হায় পিরিতি
অঘ্রানি ধানকাটা শুরু হয়েছে। কিষাণ-কামলা, ছেলে-বুড়া সবাই ব্যস্ত। এর মাঝেই জয়ধরখালী বাজারে নৌকা মার্কার মিটিং। কাদু-কালুরা অতশত খবর রাখে না। সেদিন দুপুরে উবেদ শেখের ক্ষেতে তারা ধান কাটায় মগ্ন। তরতাজা সব ছাত্ররা দল বেঁধে ধানক্ষেতে নেমে আসে। সবার সাথে হাত মিলায়। দানবকালু যা ফাঁপড়ে পড়ে, কৈ রাখে হাতের কাঁচি আর কী বা করে ধুলামাটির! তাবাদে একজন কথা বলে, বঙ্গবন্ধুর সাথের বড় বড় নেতারা মিটিঙে আসবে। — বুঝলে কাদু ভাই, নৌকা মার্কার মিটিং। আপনাদের সবাইকে মিটিঙে যেতে হবে।
দলের মাঝে এই নিয়ে দুই-একবার আলাপও হয়েছে। অবশ্য সেটা মানু মিয়ার আড়ালে। শেখ মুজিবের প্রতি মানু মিয়ার রুষ্ঠ ভাবটা দলের কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা গিরস্তের বাড়িতে, কামে-কাজের ফাঁকে ফাঁকে মানু মিয়ার অনুপস্থিতে এই আলাপটা নিয়ে নিজেদের বুঝমতো আলোচনা করে ঠিক করেছে মিটিঙে যাবে। ছাত্ররা যত কথাই বলুক কাদু-কালুরা জানে, সন্ধ্যার আগে মিটিং জমবে না। মানুষের পেট-পিঠ আছে। অধিকাংশই দীনদুক্কী চাষা, কামলা। তারা না গেলে বাজারই ঠিকমতো জমে না, মিটিং জমবে কীভাবে? অবশ্য গফরগাঁওয়ের বড় বড় ছাত্রনেতারা বলে গেছে, মিটিং শুরু হবে আছরের পরে। কিন্তু নবী শেখ তাদেরকে গত মঙ্গলবার বলে গেছে, — সত্যিকারের মিটিং অইব হাইঞ্জার পরে। তহন রফিক ভূঁইয়া ভাষণ দিব। তোমরা কেউই বাকি থাইক্য না।
মানু মিয়ার উপস্থিতিতে নৌকা মার্কার আলাপ উঠলে শুধু মাগীকুদ্দু টুঁ শব্দটা করে না। এই বিষয়ে সে মেয়েলোকের মতো ছলচাতুরি করে, চাল খাটায় কুটিল বুড়িদের মতো। কিন্তু আজকাল খেলা কিংবা কাদু-কালুরা কথাবার্তায় মানুর সামনেই নৌকা মার্কার পক্ষে মত দিয়ে ফেলে। মাগীকুদ্দুর হিসাবটা অন্যখানে। তার কথা হলো, — ভোটের সময় তো আর মানু সামনে থাকবে না। কাজেই আগেভাগে খামাখা কর্তারে চেতায়া কাম কী?
মানু মিয়া মনে মনে ক্ষ্যাপা কিন্তু বড়লোকি চালে লোকটা মুখে কিচ্ছু কয় না। আর যখন এই নিয়ে আলাপটা জমে ওঠে তখন মাগীকুদ্দু খালি চতুরা মেয়েলোকের মতো পিছলায়া পিছলায়া আলাপ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়।
কলেজের ছেলেগুলা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিরস্ত, কামলা আর তিড়িংবিড়িং করা চ্যাংড়াদেরকে ডেকে হাতে হাত মিলিয়ে বলে গেছে মিটিঙে যাবার জন্য। তাই গেরামের সব মানুষ আগেভাগে কাম শেষ করে আছরের আজান পড়তেই বাজারের পথ ধরে। ছোট ছোট বিচ্ছু পোলারাও বাদ থাকে না। তারা ছাত্রদের দেখাদেখি কলাগাছের খোসা দিয়ে নাও বানিয়ে, বাজারের পথে নেমে ছাত্রদের মতো হাতের মুঠি উঁচিয়ে আওয়াজ তুলছে :
নৌকা মার্কায় দিলে ভোট
ভবিষ্যতে অইব সুখ।
আঙ্কুর নিরালা দোকানটাতে মনখারাপ করে বসে আছে। আজ তার মতো দুক্কী কে? পা দুখানা যদি একটু চলবার মতো হতো তবে সে সবার আগেই মিটিঙে রওনা দিত। তাবাদে আঙ্কুর মনে মনে পণ করে, এবার থেকে সে দেশের মানুষের মনের কথা গানে বাঁধবে। মিটিং-মিছিলে নিজের শারীরিক উপস্থিতির বদলে গানের সুরে সুরে দেশমাতার কথা বলবে। তার লেখা বিচ্ছেদের সুরে যদি গৈ-গেরামের হাজার হাজার মুরুক্ষু-সুরুক্ষুদের দু-চোখ পানিতে ভিজে ওঠে, তবে কেন বাংলা মায়ের দুর্দশার কথা বুঝবে না?
মাগরিবের আজানের একটু আগে রসুন আঙ্কুরের দোকানে এসে দাঁড়ায়, — একপোয়া লবণ দে।
রসুনকে দেখে আঙ্কুর এখনো ধাতে আসতে পারছে না। তার কেমন আচান্নক আচান্নক লাগছে। মিটিঙের জোয়ারে গ্রামটা উজাড়। গপসপ করতে করতে ছোট-বড় সব বাজারে গিয়েছে। যেন ঈদের মতন উৎসব। রাত আটটা-নয়টার আগে কেউই আজ বাজার থেকে ফিরবে বলে মনে কয় না। মানুষ ত দূরে থাক চারপাশে একটা ফড়িংও নাই। এমন টাইমে রসুন এসেছে লবণ নিতে! আঙ্কুর পেবার মতো তোতলাতে তোতলাতে লবণ মাপে। রসুন তখন স্বনজরে আঙ্কুরকে জরিপ করে। তার একটা সন্তানের দরকার। গত তিন বছর মনের সাথে লড়াই করে সে থির করেছে, যেমতে হউক, তার একটা পুতের দরকার। স্বামী পাইয়াও পাইল না, হয়তো কপালে নাই। কিন্তু পুতের মা হতে পারবে না? অসম্ভব। সে একশভাগ নিশ্চিত, বুড়া খৈল্লাকলুকে দিয়ে এই জিনিস হাসিল হবে না। অবশ্য বুড়া রসুনকেই দোষে, তুই চুতমারানি বাঞ্জা। তর কপালে ঝি-পুত নাই।
এইসব ভাবনার মাঝেই আঙ্কুরের নিচের জমিনে রসুনের চোখ পড়ে। এইসব ব্যাপারে আঙ্কুর খুব উলুঝুলু। সে পাল্লা হাতে নিলেই জলজলা পাতলা লুঙ্গিখানা আপনা থেকেই যেন একটু এদিক-সেদিক হয়ে যায়।
রসুন সব দেখেটেখে খুশি হয়। গ্রামের মুতের পোলারাও আঙ্কুরকে ‘ঘোড়া’ বলে ক্ষ্যাপায়। সেটা তার গতরের জন্য নয়। ঘোড়ার মতো তার গুপ্ত অঙ্গের জন্য। আর আবং মুরগাটাও গত কয় বছর ধরে তাকে উপাসির মতো নজরে গিলতেছে। তাই সে নিশ্চিত, টোপটা দিতেই আঙ্কুর গিলে ফেলবে। রসুন ইচ্ছা করলে পাড়ার অন্য কোনো বলিষ্ঠ পুরুষকেও নিতে পারে। কিন্তু তাতে ঝামেলা বিস্তর। সুস্থ মানুষ হলে লোকটা যখন-তখন তাকে কাছে পেতে চাইবে। আর ফল হবে হাতেনাতে ধরা পড়া। কিন্তু আঙ্কুরের বেলায় এই ডরের কোনো কারণ নাই। ল্যাংড়া-লোলা মানুষ চাইলেই তো আর সে যখন-তখন রসুনের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে পারবে না। এই দিক থেকে আঙ্কুরকে রসুন শতভাগ নিরাপদ ভাবে।
অনেক রাতের হিসাবনিকাশের ফলাফল সে মনে মনে নড়াচড়া করে তবে-না নিজেকে শুনিয়েছে, আঙ্কুর আণ্ডুল মানুষ। কোনোদিন জোঁকেও একফোঁটা রক্ত খাইছে না। যুদিন খালি আঙ্কুরের একটা ধাক্কা সে লইতে পারে তাহলেই ছেলের মা হয়ে যাবে। তখন তাকে কেউ বাঞ্জা বলে গালি দিতে পারবে না। জিন্দিগি কয়দিনের?
নুনের পোটলা হাতে নিতে নিতে রসুন ঠারে হাসে। সেই হাসি দেখেই আঙ্কুরের হার্টফেইল হওয়ার অবস্থা। তাই মনে মনে সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে :
গীতিকবি আঙ্কুর ভাই,
নারী কি জিনিস চিনো কী তাই?
আকাশে কত রঙ খেলে,
নারীর চোখে কী বাতি জ্বলে?
রসুন মনে মনে ভাবে :
ল্যাংড়াডা বুঝল কী বুঝল না ক্যাডা জানে?
পুরুষ মানুষ না হাওরের ডাকাইত,
ঠারঠুর বুঝে কী জ্ঞানে?
রসুন আরেকবার আঙ্কুরের দিকে তাকায়, — যাইস না কোনো দিকি। একটু পরে এক দরকারে আমি আইতাছি।
অবাক আঙ্কুরের হা-করা মুখের উপর পাছা দিয়ে একটা ঢেউ মেরে রসুন দোকান থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। আঙ্কুরের মাথাটা ভোঁ করে ঘোরান খায় :
সে কী খোয়াব দেখছে?
না-জানি বিধাতা তার নসিবে কী লিখছে!
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। বাজারের দিক থেকে কামানের গোলার মতো আওয়াজ আসছে মাইকের। আঙ্কুর নেতার গলাটা চিনতে চেষ্টা করে। বিবিসির সুবাদে সে শেখ মুজিবের গলাটা চিনে। বাজারের মিটিং বাবদ আঙ্কুরের চিন্তাটা ছিল এক-পলকের। তাবাদে আবার আঙ্কুর ঘামতে শুরু করে। এই শীতেও সে ঘামছেই! এইতক সে পাঁচটা বিড়ি শেষ করেছে। তবু গলার খাঁ খাঁ কামড়ানি বন্ধ হয় না। সব কেমন তার কাছে আউলঝাউল লাগে। কেমন আতঙ্কের মতো লাগে। রসুন বিষয়ে ভয়-ভাবনা আর অতি উৎসাহে সে এখন না-মরদের মতো একটু একটু কাঁপছেও। অন্যান্য দিন রসুনকে দেখলেই তার মগজে কামড় ওঠে। দুই কান শাঁ শাঁ করে। প্রবল কামনা টুণ্ডামুণ্ডা গতরটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
তামাম দুনিয়ার ঝিঁঝিপোকারা সরবে জেগে উঠেছে। দূরে, শুকনা কালই বিলের মাঝপাথারে অনেকগুলা শিয়াল একসাথে ডেকে ওঠে। তরল অন্ধকারের উৎসাহে ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ সব খুশিতে মাউত্ত্যাল হয়ে গান গাইছে। চারপাশে মানুষের কোনো সাড়া-শব্দ নাই তবু আঙ্কুরের আছে ভয়-শঙ্কা, পানির পিয়াসের মতো অজানা এক অস্থিরতা। জীবনে এই প্রথম সে নারীর সাথে সং করবে, মত্ত হবে কামলীলায়!
আঙ্কুর দরজার মুখে বসে বিড়ি টানতে টানতে নিজের হাতের দিকে তাকায়। নিজের অঙ্গটার একটুও আভাস নাই। অন্ধকারের গভীরে তার গোটা গতরটাই ডুবে আছে। অঘ্রানের শীত তেমন একটা কাবু করতে পারে না। এমনিতেই সে ঘামছিল। এখন গতরের নোংরা চাদরটাও তার কাছে বোঝা মনে হয়। আঙ্কুর চাদরটা দোকানের গদির ওপর ছুঁড়ে মারে। প্রায় মাঝআকাশে একটা মাত্র তারা। গোটা দুনিয়ার শূন্য মাজারে শুধু এই তারাটাই একলা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, যেমনটা তার বুকের মাঝে এখন শুধু রৌশন! রৌশন!
প্রেমসংগীতের একটা নতুন লাইন হঠাৎ তার মাথায় মুখ তুলতে চাইছে। আঙ্কুর একটু মন দিলেই গানটা হড়হড় করে নেমে আসবে। কিন্তু সেইদিকে সে মনটাকে নিতে পারছে না। খালি রৌশন…তার চারপাশে খালি রৌশনের কায়া, মায়া।
ধীরে ধীরে তার ছটফটানি কিছুটা থিতিয়ে এলে সে দেখে তার সামনে রসুন দাঁড়িয়ে বলছে, — উঠ!
আঙ্কুর রসুনের গলার ফিসফিসানিতে চমক খায়। সে গীতিকবি। নারীর সঙ্গকে সে কবিতার ভাষা দিয়ে হৃদয়ে বুনন করতে চায়। কিন্তু এখন দেখে রৌশনের মাঝে কোনো প্রণয় নাই, হাসি নাই, অঙ্গে কোনো রঙ্গ নাই। সরাসরি হুকুম, — উঠ!
আঙ্কুরের দুই কান ছ্যাঁতছ্যাঁত করে ওঠে। শরীরের অচেত-অচেত ভাবটার সাথে জবানেও কোনো সাড়া নাই। তাই সে কাথা বাড়ায় না।
আঙ্কুর বসে-বসেই দরজার শিকল টেনে ছোট তালাটা আঙটায় লাগিয়ে দেয়। রসুন সামনে হাঁটতে হাঁটতে পিছনে ফিরে দেখে, আঙ্কুর বুঝি গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে! সে বুঝে ফেলে, এইভাবে অইব না।
শাঁ করে ছুটে এসে লাঠি সমেত আঙ্কুরকে একঝটকায় কোলে তুলে ফন ফন করে খালপারের দিকে ছুটতে থাকে। খড়ের বড় একটা স্তূপ সামনে পড়তেই রসুন দাঁড়ায়। এখান থেকে কলুপাড়াটা মেলা তফাতে। গ্রামের পথটাও তাই। এইসব কারণে জায়গাটা খুব নীরব। পারতপক্ষে সন্ধ্যার পরে এদিকে কেউ আসে না। মানুষ খালপারের ভূতকে খুব ডরায়। সে অনেক চিন্তাফিকির করে আঙ্কুরকে হজম করার জন্য এই স্থানটাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল।
সন্ধ্যাতারাটা আকাশে এখন আর একলা না। তার লক্ষ-কোটি গণাগুষ্টি নিয়ে এক লাফে উঠে বসেছে। উত্তর থেকে হিলহিল করে আসছে মিঠা মিঠা ঠাণ্ডা বাতাস। সেই বাতাসে আঙ্কুরের মন-গতর শীতল হয়ে আসে। রসুন তাকে কোলের কাছে বসিয়েছে। মেয়েলোকটার গতরের মিঠা মিঠা সুবাসে তার বেহুঁশ বেহুঁশ লাগছে। আঙ্কুরের জীবনে এই প্রথম নারী। এই মুহূর্তে কিছু-একটা করতে হয় বলে হতভম্ব আঙ্কুর শিশুকালে মায়ের কোমর যেভাবে জড়িয়ে ধরত, সেইমতো সে রসুনের চিকন কোমরটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। জ্বরের বিকারে তোতলাতে তোতলাতে বলে, — অ রৌশন, তুই ক্যানে আমারে এইহানে আনছস?
রসুনের মনটা রাগে ছাৎ করে ওঠে। মুরগাটা কিচ্ছু বুঝে না। খালি জানে ফকিরের মতো করে তার বুক-পেট-পিঠ দেখতে। কামের কথা ঠাহর করতে পারে না! রসুন অস্তে অস্তে হাসে আর কয়, — খালপারে তরে কব্বর দিতে আনছি।
আঙ্কুরের হুঁশ হয়। কিছুটা শরমও পায়। কিন্তু কিছুই বলে না। একবার তার ইচ্ছা হয় রসুনকে একটা চুমা দিতে, তাও পারে না। বুঝবুদ্ধি হওয়ার পর মা ছাড়া জীবনে কোনো নারীর স্মৃতি নাই। মায়ের বয়েসি বাদে আর-সব বয়সের মেয়েলোকরা তাকে পছন্দ করে না। নিজের মা বাদে কোনো মেয়েলোক পারতপক্ষে তার সাথে কথা বলে না। একবারের বেশি কেউ ফিরেও তাকায় না। রসুন যখন তাকে কোলে করে খালপারের দিকে ছুটে আসছিল, তখন রসুনের শক্ত শক্ত ভারী স্তন দুইটা বারবার তার মাথা-মুখে ঘষা মারছিল। তাতেই আঙ্কুরের মাল আউট হয়ে যাবার দশা। আর এখন রসুন তার মুখের কাছে মুখ এনে কথা বলছে। রসুনের মুখের পান-জর্দা আর গতরের মিঠা মিঠা সুবাসে তার কোনো হিতাহিত নাই। তাই-না সে হ্যাবলার মতো অবশ গতরে বসে আছে। তা না হলে কত কত রাত সে না-ঘুমিয়ে মনে মনে রসুনের গতরটার মাঝে কামনা ভরা আগুন-আগুন একটা পৃথিবীর তালাশ করেছে।
রসুন ভাবছিল কীভাবে শুরু করা যায়! আবার তার মন বারবার তাকে হুঁশিয়ার করছিল, সময় বেশি নাই। যা লইবার আঙ্কুরের কাছ থাইক্যা জটপট লইয়া ল।
সে মনে মনে আশা করেছিল এই খড়ের স্তূপে এনে আঙ্কুরকে রাখতেই বিচ্ছুটা জোর খাটিয়ে তার বুকের ওপর উঠে বসবে। এখন দেখছে আবং মুরগাটার উপরে তাকেই উঠতে হবে। সে আঙ্কুরকে টান দিয়ে চিত করে ফেলে দেয়। একটা হ্যাঁচকা টানে লুঙ্গিটা খুলে ফেলে। মুহূর্তে আঙ্কুরের তলপেটের কাছে বিশাল একটা অজগর লাফিয়ে ওঠে। রসুন নজর ফিরিয়ে নেয়। সামান্য একটা গোঁজা-কুঁকড়া গতরে এত বড় একটা জিনিস দিয়ে খোদা বুঝি আঙ্কুরের কষ্টটাকে তামশা বানিয়ে ফেলেছে! এই জন্যই ত মানুষে তারে ঘোড়া ডাকে।
আঙ্কুর পিঠের গোঁজ নিয়ে চিত হয়ে পজিশন নিতে পারছে না দেখে রসুন আবার তাকে টেনে তোলে। আঙ্কুর বলে, — আমি তরে ভালোবাসি।
রসুন কিচ্ছু বলে না। পুরুষমানুষের জবানে ভালোবাসার কথা শুনলে তার গতর ঘিনঘিন করে। পুরুষ কখন ভালোবাসার কথা বলে সেটা সে জানে। মাল আউট হয়ে গেলে পুরুষের কাছে মাগীদের দাম কয় আনা সেটাও রসুনের জানা আছে। তাই সে এই জাতীয় শব্দের তরক্কিতে মজতে নারাজ। সে এসেছে আঙ্কুরের কাছে বীজ নিতে। চাষাদের হাতের বীজে টান পড়লে তারা যেমন পড়শির কাছ থেকে দরকারি বীজ খরিদ করে, তেমনি সে আজ এক খরিদ্দার। দশমাস দশদিন পরে সে এই বীজের ফসল ঘরে তুলবে। মা হবে। পুতের মুখে মা ডাক শুনে জীবন ধন্য করবে। সে ভালোবাসা নামক তামা-দস্তা দিয়ে কী করবে? তার পুত্র নামক হীরার টুকরা চাই। ভালোবাসা আর পুরুষের কয়ফোঁটা ল্যারের মাঝে কতটা ফারাক?
রসুন নিজেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। আঙ্কুর গলায় ঘেড়…ঘেড় শব্দ তুলে ফের ভালোবাসার কথাটা রসুনকে জানায়। রসুন এবারও নিরুত্তর থাকে। এখন তার মন আঙ্কুরের তলপেটের নিচে। কতদিন সে নুন-পেঁয়াজ আনতে গিয়ে আঙ্কুরের জিনিসটা একটু-আধটু করে দেখতে দেখতে আজ সবটা দেখে ফেলেছে। বুড়া খৈল্ল্যাকলু বলতে গেলে তার গতরটা আণ্ডুলই রেখে দিয়েছে। মাসে এক-দুইবার তার উপরে উঠে কি উঠে না। তার বুক, তলপেট সব এখনও চনচনা। আর নিচেরটা…। রসুন আর ভাবতে পারে না।
রসুন আঙ্কুরকে একটানে পুতুলের মতো তার বুকের উপর তুলে নেয়। যখন আঙ্কুর রসুনের নালারপারে নামে, তখন তার মন কয় আজ সে ছিঁড়ে-ফেটে মরে যাবে। জ্বলন্ত কয়লার মতন চনচনা গরম, ভোঁতা মুগুরটা বেফানা হয়ে রসুনের নিচের জমিনে পথ খুঁজছে! রসুনের নখ থেকে তালু তক শাঁ শাঁ করে জেগে ওঠে। আরামে চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। অবস্থা যখন এইরকম জটিল তখন সে আকাশের সবচে বড় তারাটার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে। কারণ সে দাদি-চাচিদের মুখে শুনেছে, মেয়েদের গাভ লওয়ার সময় যে জিনিস চিন্তায় থাকে, সন্তানও সেই রকম ছুরতের হয়। সন্ধ্যাতারাটার মতো ঝলমলা একটা পুত তার চাই-ই।
ম্যালা পরে যখন রসুনের গতর শিরশির করে ভাঙতে শুরু করে তখন সে ডিমপাড়া মুরগির মতো কক্…কক্ করতে করতে আঙ্কুরের মুখে একটা স্তন গুঁজে দেয়। আঙ্কুর ফের তার কানের কাছে ভালোবাসার কথা নিবেদন করে। কিন্তু রসুন মনে মনে থির করে রেখেছে, এই মাসে আঙ্কুরের নিচে সে আর গতর পাতা দূরে থাক পারতপক্ষে মোরগাটার সামনেও আসবে না। একসপ্তা আগে তার মাসেরটা গেছে। যদি সত্যি সত্যিই তার পেট ধন ধরে, তবে সে বিষুরির থলিতে জোড় কৈতর উড়াবে। আর যুদিন ফের তার রক্ত ভাঙে, তবে সেরে উঠেই আঙ্কুরকে বুকে তুলবে।
…
বাংলা আমার দুঃখী মাগো
দুঃখে আঁচল ভরা,
তোমার রত্নভাণ্ডার লুটে নিলে
পরদেশি সব তস্করেরা…
পরীর গলায় নিজের লেখা গানের টান শুনেই আঙ্কুর মোচড় দিয়ে উঠে বসে। মিটিং থেকে মানুষ ফিরতে শুরু করছে। মিটিঙের ভাষণ-বক্তৃতায় শুধু দেশের কথা, দশের কথা। তাই সময় বুঝে পরীও ঠোঁটে তুলে নিয়েছে দেশের গান। এই চারলাইন শেষ হতেই কাদু-কালুরা ‘ভালো কর্তা ভা, অ-হারে হে…’ বলে জোহার দিয়ে ওঠার পরিবর্তে চিৎকার দেয় :
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু।
…
রসুন চিত হয়ে শুয়ে তার অনাগত ছেলের কথা ভাবছে। আল্লা আল্লা করে যেন বীজটা জাগামতো গিয়ে ঠাঁই লয়। শুয়ে শুয়ে রসুন এই জপটাই জপছে। উঠে দাঁড়ালেই তো পিছলা বিজলটা ভাটির টানে সরে যাবে। তাই সে আরেকটু শুয়ে থাকে। একটু পরেই আঙ্কুরের সাথে টুঁ শব্দটাও না করে রসুন সোজা কলুপাড়ার দিকে চলে যায়। আঙ্কুর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। চলে যাবার সময় রসুন নাকের একটা শ্বাসও করল না। এই কী তার পিরিতি!
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS