চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৮ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৮ || শেখ লুৎফর

মুক্তির মহাতীরে


মাঠের সরিষা ক্ষেতগুলা এখন হলুদ ফুলে ফুলে বানেছা পরীর মতো উড়তে চাইছে। বাহার লেগেছে পেঁয়াজ-মরিচ সহ সব রবিশস্যের ক্ষেতে ক্ষেতে। কাম-কাজহীন অলস সময়ে চাষিরা জমিনের বাতরে ঘুরে ঘুরে রবিফসলের জলুশ দেখে। বেকার কাদু-কালুরা এপাড়া-সেপাড়া যাতায়াতের ফাঁকে ফাঁকে মাঠের দিকে তাকিয়ে হিসাব করে, কাজের জন্য আর কতদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। মাড়াই লাগলেই তো তাদের ডাক পড়বে। শীতটা এখন তার সবগুলা নখ-দাঁত নিয়ে গরিবদরিব মানুষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই আর কয়দিন বাদেই বিলবিলান্তে শুরু হবে দল (জার্মনি কচু ও কলমিলতা) সাফ করার কাম। বড় বড় চাষিরা এখনই বোরোধানের বীজতলা রেডি করতে শুরু করেছে। কাদু-কালুরাও তো পাঁচ-দশকাঠার চাষি। তারা বর্গাচাষি বলেই জমিনের মালিকের চে তাদেরকে একটু বেশি ভাবতে হয়। সেই আগাম ভাবনা থেকেই মাগীকুদ্দু সহ কাদু-কালুরা পাঁচ-ছ’জন সকাল সকাল মানু মিয়ার বাংলাঘরের সামনে এসে বসে আছে। যে-বিলের কান্দায় মালেকের বসতঘর তার নিচের পালানে মানু মিয়ার বীজতলা। বিশাল বীজতলার এক কোনার দিকে একটুকরা ভাগিদারদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও কাদু-কালুদেরকে সবটা বীজতলাই হাল-মই দিতে হবে। খুব যত্ন আর সহিন করে বুনতে হবে বীজ। তাবাদে আস্তা বীজতলাটাতে রোজ রোজ বিকালে এসে হেউত দিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে বৃষ্টির মতো ফোয়ারা সেচ দিতে হবে। মানু মিয়া দিবে শুধু বীজটা। এই হলো মানু মিয়ার জমিদারি হিসাব।

কুয়াশাভাঙা সকালে কাদু-কালুরা মানু মিয়ার অপেক্ষায় বিড়ি টেনে টেনে জনাপ্রতি দুই-তিনটা করে পুড়িয়ে ফেললেও কর্তার দেখা নাই। মাগীকুদ্দু রাগে চ্যারত চ্যারত করে থুতু ফালছে। দানবকালুর নিরীহ চোখে আজগুবি একটা তাচ্ছিল্য। রাজা ভাবলেশহীন। তবে মানু মিয়ার মনে যে একটা কিন্তু ঢুকে গেছে সেই বিষয়ে এরা সবাই এখন মনে মনে একমত। তাই রাজারূপী কাদু মোথা হয়ে আসা হাতের বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মানু মিয়ার বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে জোরে জোরে ডাক দিয়ে বলে,  — কর্তা…তাইলে আমরা অহন যাই।

রাজার রাজকীয় গলার হাঁকে মানু মিয়া বাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মানু মিয়া বুঝি আজ তাদেরকে চিনেই না এমনি করে বলে, — হ একটা কতা তগরে সময়মত কইতে ভুইল্যা গ্যাছি। এইবার আমি কিন্তুক কেউরে জমি ভাগে দিতাম না। মনে মনে ঠিক করছি নিজেই আবাদ করাম।

কাদু-কালুরা সবাই মনে মনে এইরকম একটা সন্দেহ করেছিল। তাই কেউ কোনো আর্জি পেশ করে না। জয়ধরখালী বাজারের মিটিং-এর দিন মানু মিয়া কৌশল করে দলের সবাইকে কাজে রেখেছিল যাতে তারা কেউই ছাত্রদের মিটিং-এ যোগ দিতে না পারে। কিন্তু সেদিন কাদু-কালুরা মিটিং-এ যাবার জন্য মানু মিয়ার জমি থেকে একটু আগেভাগেই উঠে পড়েছিল। তখন মানু টুঁ শব্দটা করেনি। শুধু কুতকুতে চোখে তাদের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বলেছিল, — কাউলকুয়া আমার কোনো কামলা লাগত না।

মানু মিয়ার কথায় মাগীকুদ্দু একবার জোরে চ্যারত করে থুতু ফেলে। অহাকালুর লম্বা ঘাড়টা এমনভাবে কুঁচকে গিয়েছে যে এখন শুধু তার কানা চোখের গর্তটাই দেখা যাচ্ছে। দানবকালুর যতটা রাগ লাগছে তারচে বেশি নিজের প্রতি ঘিন্না হচ্ছে। মনের রাগ আর ঘিনপিত নিয়ে মানুষটা নিবুনিবু খড়ের বেনিতে জোরে জোরে কয়টা ফুঁ দিয়ে আগুনটা উসকে দেয়। তাবাদে কান থেকে আধপোড়া বিড়িটা নিয়ে খুব মন দিয়ে খড়ের বেনির আগুনে ধরায়। তার মনে হয় গলায়-দড়ি-বাঁধা একটা ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো সে অর্ধেকটা জীবন মানু মিয়ার মতো আরেকটা কুকুরের সামনে লেজ গুটিয়ে কাঁইকুঁই করে কাটিয়ে দিয়েছে। খোদার দেওয়া জীবনটা সে আর কত নতজানু করবে? নিজের কাছে নিজের এই জিজ্ঞাসায় তার বুক তোলপাড় করে। তারপর দানবকালুর বিরাট শরীরের ছোট্ট পেটটায় সবসময় জ্বলতে থাকা ক্ষিধাটাও এখন মালুম থেকে নাই হয়ে গেছে। মানু মিয়ার সামনে দাঁড়ালে কয় কাঠা বর্গাজমিনের তাঁবেদারিতে যেরকম বন্দি বন্দি লাগে সেই ভাবটাও রাগে-ঘিন্নায় এই মুহূর্তে উধাও!

কর্তার কথার জবাবে কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে মানু মিয়ার চোখ দানবকালুর ফুঁতে উসকে-ওঠা খড়ের বেনির আগুনটার দিকে চলে যায়। মানু মিয়া এখন শেখ মুজিবের কথা ভাবছে। দানবকালুর হাতের বেনির আগুনের মতো ঘষে ঘষে দীর্ঘদিন জ্বলতে থাকা শেখ মুজিব এখন এই দেশে দপ-করে জ্বলে ওঠা একটা দাউ দাউ আগুন। সেই এক-বেনির আগুন আজ সারা পূর্বপাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আচান্নকভাবে দানবকালুকে এখন কুখাবনগরের সর্বনাশা দানবের মতো লাগছে।

মানু মিয়া বড় করে শ্বাস লয়। সে এখন মরিয়া হয়ে কাদু-কালুদের পেটে পা দিয়ে দাঁড়াতে চাইছে। ‘হাতের নয় ভাতের মাইরে গোষ্ঠী কান্দে।’ জমি কেড়ে নিলে, কয়দিন পরেই সবক’টা উল্লুক পেট চাপড়াতে চাপড়াতে তার পায়ের কাছে বসে নেড়িকুত্তার মতো পা চাটবে।

বিড়ি ধরাতে ধরাতে দানবকালুও মানু মিয়াকে আড় নজরে একবার দেখে নেয় : বাড়ির দেউড়ির সামনে দাঁড়ানো পেটমোটা, নিষ্ঠুর এই লুচ্চাটাকে এখন সত্যিই একটা লুচ্চার মতো লাগছে। ল্যাচ্ছরের মতো লাগছে। তাবাদে দানবকালু একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মানু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, — আফনের জমিন আফনের ইচ্ছা। আমগর কী ছাতুডা আছে, মারলে পুটকি, ছিঁড়লে বাল।

তাদের কাঙাল জীবনে কিচ্ছু না থাকলেও ঘাটুদলের সুবাদে তারা এতদিন নিজের অজান্তে সত্যিকারের শিল্পীরজীবন যাপন করত। সেই জীবনে যেমন ছিল ভালোবাসা, একতা, তেমনি ছিল মান্যতা। পারতপক্ষে তারা কেউই পরস্পর গালাগালি করত না। দলের সকলে সকলকে ওজনমাফিক মর্যাদা দিয়ে চলত। তাদের জীবনে ছিল প্রকৃতির মতো এক অদৃশ্য শৃঙ্খলা। কিন্তু আজ মানু মিয়া তার স্বার্থের জন্য মধুর স্মৃতিভরা ইতিহাসের সেই পৃষ্ঠাগুলা পাপিষ্ঠ পা দিয়ে এক-লহমায় মেচাগার করে দিয়েছে। মনের দুঃখ আর অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে দানবকালুও কথার পৃষ্ঠে কথা বলে তাদের চোখের সেই চশমটাও ভেঙে দিয়েছে। কেটে দিয়েছে দাসত্বের কঠিন শিকল।

সকালের নরম সুরুজটা অনেক লম্বা শীতের একটা রাত পেরিয়ে এখন খোয়া খোয়া কুয়াশার আড়াল থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেইদিকে তাকিয়ে রাজা বসা থেকে উঠে পড়ে। তার দেখাদেখি বাকিরাও ওঠে। তারপর একেবারে নিশ্চুপে কাদু-কালুরা মানু মিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অনেক দুঃখের মাঝেও নতুন জীবনের মতো একটা অজানা আমোদে সবাই নেশার ঘোরের মাঝে একটা ক্ষেত পেরিয়ে বিলপার ধরে হাঁটতে থাকে। মানুষ হেগে উঠে আসার সময় গু’র দিকে একবার হলেও ফিরে তাকায়। কিন্তু কাদু-কালুরা আজ কেউই মানুর মিয়ার বাড়ির দিকে তাকাল না।

রাজারূপী কাদু জানে, জীবন চলে জীবনের ধাতে। এই-যে এত বছর সে কয় কাঠা বর্গাজমিনের তাঁবেদারিতে কেনা গোলামের মতো মানু মিয়ার তম্বিতে চলেছে তাতে কী মানু মিয়ার চোখে একটু চশমের দেখা পেয়েছে? হঠাৎ উঠে আসা বুকের চোরা-চিক্কন দীর্ঘশ্বাসটা কাদু আপন বুকেই চেপে রাখে। তাবাদে সে আকাশটা একবার পরখ করে মনে মনে স্বীকার করে, — খোদার দুনিয়াটা কী বিরাট আর সুন্দর!

শুয়রের লোমের মতো মানু মিয়ার পিঠের কুছুরত লোমগুলা আর দেখতে হবে না; দানবকালু আছন্ন হয়ে নির্ভার হৃদয়ে এই চিন্তাটাই করছিল। মাগীকুদ্দু মনে মনে খালি কুটকুট করে হাসছে, — কর্তা এইবার পাশা খেলায় মস্তবড় ভুল চাল দিছে। এই রকম মোটা দাগের ভুল মানু মিয়া আগে কখনো করেনি। এইখানেই তার আচান্নক লাগে। তার বিচারে একে বলে বিধির বাম। আঁতেল মাতাব্বররা যেমন মাঝেমাঝে চালে ধরা খায় এইটাও তেমনি। মাগীকুদ্দু একবার হেসে উঠতে গিয়েও চেপে যায়। সে জানে মানু মিয়া তার বাংলাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তাদেরকে ঠাহর করছে। তাই এই মুহূর্তে নীরব থাকা একান্ত জরুরি। এখন যদি তারা ঠিক টাইমে ঠিক ঝাঁকিটা দিতে পারে তাহলে কর্তা খালি দুই নয়নে লাল-নীল সুতা দেখব।

কেউ কিছু না-বললেও সবাই দল বেঁধে সোজা খেলার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। মনের দুঃখে অপমানে তারা কেউ কথা বলতে পারছে না। খেলা আর পরীকে একসাথেই পাওয়া গেল। বাড়ির সামনের খলায় শীতের মিঠা মিঠা রোদে তারা দুইজন বাতাজাল ঠিক করছে। আসছে মঙ্গলবার রাজৈ গ্রামের পাঁচটা বিলে পলো-বাওয়ার তারিখ পড়েছে। মংলাদাইড়-মধুনি বিলের রুইমাছের স্বাদই আলাদা।

এখন কাদু-কালুরা বিচ্ছেদ গান কিংবা ডায়ালগ তো দূরে থাক কথাও বলছে না। আখড়ার দেবতাদের মতো চুপচাপ সার বেঁধে খেলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাদুর বিচারে মানু মিয়া জমি কেড়ে নিছে এইডা বড় দুঃক্কু না; দুঃক্কু হইল কার লগে এতদিন তারা ‘কর্তা কর্তা’ কৈয়্যা হাড়ে-গোস্তে সামিল আছিন?

এই কঠিন নীরবতায় চরম অসহিষ্ণু হয়ে শেষমেশ অহাকালুই বোমা ফাটায়, — হুনছস রে খেলা, কর্তা আমগর জমিন কাইড়া নিছে।
খেলা বাজপড়া মানুষের মতো কতকক্ষণ ত্যাব্দা-মেরে চেয়ে থাকে। তারপর আসল কথা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, — কোন কসুরে ?
— নৌকা মার্কার মিটিং-এ যাওয়ার গোনাগারিতে।

এই কথা বলে মাগীকুদ্দু চ্যারত করে থুতু মারে। অনেকক্ষণ পর মন খুলে কথা বলতে পারায় তার আরাম আরাম লাগে। এখন থেকে তার কথায় খামাখা বিরক্ত হয়ে কেউ আর তার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকবে না। এই সুখের ভাবনাটার আরামে সে মরে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে হাজারেবিজারে কথারা এখন খৈ ফুটাতে চাইছে।

খেলা পুরাতন বাতাজালে নতুন বর লাগাতে লাগাতে কয়, — আমি জানতাম। অহন ‘জয়বাংলা’ ডাক হুনলে মানু মিয়াগর কলিজায় আগুন জ্বলে। তার অনুমতি ছাড়া সেই জয়বাংলার মিটিং-এ গ্যাছত্?

মানু মিয়ার প্রতি বিষাক্ত ঘেন্নায় কাদু এতক্ষণ নীরব ছিল। সে জানে, মানুর কাছে ঘাটুদল হল বিষবাঁশের লাঠি। সেই দলের মানুষের লগে এই ক্যারদানি! কাদু মাথা নুয়ে বুঝতে চেষ্টা করে : তার মানে মানুর কাছে নৌকা মার্কার মিটিং-এ যাওয়া বহুতকিছু। তাছাড়া আরেকটা সত্য হলো, মানু মিয়া দল ছাড়া একদিনও থাকবে না। তার মানে কী দাঁড়ায়? তার মানে হলো, মানু মিয়া তাদেরকে ছিটানি-মেরে ফেলে দেবার আগে অবশ্যই তলে তলে আরেকটা দল রেডি করে রেখেছে! সেই গুপ্তি দলের লিস্টিতে কার কার নাম থাকতে পারে? ছলিম-জব্বর-আশেক সহ ঘোড়ামোবারকের মুখ কাদুর মনে একতালে নেচে ওঠে। ঘোড়ার প্রধান পেশা চুরি। তার একটা দুর্ধর্ষ চোরের দল আছে। চুরি করে আনা মালের রক্ষক ও খরিদদার মানু মিয়া। অর্থাৎ চুরির মাল জলের দামে কিনে রাখার সময় চোরের ওপর বাটপারিটা সে ষোলোআনাই করে। দলের সবাই জানে, ঘোড়ারমোবারক চর্তুদিক থেকেই মানু মিয়ার কাছে বাঁধা। এবং নিশ্চয়ই এইভাবেই মানু মিয়ার নতুন দলটার অলিখিত সর্দার হবে ঘোড়ামোবারক।

এবার কাদু অন্যদের দিকে তাকায় : দানবকালু খেলার কৌটা থেকে গুঁড়া-করা তামাকপাতা আর কাটা কাগজ নিয়ে বিড়ি বানাচ্ছে। অহাকালু মুখ চিমটা করে বসে আছে। বেচারা বিয়েশাদির তক্কে আছে। খোরাকীর ধানটা মানু মিয়ার ভাগে জমিন থেকে মজুদ করতে পারলে মনের দুগবুগিটা কম থাকত।

মাগীকুদ্দুকে দেখলেই বোঝা যায় সে জমিনের জন্য কাঁদছে না, কাঁদছে অপমানে। রাগে, অপমানে রাজারূপী কাদুর শরীর কেঁপে কেঁপে কামানের গোলার মতো ডায়ালগগুলা বিস্ফোরিত হতে চাইছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে দমন করে। একে তো সকাল, তারপর খেলার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডায়ালগ দিয়ে সে আর নিজেকে ছোট করতে চায় না। এইযেন তার জীবনটা অত উপাস-অনটনের মাঝ দিয়েও শেকড়বাকড়, ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে; এখন যদি কেউ সাতকাঠা বর্গাজমিন তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় তাতেই কী তার পরিবারটা আটকে যাবে?

বাড়ির ভিতর থেকে খেলার মায়ের দুর্বল গলা কেঁপে কেঁপে ভেসে আসে, — এই কুদ্দু, তুই মুখ আক্করাইয়্যা বইয়া আছস ক্যা, বাড়িত আ।
মাগীকুদ্দু উঠে যাবার কালে চ্যারত করে একটা থুতু মেরে মানু মিয়ার উদ্দেশ্যে কয়, — পুটকির বিগারে মরে কুড়াইল্ল্যার মার ছাগি।

কতক্ষণ পরেই মাগীকুদ্দু সানকিভরা মুড়ি-গুড় সবার সামনে রেখে পানি আনতে আবার বাড়ির ভিতর চলে যায়। একটু পরেই নিজের সানকিটা নিয়ে এসে সে খড়ের গাদার পাশে আরাম করে বসে, — কর্তা এইবার কঠিন ফান্দে পাও দিছে।

দলের ছোট-বড় সবাই জানে, মাগীকুদ্দু গ্রামের রাজনীতির বিষয়ে কথা বলার সময় একটুও মিথ্যা কিংবা বাড়িয়ে বলে না। আলাপসালাপে যা মন্তব্য করে তার চৌদ্দআনাই বাস্তবে ঘটে যায়। তাই মুখভরা মুড়ি নিয়ে সবাই মাগীকুদ্দুর দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আদত খবরের জন্য। মাগীকুদ্দু ফিসফিস করে কয়, — হাছু কুলুর জামাই-খ্যাদাইন্ন্যা ছেরিডারে কর্তা নাকি পেট উঁচা কইর‌্যা দিছে। এই লইয়া কুলুপাড়ায় খুব ঘাফিঘুফি চলতাছে।

খেলা জানে বাড়ির ভিতরে থাকলেও তার মায়ের একটা কান এইদিকেই থাকবে। তাই সে কথাটা না-শোনার মতো করে মুড়ি মুখে ফেলে গুড়ের দলায় কামড় বসায়। বড়ভাই কাদু সামনে বসা সেজন্য দানবকালুও সানকির পাত থেকে মুখ তোলে না। এই নীরবতায় অহাকালু একমাত্র ভালো চোখটাতে মনের সবটুকু আগুন ঢেলে দিয়ে বলে, — হাছু কুলু বাবদ শ-পঞ্চাশ ট্যাহা খরচ করলেই কলুপাড়ার সব কুনকুনানি ঠাণ্ডা অইয়া যাইব।

মানু মিয়ার বরাবরের এই সহজ ফয়সালাতেও কেউ কিছু বলে না বলেই কথাটা এই পর্যন্ত এসে আটকে থাকে। খেলা শূন্য সানকিটা অভ্যাসমতো সামনের দিকে একটু ঠেলে দিয়ে কাদুর দিকে তাকিয়ে বলে, — আইয়েকাইল পলোবাওয়া, যাইতা না?
কাদু পানির গ্লাসটার শেষ কয়ফোঁটা পানি দিয়ে গুড়-লেগে-থাকা তিনআঙুলের মাথাটুকু ধুতে ধুতে বলে, — তুমি ত বাতাজাল লইয়া যাইবা; আমারে তোমার পলোডা দিয়ো।
— হ, নিতারবা। বাজান হুনছি এইবার ধর্মজাল লইয়া হাতে (পলোবাওয়া) যাইব।

ভোরের আগেই ডাকাডাকিতে গ্রামগুলা ধড়ফড়িয়ে জেগে ওঠে। কয় খাবলা পানি-পান্তা মুখে দিয়েই মানুষজন বেরিয়ে পড়ছে। সবাই এইবাড়ি সেইবাড়ি থেকে কদম কদম পায়ে আল-বাত পেরিয়ে একলাফে এসে বড় সড়কে ওঠে। সারে সারে মানুষ। সবার সাথে কত জাতের সরঞ্জাম। বাতাজাল, ধর্মজাল, ঠেলাজাল, উড়ালজাল আর পলো। পলোই বেশি। এ ওকে নাম ধরে ডাকছে, কথা বলছে, বিড়ি টানছে আর ঘোড়ার মতো ছুটছে আগা-লাফে। কায়কামলা,গরিবদরিব সহ গ্রামের সব ধরনের মানুষ শীতের এই একটা মাস ইচ্ছামতো রুই-কাতল, শৈল-বোয়াল ধরবে আর পেট ভরে মাছ খাবে।

নটা-দশটার আগেই বিলপারে যাওয়া চাই। চৌদিক থেকে শত শত মানুষ এসে বিলপার ঘিরে বসবে। তখন দরকার ছাড়া কেউ একটা কথাও বলবে না। প্রায় সকলের গামছার মাথায় বাঁধা আছে চিড়া-মুড়ি-গুড়। পোটলাটা বিলের পানিতে ভিজিয়ে গিঁট খুলে বসে যাবে। খাওয়া শেষ হলে বিলের হাঁটুপানিতে নেমে, ঢেউ দিয়ে উপরের হালকা আবরণটা সরিয়ে, বিলের পানিই দুই চুমুক খেয়ে নিবে। তাবাদে বিড়ি ধরিয়ে জোরগলায় গগনবিদারী জোহার তুলবে :

মংলাদাঁইড়-মধুনি,
চিড়া খাইয়া চুদো নি?

বিশাল মংলাদাইড়-মধুনি বিলের চারপাশ গমগম করে কাঁপতে থাকবে। আর হাজার হাজার পাখি বিলের ডহর থেকে শূন্যে উড়াল দিবে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you