সিনেভাষার সাতকাহন ৬  || আহমদ মিনহাজ  

সিনেভাষার সাতকাহন ৬  || আহমদ মিনহাজ  

রেহানা মরিয়ম নূর  কি দেখে ফেলেছেন? শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন শুনলাম। টোরেন্টে আগেই দেখে ফেলায় আমি আর খবর নেইনি। গেল সপ্তায় বন্ধুজন জাভেদ বাসায় এসেছিলেন। তার সঙ্গে বসে আরেকবার দেখলাম। ফিরতি দেখায় মনে হলো তরুণ নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের সিনেভাষা আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা রাখে। সাধারণ দর্শককে গণমাধ্যমে দু-চার কথায় ছবিটি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখেছি। ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে নাকি বিস্তর কথাবার্তা চলছে। কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ঘুরে আসা সিনেভাষার ইতিনেতি ব্যবচ্ছেদ করে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা অনেকে লিখেছেন। গুগল ঘেঁটে তার কিছু নমুনা চোখে পড়েছিল। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা অধিক হলেও কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে আলোচক ছবিটিকে নিতে পারেননি। সাদের কাহিনি ও নির্মাণশৈলী তাদেরকে হতাশ করেছে। দর্শক প্রতিক্রিয়ার নির্যাস দ্বিতীয় দফা রেহানা দেখার পর থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের ভাবনা যাচাইয়ের তাগিদ ভিতরে টের পাচ্ছিলাম। মূলত সেই তাড়না থেকে লেখাটির উৎপত্তি।

রেহানা মরিয়ম নূর সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া একাধিক কারণে ছবিটির সপক্ষে গিয়েছে। তির্যক সমালোচনার জায়গা থাকলেও ওদিকে যেতে মন চায়নি। সাদের ব্যাপারে দেশের কুলীন নির্মাতাদের কারো-কারো নিস্পৃহতা আর অযাচিত মন্তব্যে তাঁকে খেলো প্রমাণের খবর কানে এসেছে। শুনে ভালো লাগেনি। ছবির নেতিবাচক দিকগুলো আলটপকা এইসব মন্তব্যের কথা ভেবে লেখায় উপেক্ষা করেছি। ইতিনেতির বাইরে বসে রেহানায় গুঞ্জরিত সিনেভাষার পাঠ-ব্যবচ্ছেদের ভাবনা মনে তীব্র হয়েছিল। ছবিটি পরিচালক কী ভেবে বানিয়েছেন সে তো বলতে পারব না, তবে হ্যাঁ, নিজের উপলব্ধির জায়গা থেকে আমি তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছি। দর্শক হিসেবে মুক্তপাঠ বা মুক্তক্রীড়ার সুযোগ নিয়েছি বলতে পারেন। ব্যস্ত রয়েছেন জানি, তবু পাঠের সময় বোঝাবুঝির জায়গাগুলো ধরতে পারবেন আশা করি। ছবিটি যদি দেখে থাকেন তবে আপনার প্রতিক্রিয়া যোগ করলে উপকার হয়। নিজের ভাবনা ও মতামতে গলদ থেকে থাকলে এই সুবাদে সেগুলো শুধরে নেওয়া যাবে।

সাদ স্বয়ং এবং তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে যাঁরা আওয়াজ তুলেছেন তাঁরা সকলে মিলে এই রচনাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করলেন! কতটা কী বোঝাতে পেরেছি জানি না! বক্তব্য একপেশে হয়ে গেল কি-না সে-বিষয়েও নিশ্চত নই। কিছুদিন বাদে হয়ত বোঝা যাবে। পরিমার্জনায় তখন বাধা থাকবে না। রজার ইবার্ট হরহামেশা কাজটি করে থাকেন। বহু ছবির ব্যাপারে তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া পরে বদলে যেতে দেখেছি। মুগ্ধতা বেড়েছে নয়তো পূর্বমুগ্ধতা ছাটাই করা প্রয়োজনীয় ভেবেছেন। মত পরিবর্তন বা শুধরে নেওয়ার অভ্যাসকে এক্ষেত্রে আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়।

জ্যাকুয়াস রিভেত্তির দ্য বিউটিফুল ট্রাবলমেকার-এর কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ছে। রংতুলির রসায়নে ক্যানভাসে যারা চিত্রকলার জন্ম দিয়ে থাকেন তাদের মনোজাগতিক টানাপোড়েনকে যেসব পরিচালক সিনেভাষার উপজীব্য করেছেন তাদের মধ্যে রিভেত্তির চার ঘণ্টার ছবিটি অন্যতম। দেখতে বসলে চুম্বকের মতো ধরে রাখে। আমি বেশ ক’বার দেখেছি। রিভেত্তির ব্যাপারে ইবার্টের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক ছিল। ভালো ও বুদ্ধিদীপ্ত নির্মিতি হিসেবে ছবিটির প্রশংসা করেছিলেন, তবে রিভেত্তি সাবলাইম  কিছু ঘটিয়ে বসেছেন এমনটা তাঁর মনে হয়নি। পরে মত পাল্টে ব্যক্তিগত প্রিয়র তালিকায় একে স্থান দিয়েছিলেন। সাদের রেহানার বেলায় অনুরূপ ঘটা বিচিত্র নয়। ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হতেও পারে। রেহানাকে নিয়ে লিখতে যদিও ভালোই লেগেছে। সে যাই হোক, ভূমিকায় দাঁড়ি টেনে এইবার আগে বাড়ি।


সিনেমার বিশ্ববাজারে যেন ঢুকতে পারে সেকথা মাথায় রেখে তরুণ নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তাঁর ছবির কাহিনিকে পর্দায় ভাষা দিয়েছেন;—রেহানা মরিয়ম নূর প্রথমবার দেখতে বসে কথাটি মনে উঁকি দিয়েছিল। ফিরতি দেখায় পূর্বধারণায় সন্দেহ না রাখাটাই যৌক্তিক মনে হচ্ছে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান করে নেওয়ার ফলে নির্মাতার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলা যায়। একে নেতিবাচক ভাবার অভিপ্রায় অধমের নেই। বাংলাদেশে সিনেভাষার সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় সাদের ছবির বিশ্ববাজারে প্রবেশকে ইতিবাচক ঘটনা গণ্য করা উচিত। এতে করে দেশি দর্শককে ছবিটি দেখার ব্যাপারে তিনি উৎসাহী করে তুলতে পেরেছেন। মাটির ময়না-র পর রেহানা হচ্ছে দ্বিতীয় নির্মিতি যার প্রতি দর্শক আগ্রহের পারদকে ঊর্ধ্বগামী মনে হয়েছে।

কান  চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ঘুরে না এলে বাংলাদেশে এই ছবির ভাগ্যে কী জুটত তার আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়। দেশে এখন মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা দর্শক টানতে পারে না! এমতাবস্থায় মূলস্রোতের বাইরে বসে বানানো ছবি দেখতে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন সে- ভরসার জায়গা তামাদি হয়ে গিয়েছে। রেহানা মরিয়ম নূর  দেখার জন্য দেশি ভাইবোনদের আগ্রহী করে তোলার কাজকে অগত্যা পাহাড় ঠেলার শামিল ভাবাই যুক্তিযুক্ত। সিনেমার দর্শক কীভাবে তৈরি করা যায় এই ভাবনায় লবেজান ফিল্ম সোসাইটি দিয়ে কাজের কাজ কিছু হয়নি। সিনেভাষার নিবিড় পাঠ ও আলোচনায় শৈল্পিক সিনেমার পাশাপাশি মূলধারার সিনেমাকে প্রাসঙ্গিক করার কাজে সোসাইটিওয়ালাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো ঘটনা নয়। এফডিসি কেন্দ্রিক ঢাকাই সিনেমা অধঃপাতে যায় দেখে একে অবহেলা আর বিদ্রূপবাণে নাকচ করতেই উনারা একসময় দিনরজনী পার করেছেন। ভালো সিনেমার দর্শক তৈরির নামে কতিপয় আঁতেল প্রসব করা ছাড়া ফিল্ম সোসাইটির অবদান ঠিক কোথায় সেটা অধমের বুঝে আসে না।

বাংলা সিনেস্ফিয়ারের  এইসব ক্যারিকেচার সাদের নজর এড়ায়নি বোঝা যায়। দেশি চলচ্চিত্র শিল্পের দুর্দিনে নিরীক্ষাপ্রবণ সুনির্মিত ছবির ভাগ্যে কী জুটতে পারে সেকথা মাথায় রেখে রেহানাকে তিনি ক্যামেরায় ভাষা দিয়েছেন। নিজের প্রথম ছবি লাইভ ফ্রম ঢাকা-র অভিজ্ঞতা সেক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে মনে হয়। রেহানায় তিনি ভেবেচিন্তে পা বাড়িয়েছেন। চলচ্চিত্রের বিশ্ববাজারে প্রবেশ করা ছেলেখেলার বিষয় নয়। সৃজনশীল ভাবনা আর কারিগরি কুশলতার সঙ্গে সিনেমার বিপণনকে সেখানে পড়তে জানতে হয়। পেশাদারীত্ব ছাড়া ভিনদেশি দর্শকের কাছে নিজের ছবিকে পৌঁছানো কঠিন। কান-র মতো উৎসব আর সিনেমার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যাতায়াতে অভ্যস্ত জেরেমি চুয়াকে ছবির প্রযোজক হিসেবে পাওয়াটা যারপরনাই ইতিবাচক ফল দিয়েছে।

রেহানাকে পর্দায় অবমুক্ত করার পেছনে অনিশ্চয় দিনরজনী ও কাঠখড় পোহানোর গল্প নিশ্চয় রয়েছে। বাঁধন তার দু-চার টুকরো গণমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। নিজেকে আড়ালে রাখতে অভ্যস্ত সাদ ও ছবির কলাকুশলীরা সেইসব গল্প কোনো একদিন হয়ত করবেন। চলচ্চিত্র ব্যয়বহুল শিল্পমাধ্যম। তাকে শক্ত মাটির ওপর দাঁড় করাতে হলে দেশি ও বিশ্ববাজারের সঙ্গে ছবিওয়ালার পেশাদার সংযুক্তির বিকল্প নেই। তরুণ নির্মাতা সাদকে এই জায়গায় অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখতেই হচ্ছে।

চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক আবহে বাংলাদেশের নির্মাতাদের যাতায়াত অনিয়মিত হওয়ার কারণে মূলধারার বাইরে মুক্তি পাওয়া সৃজনশীল চলচ্চিত্রের দর্শক গড়ে উঠেনি। আরববিশ্বের তুরন্ত গতিতে আগুয়ান সিনেমাশিল্পের নজির এ-প্রসঙ্গে টানা যেতে পারে। গেল কয়েক দশকে আরব সংস্কৃতির ছায়ায় নির্মিত সিনেমার বিশ্ববাজারে প্রবেশের প্রবণতাকে গোনায় নিলে বাংলাদেশকে সেখানে শিক্ষানবিশের মতো দেখায়। মিশর-লেবানন-তিউনিসিয়া-আলজেরিয়া-প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল আগে থেকেই ছিল, ইদানিং সিরিয়া, মরক্কো বা সৌদি আরবের মতো দেশ সেখানে শামিল হয়েছে। কান-ভেনাস-বার্লিন আর অস্কারে তাদের যাতায়াত মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা বলা চলে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের লক্ষ্যে বানানো ছবিগুলোর সাফল্য ওদিকে সেখানকার মূলধারার ছবিতে ছাপ ফেলতে শুরু করেছে।

আরববিশ্বের ছবি দেখতে বসলে দুটি বিষয় চোখে পড়ে। হলিউড ও ইউরোপের পেশাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে ছবি তৈরিতে নির্মাতারা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এই সুবাদে সুনির্মিত ছবির সংখ্যা গেল দুই দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওমর বা প্যারাডাইজ নাউ-র নির্মাতা হানি আবু-আসাদকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কৌতুক-পরিহাসমুখর ইলিয়া সুলেমানের পরে প্যালেস্টাইনের সিনেভাষাকে নতুন উচ্চতায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রয়েছে। প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলকে আসাদ নিজের ছবিতে অহরহ বাঁধাই করছেন। অন্যদিকে হলিউডে বসে দ্য মাউন্টেইন বিটুইন আস-এর মতো দর্শক-মনোরঞ্জক ব্যবসাসফল ছবি তাঁকে বানাতে দেখা যায়।

সংযোগটি আরব অঞ্চলের সিনেভাষাকে গতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। নারী নির্মাতাদের উঠে আসা এর মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে সুখকর ঘটনা। নাদিন লাবাকি, হাইফা আল মনসুর, কাউথার বেন হানিয়া, এ্যানিম্যারি জাকির, সেলমা বেকার, মৌফিদা ত্রতলি বা রায়হানা ওবারমিয়্যার-র নাম চটজলদি মনে পড়ে এবং এরকম আরো রয়েছেন। স্বকীয়তা ধরে রেখে বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতায় নিজেকে পাকাপোক্ত করতে বিশ্বের নামকরা নির্মাতাদের সঙ্গে সংযোগ তাঁরা দৃঢ় করেছেন। মূলধারার পাশাপাশি সৃজনশীল চলচ্চিত্রের পথ পরিক্রমায় ঝুনা নারিকেল হলেও বাংলাদেশের সিনেমার সাফল্য সেই নিরিখে গোনায় আসে না। সাদের ছবির ইতিনেতি সম্পর্কে দুকথা বলার ক্ষণে দেশি চলচ্চিত্রের এইসব সীমাবদ্ধতা মনকে পীড়া দিয়ে যায়।

আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের বানানো ছবিটি নারী পরিচালকের হাত ধরে বেরিয়ে আসতে পারত! দুর্ভাগ্যই বটে, বাংলাদেশে মূলধারা ও সৃজনশীল চলচ্চিত্রে নারীনির্মাতা বিশেষ চোখে পড়ে না। দূরবীন লাগিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া ভার হয়। দেশের আর্থসামাজিক পালাবদলে নারীসমাজ যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছেন কিন্তু বিগত তিন দশক ধরে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির অবনয়ন ও অবদমনের ছাপ তাদের ওপর গভীর প্রভাব রেখেছে। নারী চলচ্চিত্র নির্মাতার অভাব সেই ইশারা দিয়ে যায়। রেহানা মরিয়ম নূর-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে যাত্রা ও আনসার্টেন রিগার্ড-এ স্থান পাওয়ার খবর যে-কারণে সাফল্যবুভুক্ষু জাতিকে ছবিটি সম্পর্কে আগ্রহী করেছে। চলচ্চিত্রের বিশ্ববাজারে এমন এক সময়ে তিনি প্রবেশ করলেন যখন মূলধারার ছবি নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছে। ওদিকে নামসর্বস্ব বিকল্পধারার সৃজনশীল চলচ্চিত্র সরকারি অনুদানে বেঁচেবর্তে থাকার প্রাণপণ চেষ্টায় লিপ্ত! সব দেখেশুনে মনে হয় দেশের সিনেমায় আশি ও নব্বই দশকটা এখনো ফুরায়নি!

বিকল্পধারায় বসে নির্মিত সৃজনশীল চলচ্চিত্রের কোনোটাই এখন আর বিশ্বের কোথাও সরকারি অনুদানের আশায় হাত পেতে বসে থাকে না। ছবিগুলোর আলাদা দর্শকশ্রেণি কালের ধারায় গড়ে উঠেছে। মূলধারার লগ্নিকার পেশাদার মেজাজে সেখানেও পুঁজি খাটায়। এত বছর পার করলেও এফডিসিতে পয়দা হওয়া ঢাকাই ছবি বাংলাদেশের মাটিতে গভীর শিকড় ছাড়তে পারেনি। তার এই নাকামিয়াবির কারণে আপেক্ষিক কম বাজেট ও শৈল্পিক ভাবনাকে পুঁজি করে হলকাটতি ছবি বানানোর ভাবনা দেশে সবল হয়নি। একটি দেশে সৃজনশীল চলচ্চিত্রের বিকাশ মূলধারার ছবি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপরে নির্ভর করে। চেয়েচিন্তে পাওয়া সরকারি অনুদানের চেয়ে পেশাদার লগ্নি তাকে শক্ত মাটিতে দাঁড় করায়। চরম অপেশাদার এক পরিবেশে বসে তৈরি মাটির ময়না-র পর রেহানা মরিয়ম নূর হচ্ছে দ্বিতীয় প্রয়াস যেখানে শিল্পমান ধরে রেখে পেশাদার আঙ্গিকে ছবি বানানোর চেষ্টা চোখে পড়ে। সীমিত বাজেটের হলেও ছবির নির্মাণপ্রণালী সাম্প্রতিক সিনেমার যেমনটি হওয়ার কথা সেটা মাথায় রেখে বোনা হয়েছে। নেতিবাচক মন্তব্যের তোড়ে সাদের ছবিখানাকে যারা বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেন তাদের বোধ করি দেশি চলচ্চিত্রের সামগ্রিক অবস্থাকে পাখির চোখ করা উচিত।

অন্তর্জালের যুগে সিনেমার বহুমাত্রিক ভাষার সঙ্গে দেশের সচেতন দর্শকের পরিচয় নেই এমন তো নয়। বাইরের দেশে নির্মিত ছবির শিল্পমান ও কারিগরি উৎকর্ষ দেশি সিনেমায় ধারাবাহিক না হওয়ার দোষে কি সাদের নিরীক্ষাপ্রবণ ছবিকে তারা নাকচ করলেন? বাংলাদেশে নারীকুলের জীবনে সংঘটিত অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার কীভাবে করা যায় সেদিকে না গিয়ে অস্বস্তিকর নীল রংয়ের বৃত্তে রেহানার প্রতিবাদকে পরিচালক গোর দিয়েছেন;—ছবিটি দেখার পর সিংহভাগ দর্শক কমন  এই অভিযোগটি তুলেছিলেন। প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল বর্গ থেকে আসা নারী-প্রগতির বয়ানে তাঁকে নির্ভার থাকতে না দেখে অনেকে নাখোশ হয়েছেন। সাদের অভিপ্রায়  সেক্ষেত্রে তাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়েছে। নারী-প্রগতির পরস্পরবিরোধী বয়ানগুলোকে একত্রে মিশিয়ে জগাখিচুড়িমার্কা রেহানাকে পর্দায় হাজির করার অভিযোগ যারপরনাই বাংলাদেশে ছবিটির প্রিমিয়ারের দিন থেকে চলছে। রেহানা মরিয়ম নূর-এর সিনেভাষায় প্রবেশ যাওয়ার ক্ষণে এইসব অভিযোগকে সঙ্গী করা দরকারি বটে!

অভিযোগ আরো রয়েছে। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায় তাদের অনেকেই ছবির কাহিনির সঙ্গে নিজেকে স্বচ্ছন্দ ভাবতে পারেননি। রেহানার আপসহীন মনোভাবকে স্ববিরোধী ও অতিরঞ্জিত বলেই তারা দাগিয়েছেন। সিনেআলোচকদের অনেকে আবার রং অর্থাৎ কালার ফিল্টারিংয়ের একঘেয়ে প্রয়োগ ও কারিগরি কুশলতায় নতুনত্ব চোখে না পড়ার অভিযোগটি তুলেছেন। নারী-স্বকীয়তার সারবত্তা উপলব্ধিতে পরিচালক গলতির পরিচয় দিয়েছেন বলেও অনেকে মত দিয়েছেন। অভিযোগগুলো কতখানি প্রাসঙ্গিক তার উত্তরে বলতে হয় পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ওপর সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিকার নিয়ে লেকচার ঝাড়ার খাসলত থেকে পরিচালক নিজে বিরত থাকার চেষ্টা করেছেন। আঁতেলমার্কা বক্তিমার পরিবর্তে নারীর একগুয়ে প্রতিবাদকে ঘিরে ঘনীভূত সমস্যাকে পর্দায় প্রাণ দেওয়ার বিষয়টি তাঁর কাছে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ে বিচরণের সময় প্রতিবাদী নারীকে যেসব বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তার একখান রাগী সংস্করণ রেহানায় দর্শক দেখতে পায়। অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে গেলে এর প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি সচরাচর কেমন হয়ে থাকে সেই নমুনা সাদ সিনেপর্দায় তুলে আনেন। দৃশ্যায়নের ধাঁচটি সেখানে নারী-প্রগতির ন্যারেশনকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত তর্কবিতর্কের উৎসমুখ অবমুক্ত করে। সাদের ছবির পুরোভাগ জুড়ে ডাক্তার রেহানার প্রতিবাদ ও আপাত সংক্ষুব্ধ পরাজয়ের ইতিনেতি বিচারে দর্শকের মতভেদ ও বাদানুবাদকে অতএব অস্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। এ তাঁর কৃতিত্ব যে, সরল সমাধানের রাস্তা খোঁজার পরিবর্তে দর্শক-আলোচককে বিভ্রান্ত করা এবং একইসঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার উসকানিটা রেহানার সিনেবয়ানে আগাগোড়া রেখে দিতে পেরেছেন।

আপাতদৃষ্টে গভীর মানসিক উদ্বেগ ও অসুস্থতার শিকার রেহানার একরোখা জেদ দমবন্ধ ধূসর নীল রংয়ের বৃত্তে মাথা খুঁড়ে মরে। তার কর্মস্থল অ-সরকারি মেডিকেল কলেজ বা আরো স্পষ্ট করে বললে থার্ড ফ্লোরটা হচ্ছে সীমানা, এর চৌহদ্দি জুড়ে অষ্টপ্রহর বিচরণে পরিচালক তাকে বাধ্য করেন। দেখে মনে হয় রেহানা তো বটেই, দমবন্ধ নীল রংয়ের বৃত্তে বাংলাদেশের নারীসমাজের বিচরণ অন্তহীন কাল ধরে চলছে! থার্ড ফ্লোরের সীমানায় নির্মাতা সাদ রেহানাকে সেই-যে বন্দি করেন তারপর তাকে আর সেখান থেকে বেরুতে দেখা যায়নি। ধূসর নীল বৃত্তের পরিসীমায় আরো কিছু কক্ষ ও অলিন্দের আভাস ছবিতে পাওয়া যায়। রোগীদের ওয়ার্ড, ডাক্তার রেহানা ও আরেফিনের চেম্বার, ওয়েটিং স্পেস ও ওয়াশরুম, এক ফালি ক্যান্টিন, পরীক্ষার হল, লেকচার আর প্রিন্সিপালের কক্ষ, ঘোলাটে করিডোর ও বৃষ্টিস্নাত ব্যালকনির সঙ্গে আরেফিনের যৌননিগ্রহের শিকার এ্যানির হোস্টেলের কক্ষ ছবিতে ফিরে-ফিরে আসে। আউটার সারফেস নয় বরং কক্ষগুলোর ইনার সারফেস-এ ক্যামেরা স্থির থাকে। কক্ষের চারপাশ নজর করানোর ইচ্ছা থেকে সে বিরতই থাকে। কেন থাকে তার উত্তর কাহিনির বুনোট মাথায় নিলে অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। উত্তরটি যারা খুঁজে পাননি তাদের কষ্ট করে হলেও ছবিটি আরেকবার দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

কক্ষের ভিতরে ও বাইরে বসে যে-মানুষগুলো কথা বলে পরিচালকের ক্যামেরা কেবল তাদের দিকে তাক করা থাকে। মানুষের মুখ ছাড়া দ্বিতীয় অনুষঙ্গকে জায়গা দিতে অপারগতা রেহানা মরিয়ম নূর ছবির বড়ো বিষয়। ক্লোজশটের বাড়াবাড়ি দেখে অনেক দর্শক নির্মাতার ওপর ঝাল ঝেড়েছেন। বাড়াবাড়িটা একঘেয়ে হতে পারে কিন্তু অকারণে ঘটেনি। ক্যামেরা সঞ্চালনে সাদের তরিকাটা এখানে একান্তভাবে ইচ্ছাকৃত। সিনেপর্দায় শ্বাসরোধী বা সাফোকেটেড হাইপ তৈরির জন্য পরিচালক এটা প্রয়োগ করেন। শুরুতে এই সাফোকেশন দর্শকের ওপর ভার হয়ে চেপে বসলেও কাহিনির গতির সঙ্গে পা মিলিয়ে সংলাপ যত আগায় তারা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকে। সাফোকেশন-র ঘটনা সেক্ষেত্রে ক্রমশ চোখে সয়ে যায়। বিশ্বের সিনেভাষা বিশেষ করে আর্টহাউজ ও আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমায় এরকম দৃষ্টান্ত খুঁজলে পাওয়া যাবে। রেহানার যে-গল্পটি পরিচালক ছবির পর্দায় তুলে আনতে চেয়েছেন তাকে অনুসরণ করলে উদ্দেশ্যমূলক এই অস্বস্তিকে অনাবশ্যক ভাবার যুক্তি গৌণ হয়ে পড়ে।

যা-ই হোক, কক্ষের প্রসঙ্গে ফেরত যাই। বাংলাদেশের সমাজে রেহানার মতো নারীদের ভবিতব্য বোঝাতে কক্ষগুলোয় পরিচালক বারবার ঢোকেন। ভবনের থার্ড ফ্লোর ছেড়ে ক্যামেরা ভুলেও বাইরের খোলা আকাশে গমন করে না। কক্ষ বা অলিন্দরা মিলেঝুলে একখানা ভবনের জন্ম দিলেও ক্যামেরায় এর ভিতর-বাহির তুলে ধরার ইচ্ছা তাঁকে আকুল করেনি। অনীহাটা যথারীতি সেখানে উদ্দেশ্যমূলকই থাকে। এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে রেহানার গমনাগমনের দৃশ্য ধারণে সাদ তাই বারবার বাধ সেধেছেন। ক্যামেরার মুভমেন্টকে সেখানে ছেটে ফেলতে দেখা যায়। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে গমনের পরম্পরা ভেঙে আশির দশকের প্যারালাল সিনেমা আর নব্বইয়ের ডগমা 95-র ধাঁচে বানানো ছবির মতো অনবরত কাট ও জাম্প করতে থাকেন। অস্বস্তিকর ক্যামেরা সঞ্চালনের তরিকায় একমাত্র নিশ্চিত ঘোষণা লিফটের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর;—কাহিনির কুশীলবরা থার্ড ফ্লোরে আছে একথা স্মরণ করিয়ে দিতে তার ভুল হয় না। সূত্রখানা যদি না থাকত তবে রেহানারা কার্যত কোথায় ঘুরছে তার হদিশ পাওয়া দর্শকের পক্ষে কঠিন হতো।

ধূসর নীল রংয়ের অস্বস্তিকর বৃত্তে বসে রেহানা ছাত্রছাত্রী পড়ায়। রোগী দেখে। মেয়ে ইমুর সঙ্গে মাঝেসাঝে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়া ও বাজারসদাই নিয়ে ভাই রনির সঙ্গে ফোনে বা সাক্ষাতে সাংসারিক আলাপ সারে। পরীক্ষার্থীকে নকলের দায়ে হল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটিয়ে বসে। রুটিন ছন্দে বাঁধা কাজগুলোর চাপে ত্যক্তবিরক্ত রেহানা এভাবে ডাক্তার আরেফিনের কক্ষে ছাত্রী এ্যানির যৌননিগ্রহের শিকার হয়ে বেরিয়ে আসার সাক্ষী বনে যায়। আরেফিনের কক্ষে কিছু একটা চলছে;—এই সন্দেহ তার অনেক দিনের। ছবির সূচনাভাগে কলিগের কক্ষের দরোজার সামনে তার দাঁড়িয়ে পড়া ও বন্ধ দরোজায় উন্মত্ত করাঘাত বুঝিয়ে দেয় সন্দেহটা তাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছে। অবশেষে এ্যানির যৌননিগ্রহ সেই সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে।

কলিগের ওপর অযাচিত গোয়েন্দাগিরিকে অনেক দর্শক অস্বাভাবিক বলে মত দিয়েছেন। তাদের মন্তব্য অবান্তর এমন নয় তবে ছবির কাহিনি ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় অধিক মূল্য ধরে না। কাহিনির পরম্পরা যে-রেহানাকে তুলে ধরেছে সেখানে তার সন্দেহপ্রবণ অস্থির উৎকণ্ঠাকে বরং এক পর্যায়ে স্বাভাবিক ভাবতে দর্শক বাধ্য হয়। খিটখিটে মেজাজের রেহানাকে সাইকো হিসেবেও অনেকে মার্কিং করেছেন। ছবির কাহিনির ওপর আলো ফেললে তাকে সাইকো ডাকার প্রাসঙ্গিকতাটি জোরালো থাকে কি? প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন, কেননা রেহানাকে সাইকো ভাবার যত আনুষঙ্গিক ছবির নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে সেগুলোকে পাঠ করার জায়গাটি সেখানে নিস্তেজ হয়ে আসে। এর অর্থ হলো দর্শক রেহানার ব্যাধিকে বড়ো করে দেখছেন কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার কার্যকারণ নিয়ে ভাবতে চাইছেন না! ছবির প্রতি পরতে কার্যকারণগুলো যদিও তাকে শিকার করবে বলে ওঁত পেতে থাকে!

রেহানার জীবনে এ্যানির অনুরূপ কিছু ঘটেছিল কি?—উত্তরে পরিচালক ঝেড়ে কাশেননি। হতে পারে এ্যানির অভিজ্ঞতা তাকে সইতে হয়নি। পুরুষের আচমকা  সুযোগ নেওয়ার অভিজ্ঞতা বিবর্জিত নারী অবশ্য জগতে খুঁজে পাওয়া ভার। নারীজীবনে সংঘটিত অসংখ্য আচমকার কোনো একটা রেহানার জীবনে ঘটেনি এই ভাবনায় তাই বিশ্বাস রাখা কঠিন। যদি ধরে নেই তার জীবনে এমন কিছু ঘটেনি তবু ওইসব আচমকার পরোক্ষ চাপ থেকে রেহাই পাওয়া কোনো নারীর পক্ষেই সম্ভব হয় না। তার চারপাশে এমন অভিজ্ঞতার শিকার মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়। রেহানা তাদের ব্যাপারে বিলকুল বেখবর সে তো আর হতে পারে না! বাংলাদেশের সমাজে আচমকা অভিজ্ঞতার বিপদআপদ সম্পর্কে মেয়েরা ছোটোবেলা থেকেই সচেতন হতে বাধ্য হয়। সচেতন হওয়ার অভিজ্ঞতাটি হয়ত অতিকায় চাপ হয়ে রেহানার মনে চেপে বসেছিল। তার সন্দেহপ্রবণ উৎকণ্ঠার এইসব গল্প বলা থেকে সাদ বিরত থেকেছেন এই যা। অনুমানের বিষয়টি তিনি দর্শকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

কর্মজীবী নারীর জীবনে পুরুষ সহকর্মী বা অফিসের বসকে নিয়ে সন্দিহান হওয়ার ব্যাপারখানা পৃথিবী জুড়ে অহরহ ঘটে। তফাত এটুকু, সন্দিহান নারীকুল রেহানার মতো সকল সময় সহকর্মী বা বসের দরোজায় করাঘাতটা করতে পারে না। দ্বিধা-ভয় ইত্যাদির সঙ্গে শালীনতার ঘোরপ্যাঁচ তাকে কাবু রাখে। সাইকো নামের দুর্নাম সয়ে রেহানা কাণ্ডটি ঘটিয়ে বসে। আরেফিন তার সহকর্মী হওয়ার কারণে ওটা সে পেরেছে। আরো ঊর্ধ্বতন কেউ হলে পারত কি-না এই ভাবনা ছবি দেখতে বসে মনে উঁকি দিয়ে যায়।

চেপে যাওয়ার সংস্কৃতি এখানে গণ্য কারণ। এর চক্কর সন্দিহান নারীকে তার সহকর্মী অথবা ওপরওয়ালার দরোজায় করাঘাত করা থেকে বিরত রাখে। স্মরণ রাখা ভালো, চেপে যাওয়ার প্রবণতা বিশ্বের সকল দেশকালে কমবেশি সুলভ। ক্ষমতাকেন্দ্রের রাজাধিরাজ হয়ে মানবসংসারে পুরুষরা আজো ছড়ি ঘোরাচ্ছে। নারীর পক্ষে তাকে শতভাগ বিশ্বাস করা যারপরনাই সম্ভব হয় না। সে কখন কী করে বসে এমতো শঙ্কার ঝড় হাজার বছরের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে নারীর রক্তের ভিতরে সহজাত সংস্কারে মোড় নিয়েছে। বেগানা পুরুষের সামনে ক্ষণে-ক্ষণে শাড়ির আঁচল বা উড়না ঠিক করার অভ্যাস থেকে নিষ্কৃতি লাভের কথা সে তাই ভাবে না। অরক্ষিত বিশ্বে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে পুরুষের চোখের ভাষা নজর করা তার বেলায় জরুর হয়। জগদ্দল সিস্টেমের ভিতর দিয়ে যাতায়াতের কারণে আচমকা আক্রমণের শিকার হওয়ার উৎকণ্ঠা বুকে পুষে আরো দীর্ঘ কাল তাকে এভাবে পথ চলতে হতে পারে। পরনারীর প্রতি পুরুষের সম্মানবোধ ও নৈতিকতা এই উৎকণ্ঠার অবসানে যথেষ্ট নয়। সম্মানবোধ ও নৈতিকতা হচ্ছে বালির বাঁধ। কখন কীভাব ভেঙে চুরমার হয় তার ঠিক নেই। রেহানার অভদ্র করাঘাত জগদ্দল সিস্টেমের আড়ালে সুরক্ষিত আরেফিনদের দরোজা ভাঙার শক্তি কেন রাখে না ছবিতে সাদ সেটা তুলে ধরেছেন। বার্তাটি বোধহয় দর্শক সেখান থেকেই পায়,—আরেফিনের মতো পুরুষকে সতর্ক ও বিচলিত করতে তার বন্ধ দরোজায় মর্বিড করাঘাত হানা ছাড়া নারীর রেহাই নেই।

আরেফিনের দরোজায় রেহানার করাঘাত প্রচলিত ছকে পুরুষকে ভয় দেখানোর অস্ত্র রূপে পরিচালক ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়নি। তাকে বিচলিত করার উদ্দেশ্যে অস্থির করাঘাতটা সে চালিয়ে যায়। ধার্মিক রেহানার নৈতিক শুচিবায় সেখানে ভূমিকা রাখে। সে হয়ত ভাবে,—বেহায়া লোকটিকে শায়েস্তা করতে হলে আগে তাকে বিচলিত করা প্রয়োজন। বিচলিত হলে তার ঘুমন্ত বিবেক ও অনুতাপ জেগে উঠতেও পারে। এ্যানির নিকট দুঃখ প্রকাশ আর পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়া ছাড়া তার তখন উপায় থাকবে না। আরেফিনের সঙ্গে ছবির মাঝ অবধি চলমান সংঘাতে এর বেশি প্রত্যাশা রেহানা করেনি। একগুয়ে হলেও সে কিন্তু বোঝে ক্ষমতাবলয়ে আরেফিনকে সুরক্ষিত রাখার পেছনে যত আনুষঙ্গিক সক্রিয় রয়েছে তাদেরকে ওভারনাইট পরাস্ত করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

করাঘাত করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবলয়ে আঁচড় কাটা যায় তবে তাকে উপড়ানো সম্ভব নয়;—ছবিতে সাদ এটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। ম্যারি ওলস্টোনক্রাফট বা বেগম রোকেয়ার নারী-স্বকীয়তার ওজন ধারণের ক্ষমতা রেহানার নেই। নিজেকে তাঁদের মতো কেউকেটা প্রমাণের স্বপ্ন কভু দেখেছে বলেও মনে হয় না। মৃত স্বামীর স্মৃতিকে দেহ থেকে মুছে ফেলার নারী-প্রগতি তাকে তাড়িত করেনি। স্বামী কেমন ছিলেন তার আভাস ছবি থেকে পাওয়ার কোনো উপায় সাদ রাখেননি। অকালমৃত স্বামীর সঙ্গে তার দাম্পত্যের ইশারা তিনি সেখানে ঊহ্য রাখেন। কেন রাখেন সেই উত্তর খোঁজার তাড়না ছবির আলোচনায় চোখে পড়েনি।

পরপুরুষের সঙ্গে রেহানার বিবাদের জায়গাটি নৈতিক শুচিবায়ে সংক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে অকালে খতম হওয়া দাম্পত্যের ভূমিকা ছিল কি? পরিচালক এ-সম্পর্কে টুশব্দ করেননি। স্বামী লোক ভালো ছিলেন বলে হয়ত রেহানা তার স্মৃতি অঙ্গে ধরে রাখে। দুজনের অম্লমধুর সম্পর্কের বাইরে আরো বহু ব্যাপার নিশ্চয় ছিল যারা তাকে পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে মানা করে। পরিবারে রোজগারে বলতে সে একা। সৎ বাপের ঘরে মেয়ে ইমুর ভবিষ্যৎ ভেবে বিয়ের কথা ভাবে না। রেহানা না ভাবলে কী হবে বাংলাদেশের পারিবারিক সংস্কৃতি তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেবে না একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নানামুখী চাপ সামাল দিয়ে সিঙ্গেল থাকার জেদ এদেশে ধরে রাখা ভীষণ কঠিন। সিঙ্গেল  থাকার কারণে রেহানাকে কত কী টিপ্পনি সইতে হয়েছে তার গল্প সাদ কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। ছবি দেখতে বসে দর্শকরা গল্পগুলো নিজের মতো করে মিলিয়ে নিক;—এরকম ভাবনা পরিচালকের মনে কাজ করে থাকতে পারে। কতজন মিলিয়েছেন সে অবশ্য ভিন্ন কথা।

এ-রকম যত স্পেস  পরিচালক ছবিতে রেখে দিলেন সেগুলো ভরাটের দায় দু-চারজন দর্শক ও আলোচকরা কাঁধে নিয়ে থাকতেও পারেন। বাকি যারা নিতে পারলেন না তারা পর্দা জুড়ে রেহানার আচরণ ও প্রতিবাদকে উদ্ভট আখ্যা দিয়ে দায়িত্ব চুকিয়েছেন। ঘটনাটি বাংলাদেশে নারীদের কী চোখে দেখা হয় সেই নমুনাটি তুলে ধরে। নারী-প্রগতির জোশে দিশেহারা এই দেশে সত্যিকারের নারীবাদী ডিসকোর্স  এখনো গড়ে ওঠেনি। সাদের ছবি তার কারণ বুঝতে সাহায্য করে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও সংঘাতকে বহুমাত্রিক আয়তনে ভাবার ঘটনায় সিনেবোদ্ধা থেকে আমজনতার দৈন্যকে সে প্রকট করে যায়!

পরিচালক যে-স্পেসগুলো ছবিতে গুঁজে দিয়েছেন সেগুলো ভরাট করা তাঁর জন্য কঠিন ছিল না। যৌক্তিক কারণে সাদ সেদিকে গমন করেননি। যদি গমন করতেন তাহলে রেহানার Intensive Fury বা সংক্ষুব্ধতার লেলিহান শিখা ছবিতে বজায় থাকত না। একটি মেয়ের দেহকে আচমকা ব্যবহারের হক বেগানা পুরুষ রাখে কি? নারী স্বয়ং যাকে ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে সে নিশ্চয় রাখে, কিন্তু মেডিকেল শিক্ষার্থী এ্যানির জীবনে আরেফিন তো সেরকম কেউ ছিল না! এ্যানি কি তবে নিজের দেহের আচমকা ব্যবহারে আরেফিনকে সংগোপনে সম্মতি দিয়েছিল? সম্মতি দিয়ে থাকলে রেহানা তাকে মানসিক যে-পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গমন করতে দেখছে সেটা ঘটার কথা নয়। এ্যানির ঘটনায় আরেফিনের প্রতি রেহানার দুর্নিবার ক্রোধ এখান থেকে ছলকে উঠেছিল। একশো গঞ্জনার ভয়ে মেয়েটি ঝামেলা এড়াতে চাইছে বুঝে তার জায়গায় নিজেকে ভিকটিম ও এ্যানিকে সাক্ষী করতে সে মরিয়া হয়। বিষয়টি বাবা আদম ও বিবি হাওয়ার সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতাবলয়ের ভারসাম্যে আকাশপাতাল যত ব্যবধান রয়েছে তাদেরকে রিকল  করায়। ভারসাম্যের খামতি ছবিতে প্রাসঙ্গিক করে তুললেও এর ইতিনেতি বিচারের ভার রেহানার স্রষ্টা যথারীতি দর্শকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।

নারী ও পুরুষের ক্ষমতাবলয়ে ভারসাম্য কি রেহানার জীবনে সুস্থিরতা এনে দিতে পারত? রেহানা মরিয়ম নূর  দেখতে বসে জিজ্ঞাসাটি মনে উঁকি মারে। নারী-পুরুষের বর্তমান সম্পর্কের ধাঁচ বিবেচনায় ক্ষমতাবলয়ের ভারসাম্য বা তার সম্ভাবনা অবশ্য দূর ভবিষ্যতের গর্ভে আজো ঘুম যায়! ওটা নিশ্চিত করার রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অনুঘটক সমাজে অনুপস্থিত। ন্যায্যতা আদায়ে নারী যেসব পথ ধরে আগুয়ান হয় সেগুলো তাকে পুরুষের প্রতিপক্ষ করে তোলার চেয়ে অধিক কিছু দিতে পারেনি। পুরুষসুলভ কায়দায় পুরুষকে ধরাশয়ী করার পথে নামার পর নিজের মৌল স্বকীয়তার অনেকখানি তাকে হারাতেও হয়েছে। ঘরেবাইরে হাজার ঝুটঝামেলা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নারীকে দশভুজা দুর্গা করে তুললেও তার ক্ষমতার কদর করে এমন পুরুষ সংসারে মেলা ভার। ঘরগেরস্থির কাজে নারীর দক্ষতাকে পাত্তা না দেওয়ার খাসলত সংসারে সকল পুরুষের (*অধম নিজে সেই দলে পড়েন) রক্তে সহজাত। কালের ধারায় নারীর ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা থেকে পুরুষকুল মোটের ওপর আজো মুক্ত নয়।

পুরুষের বদ খাসলত শুধরানোর বেলায় নারীর ভূমিকা আবার সবসময় সুখকর হয় না। আওরত নিজের ক্ষমতার কথা মরদকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ক্ষণে প্রায়শ মেজাজ হারিয়ে বসে। তারপর দুজনকে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ঝগড়াটি নারীকে পুরুষের প্রতি বিরক্ত ও নিস্পৃহ করে রাখে। ত্যক্তবিরক্ত নারী এখন বেটাছেলেদের বোঝানো যাবে না ভেবে পরিচিত গণ্ডিতে ফিরে যায়। এর অধিক সুখ তার কপালে জোটে না। পুরুষকে সহনীয় ও নিজের সহযোগী করে তোলার নারীবাদী পন্থা নিয়ে সাদ বেশ ভাবনা করেছেন। রেহানার প্রতিবাদী স্বভাবকে নমনীয় করে তোলার ফাঁদে তিনি তাই ধরা দেননি। নারী-প্রগতির হালফিল আদলে প্রতিবাদী নারীকে গড়েপিঠে নেওয়ার ভাবনাও তাকে বশ করতে পারেনি। এর বদলে তৃতীয় এক পথের গল্প তিনি পর্দায় বয়ন করেছেন। এটা হচ্ছে সেই পথ যেখানে প্রবেশের পর রেহানা মরিয়ম নূর-কে রুগণ্ বা মর্বিড বলে দাগাতে দর্শককে তিনি নিরুপায় করে তোলেন।

মর্বিড  এক মেয়ে আরেফিনসহ সবাইকে ত্যক্ত করে মারছে;—বার্তাটির মধ্যে যে-অস্বস্তি দপদপ করে তাকে সহ্য করা কঠিন। সিনেপর্দায় প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বহমান চাপটি সাদের নির্মিতিকে ভিন্নতা দান করেছে। মর্বিড  রেহানার সামনে দুটি পথ তিনি খোলা রাখেন,—তাকে এ্যানির মতো মেনে নেওয়া শিখতে হবে নতুবা অস্থির উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভে আরেফিনদের দরোজায় করাঘাতে জারি থাকতে বাধ্য সে। অচলায়তন এতে ভেঙে পড়বে না কিন্তু সবকিছু নীরবে মেনে নেওয়ার চেয়ে ওটা ভালো। করাঘাত থামিয়ে রফা বা মুচলেকায় গমন হতাশা ছাড়া রেহানাকে কিছু দিতে পারবে না। অন্যায়ের ন্যায্য সমাধানে পুরুষতন্ত্রের দরোজায় অবিরাম করাঘাতে রুগণ্ আর কর্কশ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় অস্ত্র আপাতত তার হাতে নেই।

কেন নেই তার উত্তর রেহানা অসুস্থ হলে তাকে দেখতে আসা চিকিৎসক দম্পতির বাতচিতে সাদ খানিক তুলে ধরেছেন। দুজনের কথাবার্তায় ছদ্ম-নারীবাদ ও ছদ্ম-উদারতাবাদের সমস্যা উঠে এসেছে। দুই পক্ষের পুন্ ঘষাঘষির মাঝখানে ছবিতে রেহানার অবস্থান যথারীতি মর্বিড থেকে যায়। চিকিৎসক দম্পতির আলাপে সে যেচে ফোড়ন কাটে না। ঘোলাটে আঁখিপল্লব ঘুরিয়ে সকলকে নজর করার পর নিজ বৃত্তে ফেরত যায়। বিধবা হলেও দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা সে ভাবে না। মৃত স্বামীর সুবাদে পাওয়া হিজাব ও হাতঘড়ি তার দেহে সারাক্ষণ লটকে থাকে। এই রেহানাকে অগত্যা সমতার চেয়ে ন্যায্যতার জন্য অধিক মুখরা মানতে হয়। সাদের ছবিতে ন্যায্যতা প্রধান বিষয়। একবিংশ শতকে পা-রাখা বাংলাদেশের নারীকুলের জীবনে ধূসর নীলে আঁকা বৃত্ত ছাড়া ন্যায্য ও নির্বাধ কোনো প্রান্তরের অস্তিত্ব রয়েছে কি?—তির্যক প্রশ্নটি ছবির অন্তে পৌঁছে রেহানার সংক্ষুব্ধ পরাজয়ের দেখার ক্ষণে তীব্র হয়ে মনে বাজে।

নির্বাধ প্রান্তর বাংলাদেশের নারীকুলের ভাগ্যে আজো জোটেনি! ধার্মিক ও হিজাবি রেহানার জীবনে সে পুরাপুরি নিখোঁজ। মেডিকেল শিক্ষার্থী এ্যানি ও মিমির তাকে পাওয়ার উপায় নেই। হোস্টেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিজের অপমান ভুলতে এ্যানি যতই ব্যান্ডের গানে চিয়ার আপ হওয়ার চেষ্টা করুক তার পক্ষে আগের মতো করে নির্বাধ প্রান্তরে গমনের স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। ওদিকে কলেজের কর্ত্রী প্রিন্সিপাল ম্যাডামের জীবনে বহুদিন হয়ে গেল প্রান্তরের খবর নেই। ডাক্তার আরেফিনের দুর্ভাগা স্ত্রী আয়েশার পক্ষে এর নাগাল পাওয়া দুষ্কর। রেহানাসহ সকল নারীর নির্বাধ প্রান্তরে ছুটে বেড়ানোর সাধ যে-বয়সে খানিক ছাড়পত্র পায় সেই ছোট্ট ইমুর বেলায় ওটা অবরুদ্ধ হয়ে আসে। রেহানা নিজ হাতে সেখানে যাওয়ার পথে খিল টেনে দেয়। সাদ চতুর আর্টিস্ট। ছবির ধূসর নীল বৃত্তে এরকম বহু উপাদান তিনি সেঁটে দিয়েছেন। প্রথম দেখায় সেগুলো চেতনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। তাঁর সিনেভাষা লিনিয়ার বা সরলরৈখিক মোটেও নয়। রেহানা মরিয়ম নূর-র সিনেবয়ান উত্তম সাহিত্যের মতোই বহুকৌণিক। সরলছকে বোনা মনে হলেও এর বাঁকগুলো সর্পিল;—যথেষ্ট কুটিল আর তর্কযোগ্যও বটে!

সে যাকগে, সত্য তো এই,—ধূসর নীলের বৃত্তে এ্যানি-রেহানা-ইমু-আয়েশারা একে-একে প্রবেশ করে। সেখানে প্রবেশের পর এ্যানির মতো ছাড় দিতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়। মিশ্র সমাজের বাংলাদেশে রেহানার ধার্মিক বিশ্বাসে বোনা সংস্কৃতি তার বৃত্তবন্দি হওয়ার নিয়তিকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। আধুনিক লেবাসধারী এ্যানি বা আয়েশার পরিণতিও অভিন্ন হয়। পঞ্চাশ বছরের পদযাত্রায় বাংলাদেশে নারীশক্তির উত্থান বলতে শিক্ষা ও গৃহস্থালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাপক হারে বাইরের কর্মজীবনে শরিক হওয়াকে বোঝায়। ঘটনা মিছে না হলেও ধূসর নীলের কারাগার থেকে তার ছুটি মিলেনি। বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনীর যুগে সে আর বন্দি নয় কিন্তু তা-বলে মুক্তও নয়! নিত্যনতুন অবরোধ তুলে তাকে ঘেরাও করার প্রথায় আজো ছেদ পড়েনি। রেহানা মরিয়ম নূর পুরাতন এই সত্যকে পুনরায় স্মরণ করতে বাধ্য করে।

লোকে বলে সমাজে নারীর ভূমিকা দশভুজা দুর্গা মায়ের সমতুল। এই নারী বাচ্চা পয়দা করে ও তাকে পালেপুষে। স্বামী বা পরিবারের জন্য তিন বেলা হেসেল সামলানোর দায় মিটায়। কর্মস্থলে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শত হাজার কাজের চ্যালেঞ্জ নিতে ডরায় না। রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে কলিগ আর অচেনা পুরুষের অশ্লীল বাক্য ও ইঙ্গিত হরহামেশা মুখ বুজে উপেক্ষা করে। পুরুষ যেখানে অনায়াসে গমন করে সেখানে যাওয়া তার জন্য বিপত্তি ডেকে আনে। যখন-তখন শ্লীলতাহানির ভয় তাকে সচকিত ও সজাগ থাকতে বাধ্য করে। আবার এই নারীশক্তি পুরুষের মন পেতে তাকে প্রলুব্ধ করার রঙ্গে নামে। দেহকে সে বিজ্ঞাপন করে পোশাক ও প্রসাধনে। দেহের মুদ্রা আর শতেক ছলাকলায়। মা দশভুজার শক্তি বক্ষে ধরে যে-নারী এতকিছু অবলীলায় করে ফেলে তাকে সর্বজয়ার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য পরের মুখ পানে তাকিয়ে থাকতে হয়। স্বীকৃতির জন্য নারীবাদের বাখান গাওয়ার দায় তার ঘাড়েই চাপে। নারী তাই আপাদশির কাঙালিনী সুফিয়ার বোন। পরাণের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে;—সুফিয়ার গানের কলিতে মর্মরিত বেদনা দিনের অন্তে তার দিকে অমোঘ হয়ে ধায়। পুরুষকুলে জন্ম নেওয়া আদমের পক্ষে সাধারণ থেকে অতিকায় কাজকম্মো করার ক্ষমতায় মহীয়ান নারীকে পুরাদস্তুর ঠাহর করা যে সম্ভব নয় সেকথা আর না বললেও চলে।

পুরুষপ্রধান গোত্রে বিচরণ করলেও দশভুজা নারীকে নিজের সত্তার গহিনে অনুভবের চেষ্টা সাদ করেছেন। দুঃখ এই যে সর্বজয়া নারীর এতকিছু সামাল দেওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক সুবাসে প্রসাধিত করার ভাবনা বাদ দিয়ে ছবিটি তাঁকে বানাতে হয়েছে! দশভুজা নারীকে তিনি যথারীতি ধূসর নীলের বৃত্তে ফেরত পাঠান ও সেখানে বসে রাগেক্ষোভে ফুঁসতে বাধ্য করেন। ক্ষোভ নিগমনের রাস্তা খুঁজে না পাওয়ার হতাশা রেহানাকে পাঁচদশটা নারীর জীবন থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ধূসর নীলের বৃত্তে নারীর সমাধি ঘটার নেপথ্য রাজনীতিকে ঠেকানো যাবে না বুঝে ইতিবাচক বয়ানের দিকে সাদ আর পা বাড়াননি। সংক্ষুব্ধ হতাশা দিয়ে ছবির ইতি টানলেও নারী-পুরুষের সম্পর্ককে মধুর করে তুলতে ন্যায্যতার ইশারা সেখানে ফিরে-ফিরে ঝিলিক দিয়েছে।

সমাজে নারী-পুরুষের কোঁদল থামাতে সমতার চেয়ে ন্যায্যতা ঢের জরুরি;—প্রসঙ্গটি ছবিতে আভাসিত হওয়ার কারণে জটিল তর্কে গমনের উৎস সাদ খুলে দিয়েছেন। নারীমুক্তির প্রথাগত বচনের সাহায্যে এই তর্কের মীমাংসা সম্ভব নয়। ছবির প্রবাহ জুড়ে ব্যক্তি রেহানার প্রতিদিনের জীবন, তার অন্তর্মুখী স্বভাব, একগুয়ে জেদ ও প্রতিবাদ, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, সহকর্মী আর পরিবারের লোকজন বিশেষ করে কন্যাসন্তান ইমুর সঙ্গে আচরণকে কিছু দর্শক অসুস্থ, অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় রেহানাকে অসুস্থ দাগাতে গিয়ে ছবির গভীরতলে শায়িত রাজনীতিকে তারা অবহেলা করলেন! একটি রাজনৈতিক বাক্য উচ্চারণ না করলেও সাদের ছবিটি প্রচণ্ড রাজনৈতিক মূল্য ধরে। এইবেলা সেদিকে তাকানোর সময় হয়েছে।

রেহানা গেল তিন দশকে আমূল বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নারী সমাজের অমানিশার প্রতীক হয়ে পর্দায় বিচরণ করে। এই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমান সম্প্রদায়ের সহজাত সংস্কৃতিচেতনা এখন আর অতীতবৃত্তে দাঁড়িয়ে নেই। নতুন উপকরণ হরহামেশা সেখানে প্রবেশ করায় সমাজকে তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে শরিক থাকতে হচ্ছে। রেহানার নারী-স্বকীয়তা এর ছায়াতলে পরিপুষ্ট হয়েছে। বাঙালি নারীর জীবনে প্রবিষ্ট সংস্কৃতির নতুন রূপান্তরকে এক বাক্যে নাকচ করার প্রগতি তাকে উতলা করে না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ থেকে আগত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছাপ অঙ্গে বহন করে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার রাস্তায় নিজেকে সে অটল রাখে।

ডাক্তারি পেশার কঠিন দায়িত্ব সামলে তাকে ঘর ও বাইরের হাজার চাপ সামাল দিতে দেখা যায়। চাপ সামলানোটা আবার দর্শকমনে তার প্রতি সহানুভূতিকে তীব্র করতে বিফল হয়। বিফল হওয়ার কারণ বিস্ময়করভাবে ছবিটি যারা দেখেছেন ও দুছত্র লিখেছেন তাদের বক্তব্যে উঠে আসেনি। প্রতিবাদী রমণীর সকল দায় মিটানোর খ্যামতা রাখে এমন কোনো রেহানার দেখা পেতে তারা সম্ভবত হলে গিয়েছিলেন। রেহানা সেক্ষেত্রে তাদের যুতসই হওয়ার কথা নয় এবং সেটা হয়নি। প্রতিবাদ করতে নেমে ভদ্রতা, কমনীয়তা ঝেড়ে ফেলা খিটখিটে নারীকে অনেকের সহ্য হয়নি। নিরাপোস থাকার পথে তার উচ্চ নৈতিকতা ফলানোর বাহাদুরিকে বিরক্তিকর ও স্ববিরোধী বলে তারা মত দিয়েছেন। নারীর স্বকীয়তা অর্জনের প্রতীক রূপে দর্শক যে-বয়ান আশা করেছিলেন বলাবাহুল্য সাদের ছবিটি তার বিপরীতে গমন করেছে।

নিজের নীতির প্রশ্নে রেহানা সত্যিই অতিরিক্ত জেদি, একরোখা আর অসহিষ্ণুও বটে। আকাট এই ডাক্তারনিকে নারী-প্রগতির কোন ছকে ফেলে যায় তার ভাবনায় অনেক দর্শক পীড়া বোধ করেছেন। একদিক থেকে এটা সাদের সাফল্য গণ্য হওয়া উচিত। দর্শককে তিনি প্রথাগত সাহসিকা নারীর ভাবনায় থিতু হওয়ার খাসলত থেকে ছিটকে যেতে বাধ্য করেছেন। ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি রেহানা মরিয়ম নূর অস্বস্তি হয়ে দর্শকমনে সচল থাকে। তার নিঃসঙ্গ লড়াই ও আপাত পরাজয় ডাক্তার আরেফিন, মেয়ে ইমু আর কলেজ কর্তৃপক্ষের গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়! অনায্য সংস্কৃতির জনক সিস্টেমকে নিজের লক্ষ্যবস্তু করার কারণে ছবিটি সোজাসরল থাকার আবেশ হারায় এবং রাজনৈতিক হয়ে ওঠে।

সিস্টেম তো সেই বায়বীয় শক্তি যার ছায়ায় আরেফিনরা তৈরি হয়, এ্যানিরা কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়, অধ্যক্ষ অসহায় ও আপসকামী চরিত্র ধারণ করেন এবং মেডিকেল কলেজের মালিকবৃন্দ মিমিকে পরীক্ষার হল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা সামনে এনে রেহানাকে বরখাস্তের মওকা খোঁজেন। এরকম ভারভারিক্কি গায়েবি অবতারের সঙ্গে যে-মেয়ে লড়তে নেমেছে তার পক্ষে আপসরফায় গমনের সুইট-সুইট নারী-প্রগতি সম্ভব ছিল কি? সাদ এই প্রশ্নটি বোধহয় তার সমালোচকদের করতেই পারেন।

সুইট-সুইট  নারীপ্রগতি কেন অচল দুআনি তার ব্যাখ্যা ছবির দমবন্ধ ধূসর নীল জুড়ে লাগাতার চাপ সয়ে খিটখিটে নারীতে রূপান্তরিত রেহানাকে দিয়ে পরিচালক ফিরে-ফিরে দিয়েছেন। না, রেহানা এখানে যতটা বাস্তবিক তার অধিক ফিকশনফিকশন  হওয়ার কারণে তাকে বাস্তবাতীত বাস্তব রূপে স্বীকার করতেই হয়। পরিচালক তাকে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত গণ্ডি থেকে উঠিয়ে এনেছেন কিন্তু সেখানে স্থিরভাবে দাঁড়াতে দেননি। সমাজের একটি গণ্ডিতেও দাঁড়িয়ে থাকার এলেম তার নেই। মধ্যবিত্ত পরিসরে চলাফেরা করলেও তাকে সেখানে গড় করা মুশকিল-কি-বাত হয়। তার আচরণ মধ্যবিত্তসুলভ নারীবোধের মাঝে বেশিক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে পারে না। নিজের জেদ ও নীতির প্রশ্নে সে তাই চরমপন্থী বা এক্সট্রিমিস্ট। চলচ্চিত্রে এক্সট্রিম মুভির একটি ধারা বহুদিন ধরে চলে আসছে। সাদের রেহানায় তার খানিক ছায়া পড়েছে মনে হলো। জেদ ও নীতির প্রশ্নে তার চরমপন্থী মনোভাব মূলত তাকে মর্বিড থাকতে বাধ্য করে। মর্বিড রেহানা এভাবে ক্রমশ আজকের বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। তার এই বাংলাদেশে রূপান্তর সাদের ছবিকে পলিটিক্যাল করে তোলে।

একাত্তরের বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-অবিচার সইতে না পেরে গেরিলা সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিল। একবিংশ শতকের বাংলাদেশে শোষণ ও অবিচার বিচিত্র আকারে চরম রূপ নিলেও গেরিলা সংগ্রামে ঝাঁপ দেওয়ার রাজনীতি অনুপস্থিত। শ্রেণিকাঠামোয় বন্দি সমাজ যে-সিস্টেমের ওপর ঠেকনা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা নিজেই চরমপন্থী। সরকার এখানে চরমপন্থায় স্বমেহন করে। বিরোধীরা তথৈবচ। ধর্মে আধ্যাত্মিকতার সুবাস ছিটেফোটা মিলে না অথচ মোল্লা আর ওয়াজিদের চরমপন্থী আতরের ঘ্রাণ নাকে ঠিক জ্বালা ধরায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী প্রগতির সৈনিকরাও সমান-সমান! আমলাযন্ত্র থেকে শুরু করে তাবড় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অনুঘটক চরমপন্থার নতুন বাঁকে মোড় নেওয়ার কারণে আমজনতার ওপর এর প্রভাব তীব্র হয়েছে। গোটা দেশ যখন চরমপন্থী সেখানে রেহানার পক্ষে নরোমপন্থী হওয়া কি করে সম্ভব! সিস্টেমে পুঞ্জিভূত গায়েবি শক্তির সঙ্গে টক্কর লড়তে সে তাই নিজের ভিতরে গায়েবি চরমপন্থাকে স্থান করে দিয়েছে। দর্শকের চোখে ওটা উদ্ভট বিকার গণ্য হলেও সাদের ছবিতে এই চরমপন্থী প্রতিবাদ রেহানা মরিয়ম নূর-এর একমাত্র রক্ষাকবচ।

চরমপন্থায় বিবর্তিত সমাজে নারীর সমানাধিকার নিয়ে রেহানা একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি। সমতার জন্য দর্শক তাকে বাকবাকুম করতে দেখে না। নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়েও সে বড়ো-বড়ো বুলি কপচায়নি। নিজের স্বপ্নকে কবর দেওয়ার পর যেখানে উঠে এসেছে সেটা তাসের ঘর এই বোধ তার রয়েছে। যে-কারণে তার চরমপন্থাকে শিশুতোষ ঠেকলেও তাকে একবাক্যে কাণ্ডজ্ঞানরহিত বলাটা মুশকিল হয়। নিজের গায়েবি চরমপন্থা দিয়ে মেডিকেল কলেজের চরমপন্থায় সক্রিয় শক্তির মোকাবিলায় তার জেদকে অগত্যা বেশ প্রাসঙ্গিক মানতে হয়।

রেহানা আসলে কী চেয়েছে? সে চেয়েছে ডা. আরেফিন তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে ও এ্যানিকে সরি  বলবে। এর অতিরিক্ত গেরিলা বিপ্লবে তার জোশ ছিল না। ইমুর স্কুল কর্তৃপক্ষের আবদারকে সে ওই ন্যয্যতার জায়গা থেকে বিচার করে। দুটি বাচ্চার মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি কারো শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে না এই বোধ তার রয়েছে। ছেলেটি ইমুকে প্রতিদিন চিমটি দিয়েই যাচ্ছে! কাণ্ডটি শিশুতোষ মনে হলেও ওর এই অভ্যাস কাল মাস্তানি ও ইভটিজিংয়ে রূপ নিতেও পারে। বাচ্চাটির হাত কামড়ে দিয়ে ইমু আত্মরক্ষা করেছে। ভবিষ্যতের ইমুর নিজেকে আত্মরক্ষার জন্য এই প্রতিরোধটা অনিবার্য ছিল। রেহানা তাই মেয়েকে সাহসী  বলে বাহবা দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। এর জন্য ছেলের গার্জিয়ানকে সরি বলা মহত্ত্ব বা মিটমাটের জায়গা থেকে মধুর মনে হলেও দেশের পথেঘাটে মেয়েদের টিজ  করা আর নারীকে জড়পদার্থ ভেবে মলেস্টিংয়ের ঘটনাগুলো তো এখান থেকেই তীব্র হয়েছে।

সমস্যাটি গোড়ায় খতম করার দায়িত্ব স্কুল-কর্তৃপক্ষের হলেও তারা সেটা পালন করেনি। অভিভাবকদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজের পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত স্কুল দেশের জবরজং শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক। রেহানার লড়াই এখানেও স্কুল এবং গুড পেরেন্টিং নামে পয়দা হওয়া আজব এক চরমপন্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তাকে যদি এর মোকবিকলায় যেতে হয় তবে সন্ত হওয়া মানায় কি? সে তো ওই বাচ্চার বাপ-মায়ের সঙ্গে ঝগড়ায় নামেনি, তাকে নামতে হয়েছে জগদ্দল সিস্টেমের বিরুদ্ধে, যাকে সমাজে চরম করে তোলা হয়েছে। হিজাব ও নামাজে আটক রেহানার যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে যারা অভদ্রতা বলে দাগালেন তারা এর অন্তরালে লেলিহান অগ্নিশিখাকে দেখার কোনো চেষ্টাই করেননি।

ফিকশনাল
  রেহানার অস্থির স্বভাব পর্দায় তুলে ধরার বাহানায় পরিচালক সাদ দর্শককে ক্রমশ চরমপন্থী এইসব অস্বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য করেন। ফরাসি সিনেকার গ্যাসপার ন্যুই-র নৈরাশ্য ভারাতুর সিনেবয়ানে তীব্র ঝাঁকুনি ও অস্থিরতা দর্শককে বায়ুশূন্য শ্বাসরোধী এক জগতে ভ্রমণের স্বাদ উপহার দেয়। সাদ অতটা পেরে উঠেননি তবে ধূসর নীলের বৃত্তে বোনা সিনেভাষায় তার রেহানা ন্যুইয়ের ছবির পাত্রপাত্রীদের মতো গায়েবি অস্থিরতায় পর্দায় ছুটে বেড়ায়। এই রেহানা সুইট নয়। তার মধ্যে প্রাণোচ্ছল নারীত্বের লেশ মাত্র নেই। ছাত্র ও কলিগদের সঙ্গে আচরণে রসকষের বালাই চোখে পড়ে না। মা ও ছোট ভাই রনিকে সে খাটায় কিন্তু দুজনকে মোটামুটি ঝাড়ির ওপরে রাখে। কন্যা ইমুর সঙ্গে কালেভদ্রে তাকে কোমল হতে দেখা যায়। স্কুল-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তায় সমঝোতার চেয়ে ঝগড়ার সুর অধিক ফেটে বের হয়। এইসব ইমেজারির কল্যাণে রেহানার প্রতিবাদ ও আপসহীন হওয়ার ঘটনাগুলো ছবির শুরু থেকে অন্ত অবধি বাংলাদেশের রক্ষণশীল কিংবা সুই-সুইট নারী-প্রগতির বলয়ে বেড়ে ওঠা দর্শকের বোধ-অনুভব থেকে তাকে পৃথক ও একলা করে ফেলে। আইসোলেশনটা এখানে সেই রমণীকে সম্ভব করেছে যে একই অঙ্গে বৈপরীত্য নিয়ে বড়ো হয়েছে।

বাংলাদেশের সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে নারীর দৈনন্দিন জীবন ও মনোজগৎকে তুলে ধরার প্রবণতা বিবেচনা করলে রেহানা মরিয়ম নূরকে এই স্ফিয়ারে  নিঃসঙ্গ মানতে হয়। সাদ হয়ত প্রথম চলচ্চিত্রকার যিনি মুসলমান সংস্কৃতির সাম্প্রতিক পালাবদলের বৃত্তকে ছবির ফাঁকফোকরে ধরার চেষ্টা করেছেন। আজান, নবীর প্রশস্তিতে গীত কাসিদা বুরদা, রেহানার পোশাক, ওজু ও নামাজ আদায়ের দৃশ্যগুলো যারপরনাই সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ইসলামি জীবনাচারের প্রভাব তুলে ধরে। নামাজি ও হিজাবি রেহানার সাহসী, প্রতিবাদী বা নিরাপোস থাকার ধাতকে নারী-প্রগতির প্রথাগত ছকে আঁটানো যাবে কি?—প্রশ্নটি সাদ সুচতুরভাবে ছবিতে আগাগোড়া রেখে দিয়েছেন। নারী-প্রগতির প্রথানুগ বয়ানে যিনি আস্থা রাখলেন তিনি এখন এই রেহানাকে নিয়ে কী করবেন সেকথা ভেবে কৌতুক জাগে মনে।

বাংলাদেশের সমাজে বেভোয়ার-আজাদ বা তসলিমা ঘরানায় সুলভ প্রগতির বয়ান থেকে সাদ নিজেকে দূরে রাখেন। বয়ানকে তিনি ত্যাগ করেননি আবার বুকে আগলেও রাখেন না। বেভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ  প্রভাবিত প্রগতিতে মোটা দাগে যেসব নারী প্রতিবন্ধক বিবেচিত হয়ে থাকেন রেহানা তাদের গোত্রেই পড়ে। সাদ সেই নারীকে খানিক ফিকশনাল করে ছবির পর্দায় জীবন দিতে চেয়েছেন। প্রচলিত নারী-প্রগতির মাপে নামাজি ও হিজাবি রমণীকে প্রথাবন্দি লড়াকুর প্রতিনিধি গণ্য করা হয়। নারীকুলের ওপর ছড়ি ঘোরাতে অভ্যস্ত পুরুষতন্ত্রের অভ্যাস পাল্টানো এইসব নারীর কম্মো নয় বলে সচরাচর প্রচারণা চলে। গৎবাঁধা এইসব বয়ান মাথায় রেখে ছবিটি দেখতে বসলে রেহানার আচরণকে উদ্ভট মনে হবে। ছবির আলোচনায় যারা তাকে সাইকো ভেবেছেন তারা খুব সম্ভব গেল পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে অকার্যকর প্রমাণিত এই বয়ানের ফাঁদে পা দিয়ে নারীর সুদিন ফেরানোর খোয়াব দেখে চলেছেন।

সমাজে নারীর স্থান নিরূপণে বাংলাদেশের সমাজে সক্রিয় সকল মত-পথ-পন্থার ব্যাপারে রেহানার মনোভাব নিস্পৃহতাকে তোলে ধরে। নারীবাদ নিয়ে সে যেমন নিস্পৃহ, ধর্মীয় অনুশাসনে নারীসত্তাকে বন্দি রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও ছবিতে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। হিজাব-বোরখা থেকে শুরু করে ওজু বা নামাজ আদায়ে তাকে স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছে। বোরখা বা হিজাবের মতো পোশাকের সামাজিক বিবর্তন এখন আর একমাত্রিক হয়ে নেই। মেয়েদেরকে অবরুদ্ধ রাখার অস্ত্র হিসেবে ধর্মীয় পুরুষতন্ত্র বহু যুগ ধরে এই পোশাক ব্যবহার করে আসছে এবং সেটা যথারীতি আজো বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে রয়েছে। এর বাইরে পোশাকটিকে অনেক নারী ফ্যাশনের অঙ্গ হিসেবে পরিধান করেন। বাইরের জগতে অহরহ বিচরণে অভ্যস্ত মেয়েদের বেলায় আরব সংস্কৃতি থেকে আগত পরিচ্ছদ ঢাল হিসেবে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়। পুরুষের বদনজর থেকে সুরক্ষার প্রশ্নে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়, তথাপি মেয়েরা হয়ত ভাবেন কাপড়ের এই আচ্ছাদন তাকে পুরুষের বদনজর থেকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করছে। সাদ তার ছবিতে বাংলাদেশের সামাজিক গণ্ডিতে মেয়েরা যেসব পোশাক পরিধান করেন তার সবকটা মোটামুটি তুলে ধরেছেন। যারপরনাই রেহানার পরিচ্ছদ ছবির একমাত্র নিয়ন্ত্রক নয়। শিক্ষক আরেফিনের কক্ষে যৌন-নিগ্রহের শিকার মেডিকেল ছাত্রী এ্যানি থেকে শুরু করে আরেফিনের স্ত্রী আয়েশা বা কলেজের অধ্যক্ষ তাদের বয়স, রুচি ও সংস্কৃতি মাফিক পোশাকে ছবিতে হাজির থাকেন।

এর মানে কিন্তু এই নয় রেহানা বাংলাদেশের সমাজে সালাফি ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটার কারণে তীব্র হওয়া বিবিনিষেধের পাবন্দি করে। টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হতে চাওয়ার অপূর্ণ ইচ্ছা এ্যানির কাছে কথাচ্ছলে জানাতে সে দ্বিধা করেনি। তার মৃদু হাসির মধ্যে স্মৃতিকাতর দুঃখ জমা ছিল। মেয়েদের ফুটবল খেলা উচিত নয়;—পৌরুষ প্রভাবিত সমাজে কন্যা ইমুকে যারা এই সবক দান করলেন তাদেরকে নাকচ করতে সে দুবার ভাবেনি। প্রতিবাদী ও আপসহীন হওয়ার সিনেভাষায় রেহানাকে যারপরনাই মিত্রহীন হওয়ার নিয়তিকে মেনে নিতে হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক এই চাপ সাদ তাঁর ছবির আদ্যন্ত জুড়ে রেখেছেন এবং সেখানেই তার কামিয়াবি। আইসোলেশন  হচ্ছে রেহানার প্রাণশক্তি। শক্তিটা তাকে পরাজয়ের মধ্যেও ক্ষোভে অগ্নিগর্ভ রাখে।

জীবনযুদ্ধের চাপ সয়ে অস্থির, খিটখিটে, অন্তর্মুখী, অসামাজিক এবং অনেক বোদ্ধা দর্শকের বিচারে সাইকো বা অস্বাভাবিক…, রেহানার ওপর বর্ষিত এইসব বিশেষণ ছবির লক্ষ্য বিবেচনায় খেলো হয়ে পড়ে। অবদমনের চাপ সামাল দিতে-দিতে ক্লান্ত রেহানার মতো চরিত্ররা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। শত গোলযোগে ভারাক্রান্ত দেশে বসে আমরা সেটা টের পাই না। একথা তাই বলা যেতে পারে, রেহানা মরিয়ম নূর  সাহসিকা নারীর সর্বজয়া হওয়ার গল্প দিয়ে বোনা নয়। সন্তসুলভ সহিষ্ণুতায় নারীপুরুষের সমতার জায়গাকে আতশকাচ দিয়ে পরখ করার গল্প সে বলে না। মূলধারার ছবিতে সিস্টেমকে তোফা থাকতে দিয়ে গল্পের নায়িকা তাকে হেনস্থাকারী শয়তানের পিছু নেয়। গল্পের পরিশেষে নায়কের সাহায্যে শয়তানকে সে খতম করে। তারপর নায়কের বাহুডোরে ধরা দিয়ে শয়তানকে যে-পয়দা করল সেই সিস্টেম মহাশয়ের ঘরে সুখশান্তিতে দিনরজনী যাপন করতে থাকে। মধুর এই ফ্যান্টাসি থেকে রেহানা ও তার দর্শকদের পরিচালক সম্ভবত বঞ্চিতই করেছেন!

সম্ভবত বলার কারণ রয়েছে। সাদের ধূসর নীলে বোনা ছবি পুরুষতন্ত্রের মগজ থেকে বেরিয়ে আসা উদ্ভট এই সিনেবয়ানের খুব কাছ দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে। ডাক্তার আরেফিনের প্রতি রেহানার আক্রোশ দেখে মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় নিজের অহং তৃপ্ত করতে বুঝি সে তাকে এমন চেপে ধরেছে! একটা-দুটো শয়তানকে খতম করলে কি নারীর ওপর নেমে আসা লাঞ্ছনার নিরাকরণ ঘটে যাবে? এ্যানিকে সরি বলা অথবা রেহানার কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিলেই কি মেডিকেল কলেজের ধূসর নীলে বন্দি থার্ড ফ্লোর পাল্টে যাবে? এক আরেফিনের জায়গায় নতুন আরেফিন এলে রেহানা কি তার সঙ্গেও জঙ্গে নামবে? এইসব প্রশ্ন শেষমেষ ছবিটির নির্মাণ-কুশলতার গুণে বাতুল প্রমাণ হয়েছে।

আরেফিন নিজের দোষ স্বীকারকে প্রয়োজনীয় ভাবেনি। স্ত্রী আয়েশা তাকে ছেড়ে গেলে তার আত্ম-উপলব্ধি নতুন মোড় নিতে ব্যর্থ হয়। মানুষ হিসেবে ভুল করে ফেলেছে এই অনুভবে তাকে সুখী থাকতে দেখা যায়। এ্যানিকে দেখে তার মনে অনুতাপ-অনুশোচনা জাগে না। নিজেকে চৌকস পুরুষ ভাবার স্বমেহনে সে বহাল থাকে। এ্যানির মতো বাচ্চা মেয়ে ফেসবুকে স্যারের প্রতি নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিল, তো এই অজুহাতে তাকে মলেস্ট করতে শিক্ষক মহাশয়ের হাত কাঁপেনি। মুগ্ধতার সুযোগ নেওয়া উচিত হয়নি;—এরকম বোধ ছবির উপসংহারে এসেও আরেফিনকে অস্থির করে তুলতে বিফল হয়। সাদের সিনেবয়ান এভাবে আরেফিন ও রেহানার কোঁদলের সীমানা পেরিয়ে সিস্টেমের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে। রেহানার অহং সেখানে যতটা-না আরেফিনের বিরুদ্ধে বর্ষায় তারচেয়ে বেশি সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিস্ফারিত হয়। সাদ তাকে বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েশনের প্রতীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেন।

রেহানা হচ্ছে নারীকুলের দুর্ভাগা প্রতিনিধি। তাকে অপছন্দ করতে বাধ্য করা হয়। দয়া ও করুণায় মাখা পুতুপুতু সহানুভূতিতে বিগলিত হওয়ার সুখমেহন থেকে সাদ তাঁর দর্শককে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করেন। নারীর প্রতি সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের অনায্য আচরণের ফলে ঘনীভূত বৈষম্যকে এক্সট্রিম পয়েন্ট অব ভিউ  থেকে দেখার বাসনায় ছবিটি পর্দায় জন্ম নিয়েছে। রেহানা শুরু থেকে সকলের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ ছিল, শেষাবধি তাই থাকে। তার পরাজয় তাকে নিঃশেষ করতে পারে না। তীব্র মর্মপীড়ায় নিজেকে সে আরো অসুস্থ ও একরোখা করে তোলে। লিনিয়ার এই বয়ানের বাইরে তার জন্য একমাত্র নিরাময় হয়ে আসে কাচঘেরা ব্যালকনি, যেখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিস্নাত শহর দেখা যায়। তার হয়ত বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে। কাচের দেওয়াল ফুঁড়ে বরিষনসিক্ত আকাশে উড়াল দিতে মন চায়। সবাইকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করে, ঘরবাহিরের অজস্র চাপ সামলে সে কতটা ক্লান্তপ্রাণ! দুদণ্ড জিরান নিতে পারলে মনের সকল জ্বালা মিটে। ধূসর নীলের কারাগারে অসহায় সাপিনীর ফোঁসফাঁসের বাইরে ব্যালকনি একমাত্র স্পেস হয়ে সাদের ছবিতে বিরাজ করে। এই স্পেসটা কেবল রেহানার এবং সেখানে দ্বিতীয় মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ভার্জিনিয়া উলফের বয়ানে এই ব্যালকনি হয়ত নারীর নিজের ঘর। ওটা কাচে ঢাকা এবং অবরুদ্ধ হলেও সেখান থেকে বৃষ্টি দেখা যায়।

সাদের এই নির্মিতি রেহানা মরিয়ম নূর-এর সিনেভাষায় একমাত্র ইতিবাচক ঘটনা। নিরাশার আঁধারে ডোবানো ছবির ভাষা এই জায়গায় পৌঁছে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে নির্মিত মূলধারার ছবি থেকে সমূলে নিজেকে আলগ করে ফেলে। দুই বাংলার বিকল্পধারার সৃজনশীল চলচ্চিত্রে নারীমুক্তির প্রসঙ্গ যতখানি উঠে এসেছে তার সঙ্গে নিজের সংযোগকেও সে ছিন্ন করে। তরুণ এই নির্মাতা বাংলা ভাষার সিনেস্ফিয়ারে একা। তার কাহিনির মুখ্য চরিত্রের মতোই তিনি নিঃসঙ্গ ও নিরাকার। দর্শক এই জায়গাটি খেয়াল করলে সাদের ওপর সুবিচার ঘটে।

সিনেভাষার সাতকাহন : আগের পর্ব
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you