নদীর চর খালবিল গজারির বন / টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন || লাফিয়াজ হাসান

নদীর চর খালবিল গজারির বন / টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন || লাফিয়াজ হাসান

বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের সংস্কৃতি। আর তাঁতশিল্প আমাদের অন্যতম ঐতিহাসিক ধারক ও বাহক। দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প বা লোকশিল্পও এটি। টাঙ্গাইল জেলার তাঁতশিল্প সেই সর্ববৃহৎ শিল্পের অংশীদার।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনের সময় ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে মসলিন শাড়ির কিছু শিল্পী এসে টাঙ্গাইলে বসতি স্থাপন করেন। তাদের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প হিশেবে তাঁতশিল্পের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসে পাওয়া যায়, সে-সময় টাঙ্গাইলে মসলিন শাড়ি তৈরি হতো। প্রাচীনকাল থেকে টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগরেরা তাদের বংশপরম্পরায় তৈরি করে আসছেন নানা জাতের কাপড়। আর কাপড় তৈরি করতে লাগে সুতো। তুলা থেকে উৎপন্ন সুতো।

টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ির বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো অতি মিহি সুতোয় নিপুণভাবে বোনা। তাঁতে এই শাড়ি বোনার সময় মাড় দেওয়ার কৌশলটিও লক্ষণীয়। এই শাড়ি বোনার সময় নিপুণ শিল্পীরা তাতে নানারকম ফুল বা নকশা কাটেন। আর এই নকশাকাটা শাড়ির নামই জামদানি। জামদানি আরবি শব্দ, যার অর্থ ফুলকাটা বা নকশা তোলা। আর এ-কারণেই নকশা-তোলা শাড়ির নাম হয়েছে জামদানি।

জামদানি শাড়ির আদি এলাকা মূলত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। কিন্তু টাঙ্গাইলের মিহি তাঁতের শাড়িতে ফুল-তোলার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ি যাত্রা শুরু করে। এই শাড়ির ঐতিহ্য এখন টাঙ্গাইলের দখলে। টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ি রঙে এবং নানারকম বাহারে অনন্য। শুধু জামদানি নয়, টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়িও চিরায়ত বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ। জামদানি শুধু সুতিই হয় তা নয়, এখন সিল্ক ও সিন্থেটিক সুতাতেও এ-শাড়ি বোনা হয়।

তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত দক্ষতাভিত্তিক আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। কেউ চরকায় সুতা কাটছেন, কেউ-বা সুতা টানা দিচ্ছেন, কেউ আবার তাঁতে শাড়ি বুনছেন। সব মিলিয়ে তাঁতশিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বর্তমান ও প্রাচীন মিলিয়ে অনেক ধরনের তাঁত রয়েছে, যেমন — পাওয়ারলুম তাঁত, পিটলুম তাঁত, চিত্তরঞ্জন তাঁত ইত্যাদি। একজন পুরুষ তাঁতশ্রমিক দিনে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। আর একজন নারী তাঁতশ্রমিক বাড়িতে বসে নকশাকাটা, সুতাকাটা বা অন্যান্য কাজ করে দিনে আয় করে থাকেন ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।

বর্তমানে তাঁতশ্রমিক, তাঁতমালিক ও তাঁতব্যবসায়ীদের যৌথ প্রচেষ্টায় সার্বিক প্রতিকূলতা আগের চেয়ে একটু কমেছে বা খানিকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তাঁতের শাড়িতে এসেছে আধুনিক বৈচিত্র্য। আর বর্তমানে টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ির মূল্য ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।

পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও তাঁতের শাড়ি তৈরির কাজ করে আসছেন। টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লি হিশেবে খ্যাত অনেক এলাকা রয়েছে, এর মধ্যে কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, কুকরাইল, মমিননগর, দড়িখশিলা, কাজিবাড়ি ছাড়াও আরো অনেক গ্রাম রয়েছে। টাঙ্গাইলের অনেক উপজেলাই তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড তাঁতিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু শুধু তাঁতবোর্ডের সহযোগিতা তাঁতিদেরকে প্রয়োজনীয় উপকরণের পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারছে না। তাঁতশিল্প উন্নয়নের কথা ভাবলে সরকারিভাবে সহযোগিতার হাত আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। এবং তারপরেই এ-শিল্প নিয়ে সোনালি স্বপ্ন দেখা সম্ভব।

আমার ধারণা, তাঁতশিল্প হয়তো একদিন আর থাকবে না। কারণ, মানুষের চাহিদা পরিবর্তনশীল। আমরা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের কথা যদি ভাবি তাহলে মনে পড়বে যে এদেশের প্রতিটি বাঙালি নারী তাঁতের কাপড় পরতে পছন্দ করত। কিন্তু যতই ডিজিটাল দিনের দিকে মানুষ অগ্রসর হচ্ছে ততই নারীদের পোশাকের পছন্দ ও চাহিদায় পরিবর্তন ঘটছে। কাজেই আমার মনে হয় একদিন এই তাঁত বাঙালির ঐতিহ্য হয়ে থেকে যাবে শুধু।


রচনাটা গাঙুড়  ত্রৈমাসিকের জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ সংখ্যা থেকে গৃহীত। কবি ও লোককলা-অনুসন্ধিৎসু গবেষক অসীম সরকার কর্তৃক সম্পাদিত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক গাঙুড়। পত্রিকাটা অজিৎ স্মৃতি পাঠাগার, গলাইখালী, মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত। গানপারে পুনর্মুদ্রিত এই রচনার লেখকপরিচয়ের জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে, লেখক সিলেটের পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের একজন শিক্ষার্থী। লেখকের অনুমতি নেয়া সম্ভব না-হলেও পুনর্মুদ্রণকালে গাঙুড়সম্পাদকের সম্মতি নেয়া গেছে। — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you