বিপরীতের বাস্তব বলে একটি কথা আছে; — প্রথমে তা আমরা পড়ি কথাবিদ দেবেশ রায়ের লেখায়। লেখাটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। প্রথমে এ-শব্দবন্ধ দেখে খটকা লেগেছিল। পুরো লেখাটি পড়ে শেষ করার পর স্বচ্ছ হয়ে যায় কেন তিনি ‘বিপরীতের বাস্তব’ ব্যবহার করেছেন। আজ মনে হয় দেবেশ রায় ঠিকই উপলব্ধি করেছেন রবীন্দ্রদর্শনের রহস্যটি। রবীন্দ্রনাথ তো জগতে বিদ্যমান বিপরীতের সৌন্দর্যকে সারাজীবন অবলোকন করেছেন। এ-মুহূর্তে বিপরীতের বাস্তব অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করছি সরাসরি। একদিকে আতঙ্ক, উদ্বেগ, শঙ্কা আর ভয়ে দিনানিপাত করছে মানুষ। এক্ষেত্রে সকলেই খুব অসহায়। তবে হতদরিদ্র, দিনমজুর, ভিক্ষুক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যৌনকর্মী, ফেরিওয়ালা সহ স্বল্প আয়ের মানুষ অসহায়ত্বে পড়েছে বেশি। তাদের কোনো কাজ নেই, আয়ও নেই। ঘরে খাবার নেই। উচ্চআয়ের মানুষেরা বাঁচবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কায়। কিন্তু নিম্নআয় ও সম্বলহীন মানুষের বাঁচার চিন্তা নয়, খাবার নিয়ে শঙ্কা। তারা মৃত্যুকে ভয় করছে না। তারা বাঁচবে কি না, এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আজ খাবার পাবে কি না, আগামীকাল সন্তানের মুখে খাবার দিতে পারবে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। এ লকডাউনের মধ্যে তারা ক্ষুব্ধ। তারা নানা জায়গায় খাবারের জন্য ধর্না দিচ্ছে, বিক্ষোভ করেছে। নিম্নআয়ের মানুষেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নানাভাবে। বর্তমান সরকার সহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাধারণ মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। সোজা কথা এ-রকম একটি বিপর্যয় সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। এ-পর্যন্ত সমন্বিত উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ ও মহামারী কোনোভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। এর প্রতিরোধ হলো মূলত প্রতিষেধক। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন, বা ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে, সামাজিক দূরত্ব, মেলামেশা, সরাসরি সাক্ষাতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়াও সবাইকে বাইরে বের না হয়ে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশে অবরোধ (লকডাউন) আরোপ করা হয়েছে। কোনোকিছু দিয়ে এ-করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কী হলে কী হবে — অনুমান করেই যাচ্ছেন। কিছু কিছু ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। আসলে মানবসভ্যতার এ-সংকটে কোনো ইতিবাচক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এ-সময় পার করা হচ্ছে মাত্র।
পৃথিবীর সকল দেশের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ এখন বন্ধ। ফলে, আন্তঃদেশীয় পণ্য বিনিময়, বাণিজ্য ও নানাবিধ যোগাযোগ অচল। দেশের ভেতরেও ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির এবং সমাজের অভ্যন্তরস্থ বিভিন্নমুখি সম্পর্ক এখন বন্ধ রয়েছে। সকল আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত রাখা হয়েছে। বস্তুত, সবকিছু স্থবির হয়ে আছে। এ স্থবিরতা, স্তব্ধতার শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। বিভিন্ন দেশে পণ্য বিনিময় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অভ্যন্তরে মালামাল পরিবহনে রক্ষণশীল অবস্থা বিরাজমান। এ সুযোগে মুনাফাখোর, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা মালামাল গুদামজাত করে দাম বাড়াচ্ছে। সরবরাহ নেই বলে পণ্য আটকে রেখে বিক্রি করছে না। উন্নত বিশ্বেও এখন খাদ্যসংকট চরমে। খাদ্য উৎপাদন যেমন বন্ধ হয়ে আছে, তেমনি চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। একে তো ঘরে থাকতে হচ্ছে আবার অন্যদিকে ভয়, আতঙ্কে সরবরাহের কাজে যেতেও শ্রমজীবীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। সবকিছু মিলিয়ে জীবনের গতি স্তব্ধ, থেমে আছে।
ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব মূলত শিল্পনির্ভর। শিল্প সেখানে মৌল শক্তি হওয়ায় নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। সেখানে কৃষি আর এখন ওইভাবে নেই।বিনোদনের বিষয়বস্তু হয়ে গেছে নগরকেন্দ্রিক। গড়ে উঠেছে পাব্, ক্লাব, ক্যাসিনো, সুপারশপ, মেগাশপ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে নাগরিক জীবনে সামাজিক যোগাযোগ ও ঘনত্বের কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুততর হয়েছে। এবারেও আগের মতো মহামারী প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সঙ্গনিরোধ ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এ-অর্থে শারীরিক বিচ্ছিন্নতায় যেতে হয়েছে। ফলে ইউরোপে যান্ত্রিক জীবনের সীমানায় তাদেরকে এ বিচ্ছিন্নতা ও অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। সীমাবদ্ধ পরিসরে থাকা, বিনোদনের ভোগবিলাসী আচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের জনসাধারণ ভীষণ চাপে পড়েছে। আবার তারা হলো দৈনন্দিন আয় ও ব্যয়ের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। প্রতিটি উপার্জনক্ষম মানুষ এ কারণে স্বনির্ভর। তারা অপরের কাছে নির্ভরশীল নয়। এর ফলে এখন তারা ব্যাপক অসহায়ত্ব বোধ করছে। পেশাগত দায়িত্বে ছকে-বাঁধা কাজে অভ্যস্ত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তারা প্রথাগত আচরণে অভ্যস্ত নয়। ফলে এ পর্যায়ে এসে তারা মানসিক চাপে পড়েছে বেশি। মানুষের করুণ মৃত্যুর মিছিল দেখে আরও বেশি চাপে পড়েছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক থাকাও কষ্টকর। ইতালি ও স্পেনে এমন কোনো পরিবার নেই যে তার কোনো সদস্য বা স্বজনের মধ্যে কাউকে হারায়নি। এ ভয়াবহ দৃশ্য যে-কোনো মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। এ অবস্থায় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে আছে। অনেকেই এ ক্ষতির পর আর দাঁড়াতে পারবে না। যে-আয় দিয়েই চলে ক্লাব, পাব্, বিনোদনমূলক এবং সার্ভিসসেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলো। যে কারণে রেস্তোরাঁ, শপিংমলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও এগুলোতে কেন্দ্র করে প্রচুর লোক কাজ করত। ইউরোপের পর্যটনশিল্পও এখন হুমকির মুখে। সব মিলিয়ে উৎপাদনহীনতায় জীবন ও খাদ্যসংকট চরমে।
আমাদের জীবনের সাথে তাদের চলাফেরার বিশাল ফারাক। আমরা শিল্পের দিকে দৌড়াচ্ছি কেবল। ফলে, আমাদের নগরায়ন হচ্ছে মাত্র। ওই নগরের লোভে অনেক মানুষ আয়, জীবনের তাগিদে শহরে-নগরে চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছে। ভাসমান ব্যবসায় জড়িত হয়েছে। রয়েছে সেখানে নানা ধরনের শ্রমজীবী। এরা সকলেই স্বল্পআয়ের মানুষ। করোনা সংক্রমণের কালে শুধু নয় এর আগেও আমরা দেখেছি সংকটকালে এ ধরনের লোকজনের সমস্যা হয় খুব বেশি। এরা নানামুখি সংকট ও ঝামেলার শিকার হয়। এমনিতেই তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে বুঝে না-বুঝে নিজেরাও বঞ্চনার কিছু নকশা, উপাদান তৈরি করে। ফলে, তারা বাঁচার আশা বা জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এ হতাশা থেকেই অনেক ক্ষেত্রে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই করোনা বাস্তবতায়ও এসব খেটে-খাওয়া মানুষের খুব সমস্যা হচ্ছে। আরেকটা বিষয় অতীব জরুরি যে, প্রতিকার নেই বলে ওই ভাইরাস প্রতিরোধে সকলকে ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেকেই আছে যাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই। এরা ভাসমান জীবনযাপন করে। এতিম যারা, তাদের স্বজন নেই, বাড়িও নেই। এদের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই এখন চরম কষ্টের। আছে নিম্নবিত্তের লোকজন। তারা সামাজিক দূরত্বের কারণে আটকে আছে। এবং কারও কাছে হাতও পাততে পারে না। এভাবে বহুবিধ সংকটে আমরা কারোনা প্রাদুর্ভাবকে আটকাতে চেষ্টা করছি, নিজেরাও আটকে আছি।
অন্যদিকে ভরসা হলো — এখনও আমাদের প্রচলিত কৃষিকাঠামো বজায় আছে। কৃষিকেন্দ্রিক আমাদের সমাজ হওয়ায় আমরা কিছুটা রক্ষা পেয়েছি। কৃষিনির্ভরতা আমাদের আপাত বাঁচিয়ে দিয়েছে। খাদ্যের জন্য হয়তো আমাদের ভিন্ন দেশে না চাইতেও হতে পারে। সঠিক সময়ে যদি এবারের ধান সামলানো যায়, তাহলে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব। সেক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন, বণ্টন এবং খাদ্য মজুদব্যবস্থায় আরও বেশি জোর দিতে হবে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য আমরা এ কৃষিজীবন ও খাতকে অবহেলা করেই যাচ্ছি।
এবার করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিলো — আমাদের প্রকৃতিতে ফিরে যেতে হবে, এবং কৃষিতে মনোযোগী হতেই হবে, যদি আাগামীর কোনো সংকটকে মোকাবেলা করতে চাই। বস্তুত, কারোনা মহামারী বিশ্বকে অস্থির ও ওলটপালট করে দিয়েছে। এই স্তব্ধতা, ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষের অনেক সময় লাগবে। এরপরও আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। করোনা ভাইরাস এ যান্ত্রিক সভ্যতাকে তছনছ করে দিয়েছে। এত মৃত্যুর ক্ষত সামলানো কঠিন বা সামলানোর উপায়ও নেই।
তবে এত দুঃখ, কষ্ট, দহনের বিপরীতে করোনা কিছু শিক্ষা দিয়েছে মানবজাতিকে। এমন বিপজ্জনক ও বৈরী সময় থেকে মানববিশ্বের শিক্ষা নেওয়া অতীব জরুরি বলে মনে করি। যেমন : করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঠিক অব্যবহিত আগে বিশ্বে যে-যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল, তা এখন নেই। আইএস-এর হিংসাত্মক কার্যক্রম, প্যালেস্টাইন-ইসরাইল, সিরিয়া-তুরস্ক, সউদি-ইয়েমেন সংকট, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উত্তেজনা, ভারতে নাগরিকত্ব বিল, আফগানিস্তানে তালিবান সমস্যা, ফিলিপাইনে সন্ত্রাসী সহ বিভিন্ন সংকট, সবগুলো এখন থেমে গেছে। তাহলে বোঝা যায় মানুষ মানবতার দোহাই দিয়ে যা পারেনি, করোনা তা করতে সমর্থ হয়েছে। মানুষ সভ্যতার দাবি করেছে ঠিকই, কিন্তু করোনা যা করল, মানুষ তা পারল না।
বিশ্বায়ন সবসময়ই ছিল। শুধু সময়ের আবর্তনে এর খোলনলচে পাল্টায়। এবারে করোনাউত্তরকালে বিশ্বায়নের মানবিক পরিবর্তন না হোক অন্তত কেন্দ্রচ্যুত হয়ে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্য একটি বড় বিষয়, যা এখন পৃথিবীতে নেই। করোনার কাছে পুঁজির শক্তি যে অসহায় তা এবার প্রমাণিত হলো। তা আর বিবরণ দিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। একচেটিয়া পুঁজিবাদ, দলন-পীড়ন-দমন সবই অসার প্রমাণ করেছে করোনা। রাষ্ট্রের যে দেয়াল তা হয়তো কাঠামোর জন্য প্রয়োজন, কিন্ত মানবিক বিবেচনায় এ দেয়ালের আসলে দরকার নেই। সকলেই জানে শীতল যুদ্ধের অবসান হলে মেরুকরণেরও অবসান ঘটে। পক্ষান্তরে বিশ্ব এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। যেদিকে পুঁজির শক্তি বেশি সেদিকেই টান পড়ে এবং ভরকেন্দ্র নির্ণিত হয়ে যায়। একচেটিয়া পুঁজির কারণে বিশ্ববাজার ব্যবস্থাও ওই শক্তির কাছে চলে যায়। সেখানে ক্ষুদ্র পুঁজির বিকাশ আর টিকে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে বিশ্বের সকল মানুষই উপকৃত হয়েছে। কিন্তু সামাজিক দায়বোধ একেবারে অপসৃত হয়েছিল। সে-থেকে প্রশ্ন উঠেছিল বিশ্বপুঁজির বণ্টনব্যবস্থা কীভাবে হবে। যেখানে শোনানো হলো যে, মানবিক বিষয় ও পরিষেবাগুলোর কোনো দেয়াল থাকবে না। সেক্ষেত্রে বিশ্বপুঁজির লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অবশেষে পরিষেবাগুলোকেও পণ্য বানিয়ে ব্যবসা শুরু করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো সবচেয়ে বেশি। খোলাবাজার ব্যবস্থায় মুনাফা মুখ্য, সেবা গৌণ। একটু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সোশ্যাল ডিসট্যান্স, আইসোলেশন, কোয়ারেনটাইন শুরু হলে বিশ্বের আবহাওয়া বদলে গেলো। বাতাসের মধ্যে কার্বনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে বলে পরিবশেবিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বলেছেন। কারণ, কার্বন নিঃসরণ কমে গেছে। আমরাও এর প্রমাণ পেলাম। এখন দূষণমুক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাসে আগে থেকে স্বস্তি অনুভূত হয়। বাড়ির বারান্দায়, খোলা কোনো জায়গায় দাঁড়ালে আগের চেয়ে কিছু ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। চারদিকে গাছপালা খুব সতেজ, সজীব পরিচ্ছন্ন মনে হয়। কারণ এখন সেভাবে ধুলা বা ময়লা সেগুলোর ওপর জমছে না। বনবনানী স্বাভাবিকভাবে এখন বিস্তৃত ও বিকশিত হচ্ছে। অন্য প্রাণি, পাখি, প্রজাপতিদল মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা যেন এখন তাদের রাজ্য ফিরে পেয়েছে। চেপে-রাখা প্রকৃতি এখন স্বাধীন। সামুদ্রিক পরিবেশও বদলে গেল। সমুদ্রসৈকতে ঝিনুক, শামুকের পরিমাণ বাড়তে লাগল। সেখানে দেখা গেল লতাগুল্ম আবার গজাচ্ছে। ডলফিনের ঝাঁক আসা শুরু হলো সৈকতে। পরিবেশ প্রকৃতি যদি স্বাভাবিক না থাকে তা হলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে ভুলে না। আমরা এই প্রকৃতি থেকে জীবনের উপাদান সংগ্রহে ধাপে ধাপে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ শুরু করি। আর নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তা ধ্বংস করেছি। এতে প্রকৃতি বিরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। এজন্য বলছি — মানুষের চাঞ্চল্য বেহিসেবি যান্ত্রিক ও শিল্প উৎপাদন এবং বাজারকেন্দ্রিক হওয়াতে প্রকৃতি সহ্য করছে না। এখন করোনাভাইরাসের ভয়ে আমরা নিয়ন্ত্রিত হওয়াতে প্রকৃতি তার আপন বৈশিষ্ট্যে নিজের রূপ সাজিয়ে নিচ্ছে। হয়তো বেশিদিন এ রূপ ধরে রাখা যাবে না। আমরা অনেক মৃত্যুকে গ্রহণ করে তারপর আবার ফিরে যাব ওই ধ্বংসের পুরনো অভ্যাসে।
আজকের বিশ্ব চিকিৎসাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, পরিবেশভাবনা বাদ রেখে মারণাস্ত্র গবেষণা ও ব্যবসা প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছে। প্রথাগত ব্যবস্থা সব ভেঙে পড়েছে। এজন্য নতুনভাবে এখন ভাবতে হচ্ছে।পরিবেশকে না বাঁচিয়ে এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন যে টিকবে না তা আবারও প্রমাণিত হলো।সকল উন্নয়নই যে উন্নয়ন নয়, এর প্রমাণ তো ভূটান। সেখানে অনুল্লেখ্য জিডিপি হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতির সাথে অকৃত্রিম সম্পর্ক থাকায় ভূটান এক মানবিক দেশে পরিণত হয়েছে।ফলে, করোনার এই মহামারী ও ট্রাজিক ঘটনাবলির মধ্যে ভিন্নভাবে অবশ্যই একালের মানুষকে ভাবতে হবে।
করোনার ধ্বংসাত্মক আক্রমণের শুরু থেকে পৃথিবীতে মহামন্দা দেখা দেবে বলে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ নানা অর্থনৈতিক সংস্থা শঙ্কা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও বলেছে করোনা আক্রমণের প্রভাব ও বিশ্বমন্দা সহজে শেষ হবে না। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, ইউরোপ পরিসরের তৃতীয় শক্তি হলো ইতালি, ওই দেশই এখন বিপর্যস্ত। ফলে, করোনা প্রাদুর্ভাবে ইতালি ও অন্য দেশগুলো ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে।
সোস্যাল ডিসট্যান্সিং অর্থে শারীরিক দূরত্ব মানবিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়। বলা হয় মানুষ সামাজিক জীব। এর বদৌ্লতে আগামীতে অনলাইন বিপণন ও কেনাবেচায় মানুষ মনযোগী হবে। এতে ইতিবাচক ফল হওয়ারই সম্ভাবনা রয়েছে। ডিজিটাল বিনিময় ও বাণিজ্য সকল দিক থেকেই লাভজনক। এটি ইউরোপে ও পশ্চিমা বিশ্বে সীমিত থাকলেও এখন সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে। পশ্চিমা কিছু সংবাদমাধ্যম এর মধ্যে কিছু জরিপ কাজও পরিচালনা করেছে। তারা দেখেছে যে, মানুষ ব্যস্ততার কারণে এখন আর শপিংমলে যেতে আগ্রহী নয়। এ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই তাদের ধারণা। এখন তারা অনেকেই বলছে শপিংমল, সিনেমা হলসহ বিভিন্ন ভিড়ের জায়গায় তারা যেতে আগ্রহী নয়। ফলে, অনলাইনে কেনাকাটার অভ্যস্ততা বাড়বে। কেউ আর সরাসরি টাকা জমা বা বিনিময় করতে চাইবে না। হতাশার জায়গা হলো এতে কর্মী কমে যাবে। চাকরির সুযোগও কমে আসবে। ব্যাংক সহ অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো এদিকে নজর দেবে এখন। ইতোমধ্যে তারা এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি কৌশলী বলা যায়।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে গুণ ও মাত্রাগত পরিবর্তন আসবে বলেই মনে হয়। COVID-19 এর প্রভাবে বিশ্বস্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোলনলচে বেরিয়ে এসেছে। যা আগেও বলেছি যে, এক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থা মনোযোগী নয়। যা আছে তা বাণিজ্যনির্ভর। এখন আমরা স্বাস্থ্যবিভাগের সকলকে সচেতন হতে দেখছি। শুধু পিপিই নিয়েই বিশ্বে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। তবে মৌলিক পরিবর্তনের দিকে আমরা যাচ্ছি বলেই মনে হয়। এখন টেলিমেডিসিন ও চিকিৎসার দিকে গুরুত্বারোপ করা হবে বলেই মনে হচ্ছে। করোনাপরবর্তী বিশ্বে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তারা দেখতে চাইবে তাদের কর্মক্ষেত্র, বাড়িঘর, পরিবহনব্যবস্থা নিরাপদ আছে কি না। এমনকি বিমানে ভ্রমণ করতেও মানুষ এখন ভীতসন্ত্রস্ত থাকবে। সেক্ষেত্রে অভিবাসন, ভ্রমণ প্রক্রিয়া আরও বেশি জটিল হয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি যে-কোনো সরকার, সংস্থাকে জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
আমরা এ মুহূর্তে বিশ্বব্যবস্থার নতুন জানালা দেখতে পাচ্ছি। করোনা সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সত্য। তবে পৃথিবী ভাঙচুরের অনেক ইতিহাস রয়েছে। আগের প্রাদুর্ভাব বা মহামারী এবং দু-টি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছিল। করোনার ভয়াবহ আঘাত এ ভূগোলের অনেককিছুই পরিবর্তন করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। এ ভয়াবহ সংকটেও ক্ষমতার কেন্দ্র নিয়ে টানাটানি হবে। অনেকেই বোঝাতে চাচ্ছেন যে, পুঁজিবাদের শেষ মানেই বিশ্বসভ্যতার সমাপ্তি। কথাটি এত সহজ বলে মেনে নেওয়া কঠিন। বিশ্বপুঁজিবাদ ভোগবাদ ও বাণিজ্যের লোভে সমস্ত বিশ্বের ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তন আর কোভিড-১৯ একইসূত্রে গাঁথা। ফলত, প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দিতে হবে।
বিশ্বপুঁজি যেখানে রাষ্ট্রহীনতার কথা প্রচার করে, আবার সীমারেখাও মেনে চল, — এক্ষেত্রে তারা জ্ঞান, মেধা, পুঁজি, পরিষেবার অবাধ বিশ্বায়ন প্রচার করে। কিন্তু অসমতাকে চলমান রেখে এবং দক্ষ, কর্মী জনগোষ্ঠীর কথা বলে আবার বিধিবিধানও নির্ণিত করেছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র দৃশ্যমান থাকে কিন্তু অদৃশ্যভাবে রাষ্ট্রহীনই করতে চায় নয়াপুঁজির বিশ্বায়ন। এ স্ববিরোধিতা যদি মানুষের অধিকার ও চাহিদাকে নিশ্চিত করত, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। রাষ্ট্র যদি না-ই থাকে তাহলে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব পালন করবে কে বা সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কি কি? এখানেই নিরুত্তর পুঁজিব্যবস্থা। ফলে, থমাস পিকেটি, কার্ল মার্কস ও অমর্ত্য সেনের দোহাই দিয়ে ন্যায়মূলক, সামাজিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তবে তথ্যপ্রযুক্তি ও খোলাবাজার ব্যবস্থায় সে-সামাজিক রাষ্ট্র সম্ভব কি না — এও এক প্রশ্ন। মূলত, পশ্চিমে উদারবাদী গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষকে হ্যাংওভারে ফেলে দিয়ে সংবেদনশীলতাকে ধ্বংস করা হলো। সে-দায়িত্বহীন উদারবাদেরই মাশুল দিতে হলো করোনাভাইরাসে। অতএব, বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তন যে আসন্ন এটুকু বলা যায়। এখন শুধু তা দেখার অপেক্ষা করতে হবে।
করোনা সংক্রমণকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে কোয়ারেনটাইন, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, আইসোলেশন ও অবরুদ্ধতা ইত্যাদি চালু করা হলো মানুষের কল্যাণেই। কিন্তু এসবের মাত্রাগত কিছু ক্ষতিও আছে। বিপণনব্যবস্থার রূপান্তর, সামাজিক ও মানসিক বৈপরীত্য এসব থেকে তৈরি হবে। এছাড়াও আইসোলেশন থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজব্যবস্থায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে। এ বৈপরীত্য থেকে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক দেখতে হলে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের সংশয় দূর হতে সময় লাগবে।
বিশ্বে পর্যটনশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিদেশভ্রমণে যদি স্বাচ্ছন্দ্য না থাকে তাহলে মানুষ ভ্রমণ করতে সাহস ও নির্ভরতা দুটোই হারাবে। বাণিজ্য, পণ্য চালাচালিতে অনলাইন কম শ্রমনির্ভর হলেও পর্যটন তো আর অনলাইনে চলে না। এ কারণে পর্যটনকে আবার স্বীয় অবস্থায় প্রতিষ্ঠা করতে স্বাস্থ্য সহ অন্যান্য নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করা সকল রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। এককভাবে রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে তা করা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত বিশ্বপুঁজিবাদ মানবসমাজের চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চিতির কথা বললেও কোনোটাই পালন করেনি। শুধু পুঁজির বিকাশে যা কিছু করা সম্ভব তা করেছে। করোনা আক্রান্তের পর অন্তত সেই ভয় এসেছে — এভাবে আর চলবে না। সেক্ষেত্রে পুঁজি রক্ষা করতে হলে মানুষের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকারের নিশ্চিতি প্রয়োজন। একইসাথে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বোঝাপড়ার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির ওপর অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আবারও এ অবরুদ্ধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে — করোনা মহামারী তা দেখিয়ে দিয়েছে।
স্বপন নাথ : লেখক ও শিক্ষক
… …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS