শহুরে বাংলা গানের সদর-অন্দর, তার সেকাল-একাল আর সমাগত কালটারে নিয়া লেখা আসলেই দরকারি। এসব নিয়ে লিখতে অবশ্য বিস্তর এলেম লাগে। আমার মতন গানের গো-অক্ষর বা গ্রামারটাই জানে না, একটা গান তৈরির কারিগরি বোঝে না, গানের লোকজনের সঙ্গে ওঠবস নাই টাইপের লোকের জন্য বিষয়টা রিস্কি হয়ে যায়। অতি সাধারণ শ্রোতা হিসেবে অধম বড়োজোর একটা গানের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বোঝাপড়ার কেচ্ছা ভানতে পারে। গানের বিবর্তনরেখা বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেইটা নিয়া দু-চার কথা বলতে ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে। যারা গানের কারিগর, সমঝদার শ্রোতা ও সাক্ষাৎ গানভাণ্ডারি…উনাদের গালমন্দ খাওয়ার ঝুঁকি প্রকট সেখানে। সাতপাঁচ ভেবে তাই আর আগানোর সাহস করি না। আপনাকে তো দেখতেসি।
সাত থেকে শূন্য দশক অবধি লম্বা সময়টায় Bengali Urban Song নিয়া লোকজনের মধ্যে প্যাশন তীব্র ছিল। প্রতি দশকে সাবালক হইতে থাকা তরুণরা গানগুলায় সাগ্রহে নিজেদের রিলেট করসিলেন। রিলেট হওয়ার মতো যুগউপাদানের প্রাচুর্য এর বড়ো কারণ। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্, হামিন, শাফিন, মাকসুদ, হাসান থেকে বেজবাবা সুমন, তুহিন ও আরো অনেকে এভাবে একটা প্রজন্মের হৃদয় চুরি করেছিলেন। পরবর্তী কুড়ি বছরে সেখানে আমরা ধস নামতে দেখসি। প্যাশন বা পাগলামি যা-ই বলি তার ধার কমে আসছিল। নতুন প্রজন্মের তুর্কিরা তাই বলে নিজের রাস্তা তালাশে ডরপোক বা পেরেশান ছিলেন এমন না। মেঘদল, সাবকনশাস, সোনার বাংলা সার্কাস, আরবোভাইরাসকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ হইতে দেখসি। হাতিরপুলকে দেখতেসি এখন। তাৎক্ষণিক মনে আসছে এ-রকম কয়েকটা নাম নিলাম এখানে। সোলো বা ব্যান্ডকে একত্রে গড় করলে আরো নয়াতুর্কির নাম নেওয়া যাবে। উনাদের সঙ্গে এখন যদি পুরোনো লিজেন্ডরা আড়মোড়া ভেঙে জাগতে থাকেন, ভিন্ন প্রজন্মের শিল্পীরা যদি একে অন্যকে গানে সংযোগ করেন, আমার মনে হয় বাংলা আর্বান স্যঙে ফিকে-হইতে-থাকা রোমাঞ্চটা আরেকবার দেখা দিবে। ক্যাসেট-সিডি আর কন্সার্ট কালচারের যুগ অন্যভাবে ফেরত আসতেও পারে সেখানে, যার উত্থান আমরা একসময় নিজের চোখে দেখসি।
বাংলা র্যাপ গানের ক্ষেত্রে কিন্তু এ-রকম একটা লক্ষণ ক্রমশ বলবান হইতেসে। আলী হাসানের ব্যবসার পরিস্থিতি গানখানাকে যার সূচনাবিন্দু মানতে আমার অন্তত আপত্তি নাই। বাংলা র্যাপের যারা কান্ডারি ছিলেন, খেয়াল করলে দেখবেন, উনাদের র্যাপবুলি ও পরিবেশনা বিগত কয়েক বৎসর যাবত গতানুগতিকে নিঃস্ব হইতেছিল। র্যাপের দেহে না ছিল ধার, না আবেদন! হাসানের কনভারসেশন র্যাপ-র কল্যাণে ছবিটা মনে হয় বদলাইতে শুরু করসে।
র্যাপগানের মূল কাজ, আমি মনে করি, প্রখর জীবনবীক্ষণের পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে কদম ফেলা। সেখানে নিজেকে একীভূত করতে না জানলে র্যাপ নিছক দ্রুতলয়ের উৎপাত বৈ কিছু না। তাৎক্ষণিক আবেদন ও ধাক্কায় গায়কিকে শ্রোতার কানে জোরদার করাও তার বড়ো কাজ। রাজনীতিসচেতন সত্তাকে র্যাপবুলিতে প্রকাশ্য করতে পারাটা সমান জরুরি। স্কিবখানের সব চুপ গানে যেইটা আমরা একসময় ঘটতে দেখসি। ব্যক্তির ইমোশন কিন্তু র্যাপগানের ক্ষেত্রে নিছক ব্যক্তির একার না, তার মধ্যে সামাজিক আবেগকে সুতীব্রভাবে মিশানো লাগে, এতে করে র্যাপ সময়ের চালচিত্র নিয়া মূর্তিমান হয় ও শ্রোতাকে আলোড়িত করে। অন্যদিকে রস-পরিহাস-প্রতিবাদ-কৌতুকের সবটুকু একদেহে একীভূত করার মধ্য দিয়া শ্রোতাকে বিনোদন দিতেও ত্রুটি রাখে না।
বিগত কয়েক বছরে র্যাপগানে বেসিকগুলা মরমর হয়ে আসছিল। আলী হাসান অদ্য একটা চেইঞ্জ নিয়া হাজির হইসেন। ঝুঁকি অবশ্য প্রচুর। র্যাপে নতুন চল আসা মাত্র অন্যরা গণহারে কপি করতে থাকেন এবং অচিরে সেইটা আবেদন হারায়। কনভারসেশন র্যাপ-এ ঝুঁকি ব্যাপক মাত্রায় আছে মনে হয়। তা-সত্ত্বেও বাংলা র্যাপ যারা গিলতে পছন্দ করেন সেখানে যে গুমোট-ম্যাদামরা ভাব আসর করছিল, ওইটা দূর করতে, র্যাপবুলিতে নতুন জোয়ার তুলতে আলী হাসান দরকারি ছিলেন।
ব্যবসার পরিস্থিতির পর বাজার গরম-এ তিনি বা তাঁর দলের পরিবেশনাকে আরো ম্যাচিউরড লাগছে কানে। গানটার মধ্যে খুঁত নাই বললে চলে। উপভোগ্য ও সমসাময়িক একটা র্যাপ। রাজনীতিসচেতনার জায়গা হইতে নিরিখ করলে যার তাৎপর্য গভীর। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের আদিকালে মাকসুদ সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্যকে গানের কথায় সরাসরি আঘাত দিয়া বসতেন। শ্রোতাদের কাছে উনার এই আঘাত উপভোগ্য ছিল। সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্যকে বাক্যবাণ হানার কর্মটা ক্ষেত্রবিশেষ আমরা এখনো করি কিন্তু তার ধার কি আগের মতো আছে? র্যাপেও এমনধারা শব্দবোমার ধাক্কা ফকির লাল মিয়া ও তাঁর সমসাময়িকরা কমবেশি কাজে লাগাইতে ভুল করেন নাই। শ্রোতারা লুফে নিয়েছিল উনাদের। তথাপি, মাকসুদের ব্যবহৃত শব্দবোমার ন্যায় র্যাপারদের বোমাগুলাও অতিব্যবহারে ক্লিশে লাগে এখন। শব্দগুলা প্রাসঙ্গিক, গানে উচ্চারিত সংক্ষোভ সত্য বা অমোঘ, মনকে তবু আগের মতো তারা চাঙ্গা করে না। সেই হাইপটা মরহুম যেইটা কিছুদিন আগেও জীবিত মনে হইত। মধ্যবিত্ত শ্রোতাকুলের জন্য প্রাসঙ্গিক এইসব শব্দবোমা থেকে আলী হাসান সরাসরি মুখের বুলিতে শিফট করতে সক্ষম হইসেন। গানের বিষয়বস্তু এমন যে শিফটিং সেখানে ঘটতে বাধ্য। তো এই জায়গা থেকে আলী হাসানকে বাংলা র্যাপগানে নতুন ট্রেন্ডসেটার মানতে আপত্তির কারণ দেখি না।
তাবিব মাহমুদের র্যাপবুলিতে যে-সম্ভাবনা আমরা একসময় দেখতে পাইসি, মধ্যবিত্ত শ্রোতাদের জন্য বাঁধাই হইলেও আবেদনটা মন্দ ছিল না। উনার র্যাপবুলির ওই ধারটা মনে হইতেসে অবসন্ন। ঢাকাই সিনেমায় এন্ট্রি নিলেও তাবিবকে খেইহারা লাগে এখন। ফকির লাল, ব্ল্যাক জ্যাং বা জালালি সেট…, ট্রেন্ডসেটার ছিলেন উনারা। র্যাপের বুনিয়াদ তৈরির শ্রমে উনাদের অবদান স্মরণীয়, কিন্তু অতীতের প্রাখর্য কি অদ্য বিরাজ করে সেখানে? নাকি উনারা এখন কেবল নিজের ছায়া? তাঁদের সাম্প্রতিক র্যাপবুলিকে মোটের ওপর আবেদনশূন্য লাগে কানে। হাসান এই ম্যাদামারা আবহে অম্লযান নিয়া হাজির হইসেন। সিয়াম হওলাদার, রিজান আর অনিক সাহা অদ্য আলী হাসানের দেখানো পথে হাঁটলেও পরিবেশনাটা মন্দ না। মার্কিনি র্যাপগানের চিরাচরিত ফর্ম্যাট থেকে স্বয়ংক্রিয় এক উপায়ে তারা বের হয়ে আসছেন। জিনিসটা আখেরে খারাপ মনে হইতেসে না। কেন তার ব্যাখ্যা গানপার-এ প্রকাশিত র্যাপকাহন সিরিজে আছে মনে করি। সুতরাং কথা আর না বাড়াই।
র্যাপ মানেই অন্য র্যাপারকে মুখের বুলিতে তুলোধুনা করার মধ্য দিয়া নিজের পাওয়ার জাহির করতে হবে…, গ্যাংস্টা র্যাপ-র ধারাটা দুনিয়া জুড়ে এতবেশি চলছে যে সেখানে বিশেষ আবেদন আর অবশিষ্ট নাই। হাসানদের র্যাপবুলি এদিক থেকে চিন্তা করলে শক্তিশালী। চারপাশের অসংগতি নিয়া গান পয়দার কারণে অসংলগ্নতা কম। মার্কিনদেশি র্যাপারদের কথা বাদ দিলে সিংহভাগ র্যাপার একটা সময় পার হওয়ার পর র্যাপগানের পরিবেশনায় ক্রমাগত ফ্যান্সি হইতে থাকেন। কর্কশ কিন্তু জোরদার শব্দবোমার পরিবর্তে লুতুপুতু ভাব চলে আসে পরিবেশনায়। ভারতে এমিওয়ে বানতাই, ডিভাইন, রাফতার, নয়েজি বা জাভেদ শেখ, এমনকি ব্যতিক্রম নিয়া হাজির রাজা কুমারীর র্যাপেও ঘটনাটা ঘটতে দেখসি। গুলি খেয়ে মরার আগে অবধি সিধু মুসওয়ালা বোধহয় ব্যতিক্রম ছিলেন সেখানে। এই পাঞ্জাবির র্যাপবুলিতে পাঞ্জাব প্রদেশের স্থানিকতার সঙ্গে মার্কিনির মিশ্রণকে কার্বনকপি মনে হয় নাই।
যা-ই হোক, র্যাপের প্রসঙ্গ এ-কারণে মনে এল, পপুলার কালচারে মেট্রোলাইফের নানা অনুষঙ্গ বহন করার ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে প্রাইডের জায়গা ব্যান্ড বা এর পুরোধা যারা ছিলেন কিংবা এখন পুরোধা হওয়ার পথে হাঁটতেসেন, উনাদের মধ্যে নতুনত্ব আরো ব্যাপক হইতে দেখা শ্রোতার জন্য উপকারি। গানের কথায় যেমন নতুনত্ব দরকার, তার পরিবেশন ও গায়কীতে জিনিসটা প্রচুর পরিমাণে ঘটানো গেলে ভালো। বাচ্চু-জেমস-হাসান-মাকসুদ-সুমন-তুহিনরা তাদের যা করার কথা ছিল সেইটা ষোলোআনার উপ্রে আঠারোআনা করসেন, এখন নতুনদের সঙ্গে বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়ুয়া, জন কবিরের মতো পুরোনো খেলোয়াড় যদি সত্যিই পাগলামিটা করার কথা ভাবেন, গানের টোটাল কম্পোজিশনে সমকাল ও চিরন্তনকে একত্রে ধারণ করতে ডরায় না এমন একখান পাগলাটে প্যাশনের দিকে উনাদেরকে আবার ফেরত যাইতে হবে, যেইটা উনারা গিয়েছিলেন একসময়।
সঞ্জীব চৌধুরীকে অকালে হারানোটা মনে হইতেসে আমাদের বড়ো ক্ষতির কারণ ছিল। বাপ্পার ব্যান্ডবাজি কিন্তু তারপর থেকে জবরদস্ত সব গান নিয়া শ্রেতাদের সামনে হাজির হওয়ার প্রেরণা বা সেই দমটা হারাইতে থাকে। যা-ই হোক, আলোচনাটা অনেক বড়ো ফ্রেমে করার জিনিস। ই-মেইলে যেটুকু মনে আসছে সেইটা টুকে রাখতেসি। সাধ্য যদি হয় কোনোদিন তখন না হয় আপনি-আমি ও অন্যরা মিলে বিস্তারিতে যাওয়া যাবে।
প্রাসঙ্গিক অন্যান্য রচনা
র্যাপকাহন
শুনুন/দেখুন জন কবিরের পডকাস্টে বাপ্পা মজুমদার
শুনুন/দেখুন বাজার গরম
আলী হাসানের অন্যান্য গান
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS