যখন থেকেই আক্কেলবুদ্ধি কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে, একটু একটু বড় হচ্ছি গতরে-বহরে, খেয়াল করে দেখি যে চারদিকে সবাই রাহমানধ্বনিতে মুখরিত অথচ আমরা হারাম রাহমানের মর্তবা ঠাহর করতে পারছি না! স্বাধীনতা তুমি এইটা-ওইটা, তা তো গোড়ার দিনগুলায় হেঁড়ে গলায় চিল্লায়েছি। কিন্তু হয়রান হয়ে গেছি কিয়ৎকালের ভিতরেই। চিল্লানি বেশিদিন শইল্লে সয় না। তারও অল্পকাল বাদে একটু হাইটে লম্বা হলে পরে উগি দিয়ে দেখি যে এইসব চিল্লাপাল্লা আসলেই রিয়্যাল রাহমান না। আশির দশকের একটা পর্যায়ে উনারা প্রায় প্রত্যেক বিকালেই বিভিন্ন প্রতিবাদসভায় মাচায় উঠে শাল-আলোয়ান কান্ধে ফেলে নিপাট কন্দর্পকান্তি মুখে বসে থাকতেন এবং রোলকল অনুসারে একে একে উঠে মাইক্রোফোনে ফুঁৎকার-হুঙ্কার দিয়া যার যার কবিতা আবৃত্তি করে সেরে ফের উদাস মাচায় বসে থাকতেন শেষ বক্তা পাতিনেতাটার বক্তব্য সাঙ্গ হওয়া পর্যন্ত। ওইসময় হাজার হাজার ঘটিগরম কবিতা বাংলায় ভূমিষ্ঠ হবার এটুকুই ইতিহাসসংক্ষেপ।
খুঁজতে বেরিয়ে দেখি যে রিয়্যাল রাহমান খুবই অনুচ্চস্বরের খুবই নরম কণ্ঠের এক কবি। কিন্তু উনি এতই নরম যে ল্যাবগ্যাবে অবস্থা। মানে, যেটুকু সহনীয় রাহমান তা ওই শুরুর দিককার দুই-তিনটা কাব্য যেখানে শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ ইত্যাদি জীবনানন্দীয় উচ্চারণ লভ্য। উচ্চারণের দিক থেকে রাহমানের কবিতা আমাদেরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতই বিরক্ত করেছে যে এখনও বহু কসরতেও অনুরাগে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। বারবার নিজেরে বোঝাই যে এমন তো হবার কথা না। রাহমান বাংলাদেশের প্রধান কবি। নিশ্চয় উনার এমনকিছু গুণ রয়েছে যেইগুলা আজও ধরতে পারছি না আমরা। তা, পারি নাই যে পারিই নাই, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও রাহমানমর্তবা আজও অধরা রয়ে গেল আমাদের বা আমার কাছে অন্তত।
মুখস্থ কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো জানিই রাহমানকবিতার, সেসব জানা হয়েছে উনারে নিয়া ফাঁদা হাজারেবিজারে এ্যাসে-নিবন্ধপ্রবন্ধ পড়ে। এন্তার লেখা হতো উনারে নিয়া সাময়িকপত্রে উনি জীবিতাবস্থার শেষ দুইদশকে উনার বার্থডেগুলা এলে। প্রায় শুক্রবারগুলায় উনার দুই থেকে তিনটা কবিতার আশেপাশে পাতাভরা থাকত যত কবিতা নামধেয় বস্তু, সমস্তই বিভিন্ন নামে ছিল উনারই কবিতা আসলে। সেই জিনিশগুলা লিখতেন উনার অনুজ অনুকার কবিরা। আল মাহমুদ বা ফরহাদ মজহার পাওয়া যেত অত্যন্ত কালেভদ্রে তখন পত্রিকাগুলার পাতায়, আমরা রাহমানানুকৃতির রমরমা ঋতুতে বেড়ে উঠেছি অগত্যা। কাজেই বুঝতে দেরি হয় নাই যে উনার প্রভাব অন্তত বাংলাদেশে ব্যাপক। তবু প্রধান কবির প্রধানত্ব সনাক্ত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়া কালাতিপাত করতে থাকি এবং আজও তথৈবচ।
তবে একটা ব্যাপার বিশ্বাস করি যে নিশ্চয় উনি অনেক বড় কবি। কিন্তু বিশ্বাস দিয়া কাজ চালানো তো মুশকিল। অন্ধ বিশ্বাসের পেছনে একটা কারণ হতে পারে যে রাহমানের সমসাময়িক অনুজ ও সমবয়সী সমস্ত কবিই উনারে নিয়া আলোচনা করেছেন সপ্রশংস এবং বাংলাদেশ পিরিয়ডে উনি সর্বত্র সবার কাছেই নিরঙ্কুশ মান্য হয়েছেন। আল মাহমুদ উনারে নিয়া গদগদ প্রশংসাগদ্য লিখেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ তো লিখেছেনই। বিশাল কলেবর এবং ভীষণ সুন্দর বই লিখেছেন এমনকি হুমায়ুন আজাদের মতো লোকও, ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’ নামে। এতকিছু হবার কথা না যদি উনার কোনো গুণই না থাকে। এইভাবে একটা বায়াসড এবং ইম্প্রেসড সময়ের ভিতর দিয়ে এসেও উনার কবিতা আমারে বা আমাদেরে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না আজও। বছর-বছর উনার জন্মদিনে-মৃত্যুদিনে চেষ্টা করি কিছু কবিতা বাইর করতে বেছেবুছে, ফেইল করি ফিরেফিরে বারবার। তবু আশা ছাড়ি নাই, নিশ্চয় একদিন পারব।
তবে এমন মোটেও ভাবি না যে দোষ রাহমানের। তাইলে কি দোষ আমার/আমাদের? না, তা-ও ভাবি না। আসলে এমন হয়। কালেভদ্রে হলেও হয় এমনটা কারোর কারোর ক্ষেত্রে। এমনিতে রাহমানের কবিতার যেই গুণগুলার কথা প্রচারিত সেইগুলা প্রায় সমস্তই উনার কবিতায় হাজির দেখতে পাই; যেমন, উনার কবিতায় পুরান ঢাকা, তারপরে নয়া ঢাকা, তারপরে বাংলাদেশ, তারপরে প্রেমট্রেম, তারপরে মানুষটানুষ, তারপরে নাগরিকতা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু উনার কবিতা নিজের জন্য পড়তে একবারের জন্যও উদ্বোধিত হই না, ট্রাই করেছি, কিন্তু ভাল্লাগে না। পাপবোধের মতো হয় ভিতরে ভিতরে যে এত বড় একজন কবির কাজ ভাল্লাগতেসে না, হায় হায়, তাইলে কী উপায়! কিন্তু উপায় নাই, আল্লা হেদায়েত না দিলে উপায় দেখি না।
আবারও বলছি যে দেশের জন্য, মানুষের জন্য, অন্যের বিপদাপদ প্রেমাপ্রেমের জন্য উনার অনেক কবিতাই আছে ভালো ভালো, উন্নত উন্নত, শুধু নিজের জন্য মনোলীন উচ্চারণে পড়ার জোখা কাব্য উনার লক্ষ লক্ষ পঙক্তির ভিতরে এক-দুইটা থাকলেও অতটা স্টাডিফাডি করার ধাত তো সবার নাই। এই নিবন্ধে তেমন একটা স্টাডির শুরু করা যেত, যদিও তা করা যায় নাই। কিন্তু ভবিষ্যতের সেই সম্ভাবনা তো কখনোই মরিয়া যায় না। টুমরো নেভার ডাইস্। রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অতিকায় পুনরাবৃত্তিপ্রবণ কোনো কবির তকমা যদি কেউ ক্লেইম করার হক্ রাখেন তাইলে তিনি শামসুর রাহমান। চর্বিতচর্বণাঢ্য পুনরাবৃত্তিপর্বত থেকে কে আছে বিশল্যকরণী খুঁজে বের করবে?
রাহমানকবিতা : ভাষা, ভাবনা, যাপনজৈবনিকতা … ব্লা ব্লা …
‘আপনি নাইন্টিজের প্রতিটা কবিকে প্রশ্ন করেন, মিথ্যেবাদী ছাড়া কেউ বলবে না যে তারা শামসুর রাহমান খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। অসম্ভব। আমরা কেউ পড়িনি। মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। বড়জোর উল্টায়-পাল্টায় দেখেসি। ওনারা আমাদের ভাষায় বলেন না, আমাদের চিন্তা ও যাপনকে প্রকাশ করেন না, আমরা কেন পড়ব?’ [এবাদুর রহমান প্রণীত দাস ক্যাপিটাল, পৃষ্ঠা ৩২৫, বাঙলায়ন, ঢাকা ২০০৬]
একটা খুব অভাবিত অভিজ্ঞতা হয়েছিল রাহমান লোকান্তরিত হবার অব্যবহিত পরে একটি দৈনিকের শুক্রবাসরীয় সাময়িকীতে শামসুর রাহমানের অগ্রন্থিত অনেক-পুরনো একটি কবিতা — ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’ — পড়ে। দারুণ! ছন্দচৌকস, স্মার্ট, টানটান, কাটাকাটা, ছোট ছোট যতিছেদ সহ গদ্যবাক্য — এ এক অন্য রাহমান — কবিতাটা তার শুরু-সময়ে লেখা। তার স্বহস্তে নির্বাচিত মস্ত-কলেবর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-থেকে কয়েকটা ছাড়া বাকি বিপুলসংখ্যক রচনা আদতে ‘বিপুল অপচয়’ বলে যদি কোনো ঠোঁটকাটা আলোচক সাব্যস্ত করেন, — করেছেনও কোথাও কে যেন, হুমায়ুন আজাদের বাকভঙ্গি নকলপূর্বক, — তবে তাতে নিন্দা হয় না মোটেও। মঞ্চসফলতার সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক কত ক্ষীণ হতে পারে, রাহমানরচনা তার একটা বড় উদাহরণ। আসলে, শামসুর রাহমান বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিলেন আমাকে, আমাদেরকে, আমার আন্দাজ আমাদের বয়সী সিংহভাগেরেই, মৃত্যুর আগে যাপিত কবিজীবনের অনেক বছর ধরে।
যে-এপিগ্র্যাফটা মাথার ওপর টাঙায়েছি, নিষ্ঠুর শোনালেও ওতে সত্যতা আছে বৈকি। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, মনে হয় একটু দম নিয়া ভাববার ব্যাপার আছে। এখানে একটা ব্যাপার মারাত্মক যে, একজন কবি কী রিডারের ‘চিন্তা’ আর ‘যাপন’ প্রকাশ করতে বাধ্য? অনেক তর্কবিদ্যা ফলিয়ে যদি রিডারের ‘চিন্তা’-‘যাপন’ প্রকাশে কবি নিশ্চয় বাধ্য প্রত্যয়টি প্রমাণ করা যায়, গেল ধরা যাক প্রমাণ করা, তাহলে সেই রিডারসার্কলটি কোথাকার? কোন শ্রেণির? কি বিত্তের? এবং কোন কালের? কোন সিচ্যুয়েশনের তথা মাইনক্যার কোনো চিপাচাপার পাঠকবৃত্ত নাকি কৃষক-মজুর অথবা স্বর্ণস্পুন্ মুখে নিয়া জন্মানো মনুষ্যশাবক? প্রশ্নগুলো ওঠে একাদিক্রমে। এর উত্তরদান থেকে রেহাই পেতে একটা কথা ফট করে কয়ে ফেললেই হয় যে দুনিয়ার রিডার এক ও অভিন্ন জিনিশ, কাগজের মণ্ড কিংবা জিলিপির ময়দা টাইপের কিছু, ওর আবার ভাগাভাগি কিসের? কিন্তু সত্যিই কি তাই? রিডারের ভাগাভাগি নাই? কিংবা আদিকালের সেই কথাটা আবারও প্রচার করে যেতে হয় বারেবারে যে, কবি সর্বমানবের সর্বসময়ের সর্বপরিস্থিতির; অথচ প্রচারণাটা আজকাল আর চালানো সম্ভব না মনে হয়। ডাক্তার-বদ্যির স্পেশালাইজেশনের মতো কবিদেরও স্পেশালাইজেশন বর্তমানে দূরবীন ছাড়াই দৃষ্ট। ‘মজুরের কামারের’ কবি হবার বাসনা প্রকাশ করে এবং তদনুযায়ী লিখে যেয়েও কবি বিবেচিত হতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, ‘মনোযোগ দিয়ে পড়েছে’ যে সে-ই নিখোঁজ উত্তরমালা সামনে এনে দেখাতে পারে। কেননা ‘আমাদের ভাষায় বলেন না’ বাংলার ‘হাজার বছরের’ যুগ-যুগান্তরে জন্মানো বহু কবি, তবু ওদের কবিতা আমরা আজও পড়ি। চিন্ময়-মন্ময় নেসেসিটি ছাড়াও পড়ি নিতান্ত অদরকারেও। চর্যার পদগুলো তো, অথবা প্রাচীন-মধ্য-অন্ত্য কালের এবং ভাষার বহু কিসিমের কবি ও কবিতা, আজও পঠিত হয়। এমনকি রূপকথার আদলে কবিতা লিখেও উৎরানো কবি বিরল নয় ভূপৃষ্ঠে। স্রেফ একটা গ্রামের ছবি এঁকে, যে-গ্রাম আমার জিন্দেগিতে নেই আর কিংবা আগেও ছিল না, স্রেফ একটা ঘাসফড়িং কি তৃণপুষ্প অঙ্কন করেও, অস্তিত্ব গরহাজির যার বা যেইসবের আমার/আমাদের যাপনে, কবি কিংবা কবিতা হাজির রয়ে যেতে পারে এবং পেরেছে যুগ-যুগ ধরে। একইভাবে সমকালের বহু জঙ্গম প্রকাশিয়াও কবি ফিনিশ হয়ে যেতে পারে দেহধাম হইতে এক-নিমেষে। এমন কবি ও কবিতার উদাহরণফর্দ বর্তনে তোলা যায় এক্ষুণি তিনশতাধিক। দরকার আছে?
ম্যাজিকটা থাকে অন্য জায়গায়, বিশেষত কবিতায়, ‘চিন্তা’-‘ভাষা’-‘যাপন’ প্রভৃতি থিংস্ কবিতায় একভাবে এবং গদ্যে সম্পূর্ণ অন্যভাবে এসে ঠাঁই করে নিতে দেখি আমরা ‘হাজার বছর’ ধরে। যে-যুদ্ধটা আজকে ঘটছে, সেইটাকে একজন কবি তিনহাজার বছর আগের ব্যাপার বলে ভেবে নিয়ে একটা কাব্যিক বয়ান হাজির করতে পারেন। কবিতার সাংকেতিকতা ব্যাপারটা তা-ই তো, নয়? এবং এই সিগ্ন্যাল্ সিস্টেমের কারণেই কবিতার ইউনিক্নেস্। কাজেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে একজন কবির সামগ্রিক সম্ভার নিয়া আলাপে প্রবৃত্ত হওয়া আদৌ ফলদায়ক হয় না আখেরে। এই বিষয়টা আরেকবার আলাপে ফেরানো যাবে, এখন নয়, একটু সময় নিয়ে পরে।
রাহমান জীবনাবসানের আগের দুই-দশকদীর্ঘ সময়ে এতই বীতশ্রদ্ধ করেছিলেন আমাদেরে, এর কিছু উদাহরণ দেয়া দরকার মনে হয়, ব্যাপারটা তাহলে ‘শিক্ষামূলক’ হয় ডিটেইলসে বলতে পারলে। একটা আপাতত বলি। জীবনের অন্তিম দুই দশকে রাহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পেয়েছেন ২০টা, বিজয় দিবস পেয়েছেন ২০টা, ভাষাশহিদ দিবস পেয়েছেন ২০টা। ক্যাল্কুলেশন্ সর্বনিম্ন। কুড়িটা হিসাবে এই ৩ প্রকারের জাতীয় দিবসে কমের পক্ষে ১০টা দৈনিক পত্রিকায় একটা কবিতা লিখলে আমাদের মতো পেটরোগা পাঠকদের উপর দিয়া কী সদমা গিয়াছে, সেই বিবরণ হাজিরের দরকার আছে? কেবল রাহমান তো নন, ওই বিশবছরে রাহমানের চারপাশের অনুকারীরা কাগজের পাতা দখল করে রেখেছিলেন এবং আমাদিগের সদমা হাজারের কোঠা ছাড়ায়ে বাড়ায়ে গেছিলেন, অনুমেয় সহজেই। বীতশ্রদ্ধ হবার আরও কয়েকটা কারণ তো উপস্থিত মুহূর্তেই বলে ফেলা যায়। ধীরে, রিডার, ধীরে। জেনারালাইজেশনের জঞ্জাল তৈয়ার করা থেকে পুরোপুরি বাঁচতে কেউ পারে না আখেরে, এই নিবন্ধকার তো নয়ই, কিন্তু চেষ্টা চালানো দোষের নয় নিজেরে চেক্ দিবার ব্যাপারে। নেক্সট উয়িক্, বা মান্থে, এফোর্ট চালানো হবে। এখন দুয়ারে গাড়ি খাড়া। তাড়া, যাপনজৈবনিক যাত্রাপালার তাড়া। কাজের ঘানিটানা দৈনন্দিনতা থেকে ঈদের সুবাদে বেশ কয়েকটি দিনরাইতের ছুটি জুটেছিল, অবকাশ এরই মধ্যে ফুরায়ে এসেছে।
খেঙরার নোংরামি, খিস্তিখেউড়ের পৌষমাস
কথাটা রাহমানের কবিতা থেকে কোট নিয়ে এই শিরোস্থলে পুট করা হয়েছে। এইটা ফাল্গুন অবশ্য, পৌষ বিদায় নিয়েছে বহুদিন হলো, মধ্যিখানে মাঘ এসে চিতাবাঘিনীর মতো রতিবিকিরণ ঘটিয়ে আমাদিগের অনেকেরই হৃদয় পটিয়েছে এইবার। যাকে বলে সিডাক্টিভ, সিডিউসিং, এবারকার ঋতুশ্রেষ্ঠী শীত সন্দেহাতীতভাবেই ছিল তদ্রুপ। এহেন যৌনাবেদনময় শীত, সাচ অ্যা টেরিফিক্ সেক্সঅ্যাপিলিং উইন্টার, যেন কখনো আসেনি আগে। অ্যানিওয়ে। ডাজ্’ন্ ম্যাটার। গ্রীষ্ম হবে এইবার অধিকতর উইন্ডি, ডিভ্যাস্ট্যাইটিংলি বিউটিফ্যুল্, বিস্ময়বিতত নন্দনীয়। হয় যেন, মৌলা মাবুদ, ঘামে-প্রেমে দিবাযামে ব্যাকুল অথচ ক্রুয়েলেস্ট মোহিনী গ্রীষ্মের সনে এ-জীবনে দেখাদেখিটুকু।
প্রতিবছর ডিউরিং ফেব্রুয়ারি আমরা গানটা গাই বিভিন্ন মজলিশে, ময়দানে-মিডিয়ায়, এইবার তো বোকাবাকশোগুলোতে একযোগে ভিনদেশি-ভিনভাষাভাষী ফোকদের দিয়ে একুশের গান গাহিয়ে এহেন অবস্থা করা হয়েছে যে দেশবাসী ইমোশনে কেন্দে ফেলবার বিপর্যয় ক্রিয়েট হয়েছে। বেঙ্গলির আবেগের ন্যায় রিডিক্যুলাস্ থিংস্ ভূমণ্ডলে খুঁজিয়া পাওয়া ভার। বেঙ্গলি এমনিতেই প্যাট্রিয়টিক্ ন্যাশন্ হিশেবে খ্যাত। অবশ্য বঙ্গবাসীর খ্যাতি বিকটরূপা আনপ্রেডিক্টেব্যল্। সম্প্রতি বিদ্যাসাগর-কবিকুঙ্কুম-কাব্যবিনোদ প্রভৃতি বিচিত্র অতিসৃষ্টিস্ফীত অভিধার আবিষ্কর্তা জাতিটা ব্যবসাবাণিজ্যে বেশ মনোনিবেশ করেছে দেখতে পাওয়া যায়। ব্যবসাসাগর-বাণিজ্যকুঙ্কুম-বেনেবিনোদ পুরস্কার প্রবর্তনার খবর শোনা না-গেলেও অচিরে শোনা যাবে — এহেন প্রত্যাশা জাগরুক এই গগনচুম্বী লিট্রেচারের দেশে। কেননা আমাদের এখানে এখন বাঙ্গালা সাহিত্যোন্নয়নে সর্বনিম্ন পাঁচহাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচলাখ মূল্যমানঋদ্ধ মুদ্রার অ্যাওয়ার্ড রয়েছে একেবারেই নিদেনপক্ষে তেরো-চোদ্দো অথবা তারচেয়েও অধিক। ফলে এ-ন্যাশনের লিটারেরি বিকাশ রুধিবে সে-সাধ্যি পির-পয়গম্বর কিংবা তাতার দস্যুরও নাই। লীলাপটু কর্পোরেট ক্যাপিট্যালের মনোপোলি মুনাফাক্ষ্যাপামোতে এখন আমরা গাহি ভাষাশহিদানের গানা — আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো টুয়েন্টিফার্স্ট ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি …
কিন্তু অত ঘটা করে, অ্যাট-লিস্ট টিভিস্ক্রিন্ ধাঁধিয়ে, এলাটিংবেলাটিং অ্যাক্সেন্টের প্রোন্যান্সিয়েশ্যন্ দিয়ে ফেব্রুয়ারি রিকলের দরকারিতা আজ আর ততটা নাই নিশ্চয়। কিংবা নাই উচ্চারণের শুদ্ধাশুদ্ধি নিয়া আজাইরা কামে দেয়ালে মাথা ঢুঁশায়ে মরবার দরকারও। প্রয়োজন কোনো আইনকানুন কি বিজ্ঞ আদালতের ধার ধারে না। তার, প্রয়োজনের, পথটা আলগ। অত দুশ্চিন্তার কি আছে, মানুষ যদি অদূর ভবিষ্যতে নেয় শিখে ল্যাঙ্গুয়েজের মিডিয়া ছাড়া হাঁটাচলার রাস্তা ও কারিগরি? কিংবা গালিগালাজে, খেউড়ে-খিস্তিতে, সে যদি তার মনের ভাব ও অভাব প্রকাশিতে বা আড়াল করতেই শিখে ফেলে সেক্ষেত্রেও দুশ্চিন্তার কিছু দেখি না। কামিং ফিউচারে এ-দেবোত্তর সম্পত্তি ইনহেরিট করতে চলেছে যারা, তারা যদি ঠিক করে এইটা ভাঙিয়ে ক্যাশ পয়সা ব্যবসায় খাটাবে, বাংলামদের পাট্টা খুলবে ডিসাইড করে যদি, আমি তাতে অব্জেকশ্যনের কিছু তো দেখছিনে বেরাদরান-এ-বেঙ্গল! আর ব্যবসায় লাভ-লস্ তো আছেই, বিজনেসে নেমে বাপঠাকুর্দার নৈতিকতা নিয়া আটকে থাকলে চলে না, বিজনেসের নিজস্ব নৈতিকতা আছে হে! এবং ইয়াদ রেখো, মদের পাট্টায় খিস্তি-খেউড় হৈহুল্লোড় না-থাকিলে সেই ইনফার্নোর চেয়ে নারকীয় নৈস্তব্ধ্য কোথাও হতে পারে না।
শামসুর রাহমান কবিতায় ভাষাভূষা নিয়া ভাবিত হয়েছেন বহুবার বহুভাবে, যেমন তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তাক্রান্ত হয়েছিলেন মূলত ভালোবাসাবাসি নিয়া, রেভোল্যুশন্ নিয়া রাহমানের অবস্থানও হর্ষ ও হয়রানিকর বলা বাহুল্য। সমস্ত যোগবিয়োগ শেষে রাহমান অন্যতর উচ্চতার কবি, নিঃসন্দেহে, কিন্তু উনার ভিক্টোরিয়্যান্ নৈতিকতাশাসিত কবিমুখটিও অগোচর থাকে না। রাহমানবিচার লক্ষ্য নয় এইখানে, একটা কবিতার কয়েকটা লাইন বিড়বিড়াইতে যেয়ে একুশেফেব্রুপ্রহরে এই নিবন্ধের অবতারণা।
ঠাকুরের সর্বমোট কাব্যগ্রন্থের ফোর্থ টাইমস্ কবিতাকিতাব পয়দা-করে-যাওয়া রাহমানের ফিফথ বই ‘নিজ বাসভূমে’, এইটা আন্দাজ করছি মিড-সেভেন্টিজের পাব্লিক্যাশন্, সেই বইয়ের ভিতর ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কাসিদাটা আমরা প্রায় মেমোরাইজ্ করে ফেলতে পেরেছিলাম তৎকালীন আবৃত্তিরোগীদিগের সর্দিশিল্পের ঠ্যালায় চ্যাপ্টা হয়ে। ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়’ — এহেন পঙক্তির সুন্দর সাক্ষাতে কবিতার শুরু। স্তবক-দুয়েক পরে যেয়েও সুন্দরের সাক্ষাৎ পাই, ‘গলিত কাচের মতো জলে ফাৎনা দেখে রঙিন মাছের / আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা’ লাইনঘাটের সামনে একটুখানি তিষ্ঠ হওয়া যায় নিশ্চয়। এরপরেই, ইন-ফ্যাক্ট লাস্ট স্ট্যাঞ্জায়, রাহমানের বিবৃতিপ্রবণ সমাজচৈতন্য এসে কবিতাটার যা ঘটাবার তা ঘটায়ে ফ্যালে; এর ফলে আবৃত্তিশিল্প প্রভূত উপকৃত হয় বৈকি। লেট’স্ রিড ইট আউট লাউডলি, নিচের মঞ্চে মাইক্রোফোন্ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এক্সট্রা ইকো-রিভার্ব এস্তেমালপূর্বক কবিতাটা ঝাঁঝালো রিসাইট করি, হিয়ার য়্যু গ্য —
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শ’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
পৌষের পরেই ফাল্গুন, বসন্তরাগিণী, কথাটা আমলে রেখে রাহমানের দুশ্চিন্তাক্লিষ্ট কররেখাবলি রিড-আউট করতে পারি আমরা। গালিগালাজের মরশুমে ভাষার বারোটা না-বেজে একটা আনুপূর্ব উন্নতি ঘটে, হেন উন্নতি নিমকণ্ঠ দরবেশঋতুতে ঘটিবার নয়। খিস্তির বিকাশ আর ভাষার বিকাশ পরস্পরের পরিপূরক। কথাটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে কি? নিবন্ধান্তরে সেই ইনিশিয়েটিভ গৃহীত হবে স্যম্ আদার ডে। এখন রাহমানের এন্ডিং পঙক্তিদ্বয় খেয়াল করি, — ‘তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, / বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’ না, গালিগালাজের অবারিত সিজনেই নিশ্চিত শুভমুক্তি ঘটে একেকটা ভাষিক অবদমিতাবস্থার। আমি পারি, রিয়্যালি, খিস্তিখেউড়ের ষড়ঋতু জুড়ে পূর্ণায়ত নয়নে অ্যালফ্যাবেটের দিকে স্নিগ্ধ তাকাতে।
লেখা জাহেদ আহমদ ।। লেখাকাল ২০১৬
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS