দুর্গাপূজার হালচাল : সেকাল একাল || সুমিত্রা সুমি

দুর্গাপূজার হালচাল : সেকাল একাল || সুমিত্রা সুমি

 

পূজার হালচাল বদলে গেছে অনেক। এই পূজা শুধু ৫ দিনে সীমাবদ্ধ ছিল না।

’৯০ দশক। ভাদ্র মাস এলেই সব বাড়িতে বাড়িতে পূজা আসছে রব পড়ে যেত। শুধু মুখে নয় বরং কাজেকর্মে। বর্ষা শেষে আলমারির ৫০ বছরের গচ্ছিত অ্যান্টিক শাড়ি, শাল, পাঞ্জাবি রোদের মুখ দেখত। ন্যাপথালিনের ঘ্রাণে ভরা সেই দুপুরগুলোতে প্রশ্নে প্রশ্নে মাকে পাগল করা। একেকদিন ছিল একেক কর্মযজ্ঞের মতো। মা একদিকে ঘর ঝাড়পোঁছ করছে তো আরেকদিকে পিসি সব পূজার কাঁসা-পিতলের বাসন তেঁতুলে ধুয়ে চকচকে করে তুলছে, ওদিকে কাকা পূজার বাজারের ফর্দ করছেন। তখন পূজায় শাড়ি-কাপড়ের চিন্তা সবার আগে নয় বরং মহালয়ার পরে আসত। সবাই একত্র হওয়াই ছিল মুখ্য। কেউ আসতে পারবে না শুনলে তখন কী ভীষণ মনখারাপের দিন ছিল!

এরপর আসতো মার্কেটে যাবার দিন। তখন কেউ কাউকে পূজায় কাপড়ের জন্য টাকা দিত না। সবাই মিলে সেজেগুজে মার্কেটে যাওয়া ছিল দুর্গাপূজার প্রথম আনন্দ। সবার কেনাকাটা শেষ হতে হতে ক্লান্ত হয়ে হাতভরা ব্যাগ আর চকলেট চিপস নিয়ে ফেরা। এরপর শুরু হতো কার জামা কেমন হলো, সেটা নিয়ে নেচে বেড়ানো। তখন হঠাৎ করে মামা অথবা পিসিবাড়ির কেউ এসে চমকে দিত একব্যাগ নতুন কাপড় সহ। সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত সেসব দেখার জন্য। কেউ কিছু দিয়েছে এটাই চরম আনন্দ, সেটা কতটা মানানসই হল সেটা মুখ্য ছিল না।

ষষ্ঠীর দিন তখন মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় ব্রত পালন করতেন আর আমাদের কেমন একটা গর্ব হতো নিজের মায়ের জন্য। মন্দিরে যাবার সময় মায়ের দুই হাত ভর্তি পূজার উপচার থাকত, আমরা যেতাম মায়ের আঁচল ধরে। এই দিন নিরামিষ রান্না হতো।

সপ্তমীতে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হতো নারকেল কোরানো, গুড় জ্বাল দেয়া, দুধের ক্ষীর তৈরি। ঘ্রাণে বাসাবাড়ি মৌ মৌ। তখন এত ফ্রিজ ছিল না। নারকেল-গুড়ের পাক ঠিক কেমন হলে ১৫ দিন নাড়ু ভালো থাকবে, বাড়ির সবাই মিলে সেই হিসেবনিকেশ চলত। ছোটরা আশেপাশে ঘুরে কাঁচা নারকেল, গুড় খাওয়া থেকে শুরু করে রেডি নাড়ু পর্যন্ত ঘুর ঘুর করত। এভাবেই সপ্তমী কেটে যেত নাড়ু তৈরির উৎসবে।

অষ্টমীর সকাল। এই সকালের রোদও যেন বলতে চায়, তাড়াতাড়ি মন্দিরে চলো, অঞ্জলি হয়ে গেল! ছোট থেকে বড়, সবাই যেহেতু উপবাস রেখে অঞ্জলি প্রদান করে, তাই সকালে ছিল না কোনো রান্নার ঝামেলা। ঘুম থেকে উঠেই সাজ সাজ রব পড়ে যেত। শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করাটা ছিল প্রথম সাজের অংশ। এরপর শুদ্ধ নতুন কাপড় পরে সবাই সাজত। এর মধ্যে কয়েকজন আগেভাগে সেজেগুজে যখন দরজায় গিয়ে দাঁড়াত, তখনও কয়েকজন তাড়াহুড়ো করে লিপস্টিক নিয়ে ব্যস্ত। নতুন জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে শুরু হতো অষ্টমীর মন্দিরযাত্রা।

অষ্টমী নবমীর রাত দ্রুত হই হই করে কেটে যেত পূজামণ্ডপ ঘুরে ঘুরে। দশমীর সকালে মনখারাপ হয়ে যেত। কেন পূজা আরো দুইদিন বেশি হলো না, সেই আক্ষেপে। বিসর্জনের পর সবাই সিঁদুর খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরে লুচি মিষ্টির আয়োজন শুরু করত। কারণ এইসময় আত্মীয়স্বজনরা একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে বিজয়ার প্রণাম/আশীর্বাদ জানাত। লুচি নাড়ু মিষ্টি না-খেয়ে কেউ ফিরে যেতে পারত না। মুসলিম প্রতিবেশীদের বাড়িতে এইদিন লুচি নাড়ু মিষ্টির থালা সাজিয়ে দেয়াটা ছিল সবচেয়ে আনন্দের।

এরপর ধীরে ধীরে মোবাইল এল। সবাই খুব ‘ব্যক্তিত্ববান’ হয়ে উঠল। এত ধর্মীয়, পারিবারিক রীতিনীতি মেনে চলাটা কেমন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে লাগল। সবার রুচিবোধ এত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল যে অন্যের পছন্দে আর জামাকাপড় পরতে চায় না। প্রতিটি নিজ সিদ্ধান্তে হবে, ঠিক যেমনটা সাজলে ফেসবুকে লাইকের বন্যা বয়ে যাবে। সুগার-ফ্রি ও কস্ট-ফ্রি থাকার জন্য নাড়ু বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। অনলাইন শপিঙের যুগে মার্কেটে এখন আর যাবার তাড়া নেই। দোকানির সাথে অযথা দর-কষাকষির সময় নেই কারো হাতে। সবাই খুব ব্যস্ত। শপিঙের সময় নেই, নাড়ু বানানোর সময় নেই, অঞ্জলি দেয়ার সময় নেই, সময় নেই কারোর বাসায় গিয়ে প্রণাম জানানোর। তাই নাড়ু লুচি মিষ্টি বানানোর তাড়া নেই আজ মায়েদের। মায়েরা খুব নিঃসঙ্গ আজ। সবাই ফেসবুকে শুভেচ্ছা-প্রণাম জানায়, কিন্তু ওনারা আশীর্বাদের ভাষা টাইপ করতে জানেন না।

শুভ শারদীয়া!
অক্টোবর ২০২৪


গানপারে দুর্গাপূজা

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you