কাগুজে প্রেমদেবতা, লাজুক ঝুমকোলতা, কাঙালিনী প্রিন্সেস

কাগুজে প্রেমদেবতা, লাজুক ঝুমকোলতা, কাঙালিনী প্রিন্সেস

ভুল-শুদ্ধের সীমানা পারায়ে
একটা বাগান রয়েছে কোথাও অনাবিল কোনো অস্থানে
তোমার সনে মিলব সখা সেইখানে

সেদিন ‘ডায়ানা’ দেখতে যেয়ে এই লাইনগুলো পেলাম। “সামোয়্যার বিয়ন্ড রাইট অ্যান্ড রং / দ্যেয়ার ইজ্ অ্যা গার্ডেন / আই উইল্ মিট য়্যু দ্যেয়ার।” রুমির কবিতালাইন্স। ফ্রম দ্য পোয়েট রুমি। কিন্তু ম্যুভিতে এই ফ্রিভার্স্ ছাড়া, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির এই সুফি কালাম ছাড়া, আর-কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তাজ্ বা ক্যারিজমা কি নাই যা স্টার্টপ্যারায় অ্যাসার্ট করা যায়? একইসঙ্গে এর উত্তরে হ্যাঁ এবং না দুইটাই বলা যাবে। হ্যাঁ জয়যুক্ত হবে যদিও, বলা বাহুল্য, ম্যুভিটা যারা দেখবেন তারা এই রিভিয়্যুয়ের প্রভাবে যেন পয়লা প্যারায় নিরুদ্যম হইয়া না যান তাই কিছুটা ছাড় দিয়া আলাপের শুরুয়াৎ করে এইবার আমরা হাল্কাচালে ঝালার দিকে এগোব।

ছবিতে দেখানো হয়, ঠিক যেমনটা আমরা আগে থেকেই জানি, পাকিস্তানি হৃদয়চিকিৎসক তথা হার্টসার্জন ডাক্তার হাসনাত খান প্রিন্সেসের রিয়্যাল ল্যভ। দোদি আল ফায়েদের সঙ্গে প্রেমটা ম্যুভিতে একেবারেই স্বীকার করা হয় নাই। কিংবা যা আর যেভাবে দেখানো হয়েছে তা ‘হ্যারডস্’ নামের ব্রিটিশ ব্যবসালয়ের মালিকের অকালপ্রয়াত তনয়ের প্রতি ইনসাফ বলিয়া আদৌ মনে হয় নাই। রীতিমতো বোকা বানানো হয়েছে প্রেমিকহৃদয় আল-ফায়েদ ফ্যামিলির সুদর্শন তথা নারীমোহন নরটিকে। প্রেমিকা ডায়ানা আগাগোড়া ভান করে গেছেন পূর্বপ্রেমিকের পাষাণ মনে এনভি পয়দাইতে, সেই হেতু দোদিকে এস্তেমাল করেছেন ছলপটীয়সী নিঠুরা রাজনন্দিনী, এই ইম্প্রেশন ম্যুভিতে দেয়া হয়েছে ডেলিবারেইটলি। প্রিন্সেসের সনে একগাড়িতে অ্যাক্সিডেন্টকবলিত হয়ে মৃত্যুক্রোড়ে যেয়েও দোদি ডিরেক্টর মশাইয়ের মন গলাইতে পারেন নাই।

diana movieকিন্তু দোদি বেচারাকে দেখানো হয়েছে ঠিকই, প্রিন্সেসের প্রণয়ার্থী হিশেবে প্লেবোয়িশ দোদির প্রমোদতরী ইত্যাদি বাবতে বেশ-একটা হাইলি ইম্প্রেসিভ ইনভেস্টমেন্টের ইশারাও ঘটনার বিবরণপরম্পরা থেকে বেশ আন্দাজ করা যায়। হৃদিচিকিৎসায় কামিয়াব নামজাদা ডাক্তারের মাধ্যমেই প্রিন্সেস প্রথম মুক্তির স্বাদ লভিয়াছিলেন, ম্যুভিতে এইটা আমরা নানাভাবে প্রেজেন্টেড হতে দেখব। দোদির সঙ্গে প্রেমটা ডাক্তারকেই একহাত দেখানো, অথচ তীব্রভাবেই ডাক্তারকে কামনা। যা-হোক, রুমির কবিতার সঙ্গে ডায়ানার পরিচয় হয় ডাক্তারেরই মাধ্যমে। এই লাইনগুলো সঙ্গে সঙ্গে বাংলা করে মনে মনে রেখে দিয়েছিলাম, কে জানত যে এপিগ্র্যাফে সেই নিষ্কাব্য বঙ্গানুবাদ দিয়াই রিভিয়্যু করতে হবে একদিন ম্যুভিটার!

শুধু রুমিকাব্যই নয়, একটি সিনে কোরান নিয়াও যুক্তরাজ্যজনগণমনের গোলাপকে দেখা যায় আগ্রহী হতে। প্রেমিকের মানসগড়নের পেছনে যা যা ক্রিয়াশীল, সম্ভাব্য সবকিছু নিয়াই আগ্রহী হতে দেখা যায় প্রিন্সেসকে। অ্যাডপ্ট করতেও উৎসাহী। কিন্তু দোদি এবং হাসনাত — দু-দুজন ‘ইসলামধর্মীয়’ প্রণয়ী নিয়া রাজপরিবারে একটা চাপা টেনশন কি ছিল না সে-সময়? সিনেমায় এসবের লেশমাত্র নাই। ডিসকোর্স হিশেবে এইগুলো সম্ভাবনাময় ছিল ছবিসৃজনকালীন। কোনো সম্ভাবনাই ডিরেক্টর ছুঁয়ে দেখেন নাই। কিন্তু গাড়ির ডিকিতে করে নিশীথে অ্যাপার্টমেন্টে নাগর ঢোকানোর সিন কিন্তু পরিচালক মশাই স্কিপ করেন নাই। ইভেন গার্ডের অশ্লীল কটাক্ষও শুনাইতে কসুর করেন নাই গাড়ি গেটপাসের সময়। এই-রকম পুংনজরে দেখার দৃষ্টান্তে সিনেমাটা ভরপুর।

গোটা কাহিনি নির্ভর করেছে যে-বইটার উপরে, এমন গণ্ডায়-গণ্ডায় আখ্যান গত তিনদশকে ছেয়ে ফেলেছে বাজারহাট। মোটামুটি সবগুলোই নতুন মলাটে রসালো পুরান কিচ্ছা। ছায়াছবিওয়ালাও যদি দি নিউ অপেরা ফাঁদতেন একখানা, তা-ও অর্থ উসুল হতো অনেকটা। ডায়ানার প্রতি রিয়্যাল শ্রদ্ধা তর্পণ হতো, যদি এইসব রদ্দি রসালো বইয়ের অথেন্টিসিটি ভুলে ছবিয়াল একটা সাহসী মিথ্যাবাদী হতে পারতেন। সুলুকের নতুনতর সন্ধান না-ই মিলল যদি, মিলিয়ন-মিলিয়ন খর্চায় এইধারা ছাইপাঁশ বানাইবার বুদ্ধি ডিরেক্টরেরে দিয়েছে কোন ভূতে? এই কিসিমের কিছু কথাবার্তা ম্যুভি দেখে সেরে বেশকিছু কমোনোয়েলথভুক্ত ভূখণ্ডের ম্যুভিরিভিয়্যুয়াররা তুলতে চায়।

যেইটা আমরা আগে থেকেই জানি, বিভিন্ন মুখের বিভিন্ন মুখোশের মিডিয়া আমাদেরে যেইটা জানায়েছে শেয়ালস্বরে এক-ও-অভিন্ন স্বরগ্রামে, ঠিক টায়ে-টায়ে সেইটাই যদি ফিরে ফের জানতে পাই ফিল্ম নাম্নী হাইলি এক্সপেন্সিভ মাধ্যম মারফতে পুনরায়, কেমন লাগে ব্যাপারটা? বায়োগ্র্যাফারেরও অনুসন্ধান থাকে অ্যাট-লিস্ট প্রচল বয়ানের বাইরে/গভীরে যেয়ে একটুখানি তির্যক ভঙ্গিতে দেখতে এবং দেখাইতে। এই সিনেমায় ট্রাইটাও করতে দেখা যায় নাই ডিরেক্টর সাহেবকে। কেবলই নিউজপেপারে এবং চ্যানেলগুলোতে যে-ন্যারেটিভ শুনে এসেছেন এতদিন, শুনতে বেশ তোফা লাগলেও, ওই ভিয়্যুয়েরই ইকো শুনবেন এই সিনেমায়।

তাইলে এইটা আপনে দেখবেন কেন? হুদা টাইম কিল্ করতে কে চায় মানিমেইকিং এই মেদিনীমণ্ডলে? এক্কেবারে হুদা যাবে না তা-বলে, এক্কেবারে বেহুদা আল্লার দুনিয়ায় কিছুই নাই, একটাকিছু প্রোডাক্ট তো পাবেনই। কিংবা বাইপ্রোডাক্ট। ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়া আলাপ করতে পারবেন, ছবিদেখা সাঙ্গ করে, এইটা বাইপ্রোডাক্ট। কথা হচ্ছে, প্রোডাক্টই নাই যদি তো বাইপ্রোডাক্ট দিয়া আমি কি করমু? দুইহাজারতেরো সনে মুক্তি-পাওয়া ‘ডায়ানা’ আদতে একটা মাথা-নাই হরিণের ছাতামেলা শিং।

দুইঘণ্টা ব্যাপ্তির সিনেমায় একটা লাইনও খুঁজে পাওয়া যায় না যে-লাইনটা আপনি মিডিয়াশাসিত গত দুই/তিন দশকে পেপারপত্রিকায় পান নাই। প্রিন্সেসের জিন্দেগিতে প্রেম ছাড়া ভাবিত-হবার-মতো কোনো সংকট-সমস্যা নাই, হৃদয়দৌর্বল্য ব্যতীত কোনো ধর্তব্য দৌর্বল্য নাই, তনুমন-তোলপাড়-করা প্রাণপুরুষের প্রণয়কামনা ছাড়া আর-কোনো ধর্মকর্ম নাই। ডিরেক্টর মশাই প্রিন্সেসের প্রতি সিম্প্যাথির যেন শো-ডাউন করেছেন ম্যুভিব্যাপী। প্রিন্সেসের জীবনে বেজায় দুঃখ, উনার কষ্টের সীমাশুমার নাই, মদনজ্বালায় প্রিন্সেস ছটফটাইছেন ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানে কবরী-ফারুকের ছটফটানির ন্যায় — এই ইম্প্রেশনের ছাপ গোটা ছায়াছবি জুড়ে।

প্রেমে আপত্তি ছিল না, আপত্তি নাই হৃদয়কাণ্ডে, কাগুজে প্রেমের ব্যাপারেই রিজার্ভেশন আমাদের। কাগুজে বাঘেরই ন্যায় ফার্স ক্রিয়েট করে কাগুজে প্রেম ও অন্যান্য করুণ দৈত্যদানো। গল্পেগাছায়-কেচ্ছাকাহনে যেটুকু প্রণয়োপাখ্যান তিন-চারদশকে লতিয়েছে এই ইশ্যুতে, সেল্যুলয়েডে যদি সেইটাই পাই ভিন্নতর সমীক্ষা ছাড়া, তাইলে এইসব ডিরেক্টরগিরি ছেড়ে পাপারাৎসি নিউজপত্রিকার এডিটর হইলেই বেহতর হয়।

naomi watts‘হৃদয়ের রানী’ মিথ থেকে এই সিনেমার পরিচালক-স্ক্রিনপ্লেলেখক বেরোতে পারলে  এইটে একটুখানি সিনেমা হইবার সম্ভাবনা ছিল। অথচ গণধারণায় নিউট্রিয়েন্ট যোগানো ছাড়া ছায়াছবিটির কোনো অন্যতর অভিপ্রায় ছিল বলে দেখা যায় নাই। রয়্যাল ডাইন্যাস্টির প্রেস্টিজ পাংচার যেন না-হয় সেদিকপানেও পরিচালকের সজাগ চৈতন্য লক্ষণীয়। প্রিন্সেস ডায়ানার জীবনের শেষ দুটো বছরের সময়ফ্রেম দেখানো হয়েছে প্লে-ন্যারেটিভটিতে; এই দুই বছরে রাজপরিবারের সঙ্গে প্রিন্সেসের দ্বন্দ্ব ঘুণাক্ষরেও সম্মুখপর্দায় আনা হয় নাই। রানীর খোমা আমরা একবারও হেরিতাম যদি, বায়োস্কোপ দেখা সাত্থক হতো।

ভয়টা কোথায়? ঘাটের মড়া রাজতন্ত্র নিয়া আজও শ্রদ্ধানত যুক্তরাজ্য তবে তো ম্যুভি-লিট্রেচার করা ছেড়ে দিলেই পারে। ডেমোক্রেসির একটি বিউটি নিয়া তারিফ করতেই হবে এই সিনেমা দেখে উঠে সেরে; ডেমোক্রেসি নিরর্থ ভক্তিশ্রদ্ধা অ্যালাও করে না। আদারহ্যান্ড, কিংডম-ক্যুয়িনতন্ত্র ভক্তিশ্রদ্ধা ছাড়া নিরস্তিত্ব। দুনিয়া জুড়ে বেগড়া রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতা-দানবদর্প নিয়া ছায়াছবিগুলো বক্সব্লাস্ট করে নিত্য। কই, চিহ্নিত চরিত্রদের কেউ তো গোস্বা করে না!

নাওমি ওয়াটস্ অভিনয় করেছেন নামভূমিকায়। কেমন হয়েছে? একটা খারাপ স্ক্রিপ্ট আর ভোদাই ডিরেক্টর যদি বরাতে জুটে নাওমির মতো আপনারও, মনে রাখবেন তখন অত্যন্ত মজবুত কনফিডেন্ট পরীক্ষা দিয়াও উত্তরপত্র বাতিল হবে। চেষ্টার কমতি ছিল না নাওমির, অন্তত আউটল্যুক এবং অনেকটা ম্যানারিজম করায়ত্ত করে ফেলেছিলেন ইংলিশ/ব্রিটিশ মেধাদীপ্ত অভিনয়শিল্পীটি। কিন্তু ভরাডুবি ছিল অবধারিত। পরিচালক ছাড়া আর-সকলেই কি জিনিশটা আগেভাগে টের পেয়ে যান নাই? স্ক্রিপ্ট পড়ে ম্যাড়মেড়ে কি না তা চা-বালকের পক্ষেও বলে দেয়া আদৌ কঠিন নয়। স্ক্রিপ্ট গতানুগতের বাইরে হলে অবশ্য এডিটিং প্যানেলে এসে প্যাঁচ খাইতে পারে গুড্ডিটা।

ডায়ানার শাইনেস্, ঝুমকোলতার নমনীয় সলাস্য ভঙ্গিমা, সলজ্জ সপ্রতিভতা নাওমি অভিনয়ে এনেছেন ভালো। তবে ব্যক্তিত্বটা কোথাও ভঙ্গুর যেন। হয়তো রিয়্যাল লাইফে প্রিন্সেস তাই-ই ছিলেন, ভঙ্গুর, অতীব নমনীয়। তবু মনে হয় ব্যাপারটা আরেকটু অন্যভাবে এঁকে তোলা যেত। কতিপয় কারণে কাজেই ইম্যাজিশনে প্রবৃত্ত করে যে কে হতে পারতেন বিকল্প অভিনয়শিল্পীটি? ‘হাউজ্ অফ কার্ডস্’ সিরিয়্যালটা যাদের অভিজ্ঞতাভুক্ত, রবিন রাইটের চেহারা তারা ভাবতে পারেন। যদিও রবিন রাইট একটু বেশিমাত্রায় হার্শ, অনুষ্ণ, কর্পোরেটল্যুকিং শীতল ও ধাতব। গ্রুম করে নেয়া যাইত না ব্যাপারগুলো?

প্রণয়কাঙলামি নিয়া আর বলার কিছু দরকার আছে? বেচারা হাবাগোবা ছায়াছবিডিরেক্টর! মেটাক্রিটিক, রটেনটোম্যাটো, রজারইবার্ট প্রভৃতি ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল ম্যুভিক্রিটিসিজমের সাইটগুলো ধুয়ে দিয়েছে বেচারা অলিভার হির্শবিগেল সাহেবসুবো পরিচালকটিকে। এইটা উনার খাসলতের কামাই; আমাদের এখানে হেল্প করার কিছুই নাই।

diana
বিজনেস হয় নাই মোটেও? হয়েছে বেশ। নাকের নিচ দিয়ে ট্রেন গেছে, অল্পের জন্য কাটা পড়ত নাকটা, বা নাকে খত দিতে হতো। সদাপ্রভু ত্বরাই দিয়েছেন। পনেরো মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলারের বাজেটে বানানো ম্যুভিটা বাইশ মিলিয়ন পরিমাণের অ্যামাউন্ট উঠিয়ে এনেছে অ্যাকাউন্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এক্সপেন্ডিচার বাদ দিয়া পাঁচ-মিলয়নাধিক রইল। কম হয়ে গেছে? এই পদ্মলোচন দিয়া আর কত? যথেষ্ট হয়েছে। এইবার পরিচালকের দরকার একটা ভালো ম্যুভিলিটারেসির কোর্সে অ্যাডমিশন নেয়া।

Film Title: Diana ।। Genre: Biographical Drama Film ।। Directed by: Oliver Hirschbiegel ।। Starring: Naomi Watts, Naveen Andrews ।। Music by: Keefus Ciancia, David Holmes ।। Release Year: 2013 ।। Running Time: 113 minutes 

 

রিভিয়্যুয়ার : বিদিতা গোমেজ  

… …

COMMENTS

error: