নব্বইয়ের দশকটি বাংলা সংগীতের দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য দশক। বিশেষত পঞ্চাশ ষাটের দশক থেকে অবিভক্ত বাংলায় চলচ্চিত্রের গান যেভাবে সংগীতরুচিতে প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকায় ছিল তার শেষ রেশটুকু নিয়ে নব্বইয়ের দশক পর্যন্তই ব্যাপকতর শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে দুই বাংলাতেই যা পানসে হয়ে ওঠে। (বলে রাখা ভালো পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র সংগীতে সেই হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের কিছু স্পষ্ট সফল প্রচেষ্টা অধুনা সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের বেলায় তেমন দাবি জোর দিয়ে করা যাবে না বলেই আমার ব্যক্তিগত মতামত) এই শূন্যস্থান পূরণ করতে দুই বাংলাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয়তা।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে একঝাঁক নতুন বা পুরাতন ব্যান্ড তাদের সংগীতের মধ্য দিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথাগত নাগরিক সংগীত রুচিতে প্রবল ধাক্কা মেরেছিল তারা। যার ফলশ্রুতিতে চারিদিকে অপসংস্কৃতির ধুয়া তুলে সংস্কৃতি গেল গেল বলে রব ওঠার সাথে সাথে তরুণ সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে কান্নাকাটি চেঁচামেচিও কম করেনি। অনুরূপভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংগীত চর্চায়ও তেমনটাই কমবেশি লক্ষ্যনীয়। নব্বইয়ের ব্যান্ড সংগীতের সেই জোয়ারে এক নিঃশ্বাসে বাংলাদেশের অনেকগুলো ব্যান্ডের নাম করা যায়, নতুন তরঙ্গ সৃষ্টিতে যাদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য । যেমন — সোলস, মাইলস, রেনেসাঁ, ফিডব্যাক, ফিলিংস, এলআরবি, নগরবাউল, ওয়ারফেইজ, উইনিং, অবসকিউর, নোভা, চাইম, ডিফরেন্ট টাচ, আর্ক ইত্যাদি (সত্যি কথা বলতে এই পর্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ব্যান্ডের নাম বলে হয়ত শেষ করা যাবে না) একইভাবে পশ্চিম বাংলায়ও তখন একসাথে অনেকগুলো ব্যান্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। তবে সে কথা আরেকটু বিস্তারিতভাবে না বললেই নয়।
বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের চর্চা স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে শুরু হলেও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে পরে মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের উচ্চারণ ব্যান্ডের নেতৃত্বেই এই ইতিহাসের পাকাপোক্ত নির্মান পর্ব শুরু হয়। অন্যদিকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আজম খানের মতোই আরেক লড়াকু সৈনিক যিনি নকশাল আন্দোলন পর্বে জেল খেটেছিলেন সেই গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ড ঘরানার জাগরণের শুরু। ব্যান্ড সংগীতের সূচনাপর্বের ইতিহাসে দুই বাংলাতেই প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই যে দুজন লড়াকু মানুষ নেতৃত্বের প্রথম সারিতে চলে এলেন তাকে কি শুধুই কাকতালীয় ব্যাপার ভেবে পাশ কাটিয়ে যাব? নাকি তাঁরা যে তাঁদের রাগ ক্ষোভ যন্ত্রণা অন্যায় আর অচলায়তনকে পাল্টানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যান্ডের ঝাঁঝালো আবহটাকে ব্যবহার করে নতুন লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবে নিজেরা বুক টানটান করে যেভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং যুক্ত করলেন পরবর্তী জেনারেশনকেও সেটা নিয়ে আরও গভীর আলাপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? এই প্রশ্নটা বোধহয় এখানে তোলাই যায়। ব্যান্ড ইতিহাসের শুরুর এই সময়টিকে নিয়ে বাংলাছবির আন্তর্জাতিক পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একটা অসাধারণ মন্তব্য করেছেন —
“বড় শিল্পকর্ম সেটা যেটা তার সময় এবং ভূগোলকে ধারন করে নিজের একটা সিগনেচার তৈরি করতে পারে। সেই সময়ের বাংলা রক তাই করতে পারছিলো। কারণ বোধ হয় ঐ মুভমেন্টের নায়কেরা দেশটা চিনতো, রাজনীতিটা জানতো, মানুষরে বুঝতো। যন্ত্র বাজানো বা সুরেলা গলায় তো গাইতে অনেকেই পারে, কিন্তু সময়ের বুকে বসে কিংবা প্রেমিকার বুকে বসে খোলবাজানিয়া শিল্পী হইতে গেলে দেশ, রাজনীতি, আর মানুষরে চেনা লাগে। তবেই গানকে আর অনুবাদগান মনে হয় না।”
০২.
বাংলাদেশে যেমন সূচনা পর্ব থেকেই ব্যান্ডসংস্কৃতি ধীরে ধীরে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে, উল্টোদিকে মহীনের ঘোড়াগুলির আধুনিক প্রচেষ্টার এই সংগীত-আবহটাকে কলকাতার শ্রোতারা ঠিকঠাক হজম করতে না পারায় ’৭৫ থেকে ’৮১ এই সাতবছরে তিনটি অ্যালবামে মাত্র ৮টি গান প্রকাশ শেষেই দলটির সকলে নিজেদের গুটিয়ে নেন। আর এতে শুরুতেই ধাক্কা খায় ব্যান্ডসংগীতের এই ধারাটি। তবে নব্বইয়ের দশকে এসে আবারও নতুন অনুপ্রেরণায় পুনর্জীবিত হয় তা, আর সেই সময়ে নতুনভাবে এর পাটাতন তৈরিতে বাংলা গানে কবীর সুমনের আবির্ভাব দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে। সুমনের পর পরই নচিকেতা অঞ্জন দত্তরা দারুণ এক আবহ সৃষ্টি করেন নতুন গানের, সেই আবহেই আবারও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় কলকাতার ব্যান্ড সংগীতের। এই পর্বে মহীনের ঘোড়াগুলি আবারও নতুন আঙ্গিকে তাদের গান প্রকাশে এগিয়ে এলে বাড়তি উদ্দীপনা তৈরি হয়। পাশাপাশি এটাও অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংস্কৃতির জোয়ারও সেই আবহ সৃষ্টিতে দারুণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ড সংগীতের নবতর এই সূচনায় বেশকিছু দল প্রথাগত সংগীতরুচির বাইরে এসে বৈচিত্র্যময় একের পর এক গান উপহার দিতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তরুণ শ্রোতাইরাই এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। বিভিন্ন কলেজ ফেস্টে নতুন নতুন ব্যান্ডের জন্ম হতে থাকে সেই সময়। নব্বইয়ের এই দশকে যেসব ব্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের মধ্যে অভিলাষা, চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, ক্রসউইন্ডস, পরশ পাথর, ফসিলস, ভূমি ইত্যাদি ব্যান্ডের নাম করা যায়। তবে এদের মধ্যে আলাদা করে চন্দ্রবিন্দুর কথা না বললেই নয়।
নব্বইয়ের দশক চন্দ্রবিন্দুর জন্ম ও বেড়ে-ওঠার কাল হলেও বাংলাদেশের সংগীতশ্রোতাদের কাছে তাদের গান সম্ভবত জনপ্রিয়তা পেলো আরও কিছুটা সময়ের পর। যদিও এ কথা হলফ করে বলা যাবে না যে সেই সময়টিতেই চন্দ্রবিন্দুর তরতাজা গান বাংলাদেশের কোনো শ্রোতাই শোনেননি। অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু অধিকতর শ্রোতার কাছে চন্দ্রবিন্দু সহ পশ্চিমবাংলার অন্যান্য ব্যান্ডের অ্যালবাম বা গান তখনো ঠিকঠাক যে পৌঁছেনি এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অবশ্য এর বহুতর কারণও ছিল। প্রথমত সেই সময়টিতে এমনিতেই বাজার সয়লাব হয়েছিল বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের শিল্পীদের দ্বারা। তাদের ব্যান্ড অ্যালবাম, মিক্সড অ্যালবাম এমনকি কখনো কখনো জনপ্রিয় ব্যান্ডশিল্পীদের একক অ্যালবামের ভিড় ছিল বাজারে। পাশাপাশি প্রবল প্রতাপ নিয়ে বোম্বের ফিল্মি গানের আধিপত্যও ছিল তুমুল। এই ভিড় ঠেলে তখন তখনই আমাদের হাতে কানে পৌঁছে গেছে সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন, শিলাজিতের গান। তবে চন্দ্রবিন্দুর গান বাংলাদেশের ব্যাপকতর শ্রোতার কাছে পৌঁছনের কাজটি আরও সহজ হয়ে উঠল ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অন্তহীন’ চলচ্চিত্রে তাদের ‘ভিনদেশি তারা’ গানটি জনপ্রিয় হবার পর। একে একে আমাদের শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রোতার কাছে প্রিয় হয়ে উঠল — ‘মন’, ‘ঘুম ঘুম ক্লাসরুম’, ‘বন্ধু তোমায়’, ‘যদি বলো হ্যাঁ’, ‘আদরের নৌকো’, ‘সুন্দরী আসে ঝাঁকে ঝাঁকে’, ‘চলে যাচ্ছে দিন ঠিক পাঁচটা তিন প্রায় অন্ধকার’, ‘কেন উপরে তাকালে’, ‘আর জানি না’, ‘সুইটহার্ট’, ‘দুপুরের খামোখা খেয়াল’ ইত্যাদি…। এবং এই যে বিংশ শতাব্দী শেষ করে নতুন একটা শতাব্দীতে প্রবেশ করার পরেও বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে চন্দ্রবিন্দু নতুন স্বাদ নিয়ে হাজির হচ্ছে এটা যে-কোনো ব্যান্ডের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি বলেই মনে হয়।
০৩.
চন্দ্রবিন্দুর সংগীতযাত্রা ইতিমধ্যে দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। এতটা পথ সাফল্যের সঙ্গে পাড়ি দিতে পারা নিশ্চিতভাবেই দারুণ কৃতিত্বের ব্যাপার। ক্যাসেট আর সিডির দিন পেছনে ফেলে আমরা প্রবেশ করেছি ইউটিউবের দুনিয়ায়। ফলে অ্যালবামসংস্কৃতির দিন এখন আর নেই, যেখানে একসাথে অনেকগুলো গান পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো আমাদের। বর্তমানে কেউ কেউ একক গান রিলিজ করলেও শুধু অডিওতে আর পোষাচ্ছে না, মাথায় রাখতে হচ্ছে ঝা চকচকে মিউজিক ভিডিওর কথাও। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে ধীরে ধীরে পালটাচ্ছে শ্রোতার রুচি। গতির অস্থিরতা ঢুকে গেছে মানুষের মনস্তত্ত্বে। লক্ষণীয় বিষয় হলো পালটে-যাওয়া ঢেউয়ের এই সময়টিতেও চন্দ্রবিন্দু কিন্তু বাংলাদেশের বেশকিছু তরুণ শ্রোতার সংগীতরুচিতে স্থান করে আছে। এবং আমার পর্যবেক্ষণে সেইসব তরুণ বয়সে না হলেও মননে অনেকটাই পরিণত। আর এটি চন্দ্রবিন্দুর সবচে শক্তির একটি জায়গা। কারণ নব্বইয়ের কলেজ ফেস্টের উন্মাতাল তরুণদের আকৃষ্ট করেও চন্দ্রবিন্দু কিন্তু তখন তখনই অনেক পরিপক্ক শ্রোতার রুচিতে হানা দিতে পেরেছিল, পারছে এখনো। আর এ ব্যাপারে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চন্দ্রবিন্দুর লিরিক।
আমাদের সংগীত-ঐতিহ্যে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের অবদান বিপুল। তবে সেই ঐতিহ্যে ফিরে তাকালে দেখব সেখানে লিরিক বা সংগীতে কথার গুরুত্ব একেবারেই ছিল না। কথাকে হয়ত সংগীতের অংশ বলেই ভাবা হতো না তখন। এ ব্যাপারে ভীষণভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন —
“আমরা যে বিদ্রোহ করেছি সে হিন্দুস্থানী সংগীতের আত্মপ্রসাদের বিরুদ্ধে, গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে, তার আনন্দদানের বিরুদ্ধে না — কেননা, আমাদের গানেও তো আমরা হিন্দুস্থানী গানের রাগরাগিণীর প্রেরণাকেই মেনে নিয়েছি। হিন্দুস্থানী সংগীতকে আমরা চেয়েছি, কিন্তু আপনার ক’রে পেলে তবেই না পাওয়া হয়। হিন্দুস্থানী সুরবিহার প্রভৃতি শুনে আমি খুশি হই, কিন্তু বলি : বেশ, খুব ভালো, কিন্তু ওকে নিয়ে আমি করব কী? আমি চাই তাকে যে আমার সঙ্গে কথা কইবে।’’
চন্দ্রবিন্দুর গানে রবীন্দ্রনাথের সেই আক্ষেপ পূরণের চেষ্টা আছে। সে-চেষ্টা আরোপিত নয় বরং স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে তাদের গানে আনন্দ ও শ্রোতার সাথে কথা কইবার বৈশিষ্ট অন্য অনেকের থেকে নিজেদের আলাদা করে তুলেছে।
বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে চন্দ্রবিন্দুর লিরিক দারুণ ব্যতিক্রম এবং অনন্য। তাদের গান শুনে, না-জেনেও বলে দেয়া যায় এটা চন্দ্রবিন্দুর গান। সেই সিগনেচার বা বিশিষ্টতা তারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। স্যাটায়ারে অসাধারণ। সেন্স অফ হিউমার ঈর্ষণীয়। জটিল কথাটাও সহজ করে বলবার দক্ষতায় সুনিপুণ। গানে দারুণ ছন্দময়তা যেমন আছে, আছে কাব্যময়তাও। লিরিকের ছন্দময়তার কথা তো আলাদা করে বলাই যায়, বিশেষ করে অনুপ্রাসে। সে অন্ত্যমিলে যেমন, বাক্যের অভ্যন্তরেও তেমন। উদাহরণ হিসেবে দুয়েকটি গানের অংশবিশেষ উল্লেখ করা যায়। ‘ডাকনাম’ অ্যালবামের ‘বাসস্টপে কেউ নেই’ গানের আস্থায়ীটা যেমন —
চলে যাচ্ছে দিন, ঠিক পাঁচটা তিন, প্রায় অন্ধকার
বাসস্টপে কেউ নেই কোথাও
কিছু মেষশাবক দুটো উটকো লোক হলো রাস্তা পার
বাসস্টপে কেউ নেই কোথাও।।
গানটির ভেতরে বাইরে অনুপ্রাসের শৈল্পিক ব্যবহার এতই চমৎকার যে তা পড়লেও ভালো লাগে। আবার ‘জুজু’ অ্যালবামের স্যাটায়ারধর্মী ‘গীতগোবিন্দ’ গানটির কয়েকটি লাইন দেখি —
হৃদয় ছট্টফট্ট হয় তুমি তো আলিয়া ভট্ট নয়
টুপুর-টাপুর শ্রদ্ধা কাপুর চেষ্টা
তুমি আমার তৃণমূল তুমি আমার টোপাকুল
তুমি আমার সিরিজ ভুলের শেষটা।
অনুপ্রাসের এই ধ্বনিব্যঞ্জনা চন্দ্রবিন্দুর গানকে আরও বেশি শ্রোতাপ্রিয় করতে সাহায্য করেছে বলে মনে হয়।
উপরোক্ত লিরিকটি নিয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলাপ সামনে আনা যায়, আর তা হলো — সময়ের সাথে সাথে নিজেদের নবায়ন করে নেয়ার চন্দ্রবিন্দুর অসাধারণ প্রচেষ্টা। কারণ, উল্লেখিত স্তবকটি কিন্ত অ্যালবামে এমন ছিল না, এটা বর্তমান ভার্শন। ‘জুজু’ অ্যালবামটি যখন প্রকাশিত হয় তখন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল নয়, ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। আর ক্রেজ ছিল কারিনা কাপুর প্রীতি জিনতাদের। গানে সেই সময়টাকেই ধরা আছে —
তোমার জন্যে চিন্তা হয় তুমি তো প্রীতি জিন্টা নয়
টুপুর-টাপুর কারিনা কাপুর চেষ্টা
তবু তুমি আমার সিপিএম তুমি আমার এটিএম
তুমি আমার সিরিজ প্রেমের শেষটা।
এই যে সমাজ বদলের সাথে সাথে নিজেদের শিল্পকেও আপডেট করে নেয়া তা করতে গিয়ে ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ নামে একটি অ্যালবামও আছে চন্দ্রবিন্দুর। যেখানে পুরনো গানকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করার চেষ্টা ছিল। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের উক্তি আরেকবার উদ্ধৃতি করি, তিনি তার সংগীতচিন্তায় বলেছেন —
“সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’’
সুতরাং চন্দ্রবিন্দুর সংগীতে সেই প্রাণটুকু যে বেশ ভালোভাবে আছে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কিন্তু সংগীত তো শুধু লিরিকের বিষয় নয়, কথা সুর গায়কী মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট এসবও সমানতালে গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই চন্দ্রবিন্দু অনন্য। কারণ সবগুলো শাখাতেই ক্রমাগত ভাঙচুর ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই আজকের চন্দ্রবিন্দুর সফলতা। লিরিকের বিষয়বৈচিত্র্যের সাথে সাথে সুর ও সংগীত আয়োজনের বৈচিত্র্যও দুর্দান্ত। যার ফলে মনোযোগী যে-কোনো শ্রোতার কাছেই ধরা পড়বে যে চন্দ্রবিন্দু আধুনিক মেলোডিয়াস গান যেমন করেছে, তেমনি রক, পপ, জ্যাজ, ব্লুজ থেকে শুরু করে কীর্তনের সুরে পর্যন্ত গান করবার চেষ্টা করেছে। শ্রোতা কী খাবে আর কী খাবে না সেই ভাবনার পাথরের নিচে চাপা না-পড়ে এই যে নিরলস শিল্পনিরীক্ষার চেষ্টা, সেটাই চন্দ্রবিন্দুকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যার অন্যতম নিদর্শন পাওয়া যায় ২০১২ সালে রিলিজ হওয়া তাদের সর্বশেষ ‘নয়’ শিরোনামের অ্যালবামে। (ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ পছন্দের অ্যালবাম) এটি একই সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুর নয় নাম্বার এবং এখন পর্যন্ত শেষ অ্যালবাম। এখানে নিজেদের এতটাই ভেঙে ফেলার চেষ্টা ছিল যে দলের অন্যতম সদস্য চন্দ্রিল একটা সাক্ষাৎকারে অ্যালবামের নামকরণ নিয়ে বলেছিলেন এটা সংখ্যায় যেমন ‘নয়’ আবার ধরনে যেন এটাও বলে দেয়া এই অ্যালবামটি চেনা চন্দ্রবিন্দুর মতোও নয়। এই যে চেনা চেনা রুচিকে ভেঙে ফেলার সাহস তা জনপ্রিয় তকমা লাগা যে-কোনো ব্যান্ড বা ব্র্যান্ডের জন্যেই চ্যালেঞ্জিং। চন্দ্রবিন্দু সেই চ্যালঞ্জটা নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
০৪.
আগেই উল্লেখ করেছি যে অ্যালবামসংস্কৃতির দিন এখন আর নেই। সুতরাং চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের আর কোনো অ্যালবাম শ্রোতা পাবে কী না সে-সংশয় তো থেকেই গেল। তাদের নতুন একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাইছি। বাংলাদেশের একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে গানটিকে ভীষণ পলিটিক্যাল স্যাটায়ার বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। শুরুর লাইনটা এমন —
‘প্রধানমন্ত্রী প্লিজ আমাকে একটা মেয়ে দেখে দিন’
জানি দুই বাংলাতেই আমাদের সাংস্কৃতিক মিলের কথা। প্রতীতি হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিও তা-ই। আর এই জন্যেই বাংলাদেশের শ্রোতা হয়েও চন্দ্রবিন্দুর সাথে এত সাবলীলভাবে সংযুক্ত হতে পারা যায়। সে যেমন প্রেমের গানে, একইভাবে কৌতুকে আর বিদ্রূপেও। এই ভেবেই কি চন্দ্রবিন্দু গেয়েছিল —
সে হাসি ছুটে যেত গোধূলিমিছিলে
সবার অলক্ষেতে তুমিও কি ছিলে
হাওয়ায় হাওয়ায়
হাওয়ায় হাওয়ায়
বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেল বেলা …
শুধু বিকেল নয়, শুনছি সব বেলার গানই। চন্দ্রবিন্দুর অলক্ষেই হাওয়ায় হাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রোতার কাছে সমাদৃত তাদের গান। আশা করি হাওয়ায় হাওয়ায় সে-কথাও পৌঁছবে চন্দ্রবিন্দুর কাছে। অভিনন্দন, ভালোবাসা চন্দ্রবিন্দুর জন্য।
বিসর্গতে দুঃখ, চন্দ্রবিন্দুতে মোক্ষ
গানপারে অ্যালবামরিভিয়্যু
গানপারে কন্সার্টরিভিয়্যু
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
COMMENTS