শিক্ষিত আর সভ্য হয়ে ওঠা বাঙালি পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করা প্রথম বহিরাগত পুরুষের নাম সম্ভবত শ্রীযুক্ত অযোধ্যনাথ পাকড়াশী। উনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত ইংরাজি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, যার উপর দায়িত্ব বর্তেছিল ঠাকুরপরিবারের মেয়ে ও বৌঠাকুরানীদের শিক্ষাদান করার। স্বর্ণকুমারী দেবী তার বই সেকেলে কথায় জানান, এই প্রথম তাদেরকে পরপুরুষের সামনে আসতে হলো বলে একপাটি কাপড় শাড়ির বদলে আরো বেশি আবরণ দরকার হইছে। তারা তখন বক্ষ ঢেকে রাখবার জন্য সুশোভন পেশোয়াজ আর ওড়না পরে আসতেন। এই ঠাকুরপরিবারেই সর্বপ্রথম মেয়েদের ব্লাউজ পরিধানের প্রচলন শুরু হয়। আর এই যাত্রায় যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিত্রশিল্পী অবনঠাকুরের ভাই এই গগনঠাকুর খুবই আধুনিক মনস্ক আর জিনিয়াস ছিলেন। তিনি বাড়ির মেয়েদের বক্ষাবরণ পরে বাইরে যেতে উৎসাহ দিতেন। তিনিই সর্বপ্রথম তার মেয়ে সুজাতাকে ব্লাউজ পরিয়ে প্রকাশ্যে বিয়ে দেন। এবং সুজাতাই প্রথম বাঙালি নারী যার বিয়ে হয়েছিল ব্লাউজ পরে বাইরে এসে।
সেই ঠাকুরপরিবার থেকেই দেখা যাচ্ছে অন্তঃপুরের সংস্কার সাধন থেকে শুরু করে বাইরে গমনের উদ্দেশ্য থেকেই নারীর গায়ে শালীন পোশাক পরিয়ে দিয়েছেন পরিবারের পুরুষেরা। ক্রমে সেই বিচার অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে আজকের হাইকোর্টের রায় পর্যন্ত চলমান।
উনিশ শতক : বাঙালি মেয়ের যৌনতা (২০১৭) বইয়ে লেখক অর্ণব সাহা আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অবজার্ভেশন তুলে ধরেছেন নারীদের পোশাকবিতর্ক নিয়ে। তিনি বলেন, পোশাকবিতর্কের ক্ষেত্রে মূলত দুটি বিষয় পাওয়া যায়। প্রথমটি হলো : পোশাকবিতর্কের কেন্দ্র আর অন্যটি পোশাকনির্বাচনের মানদণ্ড। এই বিতর্কের কেন্দ্রে সবসময় থাকেন নারীরা। আর মানদণ্ড হলো : কৃষ্টি, সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেনে নারীরা কাপড় পরছেন কী না সেই গজফিতা।
আমাদের সম্মানিত বিচারপতিও অনুরূপ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, নরসিংদীতে যাওয়া নারীর পোশাক আমাদের ঐতিহ্য ও রীতি অনুযায়ী অগ্রহণযোগ্য। উনার মানদণ্ড হচ্ছে আমাদের রীতিসিদ্ধ ঐতিহ্যগত পোশাক।
কিন্ত পোশাক বিষয়ে কখনো এই বিতর্ক দেখা যায় না যে, পুরুষের পোশাক কেমন হবে বা তারা কি পরবেন? এই যে গরম পড়ছে সেই গরমে অনায়াসে একজন ছেলের পক্ষে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে রাস্তায় হাঁটা সম্ভব হলেও মেয়েরা সেটা পরতে পারবে না। কিংবা এই গরমে কেন একজন নারী আপাদমস্তক ঢেকে বের হবেন এই প্রশ্নটাও নারীরা করতে পারবেন না। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি শুধু পুরুষের ইচ্ছা আর প্রাধান্যের পক্ষে। আমাদের রীতিসিদ্ধ ঐতিহ্যে সচরাচর একজন পুরুষের লুঙ্গি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে ফেলার পক্ষে গেলেও একজন নারীর প্রস্রাবের চাপে ব্লাডার ফেটে গেলেও যে-কোনো অবস্থায় তার বাইরে প্রস্রাব করার পক্ষে না।
লেখক আরো বলছেন, আমাদের এই সমাজে পোশাক হলো একটি নৈতিক বিনিয়োগ যার সাহায্যে আমরা সভ্যতার স্তরপরম্পরায় অগ্রগতির মাপকাঠি নির্ধারক করি। উনার এই কথাটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আগে নারীদের ঘরে রেখেই আমরা শালীনতা নির্ধারণ করেছি। তারপরে তাদেরকে বক্ষাবরণ দিয়ে আচ্ছাদিত করে বাইরে পাঠিয়েছি। ক্রমে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বারান্দায় আর উঠানে পায়চারি করতে দিয়েছি। আর এখন আমরা তার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি চোখ ছাড়া সব কিছু অবগুণ্ঠিত করার ফর্মুলা।
নারীর গায়ের পোশাক সবসময়ই পুরুষকেন্দ্রিক। ইভেন পোশাকের যে জাতীয়তাবাদী আর ধর্ম বিষয়ক সীমানা সেখানেও পুরুষতান্ত্রিক ইগো সর্বদা সক্রিয়।
হিন্দুধর্মে বিধবাদের পোশাক হিসেবে আসলে এক-কাপড় পরার প্রচলন আগে থেকেই সধবাদের মতোই ছিল। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো তার রঙ। বিধবারা শাদা শাড়ি পরতেন কারণ এটা শোভনীয়তার বা শুভ্রতার প্রতীক। রঙিন পোশাক বিধবাদের পরতে দেয়া হতো না। রঙিন কাপড় কেন অশোভন এই প্রশ্নের উত্তর আমি সরাসরি কোথাও পাইনি তবে বিধবাদের অযৌন রাখার যে পুরুষতান্ত্রিক বাসনা সেখানে তাদের নিষ্ক্রিয় হিসেবে তুলে ধরতেই শাদা কাপড়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব গড়ে ওঠে। এখানে অবশ্যই আরেকটি বিষয়ও জরুরি আর তা হলো চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া। শাদা শাড়ি আর রঙিন শাড়ির মধ্যে সধবা আর বিধবা চিনতে পারাটা পুরুষতান্ত্রিক সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি ছিল।
শোভনীয়তার মতো শালীনতা ( modesty) বিষয়টাও এখানে জরুরি। ব্রিটিশদের আগমনের পরে এই অঞ্চলের মেয়েরা শাড়ির বাইরে অন্যান্য পোশাক পরতে শুরু করে। সেগুলোর মধ্যে শেমিজ, কামিজ বা লং গাউন ছিল অন্যতম। তখন জনমনে একটি ভীতিকর প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে পোশাক কি আধুনিক ও যুগোপযোগী হয়ে উঠছে কী না? আর এই চিন্তা মূলত যাদের কাছ থেকে আসতো তারা সবাই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। যারা শহর কলকাতাকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতেন আর সাহেবদের আনুগত্যতায় নিজদের গড়ে তুলতেন। এই সময়ে তারা সমাজে ‘ভালো মেয়ে’ বনাম ‘খারাপ মেয়ে’-র ধারণা গড়ে তোলেন।
তৎসময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘বামাবোধিনী’, পুরো উনিশ এবং বিশ শতকের ’৩০ দশক পর্যন্ত এইসব বিতর্ক জিইয়ে রেখেছিল। এখানে একটা আয়রনি হলো ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন পুরুষ আর লিখতেন নারীরা। অধিকাংশ নারীকণ্ঠেই পুরুষের সুরের মতো বলিষ্ঠতা প্রকাশ পেত। এই পত্রিকায় ভদ্র নারীদের নারীত্বের গুণ প্রচারের যে ভূমিকা নিয়েছিল সেখানে তারা লজ্জ্বাকে নারীর ভূষণ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিল, যা মূলত সংরক্ষিত হতো মার্জিত পোশাক দিয়ে। এই রক্ষণশীল নৈতিকতার প্রতিফলন পাই আমরা ১৯২২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘স্ত্রীলোকের পরিচ্ছদ’ নামক আরেক প্রবন্ধে। সৌদামিনী খাস্তগীর নামের এক লেখিকা বলেন, “মেয়েরা যে পোশাকই পরুক না কেন, সর্বাঙ্গে একটি চাদর বা শাল জাতীয় কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখাটা একজন ভদ্রমহিলার কর্তব্য।” মূলত ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের মোরালিটি এখানে এসে এনলাইটেন বাঙালির মোরালিটিতে রূপান্তরিত হয়, যা অপরাপর নৈতিকতার মতো নারীর পোশাকের সীমানা নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে।
এখানে এসে উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো একটি পোশাকের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিও শুরু হয়। নারীদের পোশাকে ব্রিটিশদের রুচির প্রাধান্য বনাম বাঙালির ঐতিহ্যই ছিল এই দ্বৈরথের কেন্দ্র। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এই বিতর্কের মূল কথাই ছিল তুমি যতই ব্রিটিশের পোশাক পরো না কেন দেশীয় পোশাকেই তোমার দেশপ্রেম নির্ধারিত হয়ে উঠবে। বিদেশি পণ্য বর্জন করে তখন স্বদেশী পণ্যের উপরে জোর দেয়া হয়। এভাবেই এই পোশাক জাতীয়তাবাদের আড়ালে নারীদের জন্য একটি ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ মেয়ের নৈতিকতা দাঁড় করায় যা ব্রিটিশদের পরা কাপড়ের বৈধতা দেয় নারীর বুকে শাল বা চাদর জড়িয়ে দিয়ে। আমার ধারণা, এতদঅঞ্চলে ব্রিটিশ পোশাকের উপরে আচ্ছাদন দিতে গিয়েই মেয়েদের বুকে শালীনতা রক্ষার জন্য ওড়না এসে জুটছে। যদিও এর ভিন্নরকম প্রচলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে পারে। কিন্তু মেয়েদের বুকে ঝোলানো পুরুষতন্ত্রের সোসাইটি বা ভালো মেয়ের মানদণ্ড হিসেবে তখন থেকেই ওড়না নামক এই অপ্রয়োজনীয় জিনিস পুরুষতন্ত্রের ইগো সেটিসফাই করতে যুগ যুগ ধরে ঝুলে আছে।
ওড়না; — নারীর বুকে ঝোলানো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতীকী ‘সোসাইটি’।
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS