গানের মানুষ ছয়জনা : আড্ডায় গানগল্প / সমাপ্তি কিস্তি

গানের মানুষ ছয়জনা : আড্ডায় গানগল্প / সমাপ্তি কিস্তি

[পূর্বপ্রকাশিত কথোপকথাটায় তিনটা প্রসঙ্গ ধরে আলাপ জমে উঠেছিল, প্রসঙ্গত্রয় একে একে : মৌলিক গান, সংগীতশিল্পীর লিভিং ও লড়াই এবং সোলো ও ব্যান্ড তরিকায় গাইবার সুবিধা-অসুবিধা। প্রাণবন্ত কথোপকথনভিত্তিক আড্ডাটার আগের কিস্তি শিবু কুমার শীলের কথায় সাময়িক ইস্তফা টানা হয়েছিল; পত্রস্থ হতেছে এক্ষনে সেই ইস্তফা-টানা আলাপের পরবর্তী কিস্তি, যেখানে ব্যান্ড ও সোলো সংগীতানুশীলন-সৃজনের কথাচক্রটির জের ধরে শুরু হয়ে এরপরে আলাপ গড়িয়েছে দেশের মিউজিক-ইন্ডাস্ট্রি ছাড়াও প্রোডাকশন ও স্টুডিয়োরেকর্ডিং এবং আলাপরত শিল্পীছয়ের প্রিয় কম্পোজিশন ইত্যাদি ঘিরে, এবং এইটাই এর সমাপ্তি কিস্তি।

কিন্তু পূর্বানুবৃত্তির দরকার আছে কি? লিঙ্ক দিয়া যাওয়া যাক বরঞ্চ পূর্ববর্তী কিস্তিটির, যেইটা গানপারে আপ্ করা হয়েছিল হপ্তা-আড়াই আগে, এই লিঙ্ক ক্লিক করলেই ইনিশিয়্যাল কিস্তিটা পাওয়া যাইবার কথা। গানপারে এই রিপ্রিন্টের ব্যাপারে একটা হাল্কাপাৎলা ভাষ্য ওই কিস্তিপ্রিফেইসে অ্যাভেইল করা যাবে। এছাড়াও কন্টেন্টটা কালেক্ট করার সোর্স ও অথার্শিপ ইত্যাদি নিয়াও তথ্যাদি কিছুটা আছে সেইখানে।

যে-ব্যাপারটা অ্যাড করা যায় এন্ডিং এই কিস্তিতে, সেইটা হচ্ছে, যে-পত্রিকায় আজ থেকে একদশক আগে এইটা ছাপা হয়েছিল তাতে একদম স্টার্টপেজে এডিটোরিয়্যাল হিশেবে ক্রেডিটকলাম-প্রিন্টার্সলাইন ইত্যাদির ডানপাশে স্রেফ তিনবাক্যে এই কথাগুলো লেখা হয়েছিল : “মৌলিক গান হারিয়ে যাচ্ছে — এমন অভিযোগ পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে এসেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। নিজেদের কথা, সুর ও গান নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিল ‘বিনোদন ২০০০’। এবার তারই বিস্তারিত।” আর-কিছু রইল কি বাকি? প্রিজার্ভ করতে চাইছি আমরা বাংলা শাহরিক গানচর্চার নয়া-পুরানা আলাপসালাপের ইচ অ্যান্ড এভ্রি ডিটেইলস্।

ও হ্যাঁ, এই আড্ডার আগের কিস্তিটি আপ্লোড হবার পরে মেঘদলের মেম্বার কবি, চিত্রী ও লিরিসিস্ট-কণ্ঠশিল্পী শিবু কুমার শীল সামাজিক সংযোগমাধ্যমে এই কনভার্সেশনকালীন নিজের একটা তাৎক্ষণিক বিবেচনার পরবর্তী রিয়্যালাইজেশন শেয়ার করেছেন, যেখানে শীলের চলিষ্ণু চিন্তার নজিরটা পাওয়া যায়, এইখানে সেই রেস্পোন্সটুকু ডক্যুমেন্টেড রাখা আমরা দরকার মনে করছি; শিবু কুমার শীল বলছেন, “এই আলোচনায় অনেক গান অনেক নাম উঠে এসেছে, তবে খারাপ লিরিকের নমুনা হিসেবে ‘সালেকা মালেকা’-র নাম নেয়া উচিত হয়নি আমার। এর জন্য মাফি চেয়ে নিচ্ছি আগেভাগে।” ইন্টার্ভিয়্যুলিঙ্ক শেয়ার দেবার সময় এই মন্তব্য করেন তিনি, মন্তব্য-অংশে একজনের কোয়্যারির রিপ্লাই দিতে যেয়ে শীলের আরেকটা সংযোজনী রিমার্ক গুরুত্বপূর্ণ : “সালেকা-মালেকা বলি বা আজম খানের অন্য গানগুলোর কথাও যদি বলি, আমি খেয়াল করেছি এই গানগুলো কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তীয় ভোক্তার বাইরে গিয়ে লেখা। যেটা কোয়ালিটিফ্যুল নয় হয়তো কিন্তু রেভোল্যুশন্যারি, এটা আমার আজকের চিন্তা।” আর, এসবের পেছনে যে-কমেন্টটা আছিল, যদি পূর্ববর্তী কিস্তি থেকে সেইটা উদ্ধার করে খেই ধরাইতে চাই, ব্যাপারটা ছিল এ-ই : “আমি যদি নন্দনতাত্ত্বিক বিচারের জায়গাটা থেকে বলি তাহলে বলব, তখনকার সালেকা-মালেকা (আযম খানের) গানটি কিছুই হয়নি। তবে এর চাইতেও ভালো লিরিক তখন ছিল কিন্তু প্রচার পায়নি।” (দ্রষ্টব্য পূর্ববর্তী কিস্তি)

বিশেষকিছু উল্লেখযোগ্য সাড়াশব্দ আর পাওয়া যায় নাই, কিংবা আমাদের নজরে ঠেকে নাই, কিছু কম-বেশি সাতশতাধিক শেয়ার হয়েছে কথোপকথাটা, সাড়াশব্দ পেলে নথিবদ্ধ রাখা যেত, আগামী দিনগুলোতে এই আড্ডাকেন্দ্রী কিছু সংযোজন-বিয়োজন অফার করেন যদি কেউ তবে আমরা তা আমলে নেব নিশ্চয়। — গানপার]

gaaner manush

কৃষ্ণকলি : আমি বিষয়টার কিছুটা আক্ষরিক দিকগুলো বলব। যখন কেউ একটা দল করে, সে একটা পরিবেশ পায় এবং পারস্পরিক সাপোর্ট পায়, যার কারণে দলটা তৈরি করতে পারে। আবার একইভাবে কেউ যখন একা গান করে তখন তার ওই ঘটনাগুলো ঘটে যায়নি বা সাপোর্টগুলো ওভাবে পায়নি বলেই হয়তো করে। তবে আল্টিমেইটলি সবই কিন্তু গ্রুপ। কারণ যে সোলো গাইছে তাকেও আরেকজনকে দিয়ে তবলা বাজিয়ে নিতে হচ্ছে, আরেকজনের কাছ থেকে সুর করে নিতে হচ্ছে, কথা নিতে হচ্ছে — মানে নির্ভরশীলতার একটা বিষয় এসেই যাচ্ছে। আসলে আর্টের পুরো বিষয়টাই একটা গ্রুপের বিষয়। একই বিষয় আমরা পেইন্টিঙের ক্ষেত্রেও দেখছি। ব্যান্ডের বিষয়টা হলো একটা ফর্মের বিষয়। পাশ্চাত্যে এ-রকম একটা ব্যাপার ছিল, কমিটমেন্টের বিষয় ছিল — এখানেও ওই-রকম একটা ইমোশন তৈরি হয়েছে, ওই ফিলোসোফিক্যাল কন্টিন্যুয়িটির প্রতিফলন এখানে ঘটেছে। এখানেও গ্রামে গ্রামে বাউলদের গ্রুপ হচ্ছে। সেখানে নানান ছাড়ের বিষয়ও আসছে। আমি যখন অর্ণবের সঙ্গে মিউজিক অ্যারেঞ্জ করছিলাম, তখন ওর সঙ্গে আমার ৯০% জায়গায় মিউচুয়্যাল এবং ১০% জায়গায় ঝগড়া হচ্ছিল। তবে আমি মনে করি, এই অমিলগুলো না-হলে কাজও ভালো হবে না।

তুহিন : ব্যান্ডের ক্ষেত্রে যে-যত সংখ্যার দিক দিয়ে বড় হবে এবং বেশি সময় ধরে টিকে থাকবে সে তত ক্রিটিক্যাল হবে, তত ভাঙচুর হবে, তত মজা হবে। একটা ফর্ম্যাটে পড়বে। মানসিক দিক দিয়ে সোলোর চেয়ে ব্যান্ডটা কঠিন। কারণ এখানে পাঁচজনের জন্য ছাড় দিতে হয়। আন্ডার্স্ট্যান্ডিঙের একটা বড় বিষয় আছে। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আনন্দ-দুঃখ সবকিছু শেয়ার হয়। একজন লিখছে, আরেকজন সুর দিচ্ছে, আবার আরেকজন বাজাচ্ছে — এ-বিষয়গুলো শেয়ারিঙের মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। বিষয়টা অনেকটা এ-রকম যে, যার যতটুকু আছে সবটুকু উজাড় করেই দিই। তারপর সংঘবদ্ধভাবে নেমে পড়ি জাগরণের আন্দোলনে। একসঙ্গে কাজ করতে গেলে পার্ফেকশনের ব্যাপারটা থাকে। আমরা আসলে কখনো খারাপ কিছু ডেলিভারি দিতে চাই না।

জিয়া : আফ্রিকার ট্রুবাডুর্স সম্প্রদায় প্রথম ব্যান্ড ফর্ম করে। আমাদের দেশের বাউলকালচার, যাত্রা, পালাগান — গ্রুপওয়ার্ক হচ্ছে সর্বত্রই। ব্যান্ডকালচারে কয়েকজন সমমনা মানুষ একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু সোলোতে তা হচ্ছে না। সোলোতে অনেক সময় দুই রকম ব্যাপার থাকে — আমার মিউজিক আরেকজন করছে, বাকিসব অন্য কেউ দেখছে, আমি শুধু গলাটা দিয়ে চলে এলাম। আবার আরেকটা বিষয় থাকে, আর্টিস্ট তার মনমতো ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে খেলতে পারে না — যখন সে খেলতে চায় আসলে। সেই বিষয়টা ব্যান্ডের বেলায় হয় না; এখানে সবাই সবার টেস্ট সম্পর্কে জানে ও বোঝে। তাই ব্যাপারটা সহজ হয়। পুরো বিষয়টার মধ্যে একটা থিম থাকে। তবে সব সোলো আর্টিস্টের ক্ষেত্রে এ-রকম হয় না। যারা আসলে গান করছে তারা সোলো করেও নিজেদের মতো গ্রুপ ফর্ম করছে।

প্রসঙ্গ ইন্ডাস্ট্রি

শিবু : আমরা যারা গান করছি তারা নির্দিষ্ট কিছু কোম্প্যানির কাছে দায়বদ্ধ। এখানে প্রথম বিষয় হচ্ছে রুচি, দ্বিতীয়ত মার্কেটিং। আজকে যদি আমরা কোনো মিউজিক প্রোডাকশন হাউজের কাছে যাই তবে দেখব তারা একটা গণ্ডির মধ্যে মার্কেটিংটা করে। সেখানে আমি এথিক্যালি মানি না যে আমার গান শুধু পাঁচজনের জন্য। আমার গান প্রথমত আমার জন্য, দ্বিতীয়ত সবার জন্য। এই মার্কেটিংটা ঠিক না হলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ি। এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে ‘সংগীতা’, ‘সাউন্ডটেক’ — এরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে এই মার্কেটিঙের ক্ষেত্রে। কিন্তু এদের রুচির জায়গাটা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে।

সুমন : ইন্ডাস্ট্রিতে বড় যে-কোম্প্যানিগুলো আছে তারা নতুনদের প্রোমোট করছে না বরং যারা এস্ট্যাবলিশড তাদের অ্যালবাম প্রোমোট করছে। ‘সাউন্ডটেক’, ‘সংগীতা’ ভালো মার্কেটিং করছে; — কিন্তু নতুন যে তাকে পেট্রোনাইজ করলে সে খুব ভালো করবে, সে-বিষয়টায় নজর দিচ্ছে না। তবে যেসব কোম্প্যানি এভাবে নতুনদের নিয়ে কাজ করতে চায় তারা সংখ্যায় এত কম যে লোড নিতে পারছে না। যেমন নতুন কেউ একটা অ্যালবাম বের করতে চাইলে তাকে একসঙ্গে তিনটা অ্যালবামের জন্য সাইন করতে হয়, এটা একটা অনেক বড় অন্তরায়।

জিয়া : ‘জি সিরিজ’-এর নাম আসে এখানে। ‘জি সিরিজ’ খুব ভালোভাবেই কাজ করছে, প্রোমোট করছে নতুনদের, বড় পরিসর নিয়ে কাজ করছে। সোলো শিল্পী, যেমন — রম্য, মেসবাহ এদেরকে নিয়ে কাজ করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলেও এদের গান শোনা যাচ্ছে। তবে এ-রকম হাউজ একটাই। এখানে মনোপোলি কাজ হচ্ছে, যে-কারণে আমরা তাদের সঙ্গে এক হয়ে তিনটা অ্যালবামের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। তারা সোলো, ব্যান্ড উভয় নিয়েই কাজ করছে। তবে হাউজগুলোর কাছে আমরা কখনো-কখনো ভিক্টিম হয়ে যাই মনোপোলির কারণে।

তুহিন : আসলে হাউজগুলোর মধ্যে যার যত ডিলার আছে অথবা শোরুমগুলোর সঙ্গে যাদের ভালো লেনদেন আছে তাদের দ্বারা তত ভালোভাবে প্রচার সম্ভব হচ্ছে। এদিকে আমরা দেখছি মমতাজের একের পর এক সিডি বের হচ্ছে, ভালো প্রচার পাচ্ছে — আমাদের আপামর জনতা শুনছেও সেই গানগুলো। ফলে হাউজগুলো রিটার্ন নিয়ে এখানে ভাবছে না। তবে প্রধান হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়াই পারে ভালো জিনিশটাকে ছড়িয়ে দিতে। আবার ধ্বংসও করতে পারে। এখানে একটা প্রোডাকশন হাউজ নিয়ে ফাইট করতে অনেক প্রোসেসের ব্যাপার থাকে। একটা বিষয় থাকে যে, এখানে যারা মালিক তারা মিউজিক কতখানি বোঝে জানি না, তবে ব্যবসা খুব ভালো বোঝে। নিজেদের কিছু লোকজন দিয়ে জাজমেন্টের কাজটা সেরে ফেলে। প্রোপার জাজমেন্টের ওপর কোনো ব্যক্তি বা ব্যান্ড উঠে আসছে না। আমাদের তো মানুষকে জানাতে হবে বাজারে কি আসছে। তখনই তো মানুষ একলাইন হলেও শুনবে। সে-কারণেই প্রচারটা বড় একটা ব্যাপার। তবে সেটা সঠিক প্রচার হতে হবে।

কৃষ্ণকলি : যে-ধরনের গান হোক, যে-রুচিরই গান, যে-ধরনের আর্টিস্ট হোক না কেন, ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব হচ্ছে তা সর্বসাধারণের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। আর আমার মনে হয় আমাদের গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে গান একটা জীবনচর্চার মতো ব্যাপার। শ্রোতা হিশেবে তারা অনেক উঁচুতে। ভালো কোনোকিছু তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে তারা তা অবশ্যই গ্রহণ করবে। কিন্তু এই দায়িত্বটা কার? এক হলো ইন্ডাস্ট্রি আর দুই হলো মিডিয়া। ইন্ডাস্ট্রি যা করে তা হলো বের করে দিয়ে খালাস। মাঝেমধ্যে নিজস্ব বলের জোরে মিডিয়াকে ক্যাপ্চার করে। আর মিডিয়ার বিষয় হলো, আর্টিস্ট তার কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করবে, তবেই সে প্রচার পাবে। আসলে মিডিয়া সবাইকে নিয়ে সমানভাবে কাজ করবে সেটাই আমরা আশা করব। তবে সেই-রকম কোনো সাড়া আমরা তাদের কাছ থেকে পাই না। ব্যাপারটা এ-রকম দাঁড়ায় যে আর্টিস্ট যেন তার নিজের প্রচার নিজেই করে, যে-দায়িত্বটা আসলে ইন্ডাস্ট্রির এবং মিডিয়ার।

সজীব : বাইরে প্রত্যেকটা আর্টিস্টেরই একটা করে ম্যানেজার থাকে, যার কাজ হলো সঠিকভাবে প্রচারকাজটাকে সম্পাদন করা। আমাদের পরিসরটাও ছোট। সেখানে আমরা চাইলে নিজেরা এ-রকম একটা সিস্টেম চালু করতে পারি। আমি নিজেও চেষ্টা করছি।

শিবু : কোন হাউজ থেকে প্রোডাক্টটা বের হচ্ছে, শ্রোতার কাছে সেটাও একটা বিষয়। লোগো এখানে একটা ফ্যাক্টর।

জিয়া : আমার মতে অল্টার্নেটিভ ধারার কোনোকিছু বাজারে এলে সেটা মানুষ অবশ্যই গ্রহণ করবে, তবে সেটা তাদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাতে হবে। আমরা যদি তিশমার কোন অ্যালবামটা বাজারে আসছে সেটা প্রচার না করে ওকে নিয়ে কী কী স্ক্যান্ডাল বাজারে আছে তা নিয়ে লেখালেখি করি, তাহলে কেমন করে হবে?

সজীব : আমার প্রোডাকশন হাউজ আমাকে বলেছে যে, আমার প্রচারণার কাজ আমাকেই করতে হবে।

কৃষ্ণকলি : আমার কাছে আসিফের বিষয়টা খুব হাস্যকর লাগে। টানা দুই বছর পেপারে তার ছবি বের হবার পর সে স্টার হয়েছে। সে কী গেয়েছে তার জন্য সে কিন্তু স্টার হয়নি। যদিও আমরাই তাকে স্টারখ্যাতি দিচ্ছি।

জিয়া : আমি আমাদের একটা এক্সপেরিয়েন্সের কথা বলি। আমরা নিজেরা ইনিশিয়েটিভ নিয়ে ‘রেবিট প্রকাশনী’ থেকে আমাদের ‘জাহাজী’ অ্যালবামটা বের করলাম। নিজেরা বেশ খাটাখাটুনিও করলাম। কিন্তু সব জায়গায় একই প্রশ্ন উঠল, বাজারে সিডি পাওয়া যায় না। পরে একটা কন্সার্টে ‘জি সিরিজ’-এর সঙ্গে একই অ্যালবামের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলাম। তখন আমাদের এই কমপ্লেইনটা বন্ধ হয়ে গেল। কেননা তাদের একটা পাইপলাইন তৈরি করা আছে। তারা কোথায় কীভাবে মার্কেটিং করবে আর কীভাবে তা পৌঁছাতে হবে তা বেশ ভালো করেই করে।

শিবু : আমি নিজে একটা পত্রিকা-অফিসে আমাদের অ্যালবামটা বের হবার পর কয়েকবার গিয়েছি, কথা বলেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। এখন আমার করণীয় কী? আমি কি তখন বাচ্চুভাইকে ফোন করে বলব, ভাই একটু দেখেন, তিনি তখন ওই পাতার সম্পাদককে বলবেন, — একটু দেখেন, যদি কিছু করা যায়। এ-বিষয়টা কি ঠিক? এথিক্যালি আমার সেটা করা উচিত ছিল? কিন্তু তারপরও আমি করেছি। আর দাঁড়াল কি জানেন, পরবর্তী সময়ে আমার জন্য জায়গা বেরোল না কিন্তু আসিফকে নিয়ে একটা বড় কাভারেজ হলো। মার্কেটে কী হচ্ছে, কার অ্যালবাম বের হচ্ছে সেটা নিয়ে কি মিডিয়ারই খোঁজখবর নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত না? আমাদের তাদের কাছে কেন বারবার গিয়ে দাঁড়াতে হবে?

আমাদের সিডি বের হবার সময় একটা ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সময়ে আরেকজন বিখ্যাত আর্টিস্টের সিডি বাজারে বেরিয়েছে। আমরা জানতে পারলাম যখন লোকজন গিয়ে আমাদের সিডি বাজারে খুঁজত তখন নাকি তারা ঐ সিডির প্রচারণা চালাত। তারা আমাদের সিডি তিনটা পেলে সেই সিডি পেত আটটা। তাই তাদের প্যুশসেল করতেই হতো সেই সিডি, অথচ সেখানে আমাদের চাহিদা ছিল বেশি।

রেকর্ডিং ও প্রোডাকশন

সজীব : আগে ২৪ ট্র্যাকে অ্যামফ্যাক্স-এ গাইতে হতো; যাতে করে রেকর্ডিঙের সময় এবং লাইভে একইভাবে গাওয়া যায়। ওই বিষয়টা ভালো ছিল। আর এখন কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে, বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে এবং অনেক ধরনের গ্যাজেট ব্যবহার করছি, যাতে করে আমরা ভাববার প্রশ্রয়টুকু পাচ্ছি। খারাপ হলেও ভাবছি ঠিক আছে। আবার এখানে কারেকশনের সুযোগ আছে। আসলে আমরা মেশিনের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। যদিও সবকিছুর ফলাফল খুব তাড়াতাড়ি মিলছে। আগে পার্ফেকশনের ব্যাপারটা বেশি ছিল।

শিবু : আমি যখন ডিজিটাল জায়গায় বসে কাজ করছি তখন আমার মনে হয় সেখানে টিউন থেকে শুরু করে প্রতিটা বিষয়েই প্রোপার্লি কাজ করা সম্ভব। আমার কাছে যখন অপ্শন আছে, তবে কেন সেই সুযোগটা নেব না? তবে কণ্ঠের দুর্বলতা ঢাকার জন্য এর ব্যবহারে আমি বিশ্বাসী না।

সুমন : কম্পিউটারে বসে গিটারের একসঙ্গে তিনটা টোন দেয়া সম্ভব, সেটা ম্যানুয়্যালি পারব না। এই সুবিধাটা আমরা পাচ্ছি।

জিয়া : ডিজিটালি আমরা একটা টেক দিলাম কিন্তু সেটা আমাদের ভালো লাগল না — ঠিক আছে আরেকবার দেখি — এই বিষয়টা আছে। অর্থাৎ যাচাই করার বিষয়টা আছে। সেটা একটা ভালো ব্যাপার। কিন্তু একটা প্র্যাক্টিস আমার কাছে খারাপ লাগে যে, অনেক সফটওয়্যার দিয়ে অনেককিছু বানিয়ে ফেলা যায়।

কৃষ্ণকলি : আমার মনে হয় আমাদের পূর্ববর্তী সময়েরও কিছু সুবিধা ছিল আর এখনও আমরা অনেক সুবিধা পাচ্ছি। যেমন আমি সোলো গান করছি, অনেক ইন্সট্রুমেন্ট সাপোর্টই আমার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমি বর্তমান পদ্ধতিতে কম্পিউটারে কাজ করে সেই সুবিধাটা পেয়ে যাচ্ছি। আসলে আমি মনে করি কোনোকিছুরই ফেলে দেয়ার দরকার নেই। মিউজিক এমন একটা বিষয় যেখানে প্রচুর এক্সপেরিমেন্টের দরকার আছে।

তুহিন : আমার মনে হয় ডিজিটাল রেকর্ডিং হাউজে বসে আমরা খুব সহজে কাজ করে ফেলতে পারছি বলে আমাদের প্র্যাক্টিসের বিষয়টা অনেক কমে গেছে। আগে অনেক চর্চার পর রেকর্ডিঙের কাজটি হতো আর এখন আমরা ওই জায়গাতে বসেই অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে পারছি।

­প্রিয় গান

সজীব : আমার অ্যালবামের ‘চাকা’ গানটি বন্ধু নীলের লেখা। গানটি হাতে পাবার পরপরই বগুড়া যাচ্ছিলাম। গাড়িতে বসেই ল্যাপটপে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে দিয়ে কম্পোজ করে দেখলাম, অ্যারেঞ্জ করে দেখলাম। দেখলাম এবং ফাইন্যাল করে ফেললাম। এখানে, সেই চলার গতিটা আমাকে হেল্প করেছিল। অ্যা ট্রিপ টু বগুড়া অ্যান্ড আমার ‘চাকা’ ফিক্সড। এই-যে লিরিক এবং গানের অ্যারেঞ্জমেন্টের রিলেটেড বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছে।

কৃষ্ণকলি : আমার অ্যালবামের ‘সাতকাহন’ গানটি পৃথিবীর তাবৎ নারীদের নিয়ে করা, এখানে চন্দ্রাবতী থেকে শুরু করে মহুয়ার ব্যথাগুলোকে কমিউনিকেইট করা হয়েছে। তবে গানটি এসেছিল আসলে আমার মার সঙ্গে তর্ক করতে করতে। মাকে বলেছিলাম, তোমার এই সাতকাহন আমার জীবনে কন্টিনিউ হচ্ছে। এই গানটিতে আসলে আমার পার্সোন্যাল ইমোশন বেশি কাজ করে। তবে দুঃখের ব্যাপার, এই গানটিই সবচেয়ে কম পপ্যুলার।

জিয়া : আমাদের দুটো অ্যালবাম। ‘জাহাজী’ ও ‘ইচ্ছেঘুড়ি’। জাহাজী অ্যালবামের একটা গান ‘লাল-নীল গল্প’; গানটি নিয়ে প্রায় দেড়মাস টানা স্টুডিয়োতে পড়েছিলাম। তারপরও সেটিস্ফেকশন লেভেলে পৌঁছায়নি ব্যাপারটা। আড়াইশ’-তিনশ’ টেক দেবার পর গানটি ছেড়ে দিলাম।

সুমন : আমাদের অ্যালবামের ‘আমার শহর’ গানটি নিয়ে বলি। রাস্তায় হাঁটার সময় দেখতাম ল্যাম্পোস্টের ওপর কাক বসে থাকত, কখনো ভেজা অবস্থায় কখনো-বা খটখটে রোদ্দুরে। ওকে দেখে মনে হতো ওর অবস্থা আমার শহরের মতো। অনেক আন্দোলনের পরও অন্যায়ের পরও তা পাশ কাটিয়ে যাবার শক্তি আমাদের নেই। এখানে কাকের ওই নিঃসঙ্গতা, আমি সেটা ফিল করেছি পুরো শহরের ক্ষেত্রে, তবে আমরা গানটা যেভাবে করেছি সেভাবে হয়তো সবাই নিতে পারেনি।

আড্ডার পার্শ্বচিত্র

শুধু যে গান নিয়ে আড্ডাটা হয়েছে তা নয়। আমরা গান শুনেছিও ওদের কণ্ঠে। কথার প্রসঙ্গ ধরে অনেককিছুর উত্তরই ওরা গানে গানে দিয়েছে। নিজেদের ওরা কখনো-কখনো প্রেশারক্যুকারে চেপে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়, যেখানে অনেকক্ষণ পরপর একটা করে হুইসেল বেজে ওঠে। অনেকটা সেই কারণেও খোলা আকাশের নিচে এই আড্ডায় ওরা অনেক জমে-থাকা কথা খোলা মনে বলতে পেরেছে। বলতে পেরেছে অনেক ক্ষোভের কথা। পোলিটিক্যালি ও ইকোনোমিক্যালি যদি আমাদের দেশটা সাউন্ড থাকত তবে আমরা গান নিয়ে গত বছরগুলোতে অনেক দূর যেতে পারতাম, কালচারালি আরও ডেভেল্যপড থাকতাম, — এমনটাই ভাবেন তারা। তখন মৌলিক বিষয়গুলো আরও অনেক প্রাধান্য পেত।

সেলাম আদাব শুভেচ্ছা

আড্ডা শেষে আমরা গেলাম ছোট একটা নৌবিহারে। ডাঙায় বসে যদিও টুকটাক সবাই গান করছিল, কিন্তু কৃষ্ণকলির কণ্ঠে বেজে ওঠেনি একটুকু সুরও। নৌকা যখন মাঝদরিয়ায় তখন শিরদাঁড়া শক্ত করে সবার সঙ্গে সেও ধরেছিল — “সেলাম চাচা সেলাম তোমার পায় / বড় নাওয়ের মাঝি মোরে বানাইছে আল্লায় …

প্রতিবেদনের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলো ধারণ করেছেন শ্রাবণ রেজা; প্রতিবেদনকারী : বিজলী হক

 

প্রথম কিস্তি: গানের মানুষ ছয়জনা : আড্ডায় গানগল্প

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you