চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১০ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১০ || শেখ লুৎফর

বাড়ির শোভা বাগবাগিচা, ঘরের শোভা নারী


আঙ্কুর নতুন লেখা একটা গানের সুর বাঁধছিল। পরী তার কোলে বসে সেই সুরটা ঠোঁটে তুলে নিচ্ছে। দলের কর্তা বেখায়ালে বিড়ি টানছে। এইসব ইয়েটিয়ে বাবদ মানু মিয়ার কাছে পরীর কোনো গুরুত্ব নাই। কিন্তু দুই-চারটা বিচ্ছেদ গান লিখে আঙ্কুরের ক্যারদানি তার একটুও ভালো লাগে না। টুন্ডামুন্ডা একটা মানুষকে খোদা বাঁশের মতো একটা জিনিস দিলো! জিন্দেগিতে যে যন্ত্রডা পেশাব ছাড়া আর কোনো কামে লাগবে না।
মানু মিয়া মনখারাপ করে আঙ্কুরের দিকে তাকায়, খাচ্চরটা পরীরে কোলে বসায়াই মাল আউট কৈরা দিতাছে নাকি?
মানু মিয়া জোরে থুতু ফালে, তার যন্তরটা যুদিন আঙ্কুরের মতন অইত!

এইসব রাগ,অভিযোগের মাঝেই মানু মিয়ার মনে আক্ষেপ জাগে, ভুঁড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মজাই শেষ। এই দুঃখে আঙ্কুরের প্রতি সে আরো বেশি ক্ষ্যাপা। তাবাদে বাইরে বাইরে সে সবাইকে খুশি রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু সবসময় পারে না। মাঝেমাঝে রাগে সে অন্ধ হয়ে যায়। তখন দাবার চালে ভুল করে ফেলে। তাই সে সবসময় বিরক্ত থাকে।  গত কয়-বছর ধরে কর্তা হিসাবে তার যা খরচ হওয়ার কথা, তার অর্ধেকটাও হয় না। খেলা নীরবে জাল বিস্তার করছে। হয়তো খেলা নিজের অজান্তেই আজাজিলের মতো একটু একটু করে তার বুকের দিকে ছুরি তাক করে এগিয়ে আসছে। যেমন করে পাকিস্তানের হৃদপিণ্ডের দিকে খাবলা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ মুজিব!

এইসব ভাবলে মানু মিয়ার ভালো ঘুম হয় না। বৈশাখের ঠা ঠা গরমেও তার শীত করে। আবার মাঘ মাসের শীতের রাতেও এইসব ভাবতে ভাবতে গরমে সে গতরের লেপ ফেলে দেয়।

প্রথম যৌবন থেকেই তার নজর কলুদের লাল লাল বৌ-ঝিদের দিকে। ঝক্কি আছে ঠিকই কিন্তু খুব সস্তা। ঘাটুছেরা বিষয়ে আগে আগে মানু মিয়া বলত, — নাওয়ের কাম তক্তায় হয় ক্যামনে !

অরে কাল বিধি,
এসেছিলাম সোনার দেশে
রূপার কাঁকন পরে …

পরী গুনগুন করে গানটা আঙ্কুরের ঠোঁট থেকে তুলে নিচ্ছে, তা দেখে মালেক মেয়েলি সুরে একটা ঘাটুগানে টান দেয় —

অরে প্রাণকৃষ্ণ,
নিশিতে ক্যান ঢেলা মারো
আমার ভাঙা ঘরে …

ঘোড়ামোবারক কোদাল চালাতে চালাতে মালেকের কথার জবাব দেয় —
জলের ঘাটে ক্যান গো সখি
একলা একলা যাও,
সুযোগ বুঝে ক্যান সখি
বুকের আঁচল সরাও।

কাদু-কালুরা কোদাল চালাতে চালাতে নরম সুরে জোহার দেয়, — ভালো কত্তা ভা, অ হারে হে …

আশপাশের পাড়াগুলার বৌ-বেটিরাও এসছে। তারা গাছগাছালির আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দুই-তিনজন করে ছোট ছোট দল বেঁধে কান পেতে আছে। পাড়ার ছেলে-বুড়া-তরুণরা তো অনেক আগেই এসে আমগাছের ছায়ায় আসর জমিয়ে বসেছে। কার্তিকের ঝিমধরা দিন। থমকে থাকা গরম বাতাসে ধানের রেণুর মিঠা মিঠা সুবাস। গাছগাছালি, ঝোপঝাড় আর ক্ষেত-খলার কালচে সবুজে আবহমান বাংলার বিষণ্ণ মমতা। মানু মিয়া আঙ্কুরকে বলে, — তর গানডা যুইত কইরা ধরচা! এই পরী, গান ধর!
আঙ্কুর নীরবে মাথা ঝাঁকায়। পরী ও…ও… করে টান দেয়, —

অ রে কাল বিধি …

উত্তেজনা আর সুখ-শিহরণে আঙ্কুরের দুর্বল শরীরটা কেঁপে ওঠে। সে গদগদ গলায় বলে, — হেই গানডা ধর রে পরী!
পরী ডগমগ যুবতীর মতো উজ্জ্বল, রহস্যময় চোখদুইটা নাচিয়ে বলে, — কোনডা?
— আমি কার সাথে বাণিজ্যেতে যাব …
পরীর চোখ দুইটা আবার ঝলক দিয়ে ওঠে। সে মাথা নিচু করে খানিক ভাবে। ততক্ষণে আঙ্কুর হারমোনিয়ামে সুরটা বেঁধে ফেলেছে। পরী একটু সময় উঁ…উঁ…করে গানে টান দেয়।

কলির কাইল্ল্যা সওদাগর,
না খাওয়াইলা দুধের সর,
অ রে না খাওয়াইলা নারিকেল ভাঙ্গা পানি,
অ রে সওদাগর
আমি কার সাথে বাণিজ্যেতে যাব?

— এই নিঝুম দুফুরে ঘাটু ধর, ঘাটুগান জমব ভালা।

আঙ্কুর আর পরী দু-জনেই চমকে ওঠে। চেয়ে দেখে নবী শেখ আসছে। আঙ্কুর পরীর পিঠে আস্তে করে একটা খোঁচা দেয়। পরী তার কোল থেকে উঠে দাঁড়ায়। আঙ্কুরও ঠিকঠাক হয়ে বসে নবী শেখের দিকে নজর দেয়। লুঙ্গির উপরে হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। ঠোঁটে রমনা সিগারেট। জীবিকায় লোকটা মাঝি হলেও নগ্দা কামাই মন্দ না। গঞ্জে-মোকামে নিত্য যাতায়াত। একহারা গড়নের মানুষটার মুখে পান আর হাসি লেগেই থাকে। কথা বলে হৈ হৈ করে। সংসারের পঞ্চ-তরফের তত্ত্বতালাশে বিস্তর এলেম রাখে। নবী শেখ মানু মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে খৈ-ফুটার ভঙ্গিতে কথা বলে, —
এই বছর জব্বর একখান দল বানছ মিয়া, দশজনের মুহে মুহে খালি তোমার নাম। পরী ত এক্কেবারে বাইস্কোপের নায়িকা আইয়া গ্যাছে। দশ গেরামের সব চেংড়া-বুড়া অহন পরীর নামে কাত হয়।
কাতলা মাছের মতো গোমড়া মুখের মানু মিয়া হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়, — আফনেগর মতন মরুব্বিগর আশিব্বাদ।

এই কথা বলতে বলতে সে নবী শেখের হাত দুইটা জড়িয়ে ধরে। পরী এতক্ষণে বুঝে গেছে, এই তাহলে নবী শেখ। মানু মিয়া তার দিকে চোখে ইশারা করতেই সে লোকটার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। নবী শেখ হাসিমুখে পরীর মাথায় হাত রাখে, আর সালাম লাগত না, কাম যা করবার কইরা লাইছ। অহন খালি তাল ঠিক রাইখ্যও।

নবী শেখ আসন পেতে বসতেই পরী তার কোলে গিয়ে বসে। সে হাসতে হাসতে বলে, থাউক থাউক আর কোলে বইতে অইব না। পরী ওঠে না। নবী শেখ পকেট হাতড়ে আটআনার দুইটা আধুলি পরীর হাতে দিয়ে বলে, — যাও চাটাইয়ের মইদ্যে গিয়া বও।

নবী শেখের আগমনে বেগুন খেতের গোটা দলটা কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে গেছে। ঘোড়ামোবারক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ডায়ালগ ছাড়ে, — খুশামদেদ, খুশামদেদ, জনাবের আগমনে আজ চেমননগর ধন্য হলো! গোলাপ-চন্দনের খুশবুর মতো আপনার সুখ্যাতি তামাম মুল্লুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক আলামপনা।

কাদু-কালু, অহাকালু সহ দলের সবাই একদফা হাততালি দিয়ে ঘোড়ামোবারকের সম্ভাষণ ও নবী শেখের আগমনকে সাধুবাদ জানায়।

চাটাইয়ে বসতে বসতে নবী শেখ মানু মিয়ার দিকে রমনা সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। মানু মিয়া দেখে, নাওয়ের হাল-বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে নবী শেখের হাতের তালুতে বড় বড় কয়রা পড়ে গেছে। রোদে জ্বলেপুড়ে মানুষটার শৈল-গতরের চামড়া ঝামা। কিন্তু নবী শেখের কায়া-কর্মে কোনো দুঃখ-জড়তা নাই। চলন-বলনে সে শিক্ষিত-সচ্ছল মানুষের মতো। লোকটা যে-কয়দিন বাড়িতে থাকবে, মকমকা বাজার করবে, হাটে-ঘাটে খেঁচে আড্ডা দিবে, পাড়া-পড়শীর তত্ত্বতালাশ নিবে। তার ফাঁকে-ফাঁকে নয়া বর্ষার খলখলা পানির মতো শহর-বন্দরের তাজা খবর ভরে দেবে। পাড়ার মানুষকে জানাবে ইয়াহিয়া খানের বজ্জাতি আর শেখ মুজিবরের সংগ্রামের কথা। গৈ-গেরামের দীন-দুঃক্কী মানুষগুলা হা-করে সেই আলাপ শুনবে, তিলেকের জন্য হলেও সংসার নামের অতল গহ্বর থেকে চোখ মেলে তাকাবে, জীবনের তিতা ভুলে ফকফক করে হাসবে। মানু মিয়া জানে, নবী শেখ হক কথার মানুষ। কোনো ব্যাটাকে সে পুছে না। কিন্তু নবী শেখের এই জিনিসটাই মানু মিয়া একদম সইতে পারে না। দুই পৈসার মুরদ নাই তর এত ক্যারদানি ক্যা? তুই বেডা খাইবে, নাও লইয়া মোকামে-বন্দরে পাটের ক্ষ্যাপ দিবে। তর ক্যার রাজনীতির ফুটানি?

নবী শেখ সিগারেটে লম্বা দম দিয়ে বলে, — তাবাদে আঙ্কুর নয়া কোনো গান বানছ?
আঙ্কুর চোখ তোলে; তার বিষাদভরা চিকচিকে নয়নমণিতে পলে পলে হাজার কথা খেলে যাচ্ছে। অতল চোখের তারায় ঝিলিক তুলে আঙ্কুর জবাব দেয়, — জে, একখান গেছে-কাইল বান্ধা হইছে।
— প্রেমসংগীত, না বিচ্ছেদ?
— বিচ্ছেদ।
নবী শেখ হাত নেড়ে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলে, — সুযোগমতন হুনামনে, এই টাইমে বিচ্ছেদ জমত না। গানের রাজকুমারী বিচ্ছেদ অইল রাইতের জিনিস। আসমানে ঝলঝলা তারা আর নিঝুম পাথারে তুমি একলা। ব্যস, অহন বিচ্ছেদ লাগাও। দ্যাখবা তামাম দুইন্যায়ডা তোমার লগে কানতাছে।
— জে, হাজার কথার এক কথা।
মানু মিয়া পরীর দিকে তাকায়। পরী বলে, — জে, আফনের আশিব্বাদ হইলে একখান ঘাডুগান ধরতে পারি।
নবী শেখ পরীর মাথায় হাত রাখে। বাপের মতো বড় আপন সে-হাত। সারামুখে মিঠা হাসি ছড়িয়ে বলে, — ঠিক আছে, কিন্তু বাশশা কই? বাশশা না অইলে ত জোড়া মিলত না।

খেতের সুলা প্রায় শেষের দিকে। দূর থেকে আবাদি জমিটা এখন মায়ের মুখের মতো মায়াভরা। চোখ মেলে চাইলে মনটা জুড়িয়ে যায়। মানু মিয়ার চোখ সেইদিকেই। চারাগুলা এইমাত্র ভূমিষ্ঠ গাইয়ের বাছুরের মতো চোখ মেলে তাকাচ্ছে, ঠা ঠা রোদ আর ল্যাড়িব্যাড়ি বাতাসে কানঝাড়া দিয়ে খেলছে। মানু মিয়া পিটপিট করে সারা তল্লাটটা জরিপ করে। কয়েক খেত দক্ষিণে নদীর পার ঘেঁষে পালপাড়া। তারপর দাসপাড়া, সাহাপাড়া, রায়পাড়া। পুরো তল্লাটটাই দোআঁশলা মাটির। এ জমির মন-মর্জি আলাদা। ওই দ্যাখো, পালেরাও মনের হাউসে বেগুনখেতে সুলা দিচ্ছে। পেঁয়াজ-মরিচ, তামাকের খেতও রেডি প্রায়। আর মাসখানেক পরে এই মুল্লুকে চোখ-ধরা যাবে না। ফসলের সে কী বাহার হবে!

আফসোস মানু মিয়ার কলিজায় কুটকুট করে কামড়ায়। কলুদের লাল লাল ছেরিগুলা নিয়ে তার যৌবনকালটা অহেতুক গেছে। তখন সে সত্যিই অন্ধ ছিল। তা না-হলে পঁয়ষট্টির রায়টের সময় কাদু-কালুদের নিয়ে যুইত করে কয়টা ধাওয়া দিলেই পালেরা সব ফেলে একদৌড়ে গিয়ে ইন্ডিয়াতে উঠত। আর এই কুশৈত্ত্যা (অপয়া) নবী শেখ, তে-পথের ষণ্ডার মতো রায়টের সময় শেখপাড়ার চ্যাংড়াদের নিয়ে সারা হিন্দুপট্টিতে টহল বসিয়েছিল। আর সে-কী যেই-সেই টহল! হিন্দুদেরকে ফুলের টোকা দেয় কার বাপের সাধ্য! মানু মিয়ার বিবেচনায় শেখপাড়ার মানুষগুলা একেবারে জংলি।

নবী শেখ চুঁই-চুঁই করে সিগারেটে টান দিয়ে বলে, — মানু মিয়া দ্যাহি এক্কেবারে পাত্থর অইয়া গ্যালা।
অন্যমনস্ক মানু থোম্বা থোম্বা আঙুলে চিকন গোঁফ টানছিল। নবী শেখের কথায় চমক ভাঙে, — কী যে কন, গানের রাজা ঘাডু। এই পরী, খুব যুইত কৈর‌্যা একখান ঘাডু ধরছা।

পরী তার লম্বা চুলে ঝাঁকি দিয়ে শরীরে মেয়েলী বাহার তুলতে তুলতে বলে, — বাশশা অইলে সুবিধা অইত।

নবী শেখ পকেট থেকে তামার খিলাল বের করে দাঁত খিলায়। সুপারির কণা কুটকুট করে ভাঙতে ভাঙতে বলে, — বাশশা কই?

মানু মিয়া উসখুস করে, ভারী শরীরটায় মোচড় তুলে অহাকালুকে ডাক দেয়, — এই একব্যাটারি, বাশশারে একটা ডাক দ্যাছা।
কিন্তু বাশশাকে ডাকতে হয় না। তার ভরাট কণ্ঠে একটা গান ধরে সে এদিকেই আসছে —

আজি কী স্বপন দেখিলাম সই গো, যামিনী ভোরে
ডাকে প্রাণনাথে ধরে হাতে,
আমার নিদ্রা গেল দূরে সই গো, যামিনী ভোরে।

ঘুমের ঘোরে ছিলাম গো সখি, স্বপনে বন্ধুরে দেখি,
জাগিয়া না পাইলাম গো তারে…

বিকালের বাতাসে কেঁপে উঠা ঝিঙে-ফুলের মতো পরীর মনটা নেচে উঠছে। সে আমোদভরা গলায় বলে, — ওই যে বাশশা আইতাছে।

কাদু-কালুরাও ক্ষেত থেকে উঠে আসে। সুলা দেওয়া শেষ। অহাকালু কোমরের নতুন গামছাখানা খুলে বসন্তের দাগে ভরা খাউদা খাউদা মুখ মোছে। নষ্ট চোখের গর্তটা এখন রোদ-গরমে পচা ঘায়ের মতো দগদগ করছে। দেখতে লাগছে মানিকহার’র কিচ্ছার সেই রাক্ষসটার মতো। চিমসে পেটটা পিঠের সাথে লেগে আছে। কতকাল যেন ঠিক মতো দানাপানি পায় না। মোটা মোটা হাড়ের লম্বা খাঁচাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার আজন্ম উপোস পেটের খিদা, ঠা ঠা রোদে-পোড়া ক্লান্তি কোনোকিছুই অহাকালুর বিকট মুখাবয়বে তিল পরিমাণ ছায়া ফেলতে পারে না। সে সবসময় একটা ঘোরে থাকে। তার ভাঙা ঘরটা ঠিক করেছে। বিয়ে কারার জন্য পাঁচটাকা সাড়ে-আটআনা দিয়ে ভাগলপুরী লুঙ্গিটা কিনেছে। কলুপাড়ায় সুদে লাগিয়েছে সাতকুড়ি টাকা। এতসব উদ্যোগ-আয়োজনের পেছনে কত মেহনত, কত কষ্ট আর স্বপ্ন। তাই এইসব জিনিস তার দুঃক্কী মনটাকে সবসময় খোঁচায়। বাড়িতে গিয়ে উঠানে পা দিতেই বুকটা হাউত করে জ্বলে ওঠে। মাটির দেওয়ালের উপর নতুন ছনে ছাওয়া তার ছোট্ট ঘরটা অন্ধকার। বাতি দিবার মানুষ নাই। তার একটা চোখ নষ্ট বলে গ্রামের মানুষ তাকে একব্যাটারি ডাকে। বসন্তের দাগে ভরা খাউদা খাউদা মুখটার দিকে বুড়িরাও একবারের বেশি তাকায় না। তাই তার নসিবে বউ জোটে না। অথচ তামাম দুনিয়ার মানুষ জানে : ‘বাড়ির শোভা বাগবাগিচা, ঘরের শোভা নারী।’
অহাকালু এইসব ভাবতে ভাবতে ফস করে কাঠিতে আওয়াজ তুলে বিড়ি ধরায়। একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, — গৌড় অভিযান সমাপ্ত হয়েছে আলামপনা, কাশিদ আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনায় অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

রাজারূপী কাদু গামছায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতেই তৈরি হয়ে নেয়, — হে বিশ্বস্ত অনুচর, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। এই দ্বিপ্রহরের অগ্নিঝরা রোদে তুমি অশ্ব ছুটিয়ে শত মাইল পেরিয়ে এসেছ সুসংবাদ দিতে। সর্বাগ্রে তোমার জলপান ও বিশ্রাম আবশ্যক। তোমার জন্য আনারের রসের মতো সুমিষ্ট জল চাই। কোথায় গেল বাঁদি? বাঁদি…
— বাঁদি অন্তপুরে, এখন আপনার চরণদাসী বিলক্ষণ হাজির। এই নিন আনারের রসের মতো সুমিষ্ট-শীতল জল। আর একবার চেয়ে দেখুন মহারাজ, বিজয়ের উল্লাসে চেমননগর আজ উৎসবে মাতোয়ারা। ঘ্রাণ নিয়ে দেখুন, আকাশে-বাতাসে আজ শুধু পোলাও-কোরমার খুশবু।

সবাই তাকিয়ে দেখে মাগীকুদ্দু হাজির। মেয়েদের মতো কাঁখে জলভরা কলসি। ক্ষারে-ধোয়া গামছাখানা আড়াআড়ি করে বুকে ফেলা। হররোজ কামানো দাড়ি-গোঁফহীন মুখাবয়বে কুচুটে রমণীর মতো উদ্ধত ফণা। স্বাদেভরা নানান পদের রান্না শেষ করে, খেলাকে সাথে নিয়ে তড়লড় ভঙ্গিতে সে ছুটে এসেছে। মেলা আগে সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে। কাদু-কালুদের পেছনে নদীপারের ঘন বাঁশবনের ছায়া এসে আমগাছের ছায়ার সাথে মিলে হয়ে উঠেছে গভীর। সেই শীতল বাও-বাতাসে চিরন্তনী বাংলার সোঁদা গন্ধ, মায়ের মমতামাখা আদর।

কাদু এক গ্লাস পানি খেয়ে দাঁড়াতেই নবী শেখ তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয়, — তাবাদে ক্যামুন আছ রাজা?
কাদু একটু আচান্নক হয়। নবী শেখ কেউকেটা কেউ না। তাদের মতোই সামান্য একজন। তার ত কয়েক কাঠা জমি আছে, নবী শেখের তা-ও নাই। সম্বল শুধু নাওটা। কিন্তু হলে কী হবে, লোকটা খুব কারিন্দা। মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জানে। বুকভরা সাহস আর বুদ্ধি। দরদ-দুস্তিতে তুলনা নাই। নাও নিয়ে লম্বা লম্বা ক্ষেপ দেয়। মাঝেমধ্যে গলা তক তাড়ি খায়। তখন নাওয়ের ছৈয়ায় ঝিম ধরে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। খরচপাতি বাদে যা থাকে তাতে টেনেটুনে তার সংসারটা চলে যায়। তাদের মতো দীন-দুঃক্কীদের সাথে যেমন খাতির রাখে, তেমনি বড় বড় মানুষগুলার সাথেও চলন-বলনে নবী শেখ সচ্ছন্দ। সেই নবী শেখ তাকে পছন্দ করে। এই পছন্দ দানববাড়ির কামলা কাদুকে নয়, অবশ্যই মঞ্চের রাজা কাদুকে। তার মনে পড়ে : তিন বছর আগের চৈতমাসের কথা। ভাতের কষ্টে তার গোষ্ঠীটা তখন মরে মরে। বড় মেয়েটার একটা ছাগল ছিল তাই নিয়ে সে গয়েশপুর বাজারে রওনা দেয়। অভাবে দেশ-গাঁ জ্বলছে। মানুষের মুখের দিকে তাকানো যায় না। গরু-ছাগলের বাজার পানি। পথে রায়বাড়ির বড়কর্তার সাথে দেখা। কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসে কর্তা সিগারেট টানছে। তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে হাসি ফোটে, — কাদু মিয়া কেমন আছ?
— জে কর্তা, আফনেগো আশিব্বাদে…।
কাদু থেমে যায়। চোখদুইটা ছলছল করে ওঠে। বড়কর্তার মতো মানুষ তাকে হুজ-জিজ্ঞেস করছে! মানুষটা টুকটাক করে তাদের দলের খবর জেনে নিয়ে হঠাৎ বলে, — ছাগলটা কি বিক্রি করবা?
— জে কর্তা, বড় অনটন চলতাছে।
— কত দাম চাও?
কাদু আমতা আমতা করে, — কত আর অইব, না-হয় বিশ-পঁচিশ ট্যাহা।
বড়কর্তা ত্রিশটাকায় ছাগলটা কিনে লয়। তা-ও কত আলাপ, — তোমরা হলে শিল্পী মানুষ, সংসারের সব খবর রাখ না। এই বাজারে বিশটাকায় ছাগল আছে?

পরে কাদু তালাশ করে দেখেছে। বাজারে ছাগলটা বিশটাকার উপরে উঠবে না। আসলে বড়কর্তা ইচ্ছা করেই ঠকেছেন। তার জীবনে আরও এ-রকম অনেক ঘটনা আছে। একবার প্রসাদপুর বাজারের অন্ধকার গলির মাঝে এক ছাত্রের সাথে দেখা। ছেলেটা মাগরিবের আযানের পর থেকেই তার পিছন পিছন ঘুরছিল। আড়ে আড়ে দেখে কিন্তু কিছুই বলে না। কাদু তো ভয়ে শেষ। এখন ছাত্রদের ডরে প্রেসিডেন ইয়াহিয়া খানের হাগা-মুতা সবসময় পাতলা থাকে আর সে ত এক কামলা মানুষ। একটু পরে কুতুব হাজীর দোকানের সামনে যেতেই ছেলেটা বলে, — আপনার অভিনয় আমার খুব ভালো লাগে। আপনি সিনেমার রাজার মতো ডায়ালগ দিতে পারেন। আপনার মতো শিল্পী আমি জীবনে দেখিনি। একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।

রাজপুত্রের মতো ছিপছিপে ছেলেটা একটু পরেই একপ্যাকেট রমনা সিগারেট এনে হাতে দিয়ে বলে, — কতদিন আপনার অভিনয় দেখে মনে মনে ভেবেছি, আপনাকে একটা উপহার দেবো। এখানে তো কিচ্ছু পাওয়া যায় না। এই সিগারেটের…
ভিড়ের ধক্কায় ছেলেটা সরে যায়।

— এই কাদু আরেকটা সিগেরেট নেও।

নবী শেখের ডাকে কাদুর চমক ভাঙে। চেয়ে দেখে সবাই গোল হয়ে বসে আসর জমিয়েছে। পরী আর বাশশা মজলিসের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত। আঙ্কুর হারমোনিতে সুর বাঁধছে। বাশশা পরীর দিকে পিরিতির ভঙ্গিতে হাত তুলে গানে টান দিচ্ছে —

সন্ধ্যাকালে জলকে যেও
সুন্দরী গো, কলসি ভরে দিব।
জল ভর সুন্দরী গো জলে দিছে ঢেউ
আঁখি তুলে কও না কথা, সঙ্গে নাই মোর কেউ।

পরীর চোখে-মুখে লজ্জার আভাস, শরীরের লকলকে গড়নে উপচানো প্রেমের ঢেউ। পা-দুইটা ময়ূরীর মতো হালকা নাচে ঘন ঘন মুদ্রা বদল করছে। সে শরীরে ঢেউ তুলে বাশশার কথার জবাবে দেয় —

তুমি যে ভিন্ন পুরুষ, আমি ভিন্ন নারী।
কেমনে কহিতাম কথা, লজ্জায় যে মরি।

বাশশা যেন সত্যি সত্যিই প্রেমকাতর রাখাল। সে সাহস আর বিনয়ে, চাতকের মতো আকুল পরানে কন্যাকে জিজ্ঞাসে —

কোথায় তোমার পিতামাতা, কোথায় তোমার ঘর।
পরিচয় কহ লো কন্যা, মাগি যে উত্তর।

এই প্রশ্নের উত্তরে পরীর চকচকে কালো চোখদুইটা কষ্টে মলিন হয়ে আসে, নাচের ভঙ্গিও হয়ে ওঠে করুণ। সে রোদনভরা সুরে প্রেমিকের জিজ্ঞাসার জবাবে বয়ান করে —

নাহি আমার পিতামাতা, নাহি আমার ভাই।
সোঁতের শ্যাওলা হয়ে আমি ভেসে বেড়াই।

বাশশার চোখে-মুখে সাহসের আভাস, হাতের মুদ্রায় জিজ্ঞাসার ভঙ্গি —

পরমা সুন্দরী কন্যা, প্রথমা যৌবন।
যে-জনে দিয়েছ মালা, সে-জন কেমন।

হতাশায় পরীর চোখ ছল ছল করে, রোদনের সুরে বুক যেন ভেঙে যাবে —

কি কব দুক্ষের কথা, কইতে ভয় বাসি।
এমন সময় বিয়া না হইল — যৌবন হল বাসি।

বাশশার গলায় তিরস্কারের ঝঙ্কার, চোখের তারায় গৌরবের ঝিলিক —

কঠিন তোমার পিতামাতা, কঠিন তোমার হিয়া।
এমন বয়সের কালে নাহি দিল বিয়া।
কঠিন আমার পিতামাতা, কঠিন আমার…

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
নৌকা মার্কা দিলে ভোট
ভবিষ্যতে হবে সুখ।
জ য় বাং লা।
পরী-বাদশা নাচ থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়। নবী শেখ বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে । কাদু-কালুরা বোবার মতো পুবদিকে তাকিয়ে থাকে। পালপাড়ার আড়াল থেকে বিশ-পঁচিশজন ছাত্রের ছোট্ট মিছিলটা বেরিয়ে আসছে। ওদের মাঝে বাঁশ-কাগজে বানানো একটা নৌকাও আছে। দুইজন ছাত্র সবার আগে আগে নৌকাটা উপরের দিকে উঁচু করে তুলে-ধরে ছুটছে। তাদের পেছন পেছন আসছে মিছিলটা। নবী শেখ পাটের চালান নিয়ে গেছিল ভাটিতে। নৌকা নিয়ে ফিরে আসতে আসতে গত কয়দিন হাটে-বাজারে-গঞ্জে মোকামে-মোকামে দেখে এসেছে নৌকা মার্কার মিটিং-মিছিল। উপস্থিত সবার চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে ছেলেগুলা প্রসাদপুর বাজারের দিকে চলে যায়। সেখানে আজ হাটবার। চারপাশের গ্রামগুলা থেকে যে দীনদুঃক্কী কামলা-কিষাণরা আসবে সেইসব আনপড়-অবুঝ মানুষগুলার কাছে, বাজারের ভিড়ে টুলের উপর দাঁড়িয়ে তারা নৌকার জন্য ভোট চাইবে। তাবাদে ফিরে আসার আগে আরো কয়বার মিছিল নিয়ে বাজারটা ঘুরে ঘুরে গলা ফাটিয়ে জানিয়ে দিবে —
নৌকা মার্কায় দিলে ভোট
ভবিষ্যতে হবে সুখ।

গত কিছুদিন ধরে তারা বাজারে বাজারে এইসব দেখছে। কাদু-কালুরা অতশত বোঝে না। তবে এইবারের ইলেকশনটা যে আগের ইলেকশনগুলার মতো না এতদিনে তারা এইটুকু বুঝতে পারছে। ছাত্রদের গেয়ে-যাওয়া ‘নৌকা মার্কায় দিলে ভোট, ভবিষ্যতে হবে সুখ।’ — এই সিলকিটা তাই কাদু-কালুদের পরানেও নানান কথার ঢেউ তুলছে। কিন্তু দলের কর্তার মতি নৌকার বিপক্ষে তাই আপাতত মনের আফুডাফুকে তারা সকলেই চেপে রাখে।  এইযেন্ সময়মতো মনের কথা বলতে না-পারার দুঃক্কু, দানবকালুর বিচারে এইটাই হলো গিয়ে আসল দুঃক্কু। এই বেদন যে বুঝেও বুঝে না তার মতো হতভাগা আর কে আছে এই সংসারে! মানুষ চিরকাল বাঁচে না। কিন্তু তার কথা বাঁচে। মানু মিয়ার জন্য আস্তা দলটার সবগুলা মানুষ মাঝেমাঝে দমফোট অবস্থার মধ্যে পড়ে। তখন তারা না পারে সইতে না পারে কৈতে। পরান-জোড়ানো কথাটা জায়গামতো বলতে না পারার কষ্টটা দিনে দিনে বুঝি তাদের বিধি হয়ে গেছে। সেই বিবেচনায় মানু মিয়া কাদু-কালুদের জন্য একটা আপদ। এই মুহূর্তে সে কতকগুলা মানুষের জবান চেপে ধরে রেখেছে। মাঝেমাঝে দানবকালুর ইচ্ছা করে এই জুলুমবাজ মানুষটাকে একটা লাথি মেরে বিষুরির থলিতে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তার বিশ্বাস, যে শক্তি ও সাহসের দিক থেকে হীনবল, নাদান সে-ই শুধু প্রতিপক্ষের গায়ে হাত তোলে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you