ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের প্রাক্তন সদস্য মিজানের ভয়েস কোয়ালিটি কোক স্টুডিও বাংলা-র সুবাদে আলোচনায় আসছে। অর্ণবের সংগীতআয়োজনে রমেশ চন্দ্র শীলের মাইজভাণ্ডারী নুরের পুতুলা বাবা মাওলানার বন্দনায় মিজানের ডেলিভারি সোজা কথায় ঝাক্কাস ছিল। মাইজভাণ্ডার গানের প্রচলিত ধারার সঙ্গে নিজের তুলনাকে সে অবান্তর ভাবতে বাধ্য করে। রমেশ চন্দ্র শীল ও বাংলার কাওয়ালরা হারমোনিয়াম সহকারে যে-মাইজভাণ্ডার জিকির করেন তার আবেশ শেষ হওয়ার নয়। ওইটা এই গানের চিরায়ত স্বরূপ। যতদিন আধ্যাত্মিক আবেশটা লোকের মনে জারি থাকবে ততদিন এর বিনাশ নাই। মিজান পক্ষান্তরে নাগরিক কংক্রিটের ঘূর্ণিজালে বন্দি গায়ক। ওয়ারফেইজ-র উচ্চণ্ড বাদনপ্রণালির মধ্য দিয়া তার বিকাশ-প্রকাশ। বাংলা জবানের কোমলতাকে সেখানে পশ্চিম হইতে আগত বাদ্যযন্ত্র সমাহারে সৃষ্ট সুরের মাতন সহ্য করে ডেলিভারি দিতে হয়। আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে কিংবদন্তির মহিমায় উন্নীত অমরগীতি আল্লা মেঘ দে পানি দের সঙ্গে নুরের পুতুলার এই ফিউশনসংগীতে মিজানকে কাজটা পুনরায় করতে হইসে। দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রে উতলানো সুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়া ভোকাল কর্ডকে তারসপ্তকে তোলা ও ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ সেখানে ছিল। মাইজভাণ্ডারী গানের দেহে বহমান ফানাফিল্লার আবেশটা যে-কারণে মিসিং হওয়ার অনুভব প্রথমে কানে ঘাই দিয়া যায়। অন্যদিকে মিসিং অনুভবটা নতুন এক ফানাফিল্লাহর আবেশে মনে তরঙ্গ বহাইতে থাকে।
মাওলাকে রমেশভাবিক কাওয়ালরা সচরাচর জিকিরতালে ডাক পাড়েন। হেভি মেটালের ঘূর্ণি সামাল দিতে অভ্যস্ত মিজানের জন্য ওইভাবে ডাকাটা অবান্তর ছিল। শান্তিনিকেতনে মাথা মোড়ানো অর্ণব যে-সুর সেখানে উৎপাদন করেন সেইটা অতিক্রম করে ভোকাল কর্ডকে মাওলার আরশে নিবেদন করেছে গায়ক। গানের ভাবরস কী নিহত হয়েছিল এতে? হয়তো হয়েছিল। হয়তো হয় নাই। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বরং এই, — মিজানের গায়নরীতি নতুন আঙ্গিকে আজকের নাগরিক শ্রোতাকে মাওলার স্বরূপ চিনতে সাহায্য করেছে। শ্রোতা এই মাওলাকে সুরের তীব্র সুসংগতি ও মিজানের আতীব্র কণ্ঠস্বরের ভিতর দিয়া দেহে ফিল করে এবং উচ্ছল হয়। সুফি তরিকায় ঈশ্বরবন্দনা সর্বদা এক তরিকায় হইতে হবে তার কোনো মানে নাই। নাগরিক কংক্রিটে যে-প্রজন্ম রাতদিন লাত্থি-উষ্ঠা খায় তার জন্য মাইজভাণ্ডারীর চিরায়ত পরিবেশনরীতির পাশে নতুন গায়নপ্রণালিটা লোকে শুনতে থাকুক কিছুদিন।
ফিরোজ সাঁই সেই কবে ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা দিয়া তার সময়কার নগরজীবী তারুণ্যকে মাইজভাণ্ডার চিনিয়েছিল। অর্ণবের সুবাদে মিজান আরেকবার একই মাইজভাণ্ডারকে তাদের দেহখাঁচায় ঢুকতে বাধ্য করেছে। এই কাণ্ডে রমেশ চন্দ্র শীলের জাত খোয়া গেল বলে যারা শঙ্কায় কাতর তারা বোধ করি যুগের ভাষায় সংগীতের নবীকরণ সইতে পারেন না। সকল যুগে অতিরক্ষণশীল সমস্যাটা চোখে পড়ে। উক্ত ক্ষুরে মাথা কামানো মুরব্বিরা অবশ্য পরে যথারীতি ভ্রান্ত বা বাতিল প্রমাণিত হইতেই থাকেন। কম্পোজার হিসেবে অর্ণব ভালো নাম্বার পাওয়ার দাবিদার বটে! তাঁর এই পরিবেশনায় বাংলা গানের জাত খোয়া যায় নাই, ওইটা বরং আরো পোক্ত ও সময়-প্রাসঙ্গিক সম্ভাবনায় মাইজভাণ্ডারকে ব্যাপ্তি দিয়াছে। যা-ই হোক, এ-রকম উদাহরণ আরো আছে। এইসব নিয়া তুলানমূলক আলোচনার সূত্রপাত পত্রিকার পাতায় ঘটুক সেই আশায় কথাগুলা বলা।
একবার ভাবেন, গানের জঙ্গে টিকে থাকার তাগিদে এইসব চ্যাংড়ারা শুরুয়াতের দিনগুলায় পাঁচ তারকা হোটেলে কিংবা এলিট সমাজের অনুষ্ঠানাদিতে আংরেজি ভাষায় বিটলস, রোলিং স্টোনস, পিংক ফ্লয়েড, ডিলান–মার্লে–জিমি হেনড্রিক্স–মিক জ্যাগার বা জিম মরিসন ইত্যাদি গাইত। সেখান থেকে কোনো জ্ঞানীর পরশ ছাড়া বাংলা জবানে নিজের পরিপার্শ্বকে যাপনের অভিজ্ঞতায় তারা গমন করতে থাকে। কভার সং তথা অন্যের গান কিংবা মহাজনদের কলি আওড়ানোর মাঝে তারা নিঃশেষ হয় নাই। নিজের লেখা গানে সুর বসানোর সঙ্গে বেপরোয়া আত্মবিশ্বাসে গানগুলা ডেলিভারি দিয়েছিল। স্থানিকতা ও বৈদেশিকতার মিলনমোহনায় দাঁড়িয়ে থাকা যুবাগণের প্রেম-পিরিতি-বিরহ এবং লোকায়ত বিশ্বে সক্রিয় ভাষার জগৎকে নিজের দেহে শোষণ-পরিপাক ও নাগরিক আবহে নবীকরণকে বেশ সফল বলা চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী একটা প্রজন্মের বেড়ে-ওঠার ইতিহাসে ব্যান্ডসংগীতের ব্যক্তিক ও সামাজিক অভিঘাতের তত্ত্বতালাশ তাই সময়-প্রাসঙ্গিক। আমার কাছে জরুরিও বটে।
পশ্চিমের অতিকায় পপগায়ক ও রকারদের নিয়া সাহিত্য বা চলচ্চিত্র আমরা হামেশা পাঠ যাই; ওদিকে একজন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, আজম খান, হ্যাপি ও লাকি আখন্দ কিংবা আইয়ুব বাচ্চু-জেমস-মাকসুদ-হাসান-সুমন-তুহিন-মিজানরা অবহেলায় পড়ে থাকে। ছেলেবেলার নস্টালজিয়া ছাড়া কিছু নয় ইত্যাদি বাক্যে তাদের স্বশিক্ষিত হওয়ার সংগ্রামটাকে তুলোধুনা করার পর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে-তুলতে কুম্ভকর্ণের ঘুম যাই! ঢেকুরের আবডালে জ্বলজ্যান্ত প্রজন্মের সংগীত শ্রবণের অভিজ্ঞতা ও তার সদর-অন্দর যাপনের গল্পটা ক্রমে হাপিশ হইতে থাকে। একটা-কোনো অফলাইন/অনলাইন পত্রিকার এ-রকম আয়োজন কুম্ভকর্ণের নিদ ভাঙাইতে সহায় হইতেও পারে।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
- অন লেখালেখি, ইনফর্ম্যাল (তিস্রা দাগ) - October 11, 2024
- দুর্গাপূজার হালচাল : সেকাল একাল || সুমিত্রা সুমি - October 9, 2024
COMMENTS