জঙ্গলে দেজাভু || আহমদ মিনহাজ

জঙ্গলে দেজাভু || আহমদ মিনহাজ

গেল রাতের সংগীতাবেশে মন এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘটনাটি গতকাল ঘটলেও মনে হচ্ছে নীরবতায় গুম তারাপুর চা বাগানের ঢালু পাদদেশে বহু যুগ ধরে বসা ছিলাম। আমাদের কারো বয়স একরত্তি বাড়েনি। এমন এক মহাকালের অংশ হয়ে সেখানে বসেছিলাম যাকে নিক্তি দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। বাগানে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা জীবনে নতুন নয়। আবাল্য এইসব অনতিউচ্চ পাহাড়ের চড়াই বেয়ে ওপরে ওঠা, চা-গাছের নিচের থিকথিকে সবুজ পাতার মেঘ ফুঁড়ে কচি সবুজ কুঁড়িকে চোখ মেলতে দেখা, ঝোপঝাড়ে ছাওয়া বনলতার ফোকর গলে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি…এইসব দেখে-দেখেই তো একজীবন কাটল! সময় নিঠুর রসিক বটে! এত্তটুকুন থেকে গায়েগতরে এত্তাবড়ো হওয়ার জীবনচক্র পুরা করতে গিয়ে দেখছি পরিচিতরা একে-একে নিখোঁজ। মায়ের গর্ভ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর ওইখানে টিলার ঘনসারি দেখেছি মনে পড়ে। শিশিরহিম শীতের দিনে টিলার ঢালুতে শুয়ে সকালের সোনা রোদ এই ত্বক শুষে নিয়েছিল। গ্রীষ্মে আচমকা ঝুম বৃষ্টি নামবে বুঝে রৈ রৈ কিশোর টিলার ঢাল বেয়ে দুদ্দাড় নেমে গিয়েছে ছন কিংবা জংধরা টিনের ছাদে ঘেরাও চাতালে। সেখানে চা-পাতার স্তূপ পড়ে ছিল। গেল রাত্তিরের সংগীতাবেশ স্মৃতিকাতর ওইসব দেজাভুকে আরেকবার জাগিয়ে দিয়ে গেল।

নাতিউচ্চ টিলা, ঘনসবুজ চা-পাতা, গরিয়ান বটবৃক্ষ, এন্তার ঝোপঝাড়, অনতিস্বচ্ছ ছড়া, টিয়াপাখির ঝাঁক, মাছের অপেক্ষায় বৃক্ষডালে বসা মাছরাঙা, দিকচক্রবালে মেঘমালা হয়ে উড্ডীন পরিযায়ী বালিহাঁসের দঙ্গল আর এতকিছুর মাঝখান দিয়ে কুঁচবরণ কুলি-রমণীর হাতের আঙুল সযতনে তুলে নিচ্ছে চায়ের কুঁড়ি…, তারা সবাই আপনাদের ‘অঙ্ক’ বা গাণিতিক সংখ্যা দিয়ে বোনা গানটির কলির মতো একে অন্যের গায়ে-গায়ে লাগোয়া ছিল দিনরজনী! মনের চপল খেয়ালে তাদেরকে আলাদা করে ভাবতে চেয়েও বিফল হয়েছি বারবার। জন্ম থেকে তারা পিঠাপিঠি ভাইবোন। রাত্তিরের গানের মজমা ডপকি ও মন্দিরার তালে ধীরে-ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে আর আমার তখন দেজাভুর অনুভূতি জাগছে চিত্তে। টিলায় ছাওয়া তারাপুর বাগানের নীরব পরিপার্শ্ব তো অধমের জন্মের মিতে। মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এইসব টিলার ফাঁকফোকর ও ঢাল দিয়ে গড়াতে-গড়াতে জানি না কখন বুড়ো হয়ে গেলাম! তারপর কিছু একটা ঘটেছিল। যারা আমায় জড়িয়ে রাখত তারা হুট করে অজানায় মিলিয়ে গেল! কালান্তক কাপালিক কেড়ে নিলো সখাদের, একদিন যারা অনায়াস ছিল জীবনে।

দেখার হাওরে দয়ালের দরশন পাওয়ার শিহরণে সকলে গলা খুলে গাইছিল, ওদিকে আমি দেখতে পাচ্ছি সারি-সারি দূরত্বে হিসাব করে বোনা রাবারগাছের ফাঁক গলে কৃপাণ হাতে কে জানি সরে যাচ্ছে! না তার মুখ দেখা যায়, না শরীর। তার কেবল হাত দেখা যায়। হাতের মুঠোয় নিঠুর কৃপাণ। কৃপাণের কোপে রাবারগাছের সাদা কষ রক্তের ফোয়ারায় পাল্টে গিয়েছিল। রব্বানি আল্লাহর জিকিরে সকলে তখন বুঁদ হয়েছি। ওদিকে মাটির তল থেকে গুম-গুম শব্দ উঠে আসছিল। কৃপাণহস্ত কাপালিকের মুখখানা চকিত চোখে ধরা দিয়েছিল সেই ক্ষণে।

আলোআঁধিয়ারে তার মুখ স্পষ্ট ঠাহর করতে পারিনি। আভাসে যেটুকুন দেখা গেল তাতে কাপালিককে জীবিত বিস্ময় বলে ভ্রম হচ্ছিল। তার চোখে সংহারের জিঘাংসা খেলা করলেও মুখখানা কোমল আর মায়াবি ছিল। মনে হলো লোকটি গানের টিয়াপাখির মতো নিরাশা সাঁতরে  মাত্র তারাপুর বাগানে ঢুকেছে। আপনারা তখন স্বয়ংক্রিয় স্রোতের মতো গানের কলি ও সুরের তালে উচ্চকিত হয়েছেন আর আমি কাপালিককে শিহরণভারাতুর হৃদয়ে প্রণাম ঠুকছি। সর্বনাশের হোতাকে জানি না কী কারণে মায়াবী ঘাতক লাগছিল। গানের সুরধারার মধ্যে কৃপাণ হাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এই শঙ্কা তুচ্ছ করে সারানিশি গানের মজমা ও কোরাসে উত্তাল হতে মন অনড় ছিল। গেল রাত্তিরের বড়ো প্রাপ্তি যদি বলি তবে সেটা এই,— সংগীত হচ্ছে সর্বনাশা আগুন; এই আগুনে আত্মাহুতি দিতে পারলে মিত্ররা ফিরে আসার সম্ভাবনা জাগে, সেইসব মিত্র যারা একদিন অষ্টাঙ্গে অধমকে বেঁধে রেখেছিল।

আপনারা গলা খুলে গাইছিলেন আর ওদিকে কাপালিক আমার মনের ওপর ভার হয়ে চেপে বসেছিল। চোখ মেলে এবং বোজা থেকে ওর ভয়াল কৃপাণ নিজের গ্রীবার নিকটে টের পাচ্ছিলাম। তার হয়ত অন্যত্র থাকার কথা ছিল। লোকালয়ে ছদ্মবেশে নিশ্চয় ঘুরঘুর করছিল। কাউকে সাধনার বলি করতে নরবলীর কুশলী সেনাপতি কংক্রিটে বোঝাই বাড়িঘরকে নজরে রাখছিল এটা নিশ্চিত। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, সুদূরকালে অঞ্চলটি কামরূপ কামাখ্যা নামে সুবিদিত ছিল। লোকেরা জাদুটোনায় পারদর্শী ছিল এখানে। কাপালিকের আস্তানা ছিল তারাপুরের ঢালু টিলার উঁচায় অথবা পাদদেশে। রাবারগাছ তার চেনার কথা নয়। সেখানে তখন অন্য গাছগাছালিরা ছিল। পরদেশি বৃক্ষরা এখন না সরলে তার বুঝি নিজের আস্তানাকে ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে না! গানের মজমাকে উপেক্ষা করে সে তাই অবিরত রাবারগাছের গোড়ায় কৃপাণ হেনে চলেছিল। রাবারের সাদা কষ রক্তে পাল্টে যাচ্ছে দেখে আমার শরীর হিম হয়ে আসছিল। গানের মূর্ছনায় তখন শিবচরণের বন্দনা চলছে। তাকে সোদর জ্ঞান করার উচ্চকিত বন্দনাগানকে বেশ আপন আর মানবিক মনে হচ্ছিল। মুহূর্তিক বিভ্রমদোষে হয়ত-বা শিবচরণকে কাপালিকের দেহে আর কাপালিককে তার মাঝে গলেমিশে একাকার হতে দেখেছিলাম।

মেট্রিক্স  ম্যুভির নির্মাতা ওয়াচোস্কি ভাইরা ক্লাউড অ্যটলাস  নামে একখানা ছবি বাজারে ছেড়েছিলেন। তার একটা সংলাপ তখন কানে ঘাই তুলছে। শিবচরণের সঙ্গে আপনাদের একাত্ম হওয়ার সুরমূর্ছনা শ্রবণ করতে-করতে সংলাপখানা বিড়বিড় করছিলাম, — From womb to tomb we are bound for others। বনবাদাড়ের লতাগুল্মে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শিবচরণকে পর ভাবার কারণ তো নাই। মায়ের গর্ভ থেকে সমাধি অবধি সে এবং সক্কলের ভাগ্য একসুতায় গাঁথা। জীবনচক্রের নিয়মে বৃক্ষরা টেঁসে যায়। লতাগুল্ম শুকিয়ে হেজেমজে পচে মরে। বেহিসাবি মানুষ থেকে ঘোর হিসাবি বা সংসারী লোকটা রসাতলেই গমন করে শেষতক। পচনের অনিবার্য স্রোতে এই সত্য কেবল পড়ে থাকে, — আমরা ধরায় জন্ম নিয়েছি নিজের জন্য নয়, গর্ভ থেকে সমাধির অন্তিম ক্ষণ অবধি একে অন্যের সহিত আবদ্ধ ও দায়বদ্ধ থাকার নিয়মে বেঁধে ঈশ্বর আমাদের প্রেরণ করেছেন। অন্যকে ছাড়া নিজেকে চেনা ভীষণ শক্ত কাজ। সুতরাং একজন শিবচরণ কিংবা দিলীপকে না চিনিলে নিজেকে চিনি এ-কথা বলার জায়গা থাকছে না। তাদের সঙ্গে বাকিদের তফাৎ স্থানকাল ও পরিপার্শ্বের। তাদের কাঁধে হাত না রাখতে জানলে তারা যেভাবে আমাদের সকলের কাঁধে হাত রেখেছিল তার মাহাত্ম্য বোঝা কঠিন হয়। সকল প্রাণ এই ভুবনে সহাবস্থানের তারে বাঁধা। আমরা তো কেবল মানবপ্রজাতির অংশ নই, সম্মিলিতভাবে গাছের, পাখির, নদীর, সাগরের অথবা ওই যে তৃণলতা অচিরে গলেপচে মাটিতে মিশে যাবে… তারা সব্বাই আমাদের জন্মসোদর।

মাটি হাতে ঈশ্বর প্রকৃতি সৃজন করেছিলেন। মাটির মধ্যে জল-স্থল-অন্তরীক্ষকে তিনি জুড়ে দিলেন। এই মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল বনিআদম। শিবচরণ আর দিলীপকে তিনি এভাবে সৃজন করলেন। ওরা তাই যতটা মানুষের ঠিক ততটাই বুনো ফুল ও তৃণলতার সহোদর। তাদের ভিতরে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বুনো অজগর ঘুমায়। আবার এই দিলীপ ও শিবচরণে ঘুম যায় শতপদ্ম। পদ্মরা শতদল হয়ে ফোটে বলে শিবচরণ চায়ের গেলাস বাড়িয়ে ধরতে পারে সবার দিকে। জন্ম থেকে সমাধি নিজেকে অন্যের জন্য নিবেদিত রাখার দায় সে মিটায়। তারপর একদিন মদের সঙ্গে দায়বদ্ধ রাখার কাল ফুরালে দিলীপকে মরে যেতে হয়। যে-জীবন সুগন্ধ বিলি করে বেড়িয়েছে তাকে অন্তিমে দুর্গন্ধের ভিতর ধুঁকে-ধুঁকে নিঃস্ব হতে হয়েছিল। দিলীপ এতদিনে জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। তার জীবাশ্মের রস শুষে নিয়ে রাবারগাছেরা হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে ধারণা করি। মরে গিয়ে বা ছাই হয়েও সে অন্যকে জীবন দিতে বেজায় ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা এই যে, গর্ভ থেকে সমাধি অবধি দিলীপ ও শিবচরণের এই অন্যের সঙ্গে আবদ্ধ থাকার অভ্যাসটি সুনাগরিক বলে নাম কেনা আমি বা আমরা মিটাতে পারছি কি না।

শিবচরণগাথার এই দিকটা মনে তোলপাড় তোলার মুহূর্তে কাপালিকের জলদগম্ভীর আওয়াজ কানে আঘাত হানছিল,— রে মূঢ়, এখন থেকে তুই আর না মাটির না ঈশ্বরের। না তুই জলের, নদীর, পাহাড়ের কীবা সাগরের। তুই শুধু তোর নিজের খাতিরে বেঁচে আছিস। রে পামর, তুই শিবের পদতলে ভূলুণ্ঠিত শিবচরণ নোস। তুই একলা একটা মানুষ। না তুই মেঘের, না মেঘদলের। তোর বক্ষে মরণ দিবানিশি কেঁদে ফিরে। প্রকৃতিকে সংহার করবেন বলে যে-তুঙ্গ নাচনে মেতে ভগবান শিব রুদ্র রূপ ধারণ করেন তোর এখন সেই ক্ষণ ঘনিয়েছে। কৃপাণে শিরশ্ছেদ তোর জন্য একমাত্র নিরাময়।

কাপালিকের গুমগুম আওয়াজ মাটির অতল ফুঁড়ে ওপরে উঠে আসছিল। ওদিকে জিকিরগানের ঝুমতালের মধ্যে রাবণসম কাপালিকের কৃপাণ থেকে রেহাই পেতে অধম স্রষ্টার কাছে নিরাময় চাইছিল। কী বলব, তারাপুরের নির্জনতায় আমি তখন প্রচণ্ড পিপাসায় ঝিঁঝি আর জোনাকিকে খুঁজে মরছি। মনে হচ্ছিল ঝিঁঝির একঘেয়ে গুঞ্জন ও জোনাকির পাছায় বাঁধা স্ফুলিঙ্গ শুধু পারে কাপালিকের কৃপাণ ঠেকাতে। আমার তো সাধ্য নেই যে আপনাদের মতো করে গলায় লহরি খেলাই! ঈশ্বর সে-দান থেকে অধমকে বঞ্চিত রেখেছেন। তাই খুব করে কোরাসের সুযোগ নিচ্ছিলাম। কাপালিকের কৃপাণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সকলের সঙ্গে নিজের বেসুরো আওয়াজ জুড়ে প্রাণপণে আত্মরক্ষার চেষ্টায় মগ্ন ছিলাম। সংগীত নিছক বিনোদন নয়, ওটা আত্মার গভীর থেকে উঠে-আসা বরাভয়। মানুষকে সে শিবচরণ বা দিলীপের মতো ডাকাবুকো হওয়ার প্রেরণা দিয়ে যায়। গত রাত্তিরে এই উপলব্ধি আপনার স্বরচিত ও সুরারোপিত সংগীতের মধ্য দিয়ে আরেকবার নবজন্ম নিলো। অধম ঋণি আপনাদের কাছে যারা এমন একখান রজনী উপহার দিলেন। প্রমাণ দিলেন, কাপালিকের কৃপাণের নিচে বসে সংগীতের সুরে বিদীর্ণ হওয়ার সাহস মানুষ হারিয়ে ফেলেনি। ঘরে ফিরে কথাটি যতবার ভেবেছি শরীরে শিহরণের স্রোত বয়ে গিয়েছে। বহুদিন ধরে ইট-কংক্রিটের নাগপাশে হাঁসফাঁস মানুর জন্য এই গীতরজনী পরম পাওয়া হয়ে দেখা দিলো বটে।


সে যা-ই হোক, এইবার দু-চারটে নিরস কাজের বাক্য বলে ইতি টানি। ঘরে ফিরে ঠিক কতগুলো গান শোনা হলো তার হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এককুড়ি অথবা কুড়ি- পঁচিশেক বা তারো বেশি হবে হয়ত। সংখ্যায় কিছু যায় আসে না, তবু মনে হলো কুড়ি থেকে তিরিশে গীত গানগুলোর মধ্যে নিবিড় ঐক্য থাকায় শ্রোতার পক্ষে তাদেরকে আলাদা করে গোনা মুশকিল ছিল। সবকয়টা গানের কথা এবং ভাব কবির সজাগ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বোনা। একজন কবি ঠিক এভাবে নিজেকে শিবচরণ ও দিলীপে অভিন্ন করেন। অতঃপর শিবচরণকে আবিশ্ব প্রকৃতিমাঝারে স্থান করে দিতে আকুল হয়ে ওঠেন। আপনার বিরচিত গানগুলোয় সর্বপ্রাণবাদী বা প্যানথিয়াস্টিক  অনুভব অকাট্য হওয়ার কারণে একটা থেকে অন্যটাকে পৃথক করা দুঃসাধ্য ছিল।

এই গানগুলোর শক্তির জায়গা এখানে এভাবে জন্ম নিয়েছে মানতে হয়। শুনতে-শুনতে অভিন্ন অনুভূতিপ্রবাহ মনকে আবিষ্ট রাখে। গানের ভাবরসে রঙ্গ-পরিহাস থেকে শুরু করে কবিতার ছায়ায় লতিয়ে-ওঠা রূপকের সংবেদী আওয়াজ শ্রোতার কানে গুঞ্জরিত করার প্রয়াসখানাকে তাই বেশ লেগেছে। আমার মতো মূর্খের নাতিক্ষুদ্র বিবেচনায় সংগীত দু-রকম হয়ে থাকে, এর একটি ধারা গানের কথায় মর্মরিত ভাবরসের (*লোকসংগীত বিশেষ করে বাউলগান এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।) সহযাত্রী। কথায় নিহিত ভাবরসের সওয়ার হয়ে সুর ও বাদ্যযন্ত্রকে সে ব্যবহার করতে উতলা থাকে। সুরের বৈচিত্র্য সেখানে অন্তিম গণ্য হয় না কিন্তু ভাবরসের কারণে এইসব কথানির্ভর গানের আবেদন অনিঃশেষ মানতেই হয়। বাউল ও রবীন্দ্রনাথ তো রয়েছেনই, চটজলদি উদাহরণ হিসেবে কবীর সুমন কিংবা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গানগুলোকে আমি এই ধারায় রেখে শোনার চেষ্টা করি। উনাদের গানে বিচিত্র অঙ্গের সুর সংযোজিত হলেও কথায় গুঞ্জরিত ভাবরস মনকে আগে টানে।

অন্য ধারাটিতে কথামুখরিত ভাব মামুলি হলেও সুর সৃষ্টির কেরামতি নতুন ভাবরসের জন্ম দিয়ে যায়। ধ্রুপদি, আধুনিক, ফিউশনআশ্রিত সংগীতের ব্যাপকাংশের কথা এখানে উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। আপনার বিরচিত গানগুলো প্রথম ধারার সঙ্গে সহজাত মনে হয়েছে। শ্রোতা হিসেবে নিজের একান্ত অনুভূতিতে যা ধরা পড়েছে সেগুলো বললাম। সমঝদার শ্রোতা বা বিশেষজ্ঞ সংগীতকার অধমের ভাবনাকে নাকচ করার ষোলআনা হক রাখেন বৈকি। আপনার গানকে প্রথম ধারার মনে করার নেপথ্যের কারণ এই যে, ডপকি-মন্দিরা ইত্যাদি গানের কথার তালে তাল দিয়ে চমৎকার বাজলেও গানগুলোর কথায় মর্মরিত ভাবরসে মন বেশি পড়ে থেকেছে।

স্বীকার যাই এইবেলা, গত রাতে গানগুলো শুনতে-শুনতে অখণ্ড অনুভূতির প্রবাহে ডুবে গিয়েছিলাম। এই প্রবাহটা কবীর সুমনের একাধিক গানের ক্ষেত্রে কেন জানি এখন আর ঘটে না। তাঁর গানের কথার প্রশংসা সবাই করেন, যদিও এ-রকম বহু গান তিনি লিখেছেন যেখানে কথায় নতুন ভাবরসের পরিবর্তে একেঘেয়েমির অনুভূতি মনে চাপ দিয়ে বসে, আর একে ঢাকা দিতে হয়ত সুরের ওপর তাঁকে অত্যধিক নির্ভর করতে দেখা যায়। ওদিকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গায়কিটা এমন যে গানের প্রতি পঙক্তি মাখনে ছুরি চালানোর মতো হৃদয়ে ঢুকে যায়। তাঁর গান যখন মহীনের সদস্যরা গাইতে থাকেন, বিনয়ের সঙ্গে বলি, ওই অনুভূতি আর জারি থাকে না। মনে পড়ে যায়, একখানা গিটার বা পিয়ানোর তরঙ্গ দিয়ে যে-কাম গৌতম অবলীলায় সেরে ফেলতেন সেই কাজে বিচিত্র বাদ্য জুড়েও তাঁর দলের সদস্যরা সবসময় কামিয়াব হতে পারেননি। সাহস করে কথাগুলো বলে ফেলার পর ভাবছি কী বলতে কী বলছি কে জানে! সে যা-ই হোক, আপনার গানের সম্পদ কথায় গুঞ্জরিত কবিতার রস, ওটাকে যেন আমরা কিছুতে না ভুলি। গত রাত্তিরে গানগুলো শুনে মনে হচ্ছিল বহুদিন পর প্যানথিয়াস্টিক  অনুভূতির সায়রে ডুবে যেয়ে আবিশ্ব প্রকৃতিকে নিজদেহে লীলা করতে দেখছি। বাংলায় এই ধারার গানকে সুরের বিবিধ কসরতে অনেক সময় অযথা নষ্ট করে ফেলা হয়। ভবিষ্যতে আপনারা গানগুলোকে যদি শ্রোতা-দর্শকের জন্য অনলাইনে উন্মুক্ত করার কথা ভাবেন সেক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত যে-আবেগের সাক্ষাৎ পেলাম সেটা যেন সেখানে বজায় থাকে।

এইবার বিচিত্র অঙ্গের সুর দিয়ে গানগুলোকে নতুন করে বাঁধার পক্ষে দু-চার কথা জুড়তে মন চাইছে। উত্তম একখানা গান বাঁধার ক্ষেত্রে সদা তার স্থানিকতা গুরুতর ভূমিকা রাখে। বাংলার জলমাটিহাওয়া শুষে যে-গান বাঁধা হয়েছে সে অবধারিত নিয়মে তার স্থানিকতায় সুলভ রাগ ও বাদ্যপ্রণালিকে আগে খুঁজবে। ঘটনাটিকে এখানে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া উচিত। আপনাদের গানগুলোয় সুর হয়ত এভাবে এসে জুড়েছে। তো এই স্বতঃস্ফূর্ত সুরযোজনায় শ্রোতা হিসেবে শ্রবণসুখকর অনুভব উপহার পেয়েছি সে-কথা আগে কবুল যাই। সেইসঙ্গে স্থানিকতায় দাঁড়ানো গানে বিদেশি বিট  বা স্বরসংগীত অথবা বাদ্যযন্ত্র জোড়া সংগত নয়,— শান্তিনিকেতনফেরত তরুণ চিত্রী ও বাদ্যযন্ত্রী দ্বীপের এ-রকম একখান কথার সঙ্গে বিনীত সহমত ও দ্বিমত পোষণ করি। সহমত এখানে যে, স্থানিকতার রসে বোনা গানে স্প্যানিশ বা আফ্রোবিটের সংযোজন বদসুরত হবে যদি সুরকার গানের কথায় মর্মরিত ভাবরস অবধানে ব্যর্থ হয়ে থাকেন। আপনার গানের কথাই ধরি, জিকির অঙ্গের গানে যেমন ধরুন আফ্রোবিট রামগড়ুরের ছানার জন্ম দিবে বলেই মনে হয়। এখানে বঙ্গের লোকায়ত সুর বা বড়োজোর উপমহাদেশের ইসলামি গীতধারায় ব্যবহৃত বাদ্যপ্রণালি অধিক মানায়। কিন্তু টিয়াপাখির কান্ধে সওয়ারি হওয়ার গানখানা, শেষের দিকে পরিবেশিত দেশাত্মবোধক, অথবা মধ্যপর্বে গীত একাধিক গানে বিদেশি সুর ও বাদ্যযন্ত্র (*যদি বুঝেশুনে প্রয়োগ করা হয়।) নতুন সুর ও অনুভুতি উপহার দিতে সক্ষম বলে মনে হয়েছে।

যারপরনাই, আপাতত আমাদের পরিচিত সুরের যে-কটি অঙ্গ ও বাদ্যযন্ত্রের সমাবেশে গানগুলো বাঁধাই হয়েছে তার বাইরে গিয়ে দেশিবিদেশি সুর ও বাদ্যযন্ত্র জুড়ে নিরীক্ষা বোধ করি করা যেতে পারে। আবারো বলি, ভাবরসকে ক্ষুণ্ন না-করে কাণ্ডটা যেন ঘটে, অন্যথায় সুরে বৈচিত্র্য এলেও ভাবরসকে সেটা খুন করতে পারে। আপনার কথায় নিহিত কাব্যশক্তি এই গানগুলার প্রাণ এবং সেটাকে কিছুতেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না। গানে ভাবরসের সঙ্গে সুর ও যন্ত্রানুষঙ্গে খানিক অদলবদল নতুন ভাব ও বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সহায়ক বলে কথাটি বলা।

জনান্তিকে বলে রাখি, কুড়ি-পঁচিশেক গান শুনে মন ভরেনি। ওগুলো তো অবশ্যই, বাকিগুলোও বারবার শোনা দরকার। এ-রকম আসরে তাই সময় সুযোগ বুঝে হাজির থাকতে চাই। সেইসঙ্গে গানগুলোকে পাণ্ডুলিপিতে বাঁধাই করা ও অনলাইনে একটা-দুটো করে অবমুক্ত করা জরুরি মানি। আপাতত শব্দপ্রকৌশলীর সাহায্য ছাড়া একটা-দুটো রেকর্ড ছাড়া যেতে পারে। পরে নাহয় ক্রমান্বয়ে আরো পেশাদার অঙ্গে গানগুলোর পরিবেশনা হবে। বাংলা গানের ভাবরসের শক্তি শতবিধ অনাচারে খতম হওয়ার পথে হাঁটছে। ভাবরস ও সুরের যৌথ সঙ্গতে আপনাদের গানের দলটির যে-কারণে আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সীমিত সংখ্যায় হলেও শ্রোতারা দেখুক, বঙ্গে এখনো কবিতা ও সংগীতের মেলবন্ধন কতখানি শক্তি ও শ্রী ধরে। দয়া করে কথাটা নিয়ে ভাববেন।


আবিশ্ব সর্বপ্রাণবাদী চেতনায় ডুবে যাওয়ার ক্ষণে আমার পক্ষে কাপালিকের থেকে চোখ সরানো সম্ভব হয়নি। একরাশ রাবারগাছের বাড়বাড়ন্ত চাষাবাদে ছায়াবিস্তারী শিশুগাছকে নিখোঁজ মনে হলো। সিদ্ধির প্রভাবে অথবা স্বভাবসুলভ রসিকতার গুণে কি না জানি না অলক ব্যাংয়ের ডাক শুনতে পেয়েছেন বলে দাবি করছিলেন। আমার কর্ণে ভেকধ্বনি অবশ্য পৌঁছায়নি। দেওলা মেঘ আকাশে ডম্বরু বাজালে ভেকমহাশয় ফুর্তিতে ডাকতে থাকেন। সে-রকম মেঘের দেখা ওই রাত্তিরে মিলেনি। ঝোপঝাড়ের সঙ্গে ঝিঁঝি ও জোনাকিরা মিসিং ছিলেন। তারা সক্কলে অবশ্য নানান ছুতোয় আপনার গানে সবাক হলেন। মনে হলো যাদেরকে হারায়েছি অথবা অচিরে প্রত্নস্মৃতির কিনারায় ঠাঁই করে নেবেন, তাদেরকে গাতক জাহেদ আহমদ স্মরণ করছেন। দেজাভু  তথা পুনর্জন্মের স্মৃতি তাই আবার ফিরে পেলাম। আসন্ন মেটাভার্সের দুনিয়ায় আপনার গানগুলো কেউ যখন শুনবে তার মনে হবে এ-রকম কিছু ছিল যেখানে সে কোনো-একদিন যাপন করেছে। এ-রকম দেজাভুর ইতিনেতি ভেবে মন ক্ষণিক বিষন্ন হলো বটে!

আপনার বোনা গানগুলো কদিন বাদে যখন আরো বুড়ো হয়ে যাব তখন শুনতে মন চাইবে, কারণ যা হারিয়েছে অথবা শীঘ্র হারাতে চলেছি তাদেরকে রক্তেমাংসে অনুভব ও যাপনের সুযোগ আগামীর পৃথিবীতে থাকবে বলে বিশ্বাস করি না। যারপরনাই তারাপুরে মায়াবী ঘাতক কাপালিকের কৃপাণের নিচে বসে উদযাপিত সংগীতরজনী আমার স্মৃতিতে চির অক্ষয় হয়ে থাকল। বাপন, বিমান, অলক, দ্বীপ ও অন্য সকলে মিলে স্মৃতিটা উপহার দেওয়ার জন্য অধম চিরকৃতজ্ঞ জানবেন।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: