মারি সেলভারাজ নির্মিত কারনান তামিল তথা দক্ষিণ ভারতের ছবিকে বোধ করি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল! মহামারির কঠিন সময়ে ছবি রিলিজ করে বাণিজ্যসফল হওয়ার চ্যালেঞ্জে পাশ যাওয়া দক্ষিণী ছবির বেলায় অবশ্য বড় ঘটনা নয়। গল্প আর নির্মাণকুশলতার গুণে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের আঞ্চলিক সিনেমায় দক্ষিণ নিয়মিত বড় হিট দিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক, স্বাভাবিক সময়ে রিলিজ হলে শত কোটির ঘর পার করতে নির্মাতাকে অপেক্ষায় থাকতে হতো না, মুক্তির মাসখানেকের মধ্যে সালভারেজ হয়ত ম্যাজিক ফিগারটা ছুঁয়ে ফেলতেন। দর্শককে দেখতে বাধ্য করার যেসব গুণ তামিল বা দক্ষিণী সিনেমার পরিচালকরা একপ্রকার সহজ অভ্যাস বানিয়ে ফেলছেন নির্মাণকুশলতার গুণে কারনান তাকেও ছাড়িয়ে গেল বলেই মনে হয়েছে।
দ্রাবিড় সভ্যতার অবক্ষয়ের কালে আর্যপ্রভাবের জের ধরে বর্ণপ্রথা ভারতবর্ষে নতুন অঙ্গে ভাষা পেতে শুরু করে। সমগ্র ভূবর্ষ সে-নিগড়ে কমবেশি বাঁধা পড়লেও দক্ষিণ ভারতে সমস্যাটি আজো প্রকট হয়েই বিদ্যমান। দক্ষিণে নির্মিত সিংহভাগ ছবিতে জাতপাত আর সামাজিক ভেদাভেদের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যকে নির্মাতারা ফিরে-ফিরে ব্যবহার করে থাকেন। মালায়ালাম ভাষায় নির্মিত স্যানাল কুমার শশীধারণের এন অফ ডে গেম-এর কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়। বর্ণপ্রথা যে ভারতীয় সমাজে কতটা ভৌতিক ও ভয়ানক হতে পারে তার ধারণা পেতে এই একখানা ছবি বোধ করি যথেষ্ট। শশীধারণের ছবিখানা বর্ণপ্রথায় নিহিত ব্রাহ্মণ্যবাদ ও তার সংস্কারকে কেবল উপজীব্য করেনি, সমস্যাটি জিইয়ে রাখার পেছনে রাষ্ট্রসংঘের নপুংসক চরিত্রকে নির্মাতা বিদ্রুপবাণ হেনেছিলেন। ছবিটা খানিক অফবিট ঘরানার ছিল এবং অধিক দর্শক সেটি দেখেছেন বলে মনে হয়নি। যদিও যারা দেখেছেন তারা নির্মাতার গুণগান গাইতে কৃপণতা করেননি। কারনান এদিক থেকে শশীধারণের ছবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমজনতার কাছে পৌঁছানোর হিসাবকিতাব মাথায় রেখে গল্পের ছক বোনা হলেও আড়াই ঘণ্টার ছবিতে কোথাও একফোঁটা বাড়তি মেদ বা পৃথুলতা চোখে পড়ে না। গল্প জোরালো এবং এইবেলা তার সারাংশটুকু বলে নিতে চাই :—
তামিলনাড়ুর পাশাপাশি দুটি গণ্ডগ্রাম মেলুর ও পেডিয়াকুলাম। প্রতিবেশী দুই গ্রামবাসীর শহরে যাতায়াতের জন্য একটাই বাস–স্টপেজ এবং সেটা মেলুর-এ। পেডিয়াকুলামে কোনো বাস বিরতি দেয় না। শহরে কাজকামের জন্য যেতে হলে মেলুর গিয়ে বাসটা ধরতে হয়। স্ট্যাটাস ও ফুটানির প্রশ্নে মেলুরবাসী আবার নিজেকে প্রতিবেশীর চেয়ে উঁচা বলে ভাবে। বাস ধরা নিয়ে পেডিয়াকুলামবাসীর সঙ্গে তাদের খিটিমিটি লেগেই থাকে। এই এক বাস সমস্যার কারণে পেডিয়াকুলামরা সকল দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। তারা চায় তাদের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে যাক, শহরে চাকরি ও ব্যবসা জুড়ুক, কিন্তু মেলুর হয়ে বাস ধরার ঝক্কি আর তার ফোকর গলে মেলুরবাসীর ফুটানি ও লাগাতার খোঁচাখুঁচি তাদেরকে পীড়া দিয়ে যায়। মহাভারত-এর সূতপুত্র কর্ণের নাম এবং গুণধারী ধানুশ অর্থাৎ কারনান পেডিয়াকুলামের জোয়ান তেজি ছোকরা। সাহসী, প্রতিবাদী ও সকল কাজের কাজি হলেও ভীষণ রাগী আর একরোখা একখানা চরিত্র সে। এই অবিচার তার সহ্য হয় না। ছবির কাহানি কারনানকে কেন্দ্র করেই অগ্রসর হতে থাকে। তার একের পর এক দুঃসাহসী কাণ্ড অবশেষে গোটা গ্রামকে সাহসী, প্রতিবাদী ও একজোট করতে সক্ষম হয়।
বাস–স্টপেজের ন্যায্য দাবি আদায়ের সঙ্গে গরিবি আর নিচু জাতের খোঁটাকে জন্মের মতো পয়দলে পিষতে পেডিয়াকুলামবাসী ভয়কাতুরে স্বভাব ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে স্বয়ং রাষ্ট্রসংঘের পেটোয়া বাহিনি অর্থাৎ পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। উঁচা জাতের গরবে অন্ধ এসপি কান্নাভিরান বাস ভাঙচুরের তদন্তে নেমে পেডিয়াকুলামের গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরব্বিদের পুলিশস্টেশনে হেনস্থার একশেষ করে ছাড়ে। প্রতিক্রিয়ায় কারনান তার দলবল নিয়ে পুলিশস্টেশনে তাণ্ডব চালায় ও মুরব্বিদের উদ্ধার করে আনে।
পেডিয়াকুলামের প্রথা অনুসারে কারনান হচ্ছে দুষ্টের দমনে তাদের লোকায়ত দেবী যে-তরবারি ব্যবহার করতেন সেই তরবারির বর্তমান উত্তরাধিকারী। তরবারির উত্তরাধিকার ঠিক করতে গ্রামে বিশেষ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। মন্ত্রপূত ও হলুদ মাখানো জীবিত মৎসকে শূন্যে ছুড়ে দেওয়া হয়। পাহাড়শৃঙ্গ থেকে ঝাঁপ দিয়ে যে-বীর এই মৎস্যকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারে তাকে দেবী কর্তৃক নিযুক্ত গ্রামরক্ষক হিসেবে সকলে মেনে নেয়। কারনান অদ্য সেই সাহসী বীর এবং গ্রামবাসীর অখণ্ডতার প্রতীক। তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে গ্রামের সকলের কমন দাদু ইয়ামা রাজা ওরফে যম রাজা।
ওদিকে মিলিটারি ফৌজে কারনানের চাকুরে হওয়ার সুযোগ আসে। এই প্রথম গ্রামের কেউ সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছে। গ্রামবাসীকে রাষ্ট্রসংঘের হাতে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে ফৌজে যোগ দিতে আপত্তি ঠুকে বসলেও সকলে অনুরোধ-উপরোধ করে তাকে ফৌজ হতে পাঠায়। কারনানের গ্রাম ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নাভিরান পুলিশস্টেশন ভাঙচুরের অজুহাতে গ্রামে হামলা করে বসে। রাষ্ট্রসংঘের পেটোয়া বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার প্রতিরোধ করতে না পারার দুঃখে যম রাজা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে জীবনর ইতি টানে। কারনানকে অগত্যা ফৌজে যোগদান স্থগিত রেখে গ্রামে ফিরতে হয় এবং অবশেষে তার হাতেই দানব কান্নাভিরানের পতন ঘটে।
পুলিশ–কমকর্তাকে হত্যার দায়ে কারনানের দশ বছরের কারাবাস ঘটলেও পেডিয়াকুলামবাসী পাকা রাস্তা সহ বাসস্টপেজ আদায় করতে সক্ষম হয়, যার দৌলতে তাদের জীবনধারা পাল্টে যেতে শুরু করে। আর ওদিকে দশ বছর জেল খেটে কারনান বীরের বেশে গ্রামে ফেরত আসে। লোকায়ত দেবী যিনি ছবির পটভূমি জুড়ে অসূরবিনাশী শক্তির প্রতীক রূপে বারবার দেখা দেন কারনান-এর জয়গাথায় তাকে প্রীত ও নির্ভার হতে দেখে দর্শক।
ঠাসবুনোট কাহিনিটি নিজগুণে মনোজ্ঞ। দৃশ্যায়ন বা সিনেমাটোগ্রাফি সোজা কথায় চমৎকার! ক্যামেরার শৈল্পিক ব্যবহারে মারি সেলভারাজের কুশলতাকে কুর্নিশ যেতে হয়। লোকায়ত দেবীকে মোটিফ রূপে ব্যবহার ও কাহিনির ধারাবাহিক ছন্দে তার উপস্থাপনা মনে অপূবর্তা বহায়। লোকায়ত দেবীকে ক্যামেরায় ধারণের দৃশ্যায়নে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে চকিত মনে পড়ে। সিকোয়েন্স অনুসারে লং ও টপ শটের চমকপ্রদ ব্যবহার সাম্প্রতিক কোনো বলি বা দক্ষিণী মশালা ছবিতে দেখেছি বলে স্মরণ হয় না। লোকসংগীত ভাষার বেড়াজাল তুচ্ছ করে শ্রবণসুখকর। আবহসংগীত পরিমিত ও গল্পের সঙ্গে অঙ্গীভূত। এই ছবি তার চমকপ্রদ সিনেমটোগ্রাফির কারণে আপনা থেকে দর্শককে ঠায় বসিয়ে রাখে। প্রধান চরিত্রে ধানুশ নিজের ক্ষমতার প্রমাণ আবারো রেখেছেন। তামিল তাদের নয়া রজনীকান্তকে পেয়ে গিয়েছে বলা চলে।
আড়াই ঘণ্টা ধরে বোনা সিনেভাষার চমৎকারিত্ব নিহিত তার টানটান সুষমতায়। মিথের ব্যবহারে ছবিটি নিপুণ ও নতুন আঙ্গিকের প্রবর্তক। বর্ণপ্রথাকে পাঠের ক্ষেত্রে ভাবনা উদ্রেককারী। ক্লাস কনট্রাস্ট বা শ্রেণি-বৈপরীত্যের জায়গা থেকে বিচার করলে রাজনৈতিক। পেডিয়াকুলামবাসীর জীবন চিত্রায়নে মধুর। গ্রামের ভূপ্রাকৃতিক অবয়ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে ক্যামেরার ব্যবহার সিনেমাটিক। প্রেম রয়েছে এবং সেটা উপমাহদেশের সিনেভাষায় কমবেশি এখনো সক্রিয় ছ্যাবলামিগুলা ছাড়াই বেশ মিঠা-মিঠা লাগে। অভিনয়ে বাহুল্য বা অতিরঞ্জন একদম নেই। প্রত্যেকে নিজের চরিত্রে সতেজ ও পরিমিত। ছবিটিকে বহুরৈখিক তল থেকে পাঠ যাওয়া সম্ভব এবং সেটাই তার শক্তি। মারি সেলভারাজের ব্যতিক্রম নির্মিতি দূর ভবিষ্যতে ধ্রুপদি হওয়ার গুণ ধরে বটে।
দক্ষিণী সিনেমা কতটা বদলে গিয়েছে বা যাচ্ছে সেটা লিজো হোসে পেলিসারির জালিকাট্টু, জিতু জোসেফের দৃশ্যম-১ ও ২, থিয়াগারাজন কুমাররাজার অরণ্যকাণ্ডম ও সুপার ডিলাক্স, মহেশ নারায়ানের মালিক, দিলিশ পোতানের থন্ডিমুথালাম দৃকসাশিয়াম (প্রধান ও তার সাক্ষী), জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখরের থালাইভা ইত্যাদি দেখতে বসলে মালুম না হয়ে পারে না। আমজনতার সিনেভাষাকে নিজের আটপৌরে জীবনের চৌহদ্দিতে ধারণের যে-ঐতিহ্য ওই অঞ্চলজুড়ে রয়েছে সেটাই এখন তাকে নতুন অঙ্গে স্বকীয়তা অর্জনের শক্তি সরবরাহ করে চলেছে। ছবির-পর-ছবি প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে দর্শকের মন হরণের জন্য নায়ক-নায়িকার প্রেমের নামে ছ্যাবলামি, অকারণ ভাঁড়ামি, অনাবশ্যক অতিআবেগ, স্বল্পবসনা নায়িকা আর খুল্লামখুল্লা আইটেম-স্যং অতি-আবশ্যক মোটেও নয়। গল্পটা জোরালো হওয়া চাই আর নির্মিতির মধ্যে নতুন ভাবনা ও কারিগরি কুশলতা থাকাটা জরুর। ওই দুইটা জিনিসের মিলন ঘটাতে পারলে বাদবাকি কান টানলে মাথার মতো ছবির অঙ্গে জুড়ে যায়।
বলিউডের সিনেঘরানায় নতুনত্বের হাওয়া লাগলেও একখানা কারনান সেখানে চাইলেও তৈরি করা সহজ নয়। এর শক্ত রাজনৈতিক বার্তাকে ধারণের হ্যাডম সেখানকার পরিবেশে আজো দাঁড়াবার মাটি খুঁজে বেড়ায়। ছবিখানা দেখতে বসে মনে বিষাদ ভর করেছিল ভেবে আমরা তাহলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এখন? সিনেমায় আছি নাকি অন্যত্র হুঁশ হারিয়েছি? দেশে তোলপাড় হয়ে যাওয়া কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলন-এর ঘটনা ছবিটি দেখার সময় চোখে ভাসছিল। বামদের হল্লাগল্লার পর ওটা নীরব হয়ে গিয়েছিল। কানসাট নিয়ে কোনো ছবি আজো কি তৈরি হয়েছে? অথবা এ-রকম আরো কত ছবিই তো তৈরি হতে পারত দেশে! বাংলাদেশে সিনেমা হয় এ-কথা কেন জানি মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে মন ওঠে না।
সিনেভাষার সাতকাহন আগের পর্ব
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS