চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১২ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১২ || শেখ লুৎফর

দরদি নাই দেশে
অহাকালু এত খেয়েছে যে দাঁড়াতে পারছে না। প্রচুর খাওয়ার আজাবে সে দরদর করে ঘামছে। বসন্তের খাউদ্যা খাউদ্যা দাগে ভরা মুখটা জবজবা ভেজা। একমাত্র ভালো চোখটা কোটর থেকে বুঝি ছিটকে বেরিয়ে আসবে। বারান্দার যেখানে বসে সে খেয়েছিল তার পাশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে হাত-পা ছেড়ে লাচার হয়ে বসে আছে। খাওয়ার পর দলের সবাই পান-বিড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। গলা পর্যন্ত ঠেঁসে খাওয়ার ধকলে মালেক আর ঘোড়ামোবারক রীতিমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মালেক অহাকালুর নষ্ট চোখটার দিকে করুণ নজরে তাকিয়ে থাকে। কালো পুতলিটা নাই। ছোট একটা গর্ত। লাল গর্তটার মধ্যে একবিন্দু হলুদ কেতুর। পাশেই ঘোড়ামোবারক। তার চেহারা-গতর অসুখী মানুষের মতো থমথমে। সে-ও বেশুমার ঘামছে। তাজিঘোড়ার মতো ঘোড়ামোবারকের বলিষ্ট দেহটা এখন টালমাটাল। তাই দেখে অহাকালু মনে মনে একটু সান্ত্বনা পায়। ঘোড়ামোবারক বিড়িতে ঘন ঘন দম দিচ্ছে। একটাকিছুতে মগ্ন থেকে সে বেশি খাওয়ার আজাবটা ভুলে থাকতে চাইছে।

নবী শেখ নতুন পাতিলের মতো চনচনা। পরিমিত সুখাদ্যের তৃপ্তিতে সে এখন পান-জর্দার রঙিন সুখ। লোকটা স্বভাবমতো হৈ হৈ করে কথা বলছে। নিজের এহেন কষ্টের বিপরীতে মানুষটার আমোদ-আহ্লদ দেখে অহাকালুর রাগও হয় আক্ষেপও হয়। কেন যে সে এমন করে ! কী বুঝে যে এত খায়! কোনোদিন আর বেশি খাবে না; অন্তত শ’-খানেকবার এই কিরাটা সে জীবনে কেটেছে। কিন্তু সুযোগ এলে সে-কথা কী আর মনে থাকে? তখন ঘাড়ের পিছে বসে কে যেন তাকে খালি উসকায়, — ‘যত পারস খা … খাওয়ার মতন সুখ পিত্থিমিত নাই।’

দলের কাউকে যে হাতে একটা ইশারা দিবে সেই শক্তিও অহাকালুর নাই। লোকটার বেগতি দেখে দানবকালু কাছে আসে। বিনা বাক্যে একটা বিড়ি ধরিয়ে অহাকালুর দিকে এগিয়ে দেয়, — বিড়িডা খা, তে ঠিক অইয়া যাইব।

অহাকালু আগের মতোই অসার। ভালো চোখটা আপনা থেকেই বারবার বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু সে জোর করে চোখ মেলে আধ-পাগলার মতো বিড়বিড় করে কথা বলছে, — মুরগির গোস্তুডা, মাছের মাথা দ্যায়া মুগের ডাইলডা অত মজা হইছিন যে, মনে কইছিন আরও খাই।

দানবকালু নিবিড় মনে বিড়ি টানছিল। সে কিছুটা উদাস। ছোট ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। ঘরে ভাতের টান পড়লে সবাই চুপচাপ থাকলেও ছেলেটা খালি ভাত দ্যাও, ভাত দ্যাও কৈয়া ঘ্যানঘ্যানায়।

অহাকালুর জ্বরের প্যাঁচালে তার দপ করে রাগ ওঠে। একটা লাথি মারতে ইচ্ছা করে। তাবাদে সে একটুও রাগ না দেখিয়ে অহাকালুকে বলে, অহন এই আলাপ বাদ্দে।

অহাকালু দানবকালুর কথায় বিরক্ত হয়। সব আজাব ভুলে সে ফিসফিস করে বলে, — কী কও, কাডলের বিচি দ্যায়া মুরগির গোস্তুডা…।

গাঙপাড়ের জংলা থেকে আসতে-থাকা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দানবকালু হাসে, — জীবনের খাওয়া ত একদিনেই খাইয়া দিছস। তে আর প্যাঁচাল পারছ্ ক্যা?

মাগীকুদ্দু পাশেই ছিল। সে নিপুণ হাতে থালাবাসন, এঁটোকাঁটা সরিয়ে নিচ্ছে। সবকিছু গুছিয়ে রেখে, বাড়িটা ঝাড়ু দিয়ে সাফ-শুতু করে তবে-না তার ছুটি। অহাকালুর কথা শুনে সে চ্যারত করে থুতু ফেলে মুখঝামটা দেয়, — আহঃ মরি। খাওয়া খাওয়া কইরাই তর জীবনডা গ্যাল। কথায় আছে-না, ‘নসীবের কিল বাপে কিলায়।’ তর হইছে হেই দশা। মাইনশে খায় বাঁচতে আর তুই খাছ মরতে।

অতিথ-মেহমানদের বিদায় করে খেলা এদিকেই আসছিল। মাগীকুদ্দুর বচন শুনে সে থমকে দাঁড়ায়। দানবকালু খেলাকে দেখে তার বিরাট মাথাটা দুলিয়ে চোখ ঠারে। খেলা এক-লহমায় আসল জিনিস সমঝে ফেলে। সে একটুও না-হেসে দৌড়ে এসে অহাকালুর দুই বাজুতে ধরে, — ল ল, ঘরে ল। বিছনায় লাম্বা অইয়া একটু পৈর‌্যা থাকলেই ঠিক অইয়া যাইব।

মাগীকুদ্দু এখন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। খেলার এই কথায় তার ঝাড়ু দেওয়ার গতি আরও বেড়ে গেছে, চোখে-মুখে তুফানের আভাস। সে হুঁ বলে মুখঝামটার সাথে ছোট করে পাছাও নাড়ায়।

অহাকালুকে ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ানো হয়। তার বসন্তের দাগে ভরা খাউদ্যা খাউদ্যা গালে, কপালে ঘামের সোঁত। খেলা পরীর হাতে একটা পাখা ধরিয়ে দেয়, — জোরছে বাতাস কর।

একটু পরেই মাগীকুদ্দু ভগর ভগর করতে করতে ঘরে এসে ঢুকে। হাতে একটা বড়সড় চামচ। সে সোজা অহাকালুর শিথানে এসে দাঁড়ায়, — ভালা ভালা খাওন দ্যাখলে ত আর হুঁশ থাহে না। নে, অহন আক্কর।

অহাকালুর চোখদুইটা সন্দেহ আর ভয়ে বন্ধ হয়ে আসে। সে মাগীকুদ্দুকে একটুও বিশ্বাস করে না। ঘাটুদলে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই ওর সাথে তার বনাবনি কম। তাবাদে এখন দেশে ইরি ধানের চাষ চালুর জন্য বিদেশি ধানের বীজ-সারের সাথে বিস্তর বিষ-বাসুডিনও এসেছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। মাগীকুদ্দু বললেই বুঝি সে এখন মুখ খুলবে ?

কিছু গিলতে অমত অহাকালুকে মাগীকুদ্দু একটা ঝামটা লাগায়, — দ্যাহনি খবিশটা মুখ ভ্যাটকায়া রইছে। এই অহা আক্কর। এইডা বিষ না।

তবু অহাকালু মুখ খুলছে না দেখে তার হাসি পায়। সে বুকের গামছাটা নিজের মুখে ধরে হাসি চাপতে চাপতে বলে, — আদার রসে কালা নুন মিশায়া আনছি। খাইলে বিশ মিনিটের মাইধ্যে আরাম অইয়া যাইব।

এই কথায় কাজ হয়। অহাকালু তার গলাখানা বকের মতো এগিয়ে দিয়ে বিশাল একটা হা মেলে ধরে। মাগীকুদ্দু খুশিমনে চামচের সবটুকু রস অহাকালুর সেই অতল গহ্বরে ঢেলে দেয়। তাবাদে নিজের ফকফহা পরিষ্কার গামছাখানা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলে, — মরবে তে মর কিন্তুক আরেক ব্যাডার বাড়িত ক্যা?

মাগীকুদ্দু অহাকালুর শিথানের কাছে বসে একটা বিড়ি ধরায়। অহাকালুর অবস্থা আড়চোখে পরখ করে। ছ্যাদড় প্রকৃতির মানুষ তার একদম অপছন্দ। সেজন্য অহাকালুর সাথে তার মন মিলে না। কথায় কথায় টক্কর লাগে, আবার মায়াও হয়। মানুষটা বেবুঝ। সুযোগ পেলেই জনমের খাউন একদিনে খেয়ে ফেলতে চায়! টাকাপয়সা বাবদ অহাকালুর আক্কল-পছন্দ কাঁসা-পিতলের মতো টনটনা। নজরখানা কাক-চিলের মতো। কার্তিক-অঘ্রানে ফজরের সময় হিন্দুদের সুপারি বাগে বাগে চরাট করে। ঝরেপড়া পাকা সুপারি চোরের মতো কুড়িয়ে আনে। সুযোগ পেলে চুরিও করে। সারা মৌসুমের সে-মজুদ ফেলনা না। শুকিয়ে, সাফ-শুতু করে আঙ্কুরের দোকানে বেচলে প্রায় এককুড়ি টাকা নগদ মিলে। কয়েক বছরের গুপ্ত-সঞ্চয় দিয়ে গতবছর ভাঙা ঘরখানা অহাকালু টনটনা করে মেরামত করেছে। পাঁচ টাকা সাড়ে আট আনা দিয়ে কিনেছে একখানা ভাগলপুরী লুঙ্গি। এতসব আয়োজনের পেছনে অহাকালুর বিয়ের ইচ্ছাটাই প্রধান।

প্রায়ই মাঝরাতে অহাকালুর ভরাট ঘুম ভেঙে যায়। তখন দেখে তার নিচের শরীরটা লোহা হয়ে আছে। একটা বেটিমানুষের অভাব তার রগে রগে কহরের চাবুক মারছে। তার বুড়ি মা বলেছে, আসছে আঘুন মাসে তার বয়স তিরিশ হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের একখান বউ হলো না! এই কথা মনে হলে আহাকালুর তালু দিয়ে ভমভম করে আগুন ছোটে। এই ত আষাঢ় মাসে কলুবাড়ির জালু কলু বিয়ে করল। বিয়ের তিনদিন আগেই জালু কলু একশিশি সরিষার তেল নিয়ে অহাকালুর বাড়িতে এসে লম্বা হয়ে পড়ে, — ভাই কালু , এই নেও। এক্কেবারে খাডি জিনিস। গরম গরম ভাতের লগে মরিচ পোড়া দ্যায়া খাইতে আমিত্তির মতন লাগব।

অহাকালু গলাখানা বকের মতো লম্বা করে জালু কলুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কলুর পুতের মনের কথা আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। পারে না। লোকে বলে, কলুদের বুদ্ধি নাকি সাত চোঙ্গা। কোন মতলবে সেই কলুদেরই একজন এখন তার সামনে ঘিয়ের মতো গলতেছে!

অহাকালু ডায়ালগের সুরে জালু কলুর কাছে জানতে চায়, — মতলব কী?
জালু কলু মাথা নাড়ে, — কিচ্ছু না।
আছে, নিরিচ্চয়ই আছে, এম্নি এম্নি কী আইছ মোর কাছে?

জালু কলু অহাকালুর দুই হাত চেপে ধরে :
শুক্কুরবারে বিয়া।

পরানের ভাই,
তোমার ভাগলপুরী লুঙ্গিখানা চাই।

অহাকালুর বুকের মাঝে সমুদ্দুরের হাহাকার :

বিয়া! বিয়া!
কতকাল শুকায়া আছে আমার হিয়া!
ক্যান মোর শুকনা নাড়ার বনে আগুন জ্বালাও?
পালাও পালাও সম্মুখ থিকা পালাও।

জালু কলু কাতরে উঠে :

আড়াই ট্যাহার হাতিমার্কা লুঙ্গি পইর‌্যা কেমনে বিয়া করতে যাই।
গেরামের ইজ্জতটা ক্যামনে আমি ভিনগেরামের ধুলায় মিশাই?

অহাকালুর চোখ দুইটা চকচক করে। আর মাত্র তিনদিন পরে জালু কলুর ঘরে বউ হয়ে কাঁচা গতরের একটা মেয়েলোক এসে কলুর বিছানায় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে। অহাকালু জালু কলুর ছনের ভাঙা ডেরাটা যেন দিব্যি চোখে দেখতে পায়। কলুপাড়ায় আলো নাই বাতাস নাই। গু-মুতের গন্ধে সবসময় বাতাস ভারী আর টক টক লাগে। ঠাঁসাঠাঁসি ঘরের ফাঁক দিয়ে চিকন আর আঁকাবাঁকা গলি। গলিতে পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে। সারাদিন কালো কুতকুতা গতরের এ্যাবাঢ্যাবা পোলাপানগুলা বসে বসে অবাধে হাগে। হাগুটা কেউ ফেলে দেয়, কেউ দেয় না। রাতে বাজারফেরতা কলুরা কেউ গুয়ে পাড়া মারলে গলা ফাটিয়ে গালি দেয়, — কোন চুতমারানি গু ফালছে না?

তিন-চার হাত উঁচু মাটির দেওয়ালের উপর তালপাতার ছানি দেওয়া কৈতরের খাঁচার মতো ছোট ছোট ঘরের সাথে অসংখ্য ঘর। মাঝে মাঝে এক-দেড় হাত চওড়া গলি। গলি থেকে জাহান্নামে যাওয়ার সুড়ঙ্গের মতো মাথা নুয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। আটহাত বাই ছয়হাত ঘরে কোনো জানালা নাই। পুবের দেওয়ালের সাথে তিনটা তক্তা আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো চাঙের উপর জালু কলু বউ নিয়ে বাসর করবে?

অহাকালু জালু কুলুর দিকে তাকায় : বোঁচা নাকের ওপর মোটা গোঁফ, হলুদ ময়লাপড়া দাঁতগুলার কোনো ছিরি নাই। বুক-পেট-পিঠের পেশীগুলা টানটান। এই মোটা আর পাত্থরের লাহান শক্ত দাবনা আর উরুর দিকে চোখ পড়তেই অহাকালু নরম হয়ে আসে। তাবাদে জালু কলু সপ্তাহে ছয়দিন বাজারে বাজারে শাপলাপাতা বেচে। আর বুধবার দিন খুব ভোরে দশ মাইল দূরের বর্মী বাজারের দিকে দৌড়ায়। সেখানে বড় বড় মহাজনের আড়তে সে কুলিগিরি করে। সারাদিন দুইমন ওজনের একেকটা বস্তা মাথায় নিয়ে নদীর ঘাটে নামতে হয় কিংবা নদীরপার ভেঙে আড়তে তুলতে হয়। একটা বস্তা টানার মজুরি এক আনা।

এবার অহাকালুর গলায় যেন বিদ্রুপের সুর :

গেরামের ইজ্জতে আমার কী আসে-যায়?
আমার দুঃখের কথা কেউ কী শুনিবার চায়?

জালু কলুর চোখে অন্ধকার। তাই সে আবার মিনতিতে ভেঙে পড়ে :

তোমার মনে কী দয়া নাই?
শেষ কথা শুনিবার চাই।

অহাকালুর ভালো চোখটা দিয়ে টপটপ করে দুইফোঁটা পানি ঝরে পড়ে :

আজ চৌদ্দ বছর করিতে চাই বিয়া,
আমারে কেউ কী করিয়াছে দয়া?

এইকথা বলে অহাকালু নিরাই হয়। সে জানে, সাধে-অসাধে লুঙ্গি তাকে দিতেই হবে। না দিলে গ্রামের মানুষের কাছে এই জিনিস একটা রেকর্ড হয়ে যাবে। এক গ্রামে এই রকম লুঙ্গি থাকে দুই-চারজনের কিন্তু সেই দুই-চারটা লুঙ্গি দিয়ে বিয়ে করে আস্তা গ্রামের সব বরেরা। গ্রামের এই অলিখিত বিধি মহাশত্রুও রদ করে না।

অহাকালুর নীরবতা দীর্ঘ হয়। গোপনে গোপনে তার হৃদয়টা পুড়ে অঙ্গার হয়। লুঙ্গিটার আশায় জালু কলুর গোল গোল চোখ দুইটা চিকচিক করছে। এই দেখে অহাকালুরও ইচ্ছা করছে খাবলা দিয়ে জালু কলুর একটা চোখ উপড়ে এনে, নিজের নষ্ট চোখের ভয়ঙ্কর গর্তটা ভরাট করে ফেলে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you