এবাদ-মাসুদ সংলাপিকা : তারেক মাসুদ উবাচ

এবাদ-মাসুদ সংলাপিকা : তারেক মাসুদ উবাচ

‘সোনার বেড়ি’, ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’, ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘নরসুন্দর’ — এই সিনেমাকাজগুলোর স্রষ্টা তারেক মাসুদ। জন্মতিথি সিক্সটিসেকন্ডে তাঁরে নিয়া — বা তাঁর — আলাপচক্র হতে পারে মেমোরি রিকালেকশনের একটা ভালো উপায়। গানপারে তেমন কন্টেন্ট মজুদ নাই। রিপ্রিন্ট করা ছাড়া গত্যন্তর দেখি না। আর রিপ্রিন্টই যদি করতে হয়, তাইলে ভিড়ের বাইরেকার কিছু খুঁজে বের করা জরুর। পেয়ে গেলাম ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে এবাদুর রহমান প্রণীত ‘ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র’ গ্রন্থিকার ভিতরে অ্যাম্বুশ-করে-থাকা দারুণ দুর্ধর্ষ এক সংলাপিকা। ‘এবাদ-মাসুদ সংলাপিকা’। আলাপটা আর-দশ থোড়বড়িখাড়া সাক্ষাৎকারধাঁচা চাপান-উতর নয়, এবাদের উদ্দীপক ও তেজালো গদ্যে দেদার অ্যানেকডোট্যাল, ভাবান্তর, ট্র্যান্সক্রাইবকালে সম্ভাব্য পড়ুয়ার সঙ্গে শেয়ারিং-চিয়ারিং ইত্যাদি বিস্তর কম্যুনিকেটিভ নৈপুণ্যকলা অ্যাপ্লাই করার মাধ্যমে ব্যাপারটা এবাদীয় ভঙ্গিমায় একটা আলাদা পাঠোপকরণই হয়েছে। মাসুদেরই কথার ভিত্তিতে এই সংলাপিকাটা, বালখিল্য কথার-পিঠে-কথামূলক সাক্ষাৎকারমাত্র নয়, আরেকটু অধিকতর কিছু। তবে সেজন্যে এবাদের বইটা হাতে নিয়া পাঠ-পাঠান্তর দরকার। আমরা এইখানে এবাদের ট্র্যান্সক্রিপশনে যেটুকু কথা তারেক মাসুদ বলেছেন সেইটুকুই নিচ্ছি পড়ার জন্য। পুরো সংলাপিকাটা টাইপ করা আয়াস ও সময়সাধ্য। জরুরি ছিল পুরাটা পাঠ, হয়তো পরে সেই চেষ্টা করা যাবে ধীরেসুস্থে। এমনিতেই লেখার মালিক (লেখক যদিও গ্রন্থিক বলে প্রেজেন্ট করছেন গ্রন্থিকার প্রচ্ছদে নিজেরে) জানেন না আমরা তার বইয়ের অংশ ব্যবহার করছি, এবাদুর রহমানের সঙ্গে আমাদের কোনো সংযোগপরিচয় নাই, নিশ্চয় এইটা আমাদের অনধিকার এবং অপরাধ, তবু অনুমোদন চেয়ে একটা দরখাস্ত করব গ্রন্থিকের কাছে, এবং প্রশ্রয় পেলে সংলাপিকায় মাসুদের জবানিতে প্রেজেন্টেড বাকি কথাগুলো ক্রমশ পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগটা আমরা নিতে পারব। ততক্ষণ পর্যন্ত এই কিস্তিটা পড়ি এবং জেনে রাখি এই সংলাপিকার উৎস গ্রন্থিকার হদিস : ‘ডুবসাঁতার ও সিনেমাতন্ত্র’, গ্রন্থিক / এবাদুর রহমান, পাণ্ডুলিপি কারখানা, ২০০৯, ঢাকা। বাকি কথাগুলো বই থেকে এবাদুর রহমানের সঞ্চালন ও গ্রন্থনায় তারেক মাসুদের জবানি, নিচে প্যারাগ্র্যাফগুলো পরপর রাখা যাচ্ছে, যদিও কথাগুলো অংশত, অনেক জায়গা জাম্প দিয়া যাওয়া; জাম্পকাটগুলো পয়লা ব্র্যাকেটে একেকটি ত্রিবিন্দু যতিচিহ্নিত, কর্তিত অংশ বোঝানোর জন্য আমাদেরই ব্যবহার করা :

তারেক মাসুদ উবাচ :
যদিও আমাদের এই সিনেমা বানাবার লড়াইটা আমাদের কাছে বড় মনে হয়, কিন্তু, ল্যাটিন অ্যামেরিকা বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও এই লড়াই বিদ্যমান। (…) একটি প্রযুক্তি যা তুলনামূলকভাবে অর্বাচীন, আমরা তা বিদেশ থেকে এনে আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিস্থাপন করেছি এবং প্রমথেশ বড়ুয়া, নিউ থিয়েটার্স বা দেবিকা রানি হিমাংশু রায়ের বম্বে টকিজের সাফল্যের ভেতর দিয়ে আমরা দেখছি বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির একটি কাঠামোও দ্রুত দাঁড়িয়ে গেছে; এবং এই কাঠামো আমাদের নিজেদের মতো করেই তৈরি হয়েছে। অন্যান্য যে-কোনো মাধ্যম থেকে দ্রুত সিনেমা মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।

(…) আমাদের সিনেমা, আমাদের অন্যান্য যে আর্টফর্মগুলো আছে, আমাদের পপুলার লৌকিক যে ফর্মগুলো আছে সেসব থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সূত্র, প্রয়োজনীয় প্রাচুর্য দু-হাতে গ্রহণ করেছে; কিন্তু পপুলার আর্টফর্মগুলোর সাথে সিনেমার সখ্যের এটাই একমাত্র কারণ নয় … আমাদের অভিজ্ঞতায় যে ফোকআর্টগুলো আছে তা মূলত আখ্যান ও বয়ান নির্ভর, যেমন, যে-বয়াতি গান গাচ্ছে, সে গান পারফর্ম করছে আবার গানের ভেতর দিয়ে সে একটা বয়ানেরও বিস্তার ঘটাচ্ছে, কখনো গান থামিয়ে সে দর্শকশ্রোতাদের সাথে এই বয়ানের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলে তাদেরে এই গল্পের মধ্যে ইনক্লুড করে নিচ্ছে … এই গান একটি বয়ান এবং এই গান একটা মহাবয়ানের ভেতর হয়ে ওঠা বয়ান এবং গাতক সাহেব তার পারফরমেন্সে এটা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন বারবার। আমাদের সিনেমা তার অঙ্গ নির্মাণে এই বয়ান বিস্তারের কৌশলগুলো গ্রহণ করেছে কিন্তু গ্রহণ করেছে একটি ভিক্টোরিয়ান অবয়বের মধ্যে; আমাদের সিনেমা যতই লৌকিক বা জনপ্রিয় উপাদানের সমাহার ঘটাক এর মূল অবয়বটা ভিক্টোরিয়ান। আমাদের গান কীর্তন, ভাওয়াইয়া বা যাত্রা ইত্যাদি — যদিও এর বাণিজ্যিকায়ন হয়েছে — দর্শকদের মাঝখানে সংঘটিত হয়, এর চর্চা ও অর্থের সাথে দর্শকরা সরাসরি লিপ্ত; সিনেমা কিন্তু দর্শককে প্যাসিভ কনজিউমারই করে রাখে কারণ এর মধ্যে পাশ্চাত্য অবয়বটা পুরোপুরি হাজির। আমাদের বাঙালি চেতনা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সত্যিকার কোনো পরিবাহী, বাংলাদেশের সিনেমার ভৈত্তিক অবয়ব বা বয়ানভঙ্গিমা সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

(…) এখন অনেক হইচই হচ্ছে ও অনেক সিনেমাপণ্ডিত এমন দাবি করছেন যে বলিউডের মূলধারার ছবিগুলো ভারতীয়দের নিজস্ব সিনেমাভাষায় গল্প বলে; কিন্তু, বলিউডের এই নাচে-গানে ভরপুর মেলোড্রামার ভাষাও বা গল্পবলার বয়ানরীতিও ’৪০ দশকের হলিউডসিনেমা থেকে বের হয়ে এসেছে।

এবাদুর রহমান

(…) সিনেমার প্রযুক্তি আমরা গ্রহণ করলাম কিন্তু সিনেমাকে আমরা সঠিকভাবে ধারণ করতে পারিনি। আমাদের চলচ্চিত্রে আমরা আমাদের নিজস্বতার কোনো প্রতিফলন দেখতে পারিনি … পথের পাঁচালীকে বিদেশিরা ‘ইস্টার্ন’, ‘বোরিং’ বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু, পথের পাঁচালী দিয়েই আমাদের সিনেমার ভবিষ্যৎমুখী শিল্পযাত্রার শুরু … বাংলা সিনেমা এতদিন পশ্চিমাদের চলচ্চিত্রভাষা ব্যবহার করে বাঙালির গল্প বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সত্যজিৎ সেই ধারা ভাঙার প্রয়াস নেন এবং এবং ঋত্বিকও পাশ্চাত্যের সিনেমাভাষা নিজের মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যদিও সত্যজিৎ তাঁর লেখায় বলেছেন যে তিনি হলিউডের ছবি দেখে শিক্ষা নিয়েছেন, কিন্তু, তিনি নিজে ছবি বানাতে গিয়ে হলিউডের উল্টোপথে হেঁটেছেন। সত্যজিৎ ১৯৪৮ সালেই তাঁর লেখা ‘ওয়াটস্ রং উইথ ইন্ডিয়ান সিনেমা’-য় আমাদের সিনেমার প্রব্লেমগুলো তাঁর মতো করে সনাক্ত করছেন এবং নিজের কাজের ভেতর দিয়ে এর থেকে উত্তরণের প্রয়াস নিচ্ছেন … তিনি তো তপন সিংহ, গুরু দত্ত এদের কাজ একেবারে পছন্দ করতেন না … আবার ‘শোলে’ পছন্দ করছেন …

(…) সত্যজিৎকে নিয়ে বড় বড় কথা বলা হলেও তাঁর নির্মাণ থেকে বাংলা ছবি কিছুই শেখেনি … সত্যজিৎ রায়কে বাংলা সিনেমার গুরু মনে করা হয়, কিন্তু কোনো কমবয়সী পরিচালক তাঁকে অনুসরণ করেনি … তাঁর দেখানো পথে বাংলা চলচ্চিত্র হাঁটতে পারেনি … পথের পাঁচালী সারাবিশ্বে প্রভাব ফেলেছে … ইরানের সিনেমা, আফ্রিকার সিনেমা, বিভিন্ন দেশের নির্মাতাদের উপর সেসময় পথের পাঁচালী প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু, এই অঞ্চলে পথের পাঁচালীর প্রায় কোনো প্রভাবই নেই। বরং রূপবানের প্রভাব বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক বেশি।

চলবে 

গানপার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you