দরিদ্রতা, অসুখী দাম্পত্য বা প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যর্থতায় কবি জীবনানন্দ দাশ বিষাদগ্রস্ত ছিলেন না; মূলত মানবজন্মের কষ্টেই তিনি হতাশাবাদী ছিলেন।
জীবন মূলত এক বিপন্ন বিস্ময়। কবি জীবনানন্দ দাশ মূলত এই বিস্ময়কর সত্যের কাছেই বিপন্ন হয়েছিলেন। উচ্চ পদের চাকরি না থাকা, গায়ের রঙ সুন্দর না হওয়া, কদাকার চেহারা, সুন্দরী স্ত্রীর ভালোবাসা না পাওয়া কিংবা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা না-পাওয়ার জন্য তিনি হতাশ ছিলেন না আদৌ।
আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটতে গিয়ে যখন এসবের দেখা পেলাম তখন বস্তুগত চিন্তা আর জীবনচর্চার মানুষেরা নিজেদের চিন্তাভাবনা দিয়ে এসব ম্যাপিং করেছি, যা আদতে জীবনানন্দ সম্পর্কে খুবই ভুল প্রেডিকশন। এবং বাজে চিন্তা। তার অভাব বা দারিদ্র্য ছিল। মনোকষ্ট ছিল। কিন্তু এসবের কাছে তিনি জীবনের পরমকে দেখেননি। দেখেছেন মানবজন্মের কাছে।
উনিশশো চৌত্রিশ কবিতায় তিনি লিখেছেন :
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে
এটাই হলো জীবনানন্দ। আমাদের মতো সফলতার উত্তেজনা তার ছিল না। আমরা যেগুলো দিয়ে তারে বিচার করি তিনি এসবের প্রয়োজন বোধ করেননি। একটা ভালো চাকরি কি তার পক্ষে পাওয়া অসম্ভব কিছু ছিল? মোটেও তা ছিল না আসলে। তাহলে তারে দারিদ্র্যসীমার নিচে রেখে দুখি আর হতাশাবাদী বলে চিহ্নিত করার ভুলটা আমরা করি কেন? এটা আমাদের চিন্তার দারিদ্র্য। জীবনানন্দের দারিদ্র্য নয়।
তিনি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছেন এই পৃথিবী এই মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। এই নক্ষত্রের নিচে তার মানবজন্ম কত একা! বিন্দুর মত একা! এই বোধ তারে বিপন্ন করেছে। লক্ষ কোটি বছরের নক্ষত্রের নিচে এক নবীন শতাব্দীর অসহায় এক মানবসন্তান, যারা শুধু খেয়ে আর পরেই বেঁচে আছে। জীবনানন্দ এই যন্ত্রণায় ভুগেননি। তার বেদনা ছিল মানবজন্মের হয়ে পৃথবীতে আসায়।
রাতের তারার কাছে তাই লীন হয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। বারবার শুধু বলেছেন মানুষের হৃদয় থেকে দুঃখের মতো কেন খসে পড়ছে বিরামহীন নক্ষত্রেরা।
অথবা তিনি যে ‘আট বছর আগে’ কবিতায় লিখেছেন :
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের
মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে
অশ্বত্থের শাখা
করে নি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
বলে নি কি : বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
এই জীবনানন্দকে কীভাবে আমরা বৈষয়িকতার দুঃখ দিয়ে প্রতিস্থাপন করি? আমার বোধে আসে না। মানবজন্মের দুঃখ নিয়ে যিনি দোয়েল আর ফড়িঙের কাছে সুখ খুঁজেছেন, অশ্বথের শাখার কাছে প্রতিবাদ করেছেন, তারে জীবনের যাবতীয় জঞ্জাল দিয়ে আমরা প্রতিস্থাপন কেন করি!
জীবনানন্দ সুচেতনার মতো একটি কবিতায় লিখেছেন :
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সেসব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয় —
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
কী অসাধারণ আর নির্মল স্বীকারোক্তি মানবজন্ম নিয়ে! এই জীবন না পেলেও ক্ষতি ছিল না তার। মানুষের বাইরেও এই পৃথিবী একটা ‘সমস্ত’। মানুষ শাশ্বত রাত্রির বুকে কেবলই অনন্ত সূর্যোদয়। এই সূর্যের নিচে তাবৎকিছুই আছে। মানুষ কেবল দিন আর রাতটাই কাটায়। এর বাইরে কিছুই না সে। নাথিং। জীবনানন্দ এই হিউম্যান বিয়িং এন্টিটির বাইরের গিয়ে পৃথিবীর পার্ট হতে চেয়েছেন। তিনি হতে চেয়েছিলেন মূলত পৃথিবীর শরীর।
অথবা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-র ‘বোধ’ কবিতাটি :
আলো-অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, — কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়, — পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা — প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!
পুরো মানবজন্মকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। স্বপ্ন বা শান্তি তাকে কখনোই টানেনি। জগতের যাবতীয় অর্জন তার কাছে পণ্ডশ্রম আর তুচ্ছ ছিল। সেখানে চাকরি আর স্ত্রীর অনুকম্পা তো আরো নগণ্যতর বিষয় ছিল। আমরা তারে কেন যে এসব দিয়ে মাপি!
তার দুঃখ ছিল মূলত মানবজন্ম হওয়া নিয়েই। আমরা বড়জোর বলতে পারি দোয়েল বা শালিক না হবার দুঃখটাই ছিল জীবনান্দের হতাশার মূল কারণ। ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানার চিলের মতো না হবার দুঃখেই তিনি বিষাদগ্রস্ত ছিলেন। কিশোরীর পায়ের ঘুঙুর না হবার কষ্টেই তিনি মরতে চেয়েছেন। রোগীর শিয়রে রাখা সতেজ নাশপাতির মতো শুশ্রুষাকারী না হবার জন্য অতৃপ্ত ছিলেন আজীবন। হেমন্তের শিশিরের মতো ঝরে না পড়তে পারার দুঃখেই তিনি ট্রামের নিচে পড়ে মানবজন্মের ব্যথা ভুলতে চেয়েছেন, যে-ব্যথার বোধ তিনি আলো-অন্ধকারে গিয়েও মাথার ভেতর থেকে সরাতে পারেননি।
সেজন্যই তিনি মানবজন্ম থেকে ছিটকে নক্ষত্রের কাছে চলে যেতে চলমান ট্রামকে বেছে নিয়েছিলেন। দারিদ্র্য বা অসুখী দাম্পত্য বা চাকরির জন্য নয়। তিনি হতে চেয়েছিলেন এক পৃথিবীর শরীর। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানবভগ্নাংশ হয়ে তিনি জীবনটা কাটাতে চাননি।
কাজল দাস রচনারাশি
জীবনানন্দ দাশ গানপারে
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS