ছিল কত-না গান একদিন জীবনে আমাদের! তখন আমরা ছিলাম নবীন, ছিলাম বয়ঃসন্ধির পতাকাতলে লীন, ছিলাম চনমনে ময়দানে রোদ্দুর-ঝাঁপানো রঙিন। আর আমাদের এই একচ্ছত্রী পৃথিবীটাও তখন আজকের মতো অত একটেরে ছিল না। আরেকটু সুপরিসর ছিল, সুবন্দোব্যবস্থিত ছিল, ফুল্লপল্লবিত ছিল। অথবা আজকেরই ন্যায় ছিল তখনকার পৃথিবী, ছিল মনোটোনাস্ আজকেরই ন্যায়, কিন্তু আমরা ছিলাম জরুর গুণাকর। ছিলাম সহজের সরসের গুণগানবাহী। ছিলাম গ্রহিষ্ণু, সন্ধিৎসু, উদার রিসেপ্টর।
তখন জীবন ছিল বিটিভিশীলিত। তখন ভুবন ছিল রেডিয়োরমিত। তখন যৌবন ছিল ব্যান্ডসংগীতায়িত।
সংলগ্ন কামরা হইতে ভেসে-আসা টেলিভিশনাওয়াজে একভিড় মেমোরির মধ্যে গেলাম তলায়ে। সেইসময়ের সুখে, দুঃখে, ইউফোরিয়ায় একমাত্র ভরসাবাহন ছিল বিটিভি। ঈদের দিন-পাঁচেক আগে থেকে শুরু করে ঈদের দিন-পাঁচেক পরে পর্যন্ত প্রহরে প্রহরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার ফাঁকে ফাঁকে ফিলার হিশেবে ঈদের গান শোনানো হতো বিটিভিতে। থেকে-থেকেই শোনা যেত কমন্ কয়েকটা গান। বড়ঈদে, মানে রোজাঈদে, সেই কাজীগানের কথা বাদ রাখি, — কেননা ওইটা তো আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু শিশুকিশোরদের বিশেষ ঈদ-আয়োজনের গোটা-দশেক প্রোগ্র্যাম থাকত, প্রতিবছর দুইপ্রান্তিকে সেসব প্রোগ্র্যামে একগাদা নয়া গান কম্পোজ করা হতো। দুর্বল কথাভাগের, দুর্বল অন্ত্যমিলের, এলেবেলে মিউজিকের ধর্-তক্তা-মার্-পেরেক ধরনের সমস্ত গান। তখন তো অত মন্দ লাগত না কিছুই আজকের মতো। যদিও বড় হতে হতে বুঝেছি যে এদেশে শিশুকিশোরদের জন্য অনুষ্ঠানগুলো খুবই দায়সারাভাবে বানানো হতো। পরিস্থিতি কি অপরিবর্তিত নয় এখনও?
কর্ণে যাহাই প্রবেশিত তখন, হোক তা গান অথবা গালি, গলা দিয়া তা-কিছু পুনরুৎপাদনের আগপর্যন্ত নিস্তার নাই। ফলে গুনগুনাইনি এমন গান খুব কমই আছে অভিজ্ঞতায়। এমনকি ‘রাগলহরী’ প্রোগ্র্যামের কণ্ঠকসরতরাজিও গুনগুনিয়ে গেছি মিচকি হাসাহাসির ব্যঙ্গচ্ছলে। বেতার বাংলাদেশের ‘অনুরোধের আসর’ তো মশহুর, সকালবেলার হুজুরের পড়া শেষে ইশকুলপ্রাক্কালে ‘ঝিলিমিলি’, বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ সমস্তই ঈদের স্পেশ্যাল ব্রডকাস্ট করত। ‘নতুন কুঁড়ি’ রিয়্যালিটি শো টাইপের ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্র্যামেরও ঈদ-স্পেশ্যাল হতো।
“ঘুরেফিরে বারেবারে ঈদ আসে ঈদ চলে যায় / ঈদ হাসতে শেখায় ভালোবাসতে শেখায় / ত্যাগের মহিমা শেখায়” — এই পঙক্তিগুলোতে সুর চড়িয়ে একটা গান ছিল তখনকার কমন আইটেম। ঠিক এই ধরনের গোটা-বারো শিশুকিশোরদের ঈদের গান স্মৃতি থেকে টেনে এনে একটা পাতায় জড়ো করছিলাম, আর দেখছিলাম যে সেসবের একলাইন-আধালাইন ছাড়া আর কিছুই মনে নাই, হয়তো গোটা গানটা কানমনোযোগে শুনিও নাই কোনোদিন। পরিতাপ হচ্ছিল। পরে ভেবে দেখলাম যে এইটাই স্বাভাবিক। এই একলাইন-আধালাইনের কৈশোরশৈশবসুরগুলোই পিছনে টেনে নিচ্ছে বারবার, আজীবন, ব্যাহত করছে ব্যক্তিগত উন্নয়নের জোয়ার। আস্ত মনে থাকলে তো রক্ষে ছিল না। যা-হোক।
তথাস্তু! ঘুরেফিরে, বারেবারে, ত্যাগের মহিমা শিখিয়েপড়িয়ে যেতে এই ঈদের আনাগোনা থাকুক আমাদের বাচ্চাকাচ্চাগুলোর জীবনে।
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
- মর্মস্পর্শী মিসকিনদের দেশে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড - January 1, 2025
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
COMMENTS