দেবব্রতডম্বরু

দেবব্রতডম্বরু

শেয়ার করুন:

অবশেষে দেখা পাওয়া গেল তার, ভোররাতের দিকে। এক্স্যাক্টলি ইট ওয়্যজ্ কোয়ার্টার পাস্ট ফোর ইন দ্য আর্লি মর্ন। শোনা গেল তার মোহন মন্দ্র ডম্বরু। জর্জনির্ঘোষ। “বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে / কোন্-সে কবির ছন্দ বাজে ঝরোঝরো বরিষনে”…একটানা মাসব্যাপী যা তাণ্ডব গেল গনগনে গরমের! কাজেই বৃষ্টি এসে, ভোররাতের দিকে, ‘রেবানদীর তীরে’ যেন ছৈওয়ালা নাওয়ের নাগাল দেখিয়ে যায়, ‘শ্যামলশৈলশিরে’ যেন অঝোর বারিপাতের গায়ে কোমল পুলক লাগায়। গেল মাসব্যাপ্তির মধ্যে একেবারে হয়নি-যে তা না, হয়েছে এই তিনছটাকের মতন বৃষ্টি মাঝেমাঝে, আমাদের দেশে এই ছটাকমার্কা পানিপাতেরে কেউ বরিষন বলে না। রাতের অন্তিমে যেইটা হয়ে গেল, জর্জনির্ঘোষ বরিষন বলে এরে; হ্যাঁ, জর্জনির্ঘোষ; বজ্রনির্ঘোষ নয়। দেবব্রতডম্বরুশব্দে, জর্জনির্ঘোষ বরিষনে ভেসে গেল ভোররাতের তীর। বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়…

অবশ্য জর্জের যা সামর্থ্য, শক্তি যা, তা-ই সমস্যা বলেও মনে হয়েছে আমার কাছে চিরদিন। বাংলায় আমরা যারে বলি ব্যারিটোন ভোয়েস, বলি বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর, এর লিমিটেশনগুলো সম্পর্কে অ্যাওয়ার না-থাকলেই বিপত্তি। ঠিকমতো যদি, ঠিক সময়ে যদি, চুপাতে না পারেন, লুকাতে না পারেন, আপনার বজ্রঘোষালো কণ্ঠস্বর, যদি স্কিলের ব্যাপারটা উদোম হয়ে যায়, ক্ষ্যামতা দেখানো যদি শিল্পীর লক্ষ্য হয়ে ওঠে, এবং লক্ষ্য যদি শ্রোতার সমক্ষে ধরা পড়ে প্রকাশ্য অনায়াসে, ব্যারিটোন ব্যাপারটা ভালোগুণের পরিবর্তে দেখা দ্যায় বদগুণ হিশেবে। ব্যারিটোনওয়ালাদের ক্ষেত্রে এই বিপত্তি ঘটতে দেখা যাবে কোনো-না-কোনোভাবে, নানান গানে, নানান মাত্রায়। একেক সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে গলা, আর গায়কী হয় ব্যাহত, গোটা গানটাই নিরুদ্ধ হয়ে যায় গলার তজল্লায়। দেবব্রত বিশ্বাসের কথা মাথায় রেখেই কিন্তু কথাগুলো বলা হচ্ছে ভাবার কারণ নাই। যাদের ভোক্যাল কর্ড গডগিফ্টেড গমগমে, তাদের গান শ্রবণোত্তর কতিপয় সমুজদারের যে-একটা পাইকারি পজিটিভ অ্যাপ্রিসিয়েশন, যেন গম্ভীরতাবাহী গলার সাতখুনত্রুটিও মাফ, এমনকি গমগমে গলার আননেসেসারি গলাবাজিও অ্যাপ্রিশিয়্যাবল, এহেন পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চারপাশে দেখে দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উপস্থিত মুহূর্তে দেবব্রত ভর করে এই কথাগুলো টোকা গেল। পরে কখনো বিস্তারে যাওয়া যাবে এমন একটা আশা অন্তরে রেখে এ-যাত্রা পার হওয়া যাক লাফিয়ে।

ব্যারিটোন ভোয়েসের লিমিটেশনগুলো ধরা যায় আপনি নিজের মাতৃভাষায় যখন গান শুনছেন তখন। কথানির্ভর গান হোক, অথবা রাগপ্রধান গান—ব্যারিটোনের প্রোব্লেমগুলো ডিটেক্ট করা আদৌ কঠিন হয় না। ভাবের সঙ্গে সংগতি রাখতে পারছে কি না, আবেগ ছাপিয়ে ক্যার্দানি মুখ্য হয়ে উঠছে কি না, এইসব বিবেচ্য। গলাটা, ব্যারিটোনটা, গাইবার সময় ধাতব মনে হলেই মুশকিল। শুনবার সময় যদি মনে হয় সিমেন্টজমাট খাম্বার ভিতর থেকে একটা আখাম্বা আয়রন রড গাইছে, সেইটা যারপর-নাই যাতনার। হয়ে থাকে হামেশা এমন। জর্জের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে, এমনকি শান্তিদেবের ক্ষেত্রেও। কোনো কোনো রেন্ডিশনে, অবশ্যই, বিশেষভাবেই বিষয়টা শ্রুতিপীড়াকর হয়ে দেখা দেয়। এই মুহূর্তে এক্সাম্পল চয়িতে পারছিনে। চেনা ভাষার/ভাবাবেগের বাইরে অচেনা কারো ব্যারিটোন শুনে অবশ্য শুধু গলার কারুকাজেই বিমূর্ত পুলক পাওয়া যায়। যেমন পাভারোতি। ইটালিয়্যান অপেরাটিক টেনোর ল্যুসিয়্যানো পাভারোতি। অ্যানিওয়ে।

যেমন, ধরা যাক, শিল্পী বৃষ্টিবাদলাদিনের গান গাইছেন। এখন, বৃষ্টিদিন মানেই একচ্ছত্র গম্ভীরতা মনে করে শিল্পী ভীষণ গম্ভীরতা আঁকলেন গলা দিয়া, ত্রাহি অবস্থা হলো শ্রোতৃমণ্ডলীর সেই গাম্ভীর্য শ্রবণোত্তর, তাইলে তো হলো না। গাম্ভীর্যই বৃষ্টিদিনের একমাত্র চিহ্নায়ক নয়। আর গাম্ভীর্য মানেই নয় গভীরতা। চালু মিথটা এমনই যে গম্ভীরতা মানেই মহানুভবতা। গাম্ভীর্যই দামী মনে করেন বেশিরভাগ শিল্পী ও শ্রোতাসমুজদার। কিন্তু গম্ভীরতা ফাঁপাও হতে পারে। এবং ফাঁপাভাব ঢাকতে যেয়েও গম্ভীর হয় লোকে। ফাইন্যালি শিল্পকর্মের, সেইটা গান হতে পারে বা আর-দশটা মাধ্যমের যে-কোনোকিছু, ফ্লাইটটা জরুরি। সেই ফ্লাইট অনেক বডিঝাঁকানাকায় যেমন আসতে পারে, তেমনি গম্ভীরতাতেও উড়ান ঘটতে পারে। কিছুই পূর্বনির্ধারিত নয়।

কাজেই ব্যারিটোন হলেই মিউজিকমেলোডি আপনাআপনি এসে যাবে, নেভার এভার। ব্যারিটোন হ্যান্ডল করাটাই হচ্ছে ব্যাপার। আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী—কথাটা ব্যারিটোনওয়ালাদের ইয়াদ রাখা ফর্জ। কিন্নরকণ্ঠের অধিকারী যারা, তাদের ঝঞ্ঝাট অন্য জায়গায়, তাদের বিপদ আলাদা। ব্যারিটোনের কারণে ফ্লেক্সিবিলিটি ক্ষুণ্ন হবার, মডিউলেশন খর্ব হবার, ভাবগতিকের মধ্যে একটা আলগা আরোপিত অস্বস্তির বিপদটা তাদের থাকে না। তারা গাইলেই ন্যাচারাল লাগে মোস্টলি। প্রথম শ্রবণে অ্যাট-লিস্ট অস্বস্তিটা থাকে কম।

কয়েকদিন আগে আমাদের এক সহকর্মী তার আবাল্যযৌবনের নায়ক জর্জদার গান শুনতে যেয়ে প্রশংসা করছিলেন গলার পৌরুষের। খটকা লাগল তখনই। মনে হলো, গলায় কি কখনো ‘পুরুষ’-‘নারী’ থাকে? সেই সহকর্মীটি ভীষণ কোকস্টুডিয়োপাকিস্তানভক্ত। সন্নিকট উদাহরণ হিশেবে আব্দা পার্ভিনের গলা মনে করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসু হতেই উনি বললেন, হ্যাঁ, আলবৎ, আব্দা পার্ভিনের গলায় ইউনিক এক পৌরুষ ফুটে ওঠে। আমি আর কথা বাড়াই নাই। প্রাণভয়ে। কিন্তু আব্দা পার্ভিনের গলা শুনে চিরদিনই আমার কসমিক এফেক্টের কথা মনে হয়। যে-কোনো ব্যারিটোন ভোয়েসের ভালো রেন্ডিশন শুনে এই মহাজাগতিকতার বোধটা আসে ভেতরে। যেমন রশিদ খানের গলা শুনে মনে হয়, বেশিরভাগ সময়, একটা ধাতব আওয়াজ গমগমিয়ে তেড়েফুঁড়ে আসছে আমার দিকে। তেমন যুৎসই কোনোদিনই মনে হয় নাই রশিদ খান। উদাহরণ হিশেবে জেনারালাইজ করেই বললাম কথাটা।

ব্যারিটোন ভোয়েসের প্রশ্নে হেমন্ত মুখুজ্জে, কবীর সুমন প্রমুখ অনেক বাংলা গানকারের কথা পাড়া যাবে। এখন না কব কথা। অ্যানিওয়ে। একজন শিল্পীর নাম নিয়েই ক্যাপ টানব কলমে। খুব কম গেয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত জৈবনিক ট্র্যাজেডির কারণেই কি না জানি না উনি জীবনের মধ্যপর্যায় থেকেই গান একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন টুকটাক গাওয়া ছাড়া। বাংলাদেশপর্বে উনি বিশেষ কিছুই গান করেন নাই। অভিমানবশত? হয়তো। অথচ উনি স্টলোয়ার্ট ছিলেন প্রথমজীবনের সেই আইপিটিএ স্টেজ থেকে। তিনি কলিম শরাফী। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা গান, গণসংগীত, অনেকদিকেই উনার গলা খেলানোর নজির আমাদের সামনে আছে। এত শক্তি নিয়েও অল্প গেয়েছেন, অবাক লাগে। শুনেছি বাংলাদেশে এসে রেডিয়োর প্রতি কী-একটা ব্যক্তিগত অভিমান হয়েছিল উনার, পারিবারিক জীবনেও একটা আনেক্সপেক্টেড ঘটনার কথা জানি। কিন্তু উনার সম্পর্কে কেউ কোনো বই লিখেছেন কি না, পাচ্ছি না খুঁজে। দেহাবসানের পরে কি একটা স্মারক গ্রন্থ হয়েছিল? মনে পড়ছে না, তালাশ করছি।

জাহেদ আহমদ ২০১৬

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you