সূর্য আর চাঁদের এক মেশানো আলো || আরফান আহমেদ

সূর্য আর চাঁদের এক মেশানো আলো || আরফান আহমেদ

সুরলহরী  নামে একটা অনুষ্ঠান হতো বিটিভিতে। বোধয় রাত দশটার সংবাদের পর দিত। অই সময়টা সবচেয়ে ফ্রাস্টেটিং ছিল। কি কি জানি গাইত ওরা। অইসব গান সে-বয়সে আমার ভালোই লাগত না। তার পরে, অনেকদিন পরে, লোকমুখে নানান কথা শুনে, একদিন বিসমিল্লা খাঁ-র একটা সিডি কিনেই ফেলি, একটা না বোধয় একসাথে কয়েকটা। কিছু বুঝি না। কিন্তু শুনতে থাকি।

বাড়িতে সোমাপু গান শেখার অপপ্রচেষ্টা চালাত। আমিও তবলাফবলা বাজানোর একটা বৃথা চেষ্টা চালাই, কিন্তু কাজ হয় না। ওই যে সুরলহরীতে লোকজন যেভাবে বাজাইত, তা আমার পছন্দ হতো না। আদতে তখন অইসবের অ আ ক খ বুঝিয়ে দেয়ার মতন কোনো লোকই ছিল না বোধয়।

উপহার-পাওয়া একটা চাইনিজ ভিসিডিপ্লেয়ারে শুনতে লাগলাম বিসমিল্লা খাঁ। সমস্যা ছিল একটাই, অইটাকে টিভির সাথে জুড়ে দিয়েই শুনতে হতো, তখন বাড়ির অন্য লোকেদের টিভি দেখার বারোটা বেজে যেত। কিন্তু ততদিনে আমি পিঙ্ক ফ্লয়েডের মহা অ্যানার্কিক ইশতেহারে বুঁদ।

বিসমিল্লা খাঁ বাজান শাদি-কি-শেহ্‌নাইয়া। বিয়েবাড়ি বিয়েবাড়ি লাগে, কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন কিছু-একটা বাজে অন্যখানে, অন্য কোনো শহরে। তারপরে রবিশঙ্কর। লোকটা একটা রকস্টার এইটা বুঝতাম শুধু। আর একদিন আমজাদ আলি খাঁ। আরে লোককে বলতে হলে কয়েকটা নাম জানা থাকতে হবে তো! আর নাইলে ভর মজলিশে মাইকটা আমার হাতে আর নেই। আমজাদ আলি খাঁ এলেন, চৌরাসিয়া না ভেবেও শুনে ফেলেছি অনেক। আসলে ঢাকায় এখনো অই চৌরাসিয়াই সবচেয়ে বড় স্টার!

নকল সিডির ৩ ট্র্যাকের ২নংটা রাগ পিলু। কার মুখে যেন শুনি এইটা সন্ধ্যার রাগ। আমি রাগ পিলু শুনি, প্রতি সন্ধ্যায়। একদম নিয়ম করেই। পিলু। একটা ঝাপসা বৃষ্টিভেজা শহর, কয়েকটা নিয়ন আলো, একটা কাল্পনিক ব্যালকনি, একটা গুলিস্থান সিনেমা হল। একটা মিছে অভিমান, একটা দুঃখযাপন। একটা ঢং। প্রতিদিন সন্ধ্যায়। একটা চাপা দুঃখ। কেমন যেন মর্ষকাম। সিডির কাভারে একজন লোক একটা বাজুকা হাতে, নাম সারোদ। চোখ বন্ধ বোধয় না কি কোথায় যেন চেয়ে থাকত। অই নেশায় বুঁদ! চমৎকার সুপুরুষ সবুজরঙা কাভারে ফটোকপি আমজাদ!

আর বাজানোটা কেমন যেন বাটার টোস্ট। মাখন মাখন মুচুমুচে। স্টিলের তার বাজছে। ধাতু আর অধাতুর সংঘর্ষের শব্দ কেমন যেন মিঠা আর মোলায়েম। অই মেটালের মাঝে প্রাণ পশিল আরকি। আমি শুনি, শুনেই যেতে থাকি, তারপরে দিন পাল্টায়। নিজের একটা ঘর হয়। রাত্রিবেলাটাও এক-রকম দখল করেন খাঁ সাহেব। আমি একবিন্দুও বুঝি না মাথামুণ্ডু কি বাজায়। কিন্তু কি যেন বাজে তার সাথে। এই শহর, এই নরকযন্ত্রণা, এই বিপ্লবের হতাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবারো বেধড়ক মারধর। সরকারি ছাত্র আর পুলিশ। এই দল ভেঙে গেল, অই-যে একটা বিপ্লবের মৃত্যু। অই-যে মিছিলে আমাদের লোক গুনে ফেলে খুব সহজেই। বাড়িতে প্রতিদিন মধ্যবিত্তীয় ঝিংচ্যাক! অই-যে দরজা বন্ধ করে দিয়ে খাঁ সাহেবের বাজুকা। তারপর অই-যে রাত্তিরে ঘুমের অষুধ। নাম-মনে-না-থাকা বেহাগ। ভোরবেলায় আহিরভাইরো। কী সুন্দর নাম তার চারুকেশী!

আলাপে আপনি তার কাছে যাবেন অই-যে শান্ত সুবোধ ‘আমার বই’-এর ছেলেটির মতন। আপনি তার পিছু করবেন, আর আপনার সামনে শ্রমণ আমজাদ আলি গেরুয়াধারী তাপস। আপনি এগোবেন, শ্রমণ আপনার দিকে মুখ ফিরে চাইবে। ঠিকই মুখ ফিরে চাইবে একদিন। আপনি এগোবেন, আপনাকে টেনে নেবেন। আপনাকে চমকাবেন তিনি, সেই স্বর না যার আওয়াজ আপনার কানে এসে বাজবে। আপনাকে চমকাবেন তিনি সে-স্বরটা দিয়ে যা বাজতে গিয়েও চুপ করে গেল। যে প্রকাশিত তারে আপনি খোঁজেন না। কিন্তু যে অপ্রকাশিত, তার গভীরের মধুতে আপনার আসক্তি থাকেই হয়তো।

দিল্লীর সোহরাব জোর দিয়ে বললেন বেনারস তোমার যাওয়া দরকার। আমিও খানিকটা মিউ মিউ করে একসময় পুরুষোত্তমের একটা টিকিট কিনেই ফেলি। জ্যাকেট মাথায় দিয়ে, উপরের বার্থে শীতের সাথে লড়াই করে, আবার গায়ে জড়াই। ইন্ডিয়ান রেলে বডি দেবো কিন্তু মাথা দেবো না। বন্ধু তাপস ফোন করে বলল, ৪০ বছর পরে নাকি আজ এখন এই মুহূর্তে আমজাদ আলি খাঁ সারোদ বাজায় ভারানসির ঘাটে। আমার খুব অস্থির লাগে। আমার খুব একা লাগে। এত্ত কাছে আসার পরেও একটিবার দেখা হলো না! আমি শীতে কাঁপি ঠক ঠক। কতরকম স্বপ্ন দেখি। আর ভোরে মোঘল সরাই যেন একটা নিঃস্ব স্টেশন।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামেই তাকে প্রথম দেখি। খানিকটা জগদীশ বসু হয়তো। টিউন করেন। কি কি স্বর যেন বাজে। এইখানে লোকে পাগল হতেই এল। তাই একটু ধুমধাম শুনিয়ে দিলেন হয়তো। আহা মুনশিকুলের শিরোমণি! বাহাসে জড়ান। আবার ফিরে আসেন। একটা বিশাল ক্যানভাস সবকয়টা জিনিশই ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। উন্মাদ হতে থাকি। আগেই টের পেয়ে যাই, আজ আর নিস্তার নাই। এশকে দেওয়ানা, একদম ফানাফিল্লাহ। মাথা-ঝিমঝিম-ধরা ভোরে। মগজ কুচিকুচি করে কাটেন। মহাশক্তিধর। সুপারম্যান। আমাদের নিঃস্ব করেন। জীবনটা ঠিক আর ঢাকায় পড়ে থাকে না। এই শহরকে আরো একবার ক্ষমা করে দেয়া যায়। আরো একবার ক্ষমা করে দেয়া যায়।

ঠিক সেই অবন ঠাকুরের গল্পের মতন সূর্য আর চাঁদের এক মেশানো আলো। আমার সালাম আর ভক্তি লইবেন।


বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে  ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টে আমজাদ আলি খাঁ বাজাতে এলে লেখক ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে রাতভর মুজরো শুনে ফেসবুকে তাৎক্ষণিক এই নিবন্ধটা লেখেন। পরে এইটা ২০১৫ অক্টোবরে ‘লাল জীপের ডায়েরী’ সাইটে ছাপাও হয়। গানপারে লেখাটা আপ্লোডকালে লালজীপসঞ্চালক বিজয় আহমেদ লেখকের অনাপত্তিপত্র আদায়ের ব্যাপারে হেল্প করেছেন। — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you