সাইড ‘এ’
‘ওয়ান্স’ শুরু যখন হয়, দেখা যায় এক ছেলে ডাব্লিনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে গান গাচ্ছে। ভ্যান মরিসনের গান কভার করছে — অ্যান্ড দ্য হিলিং হ্যাজ বিগান। গিটারের ব্যাগটা সামনে রাখা, তাতে পথচারীদের দেয়া পয়সা। এক লোক এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনে, ছেলেটার প্রশংসা করে, তারপর জুতার ফিতা বাঁধার ছলে গিটারের ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দেয়। ছেলেটাও পিছে পিছে যায়। খুব বেশিদূর যেতে হয় না, ছেলেটা শেষপর্যন্ত তার পয়সা ফেরত পায়, লোকটা অনেকটা আপোসেই দিয়ে দেয়। ছেলেটাও আর খুব একটা কথা বাড়ায় না। দু’জনেই বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে পার্থক্য আসলে খুব বেশি নাই।
‘ওয়ান্স’ মিউজিক্যাল ম্যুভি। ২০০৭ সালের। ডিরেক্টর জন কার্নি, মূল দুই চরিত্রে গ্লেন হ্যান্সার্ড আর মার্কেটা ইর্গ্লোভা। আমার ‘ওয়ান্স’-এর গান নিয়ে লেখার কথা, ম্যুভি নিয়ে না। কিন্তু এই গানগুলার নিজস্ব একটা কন্টেক্সট আছে, একটা ভিজ্যুয়্যাল আছে; সেগুলা নাকচ করে দেয়া সম্ভব না, সমীচীনও না বোধহয়। তাছাড়া, যতই পর্দার রিয়্যালিটিতে ঘটা ঘটনা হোক, পর্দার বাইরের রিয়্যালিটিতেও তো এমনটা ঘটে। সবকিছুই ঘটে।
‘ওয়ান্স’-এ ছেলেটা বাস্কার, রাস্তায় গিটার বাজিয়ে গান গায়, তাতে যে যা পয়সা দেয়। স্ট্রিট-পার্ফোর্ম্যান্সের আরেক নাম বাস্কিং — পাব্লিক প্লেসে পার্ফোর্ম করা, দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বিনিময়ে। উইকিপিডিয়া বলে, বাস্কিংয়ের চল মধ্যযুগ থেকে। রোমানি জিপসিরা ঘুরতে ঘুরতে স্পেন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বাস্কিং শব্দটা ইংল্যান্ড আর ইউরোপের বাকি অংশে নিয়ে আসে। ১৯৬০-এর হিপ্পি কালচারের সাথেও বাস্কিং সম্পৃক্ত। বাস্কিং এখন বিভিন্ন দেশে প্রচলিত, বিভিন্ন নামে। বাস্কিংয়ে পার্ফোর্ম্যান্সও বিভিন্ন ধরনের হয় — মিউজিক, অ্যাক্রোব্যাটিক্স্, স্কেচিং বা পেইন্টিং, ম্যাজিক-ট্রিক কিংবা স্ট্রিট-থিয়েটার। ২০০০ থেকে সাইবার বাস্কিংয়েরও প্রচলন শুরু হয়েছে, আর্টিস্টরা তাদের কাজ আপ্লোড করে দেয়, কারো ভালো লাগলে তারা পেপ্যালে কিছু ডোনেশন দেয়। পপুলার কালচারেও বাস্কিং বহুল ব্যবহৃত, আগেও ছিল, ইদানীং হয়তো গুরুত্বটা অন্যরকম, অন্তত ‘ওয়ান্স’-এ তো বটেই।
সাইড ‘বি’
তো, ‘ওয়ান্স’-এ ছেলেটা বাস্কার। দিনের বেলা সে চেনাজানা গান কভার করে, রাত বাড়লে পর নিজের গান গায়। এ-রকম এক রাতে মেয়েটার সাথে তার দেখা হয় — সে ম্যাগাজিন বিক্রি করছিল, গান শুনে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে গানটা তার নিজের লেখা কি না। ছেলেটার বাবার দোকান আছে, হুভার (ভ্যাক্যুম ক্লিনার) রিপেয়ার করার, ছেলেটাও কাজ করে সেখানে। মেয়েটার একটা নষ্ট হুভার থাকে। পরদিন তাদের আবার দেখা হয়, নষ্ট হুভার-সমেত (কজমিক কানেকশান কখনও কখনও ভ্যাক্যুম ক্লিনারের রূপেও আসে)। মেয়েটাও মিউজিশিয়্যান, একটা মিউজিক স্টোরে সে পিয়ানো বাজায়, মালিকের অনুমতিসাপেক্ষে। তারা সেই স্টোরে যায়, মেয়েটা পিয়ানো বাজায়, ছেলেটা গিটার বাজায়, গান গায়, স্টোরের মালিকের সাথে সাথে আমরাও ‘ফলিং স্লোলি’ শুনি।
তোমার-আমার এই যে দেয়াল …
একজন মিউজিশিয়্যানের সঙ্কটগুলা আসলে কী কী? ডাব্লিনের রাস্তায় দিনের বেলা ছেলেটা নিজের গান গায় না, অচেনা গানে পয়সা বেশি আসে না বলে। ‘তো, তুমি পয়সার জন্যই করো খালি?’ — এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে থমকে যায় একটু, সে আদৌ হয়তো উত্তরটা জানে না, বা ভাবে নাই কখনও। কিন্তু ভেবে দেখলে, তার সামনে প্ল্যাটফর্ম বলতে আসলে কী আছে? মেয়েটা চেক রিপাবলিক থেকে আয়ার্ল্যান্ডে এসেছে, সাথে তার মা আর মেয়ে। সে কখনও ফুল কখনও ম্যাগাজিন বিক্রি করে, কখনও মানুষের ঘরদোর পরিষ্কার করে। সে গান লেখে, সুর করে, পিয়ানো বাজায়, কিন্তু নিজের একটা পিয়ানো কেনার সামর্থ্য তার নাই। ছেলেটা নিজের গানের ডেমো রেকর্ড করে লন্ডনে যেতে চায়, কিন্তু পয়সা আসবে কোত্থেকে? বাস্কিং করে? হুভার রিপেয়ার করে? ওদের গান রাস্তাঘাট আর মিউজিক স্টোর থেকে স্টুডিওতে ঠিক কীভাবে পৌঁছাবে?
‘ওয়ান্স’-এ আমরা ছেলেটা আর মেয়েটাকে কোলাবোরেট করতে দেখি। আমরা একটা-একটা করে গান শুনতে পাই। ‘ওয়ান্স’-এর গানগুলার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ বোধহয় লিরিক। সিম্পল অ্যান্ড কোজি — আমরা ঘরের বর্ণনা দিতে গেলে বলি এমন, তবে অনেকটা ওই-রকম, এবং তারচেয়েও বেশি। আর্টিস্টদের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন, এক-ধরনের স্টোরিটেলিং — আমরা রিলেট করতে পারি, আমাদের নিজস্ব স্মৃতি গানের সাথে যুক্ত হতে থাকে, আমাদের নিজস্ব স্টোরির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে যায়। আমরা ম্যুভির কন্টেক্সটের সাথেও নিজেদের মিলাতে পারি। যা-কিছু চাই আর যা-কিছু পাওয়া সম্ভব, তার কনফ্লিক্ট তো আমাদের কাছেও নতুন না। একদিকে ব্যক্তিগত টানাপোড়েন, আরেকদিকে আর্থ-সামাজিক সঙ্কট, এর মধ্যে প্রায়োরিটিটা কীভাবে ঠিক রাখা যায়? সিদ্ধান্তটা আমরা কীভাবে নেব? আমরা সামনে আগাতে চাই ঠিক আছে, কিন্তু সেজন্য যেটুকু ধাক্কা পিছন থেকে প্রয়োজন, সেটা কে দেবে? মাঝে মাঝে তো সেটুকুই সবচাইতে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘ওয়ান্স’-এর ছেলেটা আর মেয়েটা সেই দিক দিয়ে ভাগ্যবান — দুইজন মিউজিশিয়্যান একে-অপরকে সাহায্য করছে, কোলাবোরেট করছে, ছোটখাটো ব্যাপার না সেইটা। না-হলে, যেখানে দেখে মনে হচ্ছে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চাচ্ছে একটা ঘটনা ঘটুক, কিন্তু ম্যাটেরিয়্যাল পৃথিবী বাগড়া দিচ্ছে, সেখানে এই প্যাটার্ন থেকে বের হওয়া যায় কী করে?
আশা-প্রত্যাশা-নিরাশার ত্রিকোণমিতি
‘ওয়ান্স’-এর ছেলেটা আর মেয়েটা গ্লেন হ্যান্সার্ড আর মার্কেটা ইর্গ্লোভা। দুইজনই মিউজিশিয়্যান, একসাথে পার্ফোর্মও করত ‘দ্য সোয়েল সিজন’ নামে। ডিরেক্টর জন কার্নি এক-সময় হ্যান্সার্ডের ব্যান্ড ‘দ্য ফ্রেইম্স্’-এর বেইজিস্ট ছিল। এবং হ্যান্সার্ড একটা সময় আসলেই বাস্কিং করত, বাস্কিং নিয়ে ম্যুভির কিছু কাহিনিও হ্যান্সার্ডের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। ‘ওয়ান্স’-এর গানগুলা হ্যান্সার্ড আর ইর্গ্লোভার কম্পোজ আর পার্ফোর্ম করা, একটা গানের পার্ফোর্মার ‘ট্রান্সফেরেন্স’ নামে একটা ব্যান্ড। ‘ওয়ান্স’-এ আমরা ২০০৭ সালের ডাব্লিন দেখি, ‘ওয়ান্স’-এর গানসূত্রে আমাদের আয়ার্ল্যান্ডের কন্টেম্পোর্যারি মিউজিক নিয়ে একটা বোঝাপড়া হয়। আমরা বাস্কিং নিয়ে ভাবি, গান কীভাবে রাস্তাঘাট থেকে স্টুডিওতে যায় সেইটা দেখি। আমরা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া দেখি, বদলাতে-থাকা অর্থনৈতিক অবস্থায় ঠিকঠাকমতন বেঁচেবর্তে থাকার চেষ্টা দেখি, ইচ্ছা আর সামর্থ্যের গরমিল দেখি, অতীত-ভবিষ্যতের মাঝামাঝি বর্তমানে দাঁড়িয়ে ‘একবার কী হলো …’ সেইটা দেখি। আমরা আমাদের দেখি। ছেলেটা আর মেয়েটার তো কোনো নাম ছিল না। ছেলেটা আর মেয়েটা তো আমরাও হতে পারি, বা হইও।
আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে গান হয়তো গাই না, কিন্তু গান আমাদের মাথায় বাজে। আমাদের জীবন নির্বিবাদ যাপিত হতে থাকে বা থাকে না, আমরা একবারের অপেক্ষায় থাকি। আমরা ‘বিগ ব্রেইক’-এর চিন্তা করি। আমরা সংকেত খুঁজি, আমরা কজমিক কানেকশন নিয়ে ভাবি। আমরা মনস্থির করি সামনে আগাতে, আমরা ইতস্তত করি পিছনের ভাঙা মেরামত হয় নাই বলে। আমরা রাতদুপুর করে অফিস থেকে বাসায় ফিরে সকালে উঠে লেখার কথা ভাবি। আমাদের দিন খারাপ যায়, কিন্তু আমরা রাস্তায় অচেনা লোকেদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি। আমরা ধরে রাখি, ছেড়ে দেই। আমরা স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ভাবি কোথায় গিয়ে পৌঁছাব। আমরা অনেকদিনের ব্যবহারে ফাটল-ধরা গিটার বদলাই না। আমরা অনেক বেঠিকের মাঝে একটাকিছু ঠিক হওয়ার অপেক্ষা করি। একবার।
গান তুমি হও বিশ্রী গরম ভুলিয়ে দেয়া বৃষ্টি
গান তো একই সাথে সামষ্টিক, ব্যক্তিগতও। সামষ্টিক-ব্যক্তিগত বলতে কি কিছু আছে? হিউম্যান নেইচার-মতন? যেমন, একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আমাদের সবার ঠিক একই রকম অনুভূতি হবে? ভঙ্গি আলাদা হবে নিশ্চয়ই, প্রকাশ আলাদা হবে, কিন্তু মূল বিষয়টা, এসেন্সটা একই? ‘ওয়ান্স’-এর গান শুনলে আমার ওই-রকম মনে হয়। না-হলে, আয়ার্ল্যান্ডের দুইজন স্ট্রাগ্লিং আর্টিস্টের কাহিনিতে আমাদের আসবে-যাবে কেন? শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা তাহলে গান লেখা বা গান রেকর্ড করা নিয়ে না; গানের মধ্য দিয়ে একটা গল্প, একটা ছবি দেখিয়ে দেয়া নিয়ে। গানের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করা নিয়ে। এজন্যই হয়তো আসে-যায়, আর গানগুলা শুনলে মনে হয় ঠিক সময়ে এ-রকম ঠিক-ঠিক গানগুলা ওরা ক্যামনে গেয়ে ফেলল!
Film Title: Once ।। Released Year: 2007 ।। Genre: Drama, Music, Romance ।। Duration: 1h 26 min ।। IMDb Score: 7.9/10 ।। Director: John Carney ।। Stars: Glen Hansard, Markéta Irglová ।। Music Score: Glen Hansard, Markéta Irglová, Interference (band) ।। Net profit approximately $23.3 million
রচনাটা ‘লাল জীপের ডায়েরী’ পত্রিকায় একবার ছাপা হয়েছিল জুলাই ২০১৪ সনে।
… …
- দেয়ার ওয়াজ আ মোমেন্ট : ফার্নান্দো পেসোয়া || আনিকা শাহ - January 20, 2021
- চেস্টার বেনিংটন, লিঙ্কিন পার্ক : এলিজি কিংবা ইউলোজি || আনিকা শাহ - August 5, 2017
- ওয়ান্স : স্ট্রিট-স্যং অথবা আর্বান মিজ-অঁ-সিনের গীতমালা || আনিকা শাহ - July 27, 2017
COMMENTS