি না, তবু যেটুকু আছে এখনও তা আলবৎ গরব করার যোগ্য। গরিমাযোগ্য। মনে আছে তখন, এই তো বছর-বিশেক আগেও, গুড্ডিহাটায় ঢুকলে দুইধার জুড়ে তো বটেই এমনকি আকাশ ঢেকে কেবল ঘুড়িরঙিন রোদ্দুর দেখা যাইত, অন্তহীন ঘুড়িস্রোত। শোলার ফুলের বিক্রেতারা বসতেন যে-লাইনটায়, সেইটা ছিল দুনিয়ার দীর্ঘতম ফুলবাগিচা। তারপর কাগজ-কঞ্চির চর্কি, আমরা বলি ফর্ফরি, কিংবা ঘূর্ণি নামেও লোকে ডাকে তারে, এই সারিতে একবার প্রবেশিলে বেরোতে চাইত না মন। খৈ-মুড়ি-মুড়কির বিক্রেতারা আরেকটা ইয়া লম্বা লাইন বসাইতেন, পনেরো-ষোলো জাতের খৈ ছিল সেইসব বিক্রেতার সাজানো পসরায়। ক্ষিরা আর বেল বেচতে বসতেন পঞ্চাশ-একশ জন লোক দুইধার জুড়ে, মাঝখান দিয়া পায়ে হেঁটে চলার সরু গলিপথটুকু বজায় রেখে বসতেন সবাই। ছিল পুতুলনাচ দেখাবার বিরাট প্রেক্ষাগৃহ, ত্রিপল দিয়ে ঘের-দেওয়া অন্ধকার হলরুম, ঢুকলেই কিসসাকাহিনির সঙ্গে পুতুলের নাচ। একই কাহিনি দেখতাম ছোটমামার কানে ঘ্যানর-ঘ্যানর করে পটিয়ে দুইবার-তিনবার। টিকিট কেটে ঢুকতে হতো। টিকিটের হাদিয়া তো বলতে পারব না, নিজে কোনোদিন খরিদ করতে হয় নাই যেহেতু। বড় হয়ে জেনেছি এইটা নাকি ঐতিহ্য হয়ে গেছে, এবং ঐতিহ্য কাকে বলে এমন প্রশ্ন মনে উদয় হলে উত্তর পেয়েছি মোক্ষম : যাহা বিলুপ্ত তথা আগে ছিল অথচ বর্তমানে নাই বা প্রায়-নাই তাহাই ঐতিহ্য! অথচ তখন এইসব ছিল অঙ্গাঙ্গী রিয়্যালিটি, বাস্তবতা আমাদের শৈশবজীবনের। এখন টেলিভিশনচ্যানেলে এইসব জিনিশের অপভ্রংশ দেখায়, দেখতে পাই, এগুলোর খুব ডিম্যান্ড শুনতে পাই, পাপেট শো করে প্রচুর পয়সাকড়িও কামানো যায় এখন। তবে এইটা ঠিক যে, এখন অনেককিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বান্নি টিকে আছে, এই এলাকার জন্য এইটা একটা দারুণ মর্যাদার আর গর্বের ব্যাপার। ঢাকাদক্ষিণের বান্নি দেশে-বিদেশে মশহুর, বড় হয়ে জেনেছি এসব। ছোটবেলার দীর্ঘ স্মৃতি ঘেঁটে এখন বুঝতে পারি, বান্নির মেলা এই এলাকার মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে কেমন মেশামেশি সম্পর্কিত ছিল। যে-সময়টার কথা আমি বলতে চাইছি, সেই সময়ে ওই অঞ্চলের লোকজন তাদের সম্বচ্ছরের গেরস্তালি জিনিশপত্তর — যেমন বাঁশ-বেতের বিবিধ তৈজশ, লাঙ্গল, কোদাল-কুড়াল-বটি, শিল ও নোড়া, এমনকি সেগুনকাঠের আসবাবপত্রও এই বান্নিমেলা থেকে খরিদ করতেন সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে। আমার নানাবাড়ি ভাদেশ্বর হবার সুবাদে বান্নির সিজনে আম্মার নাইওর যাওয়া ছিল অবধারিত। ফলে বছরের-পর-বছর বান্নি ছিল কমন্ ইভেন্ট আমার জীবনে। এখনও চৈত্রমাসের রবিবারগুলোতে ভদ্রমহিলা মনে করিয়ে দেন একবার বান্নি থেকে একটু খৈ-ফর্ফরি কিনিয়া আনার জন্য। সব বছর তো পারি না যাইতে, এখন আমরা দুনিয়াজয়ী মহাব্যস্ত একেকজন হয়েছি তো। গতবার গিয়ে এসেছি ঘুরে, এর আগের বারও, এইবার শেষ বান্নি ধরব বলে দিলের ভিতর তমন্না আছে, দেখা যাক, যদি দুনিয়া মাথার ওপর ভেঙে না-পড়ে তো ঢুঁ দিয়া আসব একবার, খৈ কিনব, দুই-চাইরটা বেল তো অবশ্যই; তেঁতুল কিনব সারাবছরের মজুদ, পুরানা তেঁতুল — যার লোক্যাল্ নেইম্ তেতৈ — সে-তো ওষধি মহা, আবশ্যক ঘরে রাখা; হাতপাখা কিনব, ফর্ফরি তো প্রতিবারের ন্যায় এইবারও কিনব ছয়-সাত কিসিমের, প্রত্যেক কিসিম বিশটা করে। আজও পিচ্চিরা আমার শৈশবের খেলনা পেলে কার্টুন্-কম্পুগেইম্ ফেলে ঝলমলে রঙিন হয়ে ওঠে, এইটা আমি আমৃত্যু দেখে যেতে চাই। আমারই শৈশব আমি নিজের হাতে নির্ভুল ফিরিয়ে আনতে চাই প্রতিবার বান্নিমেলা এলে। এই ছোট্ট অনুচ্ছেদখানা, ঢাকাদক্ষিণ সিলেটের চৈতন্যপিতামহের ভিটে নিয়ে লেখা, আমারও শৈশবচেতনাজাগানিয়া। আর, বলা বাহুল্য, গৌরাঙ্গ বা নিমাই বা চৈতন্যদেব নিয়া আবছায়া স্মারক/স্মৃতিনিবন্ধপ্রতিম হইলেও রচনাটা আদৌ চৈতন্যতত্ত্ব/তথ্যভিত্তিক নয়। চৈত্রাগমে মেলা আবাহন এবং বাংলা বর্ষবিদায় প্রাসঙ্গিক এই রচনাটা, সার্বিক বিচারে এই চির্কুটসদৃশ নিবন্ধখানি, লিখিত হইতে পারল যদি কিছু পর্যটক আকৃষ্ট করা যায় ঢাকাদক্ষিণ সিলেটে মেলাচলাকালীন রথদর্শন ও কদলিভক্ষণে।
তিন পাগলের এক
অন্য দুইজনের নাম পরে নেব, এক্ষণে একের নাম লইব — চৈতন্য। ফকির লালনের একটা গানে এই ট্রায়ো বর্ণিত হয়েছে। ম্যাডস্ দ্য ট্রায়ো। চৈতে-নিতে-অদ্বৈয় — এই ত্রয়। এই তিনেরই স্মৃতি আছে বাংলার অববাহিকায়। কাজেই আরেক গ্রেইট লালন গাইছেন : “তিন পাগলে হৈল মেলা নদে এসে / তোরা কেউ যাসনে ও-পাগলের কাছে” … এরপরে একটা জায়গায় লালন বলছেন : “পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে” … যেখানে যেয়ে নাম নিচ্ছেন তার পূর্বসূরি তিন পাগলের, লক্ষ করি সেই স্তবকটা : “পাগলের নামটি এমন / বলিতে ফকির লালন ভয় তরাসে / চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে” … এই তিন পাগলের মধ্যে চৈতে হলেন নিমাই, শ্রীচৈতন্য । নিমগাছের তলায় মাতৃগর্ভ হইতে মাটিতে নেমে এসেছিলেন বলেই নিমাই নাম তার।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন অ্যারিয়া থেকে সরাসরি তিরিশ কিলোমিটার দূরে ঢাকাদক্ষিণ। লাইনের বাসগাড়ি হোক বা প্রাইভেট ভিয়্যেকল থেকে নেমেই পাবেন বাজার, সেখান থেকে এক-দেড়কিলো দূরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতামহের বাড়ি। জীবদ্দশায় শ্রীচৈতন্য ওর্ফে নিমাই তার ঠাকুমাকে দেখতে এখানে এসেছিলেন, কীর্তন করেছিলেন তল্লাট ঘুরাণ্টি দিয়ে, সেই টিলাঘেরা উচ্চাবচ অঞ্চলটা আজও পৌরাণিক একটা আবহ মনে করায়ে দেয়। শ্রীচৈতন্যদেবের কীর্তনলীলার সেই স্থানটি ক্রমশ পরিণত হয়েছে তীর্থকেন্দ্রে। সেখানে ঢুকতেই বামদিকে পাবেন শ্রীচৈতন্যমঞ্চ, ডানদিকটায় মূল মন্দিরে ঢোকার সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো আগে ছিল ঝামাপাত্থরের, লালরঙা মাটি ফুঁড়ে বেরোনো গম্ভীর ঝামাপাত্থরের ইম্প্রেশনই ছিল আলাদা, আজকাল ঝকমকা টাইলস্ বসেছে। এবং অনেক উঁচু। মন্দিরটাও ফ্লোর থেকে শুরু করে দেয়াল পর্যন্ত সুবিশাল ঝকমকা টাইলসখচিত। মনে হয় যেন শপিংম্যলে এসে ঢুকেছি। ঠিক সেই আগের আবহটুকু অন্তর্হিত। তো, সোজা ঢুকে যেয়ে পাবেন মন্দির। মন্দিরে দেখা যায় ধারাবাহিকভাবে সাজাইয়া রাখা কতকগুলো প্রতিকৃতি : নিমাই সাধুর পিতামহ, মাতামহ, পিতামাতা, তারপর একটা ছবিতে লীলাস্থানে চৈতন্য ও কৃষ্ণ যুগলবন্দী এবং বৈষ্ণব ধর্মের পাঁচ মহাজন শ্রী অদ্বৈত, শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রী গৌরাঙ্গ, শ্রী গদাধর ও শ্রীবাস পণ্ডিতের প্রতিকৃতি। ঠিক মন্দিরসংলগ্ন ভোগপ্রসাদ রান্নার ঘর, ভক্ত-সেবায়েতদের থাকার জায়গা ইত্যাদি।
ইদানীং উইকি ইত্যাদি মারফতে ঝটাপট তথ্য হাসিল করে নেয়া যায়। কাজেই তথ্যখৈ ছিটাইয়া আমরা ভারাক্রান্ত করব না এই নিবন্ধ। সংক্ষেপে জ্ঞ্যাতব্য, ১৪৮৬ সনে নদীয়া জেলার নবদ্বীপের মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্ম। মায়ের নাম শচীদেবী, বাবা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র। পরপর কয়েকটি কন্যাসন্তানের বাদে শচীদেবীর গর্ভে ও জগন্নাথের ঔরসে জন্ম নেয় দু-দুটো পুত্রসন্তান : শ্রী বিশ্বরূপ ও ও শ্রী বিশ্বম্ভর। এই বিশ্বম্ভরই আমাদের নিমাই, চৈতন্য, গতরের রঙ গৌরবর্ণ বলে উনারে গৌরাঙ্গ নামেও ডাকা হয়। আশেকানরা ভালোবেসে ‘মহাপ্রভু’ সম্বোধনে অভিসিক্ত করেন তারে।
এমনিতে চৈতন্যজীবনচরিত বইয়ের দেখা বাজারে পাওয়া যায়, আজকাল ক্লিক করলেই ইংরেজি-বাংলায় নিমাইয়ের জীবন ও কর্ম নিয়া হাজার হাজার পাতা সামনে এসে হাজির হয়। সেসব আমরা এই নিবন্ধে এড়িয়ে যাব যথাসাধ্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা মনে করেন, চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং ঈশ্বরেরই তিনটা আলাদা রূপের প্রতিনিধিত্ব করেন; এক, তিনি কৃষ্ণের ভক্ত; দুই, তিনি কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তা; এবং তিন, তিনি রাধার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ কৃষ্ণেরই নিজের রূপ। চৈতন্য কেবল শ্রীমদ্ভাগবতের বাণীই প্রচার করেছেন তা নয়, তিনি ভগবদগীতার মূল তত্ত্ব ও সূত্রগুলো অত্যন্ত ফাংশন্যাল করে এনে সেগুলো সর্বসাধারণে প্রচার করেছেন।
চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশা রাজ্যের বাসিন্দা। তার পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে তৎকালীন বাংলার শ্রীহট্ট (বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট) জেলার গোলাপগঞ্জে এসে ঢাকা-দক্ষিণ বাজারলগ্ন অঞ্চলে বসত গাড়েন। তাদের মূল বসতভিটাটি এখন পোড়োবাড়ি। জংলা জায়গায় লতাপাতাবেষ্টিত চুনসুরকির পুরানা স্থাপনাটি সিঁড়ি বেয়ে দেখে আসতে পারেন যে-কেউ। ভক্তরা প্রাঙ্গনে গড়াগড়ি দিয়া আরতি-জিকিরাজগার করেন প্রত্যেক পুণ্যতিথিতে। চৈত্রমাসে ব্যাপক জনসমাগম হয়। ইন্ডিয়া থেকেও পুণ্যার্থীরা আসেন। স্থানীয়দের ভিড় তো রয়েছেই।
জীবদ্দশায় টানা আটচল্লিশ বছর চৈতন্য তার মানবধর্ম প্রচার ও প্রসারের মিশনারি জিল্ নিয়ে এগিয়েছেন। প্রথম চব্বিশ বছর নবদ্বীপে শৈশব ও গার্হস্থ্যলীলা সম্পাদনে ব্যাপৃত রইলেও পরবর্তী চব্বিশ বছর শ্রীচৈতন্যদেব জগন্নাথ ও পুরী ছাড়াও গোটা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হরিনাম প্রচার ও কৃষ্ণভক্তি শিক্ষার কাজটা চালিয়েছেন নিরলস নির্বিশ্রাম। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ বই থেকে জানা যায়, বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ শেষে শ্রীচৈতন্য বাংলামুলুকে ফেরার পর অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজের এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তখন বর্ণপ্রথায় জর্জরিত সমাজে নিচু জাতের মানুষগোষ্ঠী নিগৃহীত হচ্ছিল। চৈতন্য তাদেরেই ত্বরাইবার মানসে হাজির হলেন বর্ণগোত্র ভেদাভেদহীন এক সহজিয়া মানবধর্ম নিয়ে।
নিজের ঠাকুমাকে দেখতে এসেছিলেন সিলেটে। একটানা থেকেছিলেন অনেকদিন। ধর্মকথা প্রচার করেছিলেন সুরে সুরে। কীর্তন গাইতে গাইতে এক-সময় লীলাচ্ছলে শূন্যে মিলিয়ে যান বলিয়া জনশ্রুতি প্রচারিত। যদিও এইসব জনশ্রুতি নিয়া আমরা তালাশমূলক কথাবার্তা পাড়ব না এই নিবন্ধে। কেবল ভক্তদের কীর্তন-আরতির সুরগুলো লক্ষ করব চৈত্রমেলায় ঠাকুরপুকুরের চারিধারে। কেবল শুনব বৈষ্ণবীরা গাইছেন : “যদি গৌর না হইত তবে কি হইত / কেমনে ধরিতাম দেহ / রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা” … ইত্যাদি। কিংবা পারলে কথা বলব চৈতন্যদেবের পিতৃকুলের উত্তরসূরি কারো সঙ্গে, মন্দিরের চারপাশে সেই মিশ্র পদবীধারী গৃহস্থদের বাস। বর্তমান নিবন্ধকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তেমনই একজনের, যিনি বর্তমানে ইন্ডিয়ায় সেটল্ড, বই লিখেছেন ‘উন্মোচিত ঢাকাদক্ষিণ’ নামে, নাম তার বাণীপ্রসন্ন মিশ্র। বইটা আনফর্চুনেইটলি খরিদ করতে পারি নাই সেই-সময়, বছর-কয়েক আগে, এরপরে স্থানীয় বইদোকানিদের দ্বারস্থ হয়েও খুঁজিয়া পাই নাই। কিন্তু চৈতন্যকে অ্যানেকডোট্যাল গল্পগাছার মধ্য দিয়া তালাশিবার একটা ইচ্ছা আজও মরিয়া যায় নাই। ঠিক যেমন শাহজালালকে অ্যানেকডোট্যালের ভিতর দিয়া কালচারাল একটা স্টাডি করার ইচ্ছাও রয়েছে।
তীর্থ ও তরণী
সিলেটে শুধু চৈতন্য মহাপ্রভুই নয়, আরও অনেক সাধকের স্মৃতিধাম রয়েছে। যেমন হযরত শাহজালাল, হযরত শাহপরান প্রমুখ। শাহজালালের সঙ্গী তিনশষাইট আউলিয়া। এরা সকলেই ধর্মপ্রচারে এসে যেভাবেই হোক প্রচুর জনসমাবেশনের কাজ করেছিলেন। এবং অনেক হাঁউকাঁউয়ের পরে স্বীকার্য যে এদের কাজকর্মের বড় একটা হাতিয়ার ছিল গানবাজনা। পাগলই ছিলেন এরা সামাজিক মানুষের লোকালয়ে।
এমন আরও রয়েছে বহু জায়গা সিলেটে ছড়িয়েছিটিয়ে, যে-জায়গাগুলো সাধকদের স্মৃতিবিজড়িত। রয়েছে এদেশের হিন্দু পুণ্যার্থীদের কাছে ভক্তির স্থল পণাতীর্থ। “সব তীর্থে বারবার / পণাতীর্থে একবার”। পণাতীর্থ এমন একটা জায়গা, যেখানে কায়মনোবাক্যে একবার স্নান করলেই অতীতের সব পাপ ধুইয়া যায়; অর্জন করা যায় অশেষ পুণ্য ও ভগবানের আশীর্বাদ। অন্য তীর্থের মতো সেখানে বারবার স্নান করার দরকার নাই। এই চৈত্রমাসেই হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যকামী মানুষ সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ নীলাভ জলে পণাতীর্থ বা বারুণী স্নান করে কলুষমুক্ত হন এবং দয়াময়ের কৃপা লাভ করেন। তাদের বিশ্বাস, পণাতীর্থ স্নানের মাধ্যমে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। এই উপলক্ষে আকর্ষণীয় একটা মেলাও বসে সেখানে।
এই পণাতীর্থ-বারুনিস্নানের সময়েই অদূরে সীমান্তবর্তী লাউড়েরগড়ে অনুষ্ঠিত হয় হযরত শাহজালালের সঙ্গী আউলিয়া হযরত শাহ আরেফিনের বার্ষিক ওরস। হযরত শাহ আরেফিনের মোকাম বা মাজার অবশ্য সীমান্তের ওপারে একটা পাহাড়ের চূড়ায় হলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অগণিত মুসলমান নরনারী ওরসে শরিক হন এবং দূর থেকে এই দরবেশের মোকাম জিয়ারত করেন। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষীদের উদারতায় প্রায়-বছরেই এ-সময়ে বিনা বাধায় ভারত থেকে হিন্দুরা আসেন পণাতীর্থে আর বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা যান হযরত শাহ আরেফিনের মোকামে। হিন্দুরা মুসলমানদের বাড়িতে থাকেন, মুসলমানরা হিন্দুদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। চৈত্রমাসে এই এলাকা হিন্দু ও মুসলমানদের এক মহামিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাঁচশতাধিক বছর ধরে এই অলিখিত ধারা যেমন অব্যাহত আছে তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বিদ্যমান। এই সুদীর্ঘ সময়ে একদিনের জন্যও দুই ধর্মাবলন্বীদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি।
লীন চৈতন্য
শুধু চৈতন্যই না, প্রায় ধর্মপ্রবক্তা/প্রচারকদের ক্ষেত্রে এমন একটা গল্প শোনা যায় যে তারা সাধনযজ্ঞ করতে করতে এক-সময় লীন হয়ে গেছেন পরমার মাঝারে। যেমন মুসলমানদের পির যারা, তাদের ক্ষেত্রে শোনা যায় তারা আউড়ি দিয়াছেন। আউড়ি দেয়া মানে আড়ালে চলে যাওয়া। আরেকটু ভেবে দেখলে মনে হবে যে জেসাস ক্রাইস্টের ক্ষেত্রেও গল্পটা প্রায় মেলানো যায়। ঈশ্বর তারে তুলে নিয়ে গেছেন। তিনি আবার আসবেন। ইত্যাদি। ঠিক আছে।
যে-কোনো গল্পই ভক্তদের ইন্টার্প্রিটেশনে এক-রকম, আর যারা ভক্ত নয় তাদের ইন্টার্প্রিটেশনে আরেক রকম। শ্রীচৈতন্যের জীবনাবসান নিয়া আমরা আউড়ির গল্প যেমন শুনেছি, তেমনি শুনেছি আরেকটা গল্পও। বলা বাহুল্য, সংগত কারণে আমাদের শিশুমনে এই দ্বিতীয় গল্পটাই অভিঘাত রেখে গেছে বেশি। কিন্তু সত্যিমিথ্যা জানি না। বাংলা ভাষার এক কবি এই রোমহর্ষক ঘটনাটা কবিতায় কীভাবে এঁকেছেন, আমরা দেখি :
শ্রীচৈতন্য অচলায়তন ভেঙে মানুষের জয়গান করেছেন।
শ্রেণি-জাতিভেদ ধুয়ে মানুষ এক-কাতারে তখন।
জনজাগরণ নবদ্বীপ, নীলাচল, দাক্ষিণাত্য,
. উড়িষ্যা, বাংলায় —
এতে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দোকান-মোকাম অচল প্রায়।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ ২৯ জুন শ্রীচৈতন্য
জগন্নাথ মন্দিরে গভীর ধ্যানে মগ্ন।
সুযোগ বুঝে তাকে হত্যা করল ঠাকুরেরা।
তার মাংস টুকরো টুকরো করে খিচুড়ির সঙ্গে রান্না করল।
সেই খিচুড়ি প্রসাদ হিসেবে শ্রীচৈতন্যের ভক্তদের মাঝে
. বিতরণ করা হলো।
আর চারদিকে প্রচার করা হলো —
শ্রীচৈতন্য জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন।
কবিতাটার নামই ‘শ্রীচৈতন্য’। কবিতাটি লিখেছেন মাহবুব কবির। ‘ফুলচাষি মালি যা-ই বলো’ নামে ২০১১ সনে বেরোনো কবিরের বইটাতে এইটা পাওয়া যায়। এই গল্পটাই আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, যেমন শুনেছি শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার গল্পটিও। খটকা শুধু একটাই এখানে যে, মাংশের ঘ্রাণওয়ালা খিচুড়ি কি বৈষ্ণবরা খান সাধারণত? ঢাকাদক্ষিণে যেয়ে প্লাস্টিকের পাতে ঢালা ল্যাটল্যাটা খিচুড়ি খেয়ে দেখেছি সেখানে হারাম মাংশের একটা কুচিও নাই। হলদিয়া কালারের সব্জিডালমেথিসুবাসের পানি-পানি খিচুড়ি।
নিবন্ধ রচনায় : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS