তখন আমরা টিনএইজ অ্যাংস্ট জানি না, কিন্তু যাপন করি। আলাদা করে গান শোনার তখন মাত্র শুরু। ডে-শিফ্টের স্কুলে যাওয়ার আগে রেডি হইতে হইতে এমটিভি আর ভিএইচওয়ান। চ্যানেলগুলা অ্যাড-জর্জরিত হয়ে যাওয়ার আগের দশা, গানই শোনাইত তখন, গানই দ্যাখাইত। তখন প্রথম লিঙ্কিন পার্ক চেনা। পয়লা ‘ক্রলিং’, তারপর ‘ইন দি এন্ড’। ‘হাইব্রিড থিওরি’ খুবসম্ভব প্রথম কেনা পাঁচটা সিডির মধ্যে একটা। তখন আমরা অ্যালবাম কিনে গান শুনতাম, তখন আমাদের শোনার কান মাত্র তৈরি হইতেছে। আমাদের ডেইজ্ড্ অ্যান্ড কনফিউজ্ড্ টিনএইজের অস্বস্তিতে এলপির গান আমাদের স্বস্তি দিত। আমাদের ব্যক্তিত্ব তখনও গজায় নাই। খড়কুটার মতন ভাইসা যাওয়া অশান্তির জগতে এলপি তখন শান্তি, ভাষাহীন অভিযোগ-অনুযোগের জগতে ভাষা। নিজেকে অবাক করে দিয়ে লিঙ্কিন পার্ক শুনতে শুনতে একদিন ঘুমায়ে গিয়ে ভাবছিলাম এই চিল্লাচিল্লির মধ্যে ঘুম কিভাবে আসে। তখনও জানি নাই যে কেওসের মধ্যেই নির্বাণ থাকে, তা সে স্বল্পক্ষণ থাকলেও।
এলপির আগে টিনএইজ অ্যাংস্টের সিনে বোধহয় ছিল অ্যাভ্রিল ল্যাভিন, এভানেসেন্স। এলপির পর আস্তে-ধীরে আসল গ্রিন ডে, অডিওস্লেভ। ইনোসেন্স টু এক্সপিরিয়েন্স। এলপি অনেকটা কানেক্টিং পয়েন্ট ছিল, ট্রানজিশনের ঠিক মাঝখানে। এই পয়েন্টে আমাদের নিয়ে আসছিল চেস্টার। সেই চিৎকারটা চেস্টারেরই ছিল যেই চিৎকারটা আমাদের ভিতরেও ছিল, বাহিরে আমরা আনতে পারি নাই। ও, ওরা যা বলত তা আমরাও বলতে চাইছিলাম, ওরা বলার পর মিলাইতে পারছি। সারা গায়ে পিলপিল করে হাঁইটা বেড়ানো রাগ-ক্ষোভ-ভয়-গ্লানি-অসহায়ত্বের মাঝে আমাদের মগজের জন্য ঠাঁই ছিল ওদের গান। এই কেউ-কিছু-না-বোঝা, এমনকি নিজেও না, যে ক্যামন লাগে — ওরা বুঝত, ওরা বলত যে এমন লাগে। চেস্টারের চিৎকারটা, ভিতরে ভিতরে চেস্টারের সাথে দিতে থাকা আমাদের চিৎকারটা তবে একটা কালেক্টিভ চিৎকারই ছিল। এসবের সাথেই আমরা আবছা আবছা ধরতে পারতেছিলাম যে আমরা নিশ্চয়ই অত একাও না, আমরা নিশ্চয়ই অনেক।
‘হাইব্রিড থিওরি’র পর ‘মিটিওরা’, তারপর ‘মিনিট্স্ টু মিডনাইট’। এরপর থেকেই এলপি থেকে দূরত্বের শুরু। এরপর থেকেই হয়তো আমরা বড় হয়ে যাচ্ছিলাম, এলপিকে ছাড়ায়ে। কিংবা আমাদের মনে হচ্ছিল যে এলপি আর আগের মতো নাই, পাল্টায়ে যাচ্ছে। পরিবর্তনকে ভালো-খারাপ ছাড়ায়ে শুধু পরিবর্তন হিসাবে হয়তো আমরা দেখি নাই তখনও। দূরত্ব আর নৈকট্যের জটিল ডায়নামিক্সটা আবার উপলব্ধি হইল চেস্টারের মৃত্যুতে। লিঙ্কিন পার্ক যে কোর-মেমোরির একটা অংশ হয়ে গেছিল, এত বছর পরও তাদের সুর-তাল-কথা যে মনে রয়ে গেছে, সেইটা টের পাই নাই। টের পাই নাই লিঙ্কিন পার্ক তার চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ, যতটুকু ভাবার কথা খেয়ালে আসে নাই।
গান আমাদের টাইম ট্র্যাভেল করায়। আমাদের টিনেইজ ফেরত আসল, এলপি ফেরত আসল, আর এইসবের মাঝে আবার, কানেক্টিং পয়েন্টে চেস্টার। চেস্টার বেনিংটন। যে কিনা সিংস লাইক অ্যান এইঞ্জল, স্ক্রিম্স্ লাইক আ ডেভিল। যাঁর জন্য রেস্ট ইন পিস বলতে পারতে সপ্তাহ ঘুরায়ে যায়, শেষে রেস্ট ইন রক বলা যায় কোনোমতে। তাঁর জার্নি, ১৯৭৬ থেকে ২০১৭, কিংবা ১৯৯৯ থেকে ২০১৭। তাঁর ট্রমা, তাঁর ডিপ্রেশন। এসবের কিছু আমরা জানছি, কিছু আমরা জানি নাই। কিন্তু তাতে চেস্টারের সাথে আমাদের সম্পর্কের হেরফর হয় নাই। আমরা জানতাম যে যা কেউ জানে নাই, তা আমরা-আমরা জানি। চেস্টারকে নিয়ে, লিঙ্কিন পার্ককে নিয়ে আমার এরকম গল্প আছে। সেইটা একটা গল্প। এরকম বহুজনের বহু গল্প আছে। আর সেই গল্পগুলা একতরফা না, দীর্ঘ সময়ের যোগাযোগে তৈরি হওয়া গল্প। আর শেষপর্যন্ত কিছুতেই কিছু এসে যায় না বললেও এসে আসলে যায়। অন্তত এইটুকুতে এসে যায়।
… …
- দেয়ার ওয়াজ আ মোমেন্ট : ফার্নান্দো পেসোয়া || আনিকা শাহ - January 20, 2021
- চেস্টার বেনিংটন, লিঙ্কিন পার্ক : এলিজি কিংবা ইউলোজি || আনিকা শাহ - August 5, 2017
- ওয়ান্স : স্ট্রিট-স্যং অথবা আর্বান মিজ-অঁ-সিনের গীতমালা || আনিকা শাহ - July 27, 2017
COMMENTS