শারদীয়া সালাম, আদাব, নমস্কার ও শুভেচ্ছা

শারদীয়া সালাম, আদাব, নমস্কার ও শুভেচ্ছা

শেয়ার করুন:

বেগড়বাই কিছু-একটা হয়েছে যে এতে ডাউট নাই, বিস্তর চিল্লাপাল্লাও শোনা গিয়েছিল বছর-কয় আগে ক্লাইমেট-চেইঞ্জ নিয়া গ্লোব্যাল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তহবিল বাগানেওয়ালাদের মুখে, কিছু বছর ধরে সেই ফ্রিকোয়েন্সির আওয়াজ আর কানে আসছে না তা-ও সত্যি। কিন্তু হয়েছে বেগড়বাই কিছু-একটা তা খালিচোখেও ধরা যায়। ঋতুর ভাবগতিকে একটা তাৎপর্যবহ পরিবর্তন মোটামুটি থিতু হয়ে যেতে লেগেছে বোধহয়। ন্যাচারের সঙ্গে অ্যাডাপ্ট্যাবিলিটি দিন-কে-দিন কমে যাচ্ছে মানুষের, তাতে অবশ্য থোড়াই অসুবিধা আমাদের, প্রযুক্তি থাকতে চিন্তা কিসের? নো চিন্তা ডু ফুর্তি। শীতকালেও যদি হিউমিডিটি, চিন্তা নাই। শীতাতপ ঘরে ও গাড়িতে হোক আয়েশী জীবনযাপন। জমিনের ফসল নিয়া ভাবনা আছে? জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড সিড ও খাদ্যশস্য তবে কেন পয়দা হলো? হুদা ভাবনায় কাজেই ফায়দা নাই। গ্রিটিংস্ জানাই সিজন্স। শরতের শুভাশীষ। সবাইকেই। বৃদ্ধা, আবালপ্রৌঢ়, তরুণী, কিশোরকিশোরী, নিউলি ম্যারেড কাপল, জরাজীর্ণ ঝগড়ুটে জায়া আর পতি, বিষণ্ণ বনিতা ও ঝলমলা নারী, শিশু, যুবক ও উজবুক সব্বাইকেই শারদীয়া সালাম-আদাব-শুভেচ্ছা।

শারদীয় রৌদ্রোৎসব
সকালবেলায়, এই সিজনটায়, অ্যাটেনশন প্লিজ্! মনোযোগে দেখুন অরুণ আলোর অঞ্জলি শারদীয়!

সকালবেলায়, বেলা ১০/১১ অব্দি, একটু ফলো-আপ রাখুন কাইন্ডলি রোদ্দুরটার। দেখবেন, জিন্দেগি সরল ও ফকফকা হো যায়েগা।

পানাফুলগুলো, সড়কের দুইধারে পানি-টান-লাগা ধানজমিনের অল্পজলা নাবাল জায়গায় একসার কচুরিপানা, ফুটে আছে যেন ঝকমকা হাসিবিকিরিত সুস্বাস্থ্যবারতা।

ভাদ্দুরে রোদের তজল্লা আপনারে যে-একটা ধাতানি দিয়া গেছে, গেল কয়মাসে ব্যাপক হাঁসফাঁস করেছেন যে দাবদাহে, এইবার একটু স্বস্তি ও সেবা আঁজলা পাতিয়া নেন শরতের।

আকাশের দিকে একবার তাকান, এই সিজনে, দেখবেন রাত্তিরের বেলায় এই-সময়টায় যেমন অজস্র তারাফোটায় একটা মায়ার আলো, দিনের বেলায় আকাশের রঙ সেই তারারঙের মতো অবিকল স্নিগ্ধমায়াময়।

দেখুন মহিষের কাঁধে লেজঝোলা পাখিগুলো শরতের সফেদ মেঘ পোয়াচ্ছে।

রাস্তাপাশের শিশুতরুগুলোর পাতা আটআনি সিকির মতো ঝলমলাচ্ছে হাওয়ালাগা রোদ্দুরে।

অর্জুনগাছের দিকে একবার তাকান। অ্যাটেনশন প্লিজ্, অর্জুনগাছের পানে একটাবার!

শারদধারা বহিছে ভুবনে … চারিদিকে দ্যাখো চাহি হৃদয় প্রসারি … দ্যাখো রোদ্দুরে লেগে আছে তুলটকাগজের মতো সুবাসিতা আসমান … চালধোয়া পানিতে যেন ধবধবা আল্পনা আঁকা বাতাসে-পাতায় … গাছে গাছে লঘুডানা অরণ্যপরীরা … ফুরফুরা চারিধারে ফুর্তির পারা …

শরৎ
চলছে। এবং চলেও যাচ্ছে। টের পেতে না পেতেই বের হয়ে যায় হাত গলিয়ে, চোখ ফসকে খসে যায় দিনদুনিয়া, এ-ই তো মরজগৎ। শরৎকাল। সবচেয়ে স্বচ্ছ ও সরল – ঋতুজগতে – এই শরৎকাল। যদিও, গতিক-ভাব দেখে মনে হয়, দৃশ্য বদল হচ্ছে আদতেই। জাহানের জলবায়ু বদলে ফেলছে তার খোল ও নলচে, পরিবর্তন আসছে তার ভাবগতিকে, মেজাজে ও মর্জিতে। দেখুন তো, কী কাণ্ড, শরৎকাল – অথচ আকাশে একটা ত্যানা-পরিমাণও পেঁজাতুলোর মতো মেঘ নাই – এইটা কী! এইটা কেমনছিরি শরৎ হইল ভাই, কী অনাছিষ্টি, কও দেখি! ভীষণ গুমটে থম-ধরা, ঠাডা-পড়া রইদ – থাবা-তাক-করা বাঘের মতো সিংহের মতো নোখ-ধার রইদ – এরে কী করে শরৎ কইয়া ডাকি কও! ধরো, তুমি চাইলা, কাশফুল দেখবা – তা, এখানে তেমন নিশ্চিন্দিপুর কই! নিবিড় নিখাদ নিশ্চিন্দিপুর! নাই, নিশ্চিন্দিপুর লোপাট, কিন্তু নিশ্চিন্দিপুর দেখার-চোখ-ও-হাহাকার বুকে নিয়ে বেড়ায় ঘুরে সারি সারি অট্টালিকার চিপা দিয়া কানাগলির কত কত বিভূতিভূষণ! নিশ্চিন্দিপুর, এক বিস্মৃতিবিপুলা নেভারল্যান্ড, অপু-দুর্গার গ্রাম। দৌড়াতে দৌড়াতে, গ্রাম থেকে অতিদূর-অনতিদূর রেললাইন দেখতে যাওয়া, কাশবনের ফোকর-ফাঁক দিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে – একসময় ট্রেন দেখতে পাওয়া এবং বিস্ময়ভরা ভাইবোনের চোখে-মুখে মিথ্যেকথার স্বর্গস্থানের অব্যাখ্যেয় ঝিলিক – এমনসব দুর্ধর্ষ দৃশ্য ধরেছেন সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমাপাঁচালিতে। স্ক্রিনে দেখা ওই দৃশ্যটা আমার কাছে অল্টার্নেইট অটম। কিন্তু, ভদ্রে, এ কেমন শরৎ! ভাদ্রমাসী চিত্তি-বিক্ষিপ্ত-করা দাবদাহ! হোয়াটেভার। ফুল ফুটলে ফুটল না-ফুটলে নাই – তেমনি কাশবন-নদীপার-রেললাইন দৃশ্যপটে থাকুক না-থাকুক – এখন শরৎ।

শরৎ, দ্বিতীয় টুকরা
শরৎকাল বিষয়ক আরেকটু বক্তব্য যাক রাখা, সংযোজনী হিশেবে ধর্তব্য, শারদীয় সংযোজনী। লিপিবদ্ধ রাখা যাক খানিকটা আরও শহুরে শরৎসম্ভার, শারদবিবরণ, শারদীয় দলিলায়ন। শরতের ডক্যুমেন্টারি। ঠিক আজকে নয়, দিন-সাতেক আগে ধারণকৃত, যদিবা জানতেই চান। দেখিয়াছি তারে, ঋতু শরতেরে, দেখেছিলেম উহারে আমি নিষ্পলক মনশ্চক্ষুযোগে। দেখিয়াছিলুম সেদিন, শোনো, শারদাকাশের সাজ। কখন-কোথায়-কীভাবে-কতটা, আস্তে হে বাপু, ক’মাইল-ক’ফার্লং-ক’গজ-ক’কিমি-ক’সেমি-ক’মিমি-ক’কেবি-ক’জিবি – আরে বাবা, দাঁড়াও, রোসো রোসো! বলব বলেই তো বসেছি। কিছু বলব বলে এসেছিনু, জন্মেছিনু, বসেছিনু স্ক্রিনে। এইবেলা এই ভবে এই ঘুটঘুইট্টা আন্ধারে, এই বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন গুমটে, হেন প্রবারনারাত্তিরে – এথা আসন পাতিয়াছিনু এই টেবিলচেয়ার-পাতা বারান্দাচাতালে। এখন শোনাই, দি রিভিয়্যু অফ শরৎসন্দর্শন, ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন অফ অ্যা ট্রিমেন্ডাস অটম আফটার্নুন। বলি কী কালাম পাঠাইলেন আমায় সাঁই দয়াময়, কী তুলকালাম ঘটাইলেন ভেতরে আমার, কীভাবে এবং কোথায় কেমন করে হলো মুলাকাত মম শারদাকাশের সনে। ব্যাপারটা, অ্যা উইক অ্যাগো ঘটেছিল, আভি বলব। উঠেছিলাম আপিশের ছাদে, একটা হাওয়াকাঠি পবনস্টিক ফুঁকতে, একলা-একা। দুপুরমুহূর্তে, মধ্যাহ্নভোজনের অব্যবহিত পর পর, সেই ছাদারোহন। ক্ষুরধার রোদ, মন্দ্রমন্থরা, বাতাস বিকল। ছাদটা ভালো প্রশস্থ, পরিষ্কার সাফসুতরা, চারধার-ঘিরে-থাকা গাছবিরিখ। কয়েকটি নিমগাছ চুল নামিয়ে রেখেছে আলিশায়, সেজন্য রূপ খুলেছে ছাদের, এই ভীষণ রোদ্দুরদুপুরেও ছাদে তাই ইতিউতি ছায়ার ছিটমহল। রৌদ্রকাঁটাতার ডিঙিয়ে সেইসব গোছাগোছা ছায়াছিটমহলে যেতে ভারি ইচ্ছাডানা হাতছানি দেয় তাই। সিঁড়িঘর থেকে সরাসরি পশ্চিম-কর্নারে গাছপাতাঢালা ছায়ার রেলিঙে ব্যাবুনঝোলা আসন গেড়ে আয়েশে বাতাসকাঠি ধরিয়েছি, দিয়েছি পাফ একটি-কি-দুটো, অমনি চোখ গেছে আকাশের পানে উর্ধ্বগগনে, গেছে মন মোর শরতের দিগদিগন্তরের সঙ্গী হয়ে সঙ্গে সঙ্গে। সেল্যুকাস! ঝকঝকে-তকতকে শরতের তশতরি! ফর্শা ফর্শা মেঘ, গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ, তুলোশুভ্রা মেঘ। অনেক অনেক মেঘটিলা, সারি সারি টিলামেঘ, জ্যাকুলিন ওনাসিসের অজস্র প্রমোদজাহাজ যেন। মনে ভেসে উঠল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইন। “এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে…”; দেখে মনে হচ্ছিল, সমুদ্রে যেন ডলফিন, শরীর ঝিকিয়ে ভেসে চলেছে যেন অসংখ্য নভোনৌযান। চরে চরে ছড়ানো নীলিমায় … ভেসে ভেসে বেড়ানো গগনভুবনে … মেঘের পিছে মেঘ ছুটেছে বাদল গেছে টুটি…। … কী মনোরম একেকটুকরো শোভন শরৎকাল! ওগো মম মোহন শরৎকাল! মনে হলো, শহরেও শরৎ সুলভ তাহলে! মেগাসিটিতে মেট্রোসিটিতে অটম আছে তবে! আছে, আলবৎ, তবে তাকাবার ফুরসত চাই। দিবালোকে চন্দ্রান্ধকারে চেনাশোনা চাই ঋতুর সনে নগুরের। আচ্ছা, ঠিকাছে, এরপর শোনোই-না কী হয়েছিল। পড়তি বিকেলে ফের উঠেছি নীলিমাছাদে, এইবার কিসের টানে – বাতাসস্টিকের, না আকাশওয়াইনের! অবশ্যই বায়ুস্টিক। তবে আকাশও কী কিছু কম টেনেছিল! ঘুরে ঘুরে দেখিনু তারে, উড়ে উড়ে বেড়ানো শরতেরে – হ্যাঁ, একেই বলে শারদাকাশ, মশহুর শরৎকাল এ-ই তো। বর্ণবিশ্লেষ বাহুল্য।

শরৎ, সকালবেলার
গত-হওয়া রাতে যে ভেবেছিলাম শরৎকাল বিষয়ে – এসেছে শরৎ পঞ্জিকাপথ ধরে অথচ টের পাওয়া যাচ্ছে না বাতাসে-বাস্তবে – এক্ষণে, এই সদ্য-ঘুম-জাগা প্রাতঃরাশ সেরে স্নানাগ্রে বারান্দাপায়চারি করে ফিরে এসে মনে হচ্ছে রাতে-ভাবা ঋতুভাবনা পুরোপুরি ঠিক ছিল না। ব্যাপারটা খানিক বিস্তারে বলার কোশেশ করা যেতে পারে। হ্যাঁ। এই সকালবেলার ফুরফুরি-কাটা সুন্দর হাওয়া গায়ে লাগতেই মনে হলো : এইটাই শরৎ! মনে হলো, শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি … গুনগুনপ্রবণ প্রভাত। মনে হলো : এই তো আমার পড়ছে মনে ছেলেবেলার গান! পড়ছে মনে মাতুলালয়ের শারদীয় শব্দছায়ারৌদ্ররঙ্গরাত্রিনিশিনিক্কণ … জোনাকিশিশিরগাছপালাপাতালাতা … পাখিপুষ্পপরিন্দা …। হ্যাঁ, ঋতু টের পেতে হলে বা ঋতুর আগমন-প্রস্থান বুঝতে চাইলে ভোরবেলা ঘুমভাঙা চাই। এই নাগরকোলাহলে সারাদিন শুধু খিদের গন্ধ, ধান্দার দ্বন্দ্ব, বিকৃতির রস। এখানে ভরদুপুরে ঋতুর গন্ধ ঋতুর ছন্দ ঋতুর রস খুঁজলে পাবে নাকি! ছিল একদা, বারো-পনেরো-পঁচিশ বছরেরও আগে, একসময় ছিল। প্রহরে-প্রহরে ছিল ঋতুর পাশ-ফেরা। কী তার বাহার, কী পেখমবৈচিত্র্য, রঙ ও রঙ্গ! ছড়ানো ছিল সহস্র-এক ঋতুসূচক দিবাদেহ ঘিরে। ছিল সিজন সনাক্ত করার ইন্ডিকেটর প্রতিবেশে দিবারাতি। ঋতু বুঝে নিতে সেইন্ট-হ্যার্মিট-কবি-অকবি-বালবৃদ্ধবনিতা কারোরই কিছুমাত্র অসুবিধা তৎকালে হতো না। তা, আইজ্ঞে, এখন ঋতুবিলাস বাদ দিয়া স্নানে যাও বাছা! আপিশটাইম বেজে গেছে ঢের আগে, ভাগ্যিস, আপিশ যেতে হচ্ছে না। শারদীয় উইকেন্ডের অবকাশ ফুরায়ে এল, সখি, কাশবনের তীরবর্তী বিড়ালের ন্যায় আদুরে নদীটির মুখ তাই থমথম। শরৎরোদ্দুর যদিও তার শরীর ঘিরিয়া নাচিতেছে ভাবাবেশে।

আশ্বিনা
রাবারপ্ল্যান্টের ভিতরে যেয়ে দেখে এসো, হোথা আশ্বিনের মগ্ন মন্থরতা আছে লেগে। দেখে এসো চৌমোহনার বাঁয়ে একটা কাঠবাদামের গাছে কেমন সম্পন্ন সচ্ছলতার চিহ্ন। লক্ষ করো পথিপার্শ্বের শিমলতাউপচানো মাচাগুলো। সবাই যেন কোনো-একটাকিছুর প্রতীক্ষারত। ধুলাবালি ঝেড়েপুঁছে মেহগনিবিরিখের পাতাগুলো প্রস্তুত হচ্ছে যেন। কার জন্য, কিসের জন্য, উই ডোন্ট নো। তবে রেডি হচ্ছে, অল অফ দেম আর গেটিং রেডি। কিসের জন্য রেডি হচ্ছ রাই? রিপ্লাই নাই। কিন্তু উত্তরে গারো পাহাড়ের একটা গা-ঝাড়া বাতাস এসে শরীর জাগায়ে দেয় এক-লহমায়। মেজাজ যায় বিলা হয়ে। এসব ক্ষেত্রে প্যাশেন্স রাখা সাধ্যায়ত্ত নয়কো। পবিত্র বঙ্গসাহিত্য করতে বসে হেন কুসুমপনা ভাল্লাগে না। মাথা যায় বিগড়ে, মেজাজ ক্রমশ বিলা হয়ে আসে। কেন হে কুসুম, হে অকথ্য দমকলের দামিনী, তব মন নাই? কী ছিরি মানসিকতা তোমার? সংকোচে কহতব্য হয় যে পাঠে আমারও মন বসে না কাঁঠাল ও অন্যান্য চাপাচুপির গন্ধে। লেকিন, বলেই ফেলি কথাটা, বাংলা হলো নোবেল লভিবার ভাষা। শারীরিকতা ধারণের যোগ্যতা বাংলার আছে কি না, তা তো পরীক্ষা করিয়া দেখি নাই, দেখিবার জো কই, লোকে আমারে সাহিত্য পরিস্কার করতে ডাকব না ভুলেও, নোবেল তো সুইডেন দূর, বাংলায় থাকার মধ্যে আছে খালি মানসিকতা, আছে খালি মনের মানুষ, ও মোর খোদা! আশ্বিনা বাতাসে এইসব মনে পড়বার কথা? তা ভাই স্মৃতির কি কোনো সিজনপরম্পরা আছে? মনেপড়াপড়ির কোনো ঋতু নাই। কাজেই আষাঢ়েও মনে পড়ে আশ্বিনেও। বরং বলা যায় আশ্বিনের এক আজিব আদল আছে। সেইটা হচ্ছে এ-ই যে, এই সময়টায় একইসঙ্গে চনমনে এবং ঝিমানো দুই ভাবেরই আন্দোলনে গাছে পাতারা নড়েচড়ে। স্ট্রিটল্যাম্পোস্টগুলোর নিতম্বশোভিত কোমর ঝালমুড়িবিক্রেতার পাশ থেকে ইশারায় ডাকতে থাকে দুদণ্ড বসে যেতে। এদিকে মাগ্রেবের আজান হয়-হয় মুহূর্ত। গোপালটিলার ঘরে ঘরে যোগাড়ের উলুধ্বনি বিবশ করে তুলেছে এই সিজনের মগ্নচৈতন্য সন্ধেটাকে। কেমন সকরুণ সুন্দর জীবনানন্দ। মরণের শ্যামসমান বিষাদ। শরতের সুডৌল সৌষ্ঠব তবু দুনিয়ার এই কোণ থেকে এখনও বিদায় নেয় নাই। এত প্রকৃতিবিনাশী কৃপাণের তাণ্ডব সত্ত্বেও তবু মর্মের ঋতুরক্ত আজও উথলায় সিজনে সিজনে। এক্কেবারে বান ডেকে ওঠে। এই ইনভিট্যাশন্যাল শারদীয়া … এত কী ইশারা হেথা … এত কী মাধুর্যের জ্বরমন্থর শরীরমুখরতা … গাধাটাকে জল দাও, ন্যাজে কী বাঁধা … গাধার অবস্থা কী করেছেন কী করেছেন দাদা …

অটমন্যাল কটন স্কাই
ইশকুলের বইতে লেখা থাকত ষড়ঋতুর ডিস্টিংক্ট ক্যারেক্টারিস্টিক্স। বর্ষার, গ্রীষ্মের, হেমন্তের, শীতের, বসন্তের। যার যার ধর্ম তার তার মতো। স্বতন্ত্র ও পৃথক। শরতের ক্যারেক্টারিস্টিক্স ছিল মুখ্যত দুইটা। নাম্বার ওয়ান, আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়; এবং নাম্বার দুই, নদীতীরে কাশফুল। দুই নাম্বার জিনিশটার সনে দেখাসাক্ষাৎ সহসা ঘটে না এতদঞ্চলে, লেকিন এক নাম্বারটা আছে। ব্যাপকভাবেই দৃষ্টিগোচর হয় পেঁজা তুলোর মতো ফর্শা ক্লাউডমাউন্টেন শরতের আকাশের দিকে কাঁধ উঁচিয়ে তাকালে।

পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। কথাটা আজকের বাংলায় কে কীভাবে বুঝতে পারবে জানি না, কিন্তু বছর-বিশ আগেও তুলা ভাঙানোর মেশিন কাঁধে নিয়া মানুষজন আমাদের আঙিনায় এসে হেঁকে যেত দুপুরের দিকে। লেপ ও তোষকের পুরনো তুলা সাধারণত প্রতিবছর রিনিউ করা হতো ঘরে ঘরে। এই রিনিউ করার কাজটা যাদেরে দিয়া করানো হতো, তাদেরে বলা হতো ধুনুরি। তুলো ধুনে লেপ-তোষকগুলো নরম ও উমদায়ক করে তোলা হতো প্রত্যেক শীতের প্রাক্কালে। ভালো ধুনুরির কদর ছিল লোকালয়ে এবং গঞ্জে-হাটে-শহরে।

এখন তো তুলোর শয্যা বা বালিশের বা লেপ-জাজিমের জন্য সিন্থেটিক কটন বাজারে অ্যাভেইলেবল। শিমুলের গাছ কয়টা চোখে পড়ে এখন এই বাংলায়? কিংবা কাপাসের ক্ষেত কই? ফোমের বিছানা, ফোমের বালিশ, সিন্থেটিক কম্বলে দেশ সয়লাব। গণ্ডারের গাত্রচর্ম হয়ে গেছে এখন আমাদের, দশহাত-দাবানো ফোমের বিছানায় গাত্রখানা কোনোমতে ফেলে দিতে পারলেই মনে করি নিদ্রাবিলাস সম্পন্ন হলো। তুলোর শয্যার মর্ম বোঝার মুণ্ডু দুনিয়া থেকে বিদায় নিতেছে ক্রমে। এখন ধুনুরির দেখা নাই আমাদের লোকালয়ে।

এই সিজনেই ধুনুরির হাঁকডাক শোনা যেত। পুরো শীত জুড়েই তুলোধুনন চলত। তোষক-লেপের সেলাই ছিঁড়ে বের-করা তুলোগুলো স্তূপ করে রাখা হতো একপাশে, তারপর সেই চিটচিটে ন্যাতানো তুলো ধুনুরির লম্বা তানপুরার মতো যন্ত্রে ফাটিয়ে ধবধবা শাদা এবং তুলতুলা নরম বানিয়ে উল্টাদিকে মেলান করে রাখা হতো। রোদ্দুরে সেই তুলোর রং যেমন হতো, তুলাপাহাড়ের সেই স্বচ্ছ নরমাভা, শরতের আকাশের দিকে তাকালে সেই স্মৃতিটাই মানুষের মনে পড়ে। পেঁজা মানে তুলো ইত্যাদির আঁশ ধুনে বা টেনে টেনে পৃথক করা। ধুনে আঁশ পৃথক করা হয়েছে এমন তুলো হচ্ছে পেঁজা তুলো।

নদীতীর আছে এখনও, তবে কাশফুল যেখানে একলাইনে ফুটিয়া থাকবার কথা, সেখানে এখন নদীর বালু উত্তোলনকারী ফড়িয়া ব্যবসায়ীদিগের দাপট। ওরা গাঙপারগুলো নদীর বালু আর পাথর বোঝাই করে রেখেছে। কাশফুল ফুটবে কোথায়? বেনিয়ারা আকাশ অক্যুপাই করতে পারে নাই, ভাগ্যিস, দুয়েকটা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখতে পাওয়া যায় তাই। না, দুয়েকটা নয়, এই-সময়টায় পেঁজা তুলোর বোঝাই জাহাজ ভেসে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। কেবল তাকাবার অপেক্ষা।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… … 

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you