ফেয়ারোয়েল টু কবরী

ফেয়ারোয়েল টু কবরী

কবরীকে দেখলে মনে হতো সমুদ্রতটবর্তী নিঝুম উদোম কোনো গ্রামবালিকা। তেমনই ঋজু, সোজাসাপ্টা, স্বচ্ছ অথচ গভীর চক্ষুজোড়। বয়সকালে এই ফিচারের লগে চেহারায়-গতরে আরও সমস্ত উপাদান এসে অ্যাড হয়েছে, এরপরও সরলতা হারায়া যায় নাই। ছিল, সরলতা তার আঁখিজোড়ায় ছিল অন্তত অন্তিম অব্দি।

কিন্তু কবরী যখন কথা বলতেন আলাপচারিতায়, তখন উনার সারল্য ও দার্ঢ্য দুনোটাই ঠিকরে বেরোত। শেষ দুই দশক তো উনার কথাবলা কারবারেই ছিল বেশি ব্যস্ততা, আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায়, এমপি হয়েছিলেন বোধহয়, আওয়ামীগুন্ডা শামীম ওসমানের চাচার বউ হবার সুবাদে এক-দুইবার সংঘাতও হয়েছিল ওসমানফ্যামিলির লগে।

গেল দুই-তিনদশক কবরী টিভিস্ক্রিনে এসছেন বহু, চলচ্চিত্রে দেখা প্রায় যায়ই নাই। কিংবা আমরা আসলে গেল দুই-তিনদশক ধরে বাংলাদেশের সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে দেখা বা ঘরে বসে দেশপ্রেমচর্চাকল্পে দেশজ চলচ্চিত্র উপভোগ করা বাদই দিয়া দিসি। কিন্তু কবরী সিনেমায় অ্যাক্ট করলে পেপারে পেতাম নিশ্চয়। নিউজ-আইটেম হিশেবে কবরীর কামব্যাক শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

আর ছোটপর্দায়, মানে টেলিভিশনে, বেশকিছু নাটকে ম্যে বি তিনি অভিনয় করসেন। আমার দেখা হয় নাই। ডিরেকশনেও বোধহয় কি কি যেন করসেন বাট আমার ঠিক জানা নাই।  কিন্তু ওভারঅল উনি হিরোয়িন হিশেবে স্পেল শেষ করে একটা গ্যাপ নিসিলেন এবং তখন উনার পার্সোন্যাল প্রাইভেট লাইফে নানাকিসু হইসে, অ্যানিওয়ে। পরে উনি ফিরসেন যখন, অভিনয়টা আর অত কন্টিনিউ করতে দেখি না তারে আমরা। ব্যবসাবাণিজ্যে গেসেন নিশ্চয়। আর সাংস্কৃতিক সুধীসমাজে দেখা যাইত উনারে নিয়মিত। পলিটিক্সে তো ভালোই লিখাইসেন নাম, খোদ পিএমের আশীর্বাদে। বেশিকিসু আমি জানি না। অবশ্য গ্যুগল্ করলে কী না জানা যায়!

গ্রামবালিকা আদলের সেই কবরী অ্যাডাল্ট হইসেন পরে। সেই ইনোসেন্সের বাইরে বারায়া কাজও করসেন। তবু কবরীর নিজের যে-একটা ফ্যানবেইস্, সেইখানে সেই দিলদিবানা ফ্যানদের মনোমসনদে কবরীর বালিকা ইমেইজ অক্ষুণ্ণই ছিল। বড়জোর ‘মিষ্টি মেয়ে’ পর্যন্ত বলতে শোনা যায় তারে, এর বেশি না। মানে, সেক্সসিম্বল প্রভৃতি সিনেতকমা তার নামের পাশে দেখা যায় নাই।

কিন্তু উনার আবেদন সত্যি সত্যিই অনন্য। প্রসাধনহীন একটা চেহারায় যে এত ঢলোঢলো গ্ল্যামার ঠিকরাতে পারে, একটা আঁচলপ্যাঁচানো কাঁচুলিবিহীন গতরেও যে অ্যাপিলের ফাউন্টেইন বইতে পারে, এইটা বাঙালি কবরীকে দেখে মেহসুস করসে ফার্স্ট। উনার অনেক সিনেমাই দেখা হইসে আমাদের, প্রায় সবই ইনডিড। এই অনুচ্ছেদে কেবল একটা সিনেমার নামই ইয়াদ করব প্রসঙ্গত। ‘সারেং বউ’। গট মাই পয়েন্ট?

ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমার সুচিত্রা সেনের মতো কবরীও শরীরী উপস্থাপনা আর সাজপোশাকের ব্যাপারে খুবই কনশাস ছিলেন, চ্যুজি ছিলেন, বিবেচক ছিলেন। ফলে এভার্গ্রিন থাকার জন্যে, নিজেরে চিরহরিৎ রাখবার জন্যে, যে-স্টেপ যখনই নেয়া দরকার তা-ই নিয়েছেন কবরী নিরাপোস। বয়সকালে সেরেমোনিয়্যাল ইভেন্টগুলায় উনার কস্টিউমসেন্স এবং প্রেজেন্টেশনসেন্সের যে-নমুনা আমরা দেখসি, তা প্রেইজ করবার মতো।

উনার বার্থনেইম মিনা পাল, চাটগাঁর মানুষ, ‘সুতরাং’ সিনেমার মধ্য দিয়া সুভাষ দত্তের প্যাট্রনশিপে উনি হয়ে গেলেন কবরী। কিন্তু এইসব তথ্য সর্বজনবিদিত, কাজেই বৃথা না-আওড়াই। কিংবা তার লাইফে ম্যারিটাল কমপ্লিকেইসি নিয়া বাঙালির হাজার জ্ঞানপিপাসা থাকলেও ওইদিক দিয়া না যাই। কিংবা আরেক বুড়া কাগজসম্পাদক স্বয়ং কবরীর ইন্টার্ভিয়্যু নিতে যায়া নায়িকার ব্যক্তিজৈবনিক একাকিত্ব, পুরুষসংসর্গ নিয়া হাহুতাশ, খোদ ওই অশীতিপর সম্পাদক নিজেরে জড়ায়া নায়িকার মুখ দিয়া অ্যাডাল্ট প্যাশনের সেন্সুয়াস যেইসব ইঙ্গিত দুঃখুদুঃখুমুখে বসাইসেন ওই ‘দীর্ঘতম’-কথিত কবরীর সাক্ষাৎকারে, সেইটার ইথিক্যাল গ্রাউন্ড নিয়াও আমরা ভাবতাসি না আপাতত। কবরীরে ফেয়ারোয়েল জানাইতে এই নিবন্ধে একটামাত্র অনুচ্ছেদ টাইপ করেই ইস্তফা দিবো। ফর নাউ; পরে অ্যাগেইন এই বিষয় রিলোড করব নিশ্চয় নেক্সট কোনো উসিলায়।

হিরোয়িন হিশেবে কবরীর ক্রেইজ কেমন ছিল তা দেখাইতে যেয়ে ‘সুজন সখী’ ইত্যাদি সিনেমার হাউজফ্যুল টকিহল দেখায়া সাহিত্যিক-সম্পাদকেরা কাগজে এন্তার লিখতেসেন এবং লিখবেন। তবে এইখানে একটু আদার-ওয়ে-অ্যারাউন্ড কবরীর জনপ্রিয়তার ব্যাপারে একটা পাত্তা লাগাইতে পারি। বিশ্বজুড়ে লাক্সের প্রোডাক্টমডেল হওয়া মোটামুটি ডিগ্নিটিরই একটা ব্যাপার, এইটা আশা করি স্বীকার-অস্বীকারের বাইরেই থাকবে। কেউ কী ইয়াদ করতে পারবেন বাংলাদেশে লাক্সের প্রথম কমার্শিয়্যাল মডেল কে হইসিলেন? উত্তর : কবরী। বিশদে বলি।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সুতরাং’ রিলিজের পর থেকে ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্য সিনেমায় নায়িকা হয়া অ্যাক্ট করসেন কবরী। অসাধারণ অভিনয়নৈপুণ্য তো ছিলই, ছিল ঢলোঢলো লাস্য ও লাবণ্যের মিশেলে এক অদ্ভুত মাদকতাময় ফেসল্যুক। ছিল বেতসলতার মতো গতর। সেই সময়টায় আধিপত্যই ছিল তার ঢাকাই সিনেমার নায়িকামহলে। এবং ঠিক এমনই টাইমে লাক্স বাংলাদেশে এন্টার করে। বেছে নেয় কবরীকে তাদের পণ্যপ্রসারের দূতী হিশেবে। কবরী লাক্সমডেল হন ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এইখানে এক্সট্রা তথ্য এইটুকুই যে সেইসময় টেলিভিশনে কমার্শিয়্যাল নয়, লাক্সের বিজ্ঞাপনগুলি ছিল মূলত স্টিলফটোগ্র্যাফিকেন্দ্রী, নিউজপেপারে পাব্লিশ হতো। কবরী লাক্সমডেল হিশেবে অ্যাপিয়্যার করেন স্থিরচিত্রায়িত হয়া।

আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়াখায়ের করি।

লেখা / সুবিনয় ইসলাম


সুবিনয় ইসলাম রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you