চেমননগরের বাতাসে রক্তের গন্ধ
—অ চাচা হুনছ, খেলা তার ডিঙ্গি নাওয়ে চাক্কা লাগাইতাছে, নৌকা মার্কার মিটিং-এ মিছিল লইয়া গয়শপুর যাইব।
পড়শি বাড়ির ভাতিজার কাছ থেকে এই সংবাদ শোনার পর থেকে মানু মিয়ার খালি এক পছতানি, — আমি এইডা কী কল্লাম! হায় কফাল, আমি ত ঘুমের মানুষ হজাক কৈরা দিছি।
বাড়ি থেকে সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। দেউড়ি পেরিয়েই থমকে দাঁড়ায়। বউ-মরা বেটামানুষের মতো বেজার মুখে মানু মিয়া কিছুতেই হাসি আনতে পারছে না! মানুষ তার দিকে এক-নজর তাকিয়েই বুঝবে, পাশাখেলার চালে ভুল করে এখন সে একটা আচুদা মানুষ। এতদিন সে কাদু-কালুদের বিরাট বিরাট গতরের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজেকে হিমালয়ের মতো মহা বিরাট মনে করত। তাবাদে এক ভুলে দ্যাখো আজ সবাই তার কালো মুখ দেখে মজা মারছে। হয়তো এই জন্যই গ্রামের মানুষ তার মতো ভুল করলে কপাল চাপড়ে বলে :
একশ কোপে কুন্দা (তালগাছের ডিঙি),
এক কোপে ধুন্দা।
মানু মিয়া মনে মনে বিড়বিড় করে, — সময়! সময়গুণে বিড়ালও বাঘ হয়ে সামনে দাঁড়ায়। যে কাদু-কালুরা একদিন ছিল তার হাতের লাঠি, বুকের ঢাল আজ তারাই তার গলার ফাঁস হয়ে চেপে আসছে! এই কাদু-কালুরা ছিল বলেই দাঙ্গাবাজ আমজাদ ঢালী তাকে যমের মতো ভয় করত, চিরশত্রু মড়লরা তাকে দেখে পথ ছেড়ে দিত সেই কাদু-কালুরা তার পেছনে না থাকলে তার সব দুশমনারা একাট্টা হয়ে যমের মতো তার দিকে এগিয়ে আসবে না? তাবাদে এইযেন কাদু-কালুরা বিগড়ে গেল এইটা কী সময়ের ক্যারদানি না? সময়! সময়! আজ তার পায়ের নখের সমান মানুষরা আওয়াজ তুলছে জয়বাংলা…!
জয়বাংলার সার কথা কি মানু মিয়া সঠিক জানে না। তবে ছোট তালুকদার তাকে হুঁশিয়ার করে বলেছে, — তোমার-আমার জন্য জয়বাংলা খুব খারাপ জিনিস। সেই জয়বাংলার কর্তা শেখ মুজিব আজ সারাদেশের কোটি কোটি মানুষের বন্ধু হয়ে গেছে। হায় নসিব! এইরকম দুঃসময়ে মানু মিয়া তুমি অত বড় ভুল করলা?
বিলপারের ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে লাগতেই মানু মিয়া মাথা তুলে দুনিয়াটা দেখে। মালেক তার খুপড়িঘরের সামনে এক-সানকি পানির মাঝে মুখ দেখে দেখে ব্লেড দিয়ে দাড়ি কাটছে। দাড়ি কাটতে কাটতে শিস দিয়ে গাইছে, — কেনবা তারে সোঁপে দিলাম দেহ-মন-প্রাণ…
মানু মিয়া মনে মনে একটা গালি দেয়, — গেরাম জুইড়া সব চুতমারানির আজকোয়া দ্যাহি ঈদ লাগছে!
মালেকের চোখ সানকির পানিতে। তাই মানু মিয়াকে সে দেখে না। সানকির পানিতে তার মুখের বদলে জন্তুর মতো বিকট একটা ছায়া দেখে মালেক চমকে ওঠে। স্বয়ং মানু মিয়া তার সামনে! আজ আর মালেক মানু মিয়াকে কর্তা বলে শ্রদ্ধায় গলে ওঠে না। তার বদলে মনে মনে একটা অশ্লীল গালি দেয়। ভেতরে ভেতরে ভয়ও পায়। কয়দিন আগে সে মানুর বাড়িটা গু দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিল। মানুষে কয়,‘চুরের মন পুলিশ পুলিশ।’ শেষ পর্যন্ত কী মালেক ধরা পড়ে গেল?
মালেক ব্লেড হাতে উঠে দাঁড়ায়। নেংটিকাছা মানুষটার গতর ভরতি শুকনা কাদার ছোপ ছোপ দাগ। মানু মিয়া মনে মনে হিসাব মিলায়, — তার মানে মালেক শেষ রাত থেকে বিলেই ছিল। খেলার নাওয়ের চাক্কা লাগানিতে নাই।
মানু মিয়ার মুখ ভার হয়ে আসে, সে মালেককে ধরতে পারে না। মালেক খুব জটিল মানুষ। বাইনমাছের মতো অনেক গভীরে তার চলাচল। রাত হলে যে কোথায় কোথায় যায়, কোন কোন ডহরে মাছ ধরে কোনো দিশা পাওয়া যায় না। তার চারটা বিলে মোটমাট এগারোটা খাদ। খাদের বড় বড় চিতল, শৈল-গজার আর বোয়াল মাছের বেশিভাগ মালেক হাপিশ করে দেয়। কিন্তু কোনোভাবেই সে মালেককে কোনোদিন হাতেনাতে ধরতে পারেনি। সব, সব তার অনুমান। সব তার সন্দেহ। আজ মানু মিয়া হাড়ে হাড়ে টের পায়, এই সন্দেহ জিনিসটা খুব খারাপ। সন্দেহের বশেই তো সে কাদু-কালুদের কাছ থেকে জমি হরণ করে নিয়ে আজ নিজেই কুখাবনগরের আহত রাক্ষসের মতো আছড়ে পড়েছে একটা অতল গহ্বরে। এই অতলের আন্ধি থেকে কী আর কোনোদিন সে আলোতে এসে দাঁড়াতে পারবে?
পারতেই হবে। সে তো সব ঠিক করেই রেখেছে। ঘোড়াকে দিয়ে সে একটা দল সাজাবে। অবশ্য এইবাবদ টাকা ঢালতে হবে। টাকা! টাকা! কম সাধে কী আর গ্রামের মানুষ বলে :
টাকায় করে কাম,
ইচ্ছামর্দের নাম।
ইচ্ছা! ইচ্ছা! মানু মিয়া…অ মানু মিয়া, এইবার তোমার সিন্দুকের ডালা খুলতেই অইব। টাকা ছড়াইতেই অইব। কয়টা কুত্তারে সায়েস্তা কৈর্যা দ্যাহাইতে অইব তোমার আতের মুঠি কত শক্ত। টাকা কোনদিনের লাইগ্যা ? তুমি ইচ্ছামরদ হইয়া যাও। দ্যাখবা সব ঠিক অইয়া গ্যাছে। সাগরে ঢেউ দ্যইখ্যা কূলে নাও ডুবানো মরদের কর্ম না।
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রাণপণ চেষ্টায় মানু মিয়ার মুখে ভাঙাচোরা একটা হাসি ঢেউ খেলায়, — খবর কী মালেক?
মালেক স্বস্তিতে লম্বা করে দম লয়। মানু টের পেলে কুখাবনগরের রাক্ষসের মতো আগুনচোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তাই নিশ্চিন্তে সে উত্তর দেয়, — জে দাড়ি কামাইতাছি।
মানু মিয়া আর দাঁড়ায় না। কিন্তু মনে মনে তার খটকা লাগে, মালেক তো আজ তাকে কর্তা বলে ডাকল না? তো না-ডাকুক। সবদিক গুছিয়ে এনে যখন একটা লাথ মেরে বিষুরির থলিতে নিয়ে ফেলবে তখন মালেক টের পাবে মানু মিয়া কী জিনিস।
মানু মিয়া এইসব ভাবতে ভাবতে হাঁটে, এই হলো মালেকের স্বভাব। সব কথার মাঝে সে একটা ফাজিলি প্যাঁচ ভরে দেয়। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাস করে, — বিয়া করতে না মালেক?
সে কোনো ভূমিকায় না গিয়ে বলবে, — হ, দ্যাহি টাইম পাইলে করাম। গরিবরা ত বিয়া করে না, কোনোমতো খালি চাইর ঠ্যাং এক করে।
মালেক আচান্নক চোখে মানু মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মানু মিয়া ঘোড়ামোবারকের বাড়ির পথ ধরলে মালেক সেই দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, — সেভেন্টিস্কয়ারের পুত ঘোড়ারে লইয়া তুমি খেলার একটা বালও ছিঁড়তা পারবা না।
এই বলে মালেক ব্লেড হাতে আবার উঠে দাঁড়ায়। বিলের উত্তর কান্দা পেরিয়ে মানু মিয়া এখন অহাকালুর বাড়ির ঢাল গড়ান দিয়ে ঘোড়ার বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছে। তাই মালেক আবেগে, রাগে মানু মিয়ার উদ্দেশ্যে জোরে জোরে একটা ডায়ালগ দিয়ে তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে, — হে দুর্বিনীত দুশমন, হে কুখাবনগরের কুটিল রাক্ষস তুমি জেনে যাও, চেমননগরের মহারাজ বঙ্গবন্ধুর মহাবিক্রমশালী সেনানায়ক খেলা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে। এইবার :
ধর অস্ত্র, কর যুজ্জু…
দেখিব কার বাহুতে কত শক্তি।
মালেক দাড়িটাড়ি কেটে বিলের ঘাটে যায়। ক্ষার দিয়ে মাথা ঘষে ইচ্ছামতো গোসল করে। আজকে আর মনে ফালানি নাই, পিরিতি নাই, খালি রাজনীতি…। রাজনীতির মিটিং-এ যাওয়ার অপরাধে মানু মিয়া কাদু-কালুদের কাছ থেকে জমি হরণ করে গ্রাম্য রাজনীতির মাঠ গরম করে ফেলেছে। তাই সে ইচ্ছা করলেও তার মাথা থেকে রাজনীতিটা ফেলতে পারছে না।
তাবাদে গোসলটোসল সেরে শীতে হি হি করতে করতে গামছাটা কোনোমতে কোমরে জড়িয়ে মালেক তার ঘরে আসে। কাপড়চোপড় পরে ফিটফাট হয়ে খেতে বসে। গতরাতের কড়কড়া ঠাণ্ডা ভাত আর টাকিমাছপোড়া ভর্তা। ঝালে হুহঃ হাহঃ করতে করতে সে আড়াই সানকি ভাত সাবাড় করে দেয়। তারপর দরজার ঝাপটা আধখোলা রেখে মালেক বিছানায় শুয়ে পড়ে। বাইরে দুপুরের ঝলমলা রোদ। মালেক শুয়ে শুয়েই আরেকটা ডায়ালগ দেয়, — ছদ্দবেশ, ছদ্দবেশ! এখন চেমননগরের ময়দানে ময়দানে যুজ্জু চলিতেছে কাশিদ। তুমি ছদ্দবেশ ধারণ করো। এখন ছদ্দবেশ অতিব জরুরি।
মালেক খুশি মনে একটা বিড়ি ধরিয়ে গানে টান দেয়, — কেনবা তারে সোঁপে দিলাম দেহ-মন-প্রাণ…
মালেক এমনভাবে জোরে জোরে গান গায় যেন সে দুনিয়ার কিছুই জানে না।
মালেক আজ বাকি দিনটা ঘুমিয়ে কাটাবে। সে মানু মিয়াকে দ্বন্ধে ফেলে আরাম পায়। খেলার নাওয়ের কাছে যাবে না। এইসব দেখে মানু মিয়ার কর্তালি হিসাবে খালি প্যাঁচ লাগবে। গ্রাম থেকে ফাড়াকে বিলের এই নির্জন কান্দায় সে খুব আরামে আছে। এখানে কেউ তাকে বিয়ের কথা বলে খোঁচায় না। গ্রামের বজ্জাত মানুষেরা অন্যের নরম জায়গায় খোঁচা মেরে সুখ পায়।
মালেক পোড়া বিড়িটা আধা-খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। ফিরতি পথে মানু মিয়া দরজা খোলা দেখে ধরে নিবে মালেক খেলার নৌকায় নাই। খেলা বয়সে ছোট হলেও মালেকের বন্ধু। নানান দিক থেকে দলের অন্য সকলের মতো মালেকও খেলার বিশ্বস্ত সহবত। এই কয়দিন আগেই রাগে সে মানু মিয়ার বাড়িটা গু দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিল। অবশ্য মানু মিয়া তাকে সন্দেহ করে না। মানুর বিশ্বাস, খেলার হুকুমে মাগীকুদ্দু এই কাজ করেছে।
মালেকের ঘুম আসছে না। নানান দিক থেকে তার মনটা ভালো না। আজ খেলার নৌকার কাছেও যেতে পারল না। কাদু-কালুদের কাছ থেকে জমি হরণ করে নেওয়ার খবর শোনার পর থেকেই তার মগজে গুয়ের কিড়া কিলবিল করছে। কপাল এমন খারাপ যে আজ মালেক কোনো মাছও পায়নি। মনটা আগুনের মতো ফাৎ ফাৎ করছে, মানু মিয়া গরিবদের উপাস পেটে দুই-পা তুলে দাঁড়াতে খুব আমোদ পায়, টাকার লোভ দেখিয়ে কলুপাড়ার উপাসী মেয়েগুলাকে সম্ভোগ করে তৃপ্তি পায়। চারপাশের অভাবী মানুষকে মানুষ না, গোলাম ভাবতে তার ভালো লাগে। মানু মিয়া তালুকদার বাড়ির বড়লোকি ঠাট-ঠমকের কথা রসিয়ে রসিয়ে গপ্প করতে খুব মজা পায়। কতদিন মানু ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে তাদের সাথে বলেছে, তালুকদারবাড়ির সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে-বৌরা টাট্টিতে হাগতে গেলে বাঁদিরা নাকি পানির বদনাটা টাট্টি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। হাগু দেওয়া শেষ হওয়ার পর আবার টাট্টি থেকে বদনা নিয়ে আসে। এদেরকে নাকি মানুষে ডাকে গু-ফালাইন্যা বান্দি। গ্রামদেশে একমুঠ ভাতের যে কত অভাব! শুধু একপেট ভাতের জন্য ওরা মানুষকে কত নিচে নামিয়ে নিয়েছে!
মালেক ঘুমের মধ্যে বারবার দেখছে, পঁচিশ হাত লম্বা একটা কাঠের মঞ্চে সে তার খেজুরগাছ কাটার পাতলা ছেনদা হাতে বসে আছে। আবার দেখে, মানু মিয়া ঘোড়ামোবারকের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা মালেকের ভালো লাগে না।
হঠাৎ মালেকের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার ঘরে প্রথমে সে কিছুই মনে করতে পারে না। এখন দিন না রাত? একটু পরে খেলার নৌকার কথা মনে হয়। স্বপ্নে দেখা ঘোড়ামোবারকের বাড়ির দিকে চলতে থাকা মানু মিয়ার লোমে ভরা শুয়র শুয়র পিঠটা এখনো তার চোখে লেগে আছে।
অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে চাদরটা নিয়ে মালেক চট করে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। এখনি খেলার বাড়িতে যাওয়া জরুরি। মানু আর ঘোড়ামোবারকের অসাধ্য কিছুই নাই। একটা নাও নিয়ে তিনগ্রামের মানুষ সারাদিন ঈদের আমুদে ছিল। এখনও যদি সে না যায় তবে খেলা কষ্ট পাবে।
মালেক হনহন করে খেলার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। কুয়াশাভরা অন্ধকারে দুনিয়াটা শীতে কাঁপছে। মালেক একটা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা টান দেয়। পাতা-কাগজের বিড়ির কড়া ধোঁয়া বুকের ভেতর কামড় মারে। হাঁটতে হাঁটতে মালেক গিয়ে বিলপারের সবচে উঁচা টেকটায় ওঠে। হাতের বিড়িটা ফেলে দিয়ে মানু মিয়ার বাড়ির দিকে বুক টানটান করে দাঁড়ায়। এইখান থেকে সাত-আটটা পতিত ক্ষেতের পশ্চিমে মানু মিয়ার বাড়ি। এই শীতের রাতে গলা ছেড়ে ডাকলেও কেউ শুনবে না। তবু সতর্কতা হিসাবে রঙ্গমঞ্চের ডায়ালগের মতো মাঝারি গলায় সে বলতে থাকে, — এই সেভেন্টিস্কয়ারের পুত মানু মিয়া, এই ক্ষেতওলার বাল মানু মিয়া, তর বউয়েরে তর শাশুরির বিছানাত্ হুতাইয়া আমি চুত্তে চুত্তে গাঙ কৈরালাইয়াম।
তারপরেই মালেক বমি করতে শুরু করে। গলা দিয়ে অড়ৎ অড়ৎ শব্দে বেরিয়ে আসছে পাথরের মতো ঠাণ্ডা আর দলা দলা ভাত, শুঁটকির ভর্তা। দুপুরের ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাতগুলা একটুও হজম হয়নি।
পেটের আবর্জনাগুলা বেরিয়ে গেলে মালেকের শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করে। সে টলতে টলতে বিলপারের ঘাটে নেমে মুখভরতি পানি নিয়ে বারবার কুলকুচা করে। ভালো করে হাত-মুখ ধোয়। মাথাটা ঠাণ্ডা করতে হাতে এক-চৈল পানি নিয়ে তালুতে দিয়ে ঘষে ঘষে মাখে। সবশেষে দুই-হাতে এক-আঁজলা পানি খেয়ে দাঁড়াতেই শরীরটা কিছু ঠিক হয়ে আসে। তারপর আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে।
এই বিলপারের কান্দা থেকে খেলার বাড়ি যেতে হলে তাকে মানু মিয়ার বাড়ির সামনের খালা দিয়ে যেতে হবে। তাই সে খুব সতর্ক হয়ে চলতে থাকে। সে শিকারী মানুষ। তার সবচে বড় সম্বল সর্তকতা। একটু আওয়াজ পেলেই বড় বড় রুই-কাতলা, শৈল-গজার নাগালের বাইরে চলে যায়।
দূর থেকে মানু মিয়ার বাংলাঘরে কুপিবাতির লাল পসর দেখে মালেকর শরীরের লোমগুলা দাঁড়িয়ে পড়ে। চারদিকটা আজ কেমন চকচক করছে! বাতাসে কেমন সন্দেহের গন্ধ! অলক্ষ্মী টুপক্ষির মতো মালেকের মনটা শুধু শুধু কুনকুনায়। তাই সে মানু মিয়ার বাংলাঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার বদলে পিছনপথটা বেছে নেয়। ঘরের ভেতর মানু মিয়া আর ঘোড়ামোবারকের গলা! ওরা ফিসফিস করে কথা বলছে। মুহূর্তে মালেকের ছোটখাট আর পাতলা দেহটা ঘরের দেওয়ালের সাথে মাথার উকুনের মতো মিশে যায়। লেপামুছাহীন দেওয়ালের ফাটল দিয়ে মালেক দেখে, ঘোড়ার সামনে কেরোসিনের একটা খালি টিন। মানু মিয়ার হাতে একশ টাকার একটা নতুন নোট। নোটটা ঘোড়ার দিকে মেলে-ধরে মানু মিয়া বলছে, — নে একশ দিলাম। বাকি পঞ্চাশ কাম শেষে কাইল সকালে নিবে।
মালেক উঁকুনের মতোই পিলপিল পায়ে নিজের আস্তানায় ফিরে যায়। তার শিরায় শিরায় আগুনের লহর, ঘোড়ামোবারক কেরাসিন দ্যায়া সব আয়োজন ছাই কৈরা দিব!
অথচ মালেকদের চোখে ঘুম নাই। আগামীকাল তারা ‘দলের কর্তা খেলা গ মিয়া… ভালো কর্তা ভা, অ-হারে হে…’ বলে আওয়াজ দিবে। ঘাটু নাচাতে নাচাতে গয়েশপুর বাজারে গিয়ে উঠবে। হাজার হাজার মানুষ পরানজোড়া কৈতরের মতো পরীকে দেখবে, পরীর সাথে তাদেরকেও দেখবে।
মালেক তার ঘরের দরজার ঝাঁপটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে ম্যাচ খোঁচায়। নিজের অজান্তেই তার শরীর গরম হয়ে উঠেছে। দুই কান ভোঁ ভোঁ করছে। তার সামনে এখন অনেক বড় দায়, অনেক বড় শিকার!
মালেকের ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে। গরম নিশ্বাস। সে মাটির কুপিবাতিটা ধরায়। বালিশের নিচ থেকে খেজুরগাছ কাটার পাতলা ছেনদাটা বের করে। চৌকির নিচ থেকে নিয়ে আসে মাটির নতুন একটা হাড়ি। তারপর কী মনে করে বাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলে আবার বাইরে এসে দাঁড়ায়। দরজার সামনে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে মুঠির আড়াল করে ভাবে, একটিন কেরোসিন জোগার করতে হলে ঘোড়াকে গয়েশপুর বাজারে যেতে হবে। তাই তাড়াহুড়ার কিছু নাই। মুঠির আড়ালে নিয়ে বিড়িটা টানে আর চারদিকে হরিয়াবাজ পাখির মতো খেয়াল করে। এক-সময় মালেকের মনে হয়, এই নিঝুম পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কেউ জেগে নাই তখন সে আবার ঘরে এসে ঝাঁপটা বন্ধ করে দেয়। বিড়িটা দাঁতে কামড়ে ধরে আবার কুপিবাতিটা ধরায়। দা-টা নতুন হাঁড়িটাতে ঘষে ঘষে অনেকক্ষণ ধারায়। শেষমেষ দা’র মুখে বুড়োআঙুল দিয়ে আলতো করে ধার পরখ করে।
তুষ্ট মনে মালেক গতরে একটা খেতা জড়িয়ে, বুকের পাশে ব্লেডের মতো ধারালো দা-টা নিয়ে বিসমিল্লা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ঠিক একটা শিকারী বনবিড়ালের মতো জুতাহীন নিঃশব্দ-পায়ে মালেক এসে বেনেভিটায় ওঠে। কুয়াশা আর আমতলের অঘোর অন্ধকারের নিচে বুকে পাটাতন নিয়ে পড়ে আছে নাওটা। রাত পোহালেই সে হয়ে উঠবে চেমননগরের রাজাধিরাজ বঙ্গবন্ধুর নৌকা। বাংলার কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের নৌকা। যে-দেশে গরিবদুঃখী মেয়েরা একপেট ভাতের জন্য মানু মিয়াদের মতো কুকুরদের কাছে দেহ মেলে দেয়, তালুকদারদের বৌ-ঝিদের গু-ফালাইন্যা বান্দি হয়, সেই দেশে ভাত কী জিনিস, ভাতের কষ্ট কী জিনিস মালেকদের চে আর কে বেশি জানে? মালেকের চোখদুইটা কড়কড় করে ওঠে, বুকটা ভার হয়ে আসে। আবেগে তার হাত-পা কাঁপছে। নিকষ অন্ধকারেই সে কাঁপাকাঁপা হাতে নাওটা একবার ছুঁয়ে দেখে, — বঙ্গবন্ধুর নাও! বুকজোড়া মানিকের মতো নাও!
নাওটা থেকে কয় হাত দূরে আমগাছের গোড়ায় একমুঠি খড় বিছিয়ে, জাত-শিকারী মালেক ঘোড়ামোবারকের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে। বুকের কাছে শক্ত করে ধরা খেজুরগাছ-কাটার ছেনদাটা তার দেহ-মনের উত্তাপে ধীরে ধীরে অগুন হয়ে উঠছে।
একশ টাকার নোটটা হাতে পেয়ে ঘোড়ামোবারকের মাথা নষ্ট নষ্ট লাগে। একভরি সোনার দাম তিনশ টাকা। এককাঠা জমির দাম একশত তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকা। একটা নাও পুড়িয়ে দিতে একটিন কেরাসিনের মামলত। এক-সের কেরোসিনের দাম দশ আনা। এই হিসাব করে ঘোড়ামোবারক তাড়ি না খেয়েই আধামাতাল।
একটিন কেরোসিনের তালাশে এসে ঘোড়ামোবারক গয়েশপুরের রেলসড়কের পুবপাশে কুদরতের বাড়িতে উঠে পড়ে। বাড়িটায় তাড়ির টক-ঝাঁঝালো গন্ধে বাতাস উতলা! তাবাদে চেমননগরের (পূর্ব পাকিস্তান) রাজা কী বঙ্গবন্ধু কী ইয়াহিয়া খান যেই হউক, তাকে চুরিচামারি করেই বাঁচতে হবে। ঘোড়ামোবারক ঘড়াৎ করে একগ্লাস পচা তাড়ি গিলে ফেলে। গিলে ফেলা মানে বাঁধ ভেঙে ফেলা। তাই গিলতে গিলতে ঘোড়া আস্ত একটা কলসির সবটুকু তাড়ি সবার করে দেয়।
ঘোড়ামোবারক আসে মাঝরাতে। তার দেহটা রাতের অন্ধকারের চে ভূতকালো অন্ধকার। সে কাঁধ থেকে কেরোসিনভরা টিনটা নৌকার পাটাতনে রাখতেই ঠন্নাৎ করে একটা শব্দ হয়। নাও থেকে একটু পশ্চিমে আমতলে বসা মালেকও সাপের খোলস ফেলে দেওয়ার মতো নিশব্দে গতরের খেতাটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। অজান্তেই বুকের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে ছেনদাটা। তাবাদে নুয়ে নুয়ে নাওয়ের পেটনার আড়ালে আড়ালে শিকারী বাঘের মতো নিশ্চুপে এগিয়ে যাওয়া। বাতাসে তালের তাড়ির পচা গন্ধ পেয়ে মালেক অন্ধকারেই মুচকি হাসে, — হাতে গরম মাল পাইয়া সেভেন্টিস্কয়ারের পুত দ্যাহি খুব মাল টানছে!
একটু পরেই বাতাসে কেরোসিনের ঝাঁঝালো গন্ধ। ঘোড়ামোবারক টিনের মুখ খুলে ফেলেছে! এখন সে নাওয়ের পাটাতনে কেরোসিন ঢালবে। তাবাদে বঙ্গবন্ধুর নাওটা ঘোড়ামোবারকের ম্যাচের একটা কাঠির সমান হয়ে যাবে। পুড়ে ছাই হয়ে যাবে চেমননগরের মানুষের সব স্বপ্ন!
মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো সুখে-দুঃখে মালেকরা কত বছর ধরে একসাথে আছে, ঘাটু নাচাচ্ছে। মালেকের হাত উঠতে চায় না। বিবেক কামড়ায়। সে জানে, তাড়ি গিললে ঘোড়ামোবারক মানুষ থাকে না। তা না হলে সে নিশ্চয়ই বিকল্প কিছু ভাবতে পারত। কিন্তু এখন ঘোড়া একটু আওয়াজ পেলেই মালেককে জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে। নতুন তক্তা দিয়ে আজকে বানানো নাওয়ের পাটাতনে ঘোড়া কী টিনটা উপুত করতে চাইছে? এই পাটাতনকেই কালকে তারা রঙ্গমঞ্চ বানাবে। পরী নাচবে। কাদু-কালুদের সাথে তারা মাথার বাবরি দুলিয়ে চিৎকার দিবে, — ভালো কর্তা ভা…।
দশ গ্রামের হাজারবিজার মানুষ আচান্নক হয়ে দেখবে তাদের এই অপূর্ব কিত্তি।
মালেক চিতা বাঘের মতো এক লাফে ঘোড়ামোবারকের মিশমিশা অন্ধকার দেহটার কাছে গিয়ে পেছন থেকে ডান কাঁধে কোপ বসায়। অরে বাবা রে…বলে একটা মরণচিৎকার দিয়ে ঘোড়ামোবারক ঘোড়ার মতো দৌড় দেয়। মালেকের বিশ্বাস গতরে শীতের কাপড় না থাকলে ঘোড়ার ডানহাতটা কাঁধের কাছ থেকে খসে যেত। সে দা’টার গায়ে হাত দিলে আঙুলে গরম রক্ত লেগে আসে।
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS