ভোটের গান রচনায় শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী

ভোটের গান রচনায় শাহ আবদুল করিম || আজিমুল রাজা চৌধুরী

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম কেবল একজন বাউল ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণমানুষের কবি। সাধারণ মানুষের মনের কথাগুলো ফুটে উঠেছে তাঁর গানে। আপোসহীন, জনদরদি, মানবপ্রেমী, সমাজসচেতন ব্যক্তি ছিলেন শাহ আবদুল করিম। অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টে ভরপুর জীবনেও কখনো বিক্রি হননি স্বার্থের কাছে। অন্যায়ের কাছে শির নত করেননি। সারাজীবন লিখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম করেছেন শোষিতের পক্ষে শোষকের বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর একটি গানে বলেন :

তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখদুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবি
করিম চায় শান্তিবিধান।।

বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামে রয়েছে শাহ আবদুল করিম সাহেবের সরব উপস্থিতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার রক্ষার প্রতিটা সংগ্রামে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় রচনা করেন অসংখ্য গণসচেতনতামূলক গান। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে সান্নিধ্য পান মাওলানা ভাসানী সহ জাতীয় নেতাদের। সেই সম্মেলনে একসাথে গান করেন গনমানুষের আরেক বিপ্লবী কণ্ঠ কবিয়াল রমেশ শীলের সাথে। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু খুব ভালোবাসতেন এবং সম্বোধন করতেন ‘আমার করিমভাই’ বলে।  বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও শাহ আবদুল করিম রচনা করেন গান :

পূর্ণচন্দ্র উজ্জ্বল ধারা
চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান।।

জয় জয় বলে এগিয়ে চলো
হাতে লও সবুজ নিশান
জাগো রে মজুর কিষাণ।।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার খবর শুনে শাহ আবদুল করিম ভেঙে পড়েন। এরপর আর-কোনো দলের বা ব্যক্তির পক্ষে তিনি আর সরাসরি যাননি। দেশের দুরবস্থা এবং শাসকগোষ্ঠীর শোষণ তাকে সবসময় পীড়িত করত। তাই তো গণমানুষের পক্ষ নিয়ে একাই চালিয়ে যান তাঁর লড়াই। ভোটের সময় এলে নেতারা শাহ আবদুল করিম সাহেবকে তাদের জনসভায় জোর করে নিত কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরে কে কার খোঁজ রাখে? নির্বাচনী জনসভায় সাধারণ জনগণ এবং ভোটারেরা নেতাদের একবাক্যে বলত বক্তৃতা দেয়া লাগবে না ভোট আপনারারে দিমুনে। আমরা করিমভাইয়ের গান শুনতে চাই। সেই সময় মানুষের চাপে নেতারা বক্তৃতা বন্ধ করে করিম সাহেবকে গান গাওয়ার জন্য মাইক হাতে দিত। করিম সাহেব দলমত না দেখে শুরু করতেন গণজাগরণের গান। উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে করিমভাইয়ের গান চলুক চলুক বলে স্লোগান দিতো।

শাহ আবদুল করিম তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : আমি নিজে একজন শোষিত গরিব মানুষ। তাই আমার কথাগুলোই শোষিত মানুষের মনের কথা হয়ে যায়। নির্বাচনকেন্দ্রিক ভোট দেয়া এবং প্রার্থী নির্ধারণ নিয়ে শাহ আবদুল করিম সাহেব অসংখ্য গণসচেতনতামূলক গান রচনা করেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো গানগুলো তেমন পরিচিত না। তাই আমি ওইগুলো সামান্য এই রচনায় তুলে ধরতেছি।

একজন স্বশিক্ষিত বাউল কি করে সহজ কথায়, সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের মনের ভাব তাঁর গানে ফুটিয়ে তোলেন তা না শুনলে, না পড়লে বোঝা মুশকিল। কিভাবে তিনি প্রতিবাদ করেছেন তাঁর ক্ষুরধার লিখনীর দ্বারা শোষকের বিরুদ্ধে তা নিচের গানটি পড়লে বুঝতে পারবেন। তিনি ভোটে অংশগ্রহণকারী শোষকদের ভোটশিকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহ আবদুল করিম বলেন :

ভোট দিবায় আজ কারে?
ভোটশিকারী দল এসেছে
নানা রঙ্গ ধরে!
ভোট দিবায় আজ কারে?

দেশে আইলো ভোটাভুটি
পরে হবে বাটাবাটি
তারপরে লুটালুটি
যে যেভাবে পারে।।

কেউ দিতেছে ধর্মের দোহাই
কেউ বলে সে গরিবের ভাই
আসলে গরিবের কেউ নাই,
গরিব ঠেকছে ফেরে।।

কেহ বলে ধন্য আমি
আমি দেশের মঙ্গলকামী
দেশ হবে পবিত্রভূমি
ভোট দাও যদি মোরে।

যার-তার ভাবে বলাবলি
করছে কত গালাগালি
স্বার্থ নিয়া ঠেলাঠেলি
বুঝবায় কয়দিন পরে।।

নিজের জ্ঞান থাকে যদি
বুঝে নেও তার গতিবিধি
শোষকের প্রতিনিধি
মালা পরাও যারে।।

আবদুল করিম কয় ভাবিয়া
ভালো-মন্দ না বুঝিয়া
অনর্থক বিভ্রান্ত হইয়া
গরিব কাঙাল মরে।।

কী পরিমাণ বাস্তবধর্মী গান, যা শাহ আবদুল করিম সাহেব বহুকাল পূর্বে বলে গেছেন আর বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আমরা তাঁর কথার চাক্ষুষ প্রমাণ পাচ্ছি! ভোটের আগে নেতারা গরিবদের বিভিন্ন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর গরিবের কথা কেউ মনে রাখে না। এই ব্যাপারে শাহ আবদুল করিম বলেন :

ভাই রে ভাই
ভোট নেওয়ার সময় আইলে
নেতা সাহেব এসে বলে
এবার আমি পাশ করিলে
কাজ করব গরিবের দায়।।

শেষে দেখা যায়
ধনীর বাড়ি খাসি খাওয়া
লাইসেন্স পারমিট দেওয়া
নৌকা বাওয়া আর সালাম দেওয়া
এই দুইটাই গরিবে পায়।।

গরিবের কি মান-অপমান দুনিয়ায়।।

গরিবের মনের কথাটি শাহ আবদুল করিম সাহেব তাঁর গানে বলেছেন। কারণ, যুগ যুগ ধরে গরিব কেন নমনম করবে ধনীদের? এই কষ্ট শাহ আবদুল করিমের মনে ছিল। তারাও তো মানুষ। ভোট দেয়া নিয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে শাহ আবদুল করিম কী চমৎকার সচেতনতামূলক গান রচনা করেছেন, যেমন :

বলো ভোট দিব আজ কারে?
ভোট দিব যে দেশের সেবক
ভোট দিব না যারে-তারে।।

যারা মোদের ভোট নিয়া, ভোটের বলে নেতা হইয়া
গরিবের খুন বিকাইয়া নিজের স্বার্থ করে
এমন মানুষ যারা যারা এসেছে নজরে
ভোট দেওয়া তো দূরের কথা, দেশের শত্রু বলি তারে।।

দেশের সেবক হবে যারা ভোটের অধিকারী তারা
ধোঁকাবাজি করে যারা তারা থাকুক দূরে
মানুষ হয়ে মানুষের দরদ নাই যার অন্তরে
এই দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলিবে না এবারে।।

আবদুল করিম বিনয় করে, থাকবেন সবাই বুঝের ঘরে
ভোট দিবে না যারে তারে প্রলোভনে পড়ে
নিজের দোষে দোষী হলে দোষ দিবা আর কারে
কত দুষ্ট লোক ইলেকশনে পাশ করতে চায় টাকার জোরে।।

কী চমৎকার বাস্তবধর্মী গান, যা রচনা করা কেবল শাহ আবদুল করিমের ক্ষেত্রেই সম্ভব। আরেকটি গানে গণমানুষের কবি শাহ আবদুল করিম বলেন :

এবার ভোট কারে দিবে
ভোট দেওয়া দায়িত্ব মোদের
ভোট যখন দিতে হবে
এবার ভোট কারে দিবে।।

শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা হলে পরিস্কার
হবে না জুলুম-অত্যাচার নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাবে।।

ভোট দাও সুবিচারের বলে, যে ভোটে সুফল ফলে
স্বৈরাচার উৎখাত হলে খাঁটি গণতন্ত্র পাবে।।

উৎখাত হলে স্বৈরাচার আসবে জনতার অধিকার
শোষকের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করে নিবে।।

দেশে গণতন্ত্র চাই অন্য কোনো কথা নাই
অধিকার আদায়ের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।।

মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আজো সেই যুদ্ধে আছি
অধিকারবঞ্চিত হয়েছি সেই অধিকার পাবো কবে।।

দেশপ্রেমিক শোষিত সবে একযোগে যখন চলিবে
শোষণমুক্ত সমাজ হবে সবাই তখন সুখে রবে।।

টাউট দালালের কথায় ভুলিও না লোভলালসায়
শত্রু যদি সুযোগ পায় বিশৃঙ্খলা ঘটাইবে।।

করিম কয় নাই জ্ঞাতিগোত্র, যারা বাংলা মায়ের পুত্র
কেবা শত্রু কেবা মিত্র বিচার করে চলতে হবে।।

স্বৈরাচার শাসকের সময় এই গানটি কবি রচনা করেছিলেন। এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বিভিন্ন গান রচনা করে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন বিপ্লবী শাহ আবদুল করিম। আরেকটি গানে শাহ আবদুল করিম বলেন :

শান্ত মনে ভোট দাও এবার
দেশের জনগণ
বহু সমস্যার পরে
আসিয়াছে নির্বাচন।।

মনে রেখো ভোটার আমি
হইও না কেউ অগ্রগামী
যেজন দেশের মঙ্গলকামী
সে আমাদের আপনজন।।

আসলে ভোট দেয়া চাই
এছাড়া অন্য উপায় নাই
অধিকার আদায়ের লড়াই
শান্তি সবার প্রয়োজন।।

আমাদের ভোটের দ্বারা
নির্বাচিত হবেন যারা
এ দেশকে চালাবেন তারা
আসিবে আইনের শাসন।।

ভোট দাও নিজে বিচার করে
ভুলিও না ধোঁকায় পড়ে
মিষ্টভাষী স্বার্থপরে
দিবে কত প্রলোভন।।

শান্তির যদি আশা করো
সৎ মানুষের সঙ্গ ধরো
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ো
করিমের এই নিবেদন।।

শোষকদের মুখোশ উন্মোচনে শাহ আবদুল করিম সবসময় ছিলেন সরব। তাই তো রচনা করলেন :

শোষিত বঞ্চিত যারা হলো নিরুপায়
শোষকের শোষণের পালা চলছে সর্বদায়।।

শোষকের ইমারত গড়তে নেতারা পাগল
রঙবেরঙে বের হয়েছে ভোটশিকারীর দল।।

কেহ বলে জাগো বাঙালি উড়াও জয়নিশান
কেহ বলে ধর্ম গেল জাগো মুসলমান।।

কৃষক-মজুরের কেহ গায় গুণগান
আসলে ধাপ্পাবাজি ভোট নেওয়ার সন্ধান।।

বাউল আবদুল করিম বলে সুক্ষ্ম রাস্তা ধরো
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো।।

আরেকটি গানে শাহ আবদুল করিম বলেন :

শোষকের শাসনব্যবস্থা যেখানে রয়েছে জারি
ভোটে মুক্তি আসিবে না শুটকির নায় বিড়াল ব্যাপারী।।

ভোট নিয়ে অধিকার পেয়ে গরিবের দেয় মাথায় বারি
ভোট নেওয়া নয় ধোঁকা দেওয়া কাজেই বলি ভোটশিকারী।।

গরিব কাঙ্গাল কৃষক মজুর এক যদি হতে পারি
বাউল আবদুল করিম বলে দুঃখের সাগর দিব পাড়ি।।

ভোটের ব্যাপারে গণসচেতনতামূলক এত তাৎপর্যপূর্ণ গান অন্য লোককবিদের ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না। তাই তো শাহ আবদুল করিম গণমানুষের কবি এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইউনিয়ন নির্বাচনে ভোটের ব্যাপারে তাঁর আরেকটি গান হলো :

শোনেন জনগণ
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন
ধনী-গরিব নারী-পুরুষ
ভোট আছে যার ভোট দেওন
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন।।

জনগণের রায় মানিবেন
এই প্রতিজ্ঞা করিয়া
দাঁড়াইলেন প্রার্থীগণ
বাংলাদেশ জুড়িয়া
আইনশৃঙ্খলার ভিতর দিয়া
জনমত যাচাইকরণ।।

ভোটের জন্য যাবেন এখন
গরিব কাঙালের কাছে
গরিবদের কিছুই নাই
তবে তাদের ভোট আছে
দুঃখ-কষ্ট করে বাঁচে
সয় যে কত জ্বালাতন।।

মজুরকে মজুরি দিয়া
মিছিলে নিবেন এখন
দেখাইতে জনগণকে
কার ভোটার কতজন
এলাকা করিয়া ভ্রমণ
চা পান চুরট খাওন।।

গরিব কাঙালকে কাছে
বসাইবেন হাত ধরে
মনে সান্ত্বনা দিবেন
আদর-যত্ন করে
দেখা যায় ভোটের পরে
হয় কত পরিবর্তন।।

বাউল আবদুল করিম বলে
ভোট দাও যারে মনে চায়
ভুলিও না প্রলোভনে
টাউট দালালের কথায়
ভালো লোকে ভোট যেন পায়
এই আমাদের প্রয়োজন।।

ভোটকে কেন্দ্র করে এইরকম আরো অসংখ্য গান রচনা করেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেশ এবং দেশের মানুষের কষ্ট দেখে তিনি খুব আফসোস করতেন। যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ বাস্তবে না দেখতে পেয়ে তিনি অনেকটা হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ জীবনে তাঁর রচিত অনেক গানে সেই আফসোস, সেই ক্ষোভ ফুটে ওঠে। যেমন একটি গানে শাহ আবদুল করিম সাহেব বলেন :

ভেবেছিলাম একদিন দেশ হলো স্বাধীন
এখন শুভদিন আসতে পারে
শোষকের মন্ত্রণা বিষম যন্ত্রণা
প্রাণে সহে না দুঃখ বলব কারে।।

মনে ভাবি তাই শান্তি সবাই চাই
তবে কেন পড়ে যাই অন্ধকারে
শান্ত নহে মন দেশের জনগণ
অসহায় এখন একেবারে।।

যার যাহা পছন্দ নাই ভালো মন্দ
স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকারে
ভালো নয় মতিগতি দিনে দিনে অবনতি
দেশজুড়ে দুর্নীতি দেখ বিচারে।।

আমলাতন্ত্রের অত্যাচার জোতদার-ইজারাদার
সুযোগ পেয়েছে এবার মজুতদারে
অসৎ ব্যবসায়ীগণ মজুতদারের আপনজন
দালাল টাউটের মন রঙবাজারে।।

সুদ ঘুষে লিপ্ত যারা মনানন্দে আত্মহারা
কৃষক মজুর যাবে মারা অনাহারে
এ কী সর্বনাশ ডাকাতি সন্ত্রাস
নাই কোনো বিশ্বাস কে কারে মারে।।

স্বাধীনতা কার নাম ভাবনায় পড়িলাম
কী যে তার পরিণাম কে বলতে পারে
করিম কয় আসলে ভুল তাই তো মিটে না গোল
আশার বাগানে ফুল ফোটে না রে।।

 আরেকটি গানে বলেন :

দিন গেল গোলমালে, মোদের দিন গেল গোলমালে
ঠেকছে বাঙাল, যারা কাঙাল, লাভ হলো না মূলে।।

পাড়াগাঁয়ে বসত-করা চৌদিকে সমস্যাঘেরা
কৃষক-মজুর দিশেহারা শান্তি নাই আসলে,
গরিব কাঙালের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে
হিতে বিপরীত ঘটাল লেজকাটা বানরের দলে।।

যারা উৎপাদন করে তারা থাকে ভাঙা ঘরে
অর্ধাহার অনাহারে ভাসে নয়নজলে
রক্ত দিয়ে স্বাধীন হলাম মুক্তি পাবো বলে
শোষিতের নাই স্বাধীনতা, আছে শোষকের কবলে।।

বলব দুঃখ কার কাছে দুঃখীর দুঃখ বেড়েছে
স্বাধীনতার ফল নিয়েছে স্বার্থপর মহলে,
অন্যকিছু মানতে চায় না স্বার্থে আঘাত হলে
নির্বিচারে গুলি চলে ছাত্র-জনতার মিছিলে।।

এখন যাহা দেখিতে পাই চলেছে ক্ষমতার লড়াই
আসলে খবর নাই দেশ কী করে চলে
স্বার্থ নিয়ে পাগল সবাই যে যাহাই বলে
দিনে দিনে অবনতি দেশ গেল রসাতলে।।

শোষিত জনগণ হতাশা নিরাশায় এখন
ভাবিতেছে হবে মরণ পড়ে যাঁতাকলে
করিম বলে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হলে
শোষিত সব এক হয়ে যাও কৃষক মজুর সবাই মিলে।।

অন্য আরেকটি গানে কবি বলেন :

অতীত বর্তমানে কি আর মিল আছে?
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নাই, ঘুরছে সব স্বার্থের পাছে।।

ব্যবসায়ী যত জনা, সত্য কথা বলতে চায় না
খাঁটি জিনিস পাওয়া যায় না, ভেজাল মিশাইয়া বেচে।
মজুতদারে মুচকি হাসে দেশ ভরেছে সুদে ঘুষে,
উচিত কইলে পাবে দোষে, বলব দুঃখ কার কাছে।।

মিথ্যা কথায় বাজায় ডঙ্কা রাক্ষস হয় গিয়ে লঙ্কা
রাজনীতির নেতার সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে গেছে
মনে মনে চিন্তা করি রাজনীতি নয় দোকানদারি
স্বার্থ নিয়া মারামারি ধর্মাধর্ম সব গেছে।।

বাউল করিমের বাণী শোনেন যত জ্ঞানীগুণী
মনে মনে আমি গনি সরিষারে ভূতে পাইছে
কখন কি হয় না-জানি ভাবি তাহা দিনরজনী
চৌদিকে অস্ত্রের ঝনঝনি শুনিয়া ভয় হইতেছে।।

গণমানুষের কবি শাহ আবদুল করিম অল্প কথায় সহজ ভাষায় মানুষের মনের ভাব তাঁর গানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতেন। যে-সকল বিষয় নিয়ে বিশাল বিশাল বই রচিত সেই-সকল বিষয়ের সমাধান তাঁর গানে খুব সহজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেন :

কেবা শত্রু কেবা মিত্র
বুঝে ওঠা দায়
তাই তো দেশের অবনতি
সাধুর নিশান চোরের নায়।।

চার লাইনের কথা, কিন্তু চিন্তা করলে অনেক বড় জিনিস। সবার উদ্দেশ্যে শাহ আবদুল করিম বলতেছেন :

ও ভাই জোরজুলুমি ছাড়ো
মানুষ যদি হইতে চাও মানুষের সেবা করো।।

স্রষ্টায় সৃষ্টি করেছে, সবাই বলো স্রষ্টা আছে
পরিণাম রয়ে গেছে এখন যাহা করো।
কালেমা নামাজ রোজা ইমান হইল বড়
ইমান যদি ঠিক না থাকে কিসের নামাজ রোজা করো।।

মানুষ খোদার প্রিয় পাত্র তারে না ভাবিয়া মিত্র
টাকাপয়সা জমিজোত্র তাই ভেবেছ বড়
স্বার্থ নিয়া দলাদলি ভাইয়ে ভাইরে মারো
দুর্বলেরে দায়ে ঠেকাইয়া বলপূর্বক ডাকাতি করো।।

আজ যা আছে কাল র’বে না টাকাপয়সা যতই কও-না
শক্তিবল যৌবন থাকে না অবশেষে মরো
মরলে কিছু সঙ্গে যায় না নিজেই বুঝতে পারো
তুমি-বা কার কেবা তোমার আগে নিজের বিচার করো।।

মানুষ হওয়ার ইচ্ছা থাকলে মানুষের সেবা করিলে
বাউল আবদুল করিম বলে মানুষ হইতে পারো
হিংসা নিন্দা দিলের গুমান লোভলালসা ছাড়ো
ছয় রিপুকে বাধ্য করে প্রেমবাজারে বেপার করো।।

অন্য আরেকটি গানে বলেন :

মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা।।

শাহ আবদুল করিম তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন বাঙালির সকল আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রেম, ভালোবাসায় কোটি বাঙালির হৃদয়ে। যতদিন বাঙালি থাকবে ততদিন তাঁর বাণী থাকবে। তাঁর বাণী শোষিত মানুষের শক্তি হয়ে সাহস জোগান দিবে কালের পর কাল যুগের পর যুগ। জয় হোক শাহ আবদুল করিমের।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you