বিলাই

বিলাই

বিলাইদিন … বেড়ালরাত্রি … দিনভর মার্জার … রাতভর শ্রোয়েডিঙ্গার … অনেক পুরনো এক লেখকের কঠিন কঠিন ভোক্যাবুলারি দিয়া খামাখা স্পাইরাল সিন্টেক্সে লেখা পানিক্লিয়ার কিছু লোককথিত তত্ত্বকথ্য সবক দিতেসি … রিভিশন … পরীক্ষা নাই কিন্তু পণ্ডিতি তো জীবন থেকে ইরেডিকেইট করবার পারি নাই আজতক … ইচ্ছাও নাই … ইট ইজ্ ইন-ফ্যাক্ট অ্যা গেইম … লেট্’স্ প্লে অন … শ্রোয়েডিঙ্গার … ওহে বন্ধু, ভবসিন্ধু, সবুজ বান্ধবী … প্রিয় মার্জার …


বিলাই, বিড়াল, বেড়াল, মেকুর, মার্জার। প্রাচ্যের মোস্ট পপুলার পেট অ্যানিম্যাল দ্য ক্যাট, পশ্চিমে যেমন ডগ। বিশেষভাবে এই সাবকন্টিনেন্টাল ভূখণ্ডে বেড়াল হলো সবচেয়ে ঘরোয়া প্রাণি। মিল্ক খায় চুকচুক শব্দে, অবশ্য দুগ্ধপায়ী বিড়াল বইপত্রে ছাড়া আজকাল দেখা যায় না খুব-একটা, খুব কম বিড়াল পাওয়া যাবে যে কিনা নিয়মিত মিল্ক পান করার সুবর্ণ সুযোগ পায়। বেশিরভাগ বিড়াল কাঁটাকুটা খায়, থালার উচ্ছিষ্ট খায়াই জীবনাতিপাত করে, এবং বিড়ালের চোখ রাত্রিকালে দাদাজানের তসবিদানার ন্যায় ঠিকরোয় রেডিয়েন্ট আলো। শৈশবে মাতুলালয়ে হেঁশেলের কাছে, স্পেশ্যালি শীতকালে, বেড়াল কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকত। সকালবেলা উনোনের পুরনো ছাই ফেলতে যেয়ে দেখা যেত ঘুমায়া আছে মিষ্টিবিষণ্ন মামাতো বোনের ন্যায় আদুরে ভঙ্গিমায় বিলাই প্রিয়তমা। আলগোছে চোখ খুলি শীতকাতুরে বেড়াল তাকাত অনিচ্ছায়, এবং কুণ্ডুলি ভেঙে উঠে যেত চোখ মিরমিরিয়ে কলতলার দিকে।


ছেলেবেলায় একটা অমার্জনীয় অপরাধ করে যেতাম লাগাতার, প্রতিদিন দুপুরবেলা আম্মা-চাচিমার ভাতঘুমের সুযোগে, আমরা ভাইবোন মিলে। বেড়াল বেচারার পিছে সারাক্ষণ লাগা, তারে ত্যক্ত করা, বালিঢিবিতে সে শৌচ করতে গেলেও তারে ফলো করা। প্রাইভেসি বলতে কিছুই ছিল না বেচারার, আমাদের দৌরাত্ম্যে। একেবারেই শিশুতোষ খেলা হিশেবে ব্যাপারটা স্টার্ট হইসিল, সর্ট-অফ সুখস্মৃতিই হতো হয়তো, তবে গোল বাঁধে একটি ঘটনায়। সেই নির্মম ঘটনাটা দিয়াই অবশ্য সমাপ্ত হয় আমাদের বেড়াল-ত্যক্তকরণ, আমরা বড় হয়ে উঠি এই ঘটনা দিয়াই। নিয়মিত দুপুরের খেলায় একদিন নির্দোষ নিরীহ একটি বিড়াল আমরা ধানবহনের-কাজে-ব্যবহৃত বড় একটি চটের বস্তায় ভরে ফেলি। বস্তার মুখ কষে বেঁধে নিশ্ছিদ্র-প্রকোষ্ঠে-ধৃত বিড়াল আমরা আম্মার কাছে নিয়া যাই, সাফল্য সেলিব্রেট করতে, কিন্তু ঘুমঘোরে আম্মা কী ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন খেয়াল করি নাই। ফিরে এসে, ন্যাচারালি, খেলতে লেগে যাই। কিন্তু এইবার অন্য খেলা বাদ, সমস্ত খেলার প্রতিভা বিনিয়োগ করে বেড়ালের পিছু লাগি আমরা। হাতে-বানানো ক্রিকেটব্যাট দিয়া বাঁধামুখ বস্তার গায়ে পেটানো উপর্যুপরি, বিড়ালচিৎকার প্রাণত্রাহি, শিশুদের উল্লাস তাতে দ্বিগুণ অধিক! বহুক্ষণ এইভাবে বস্তাবন্দী বিড়ালের আহাজারি আর বস্তাসমেত ছুটোছুটির জান-বাঁচানিয়া খেল দেখতে দেখতে একসময় ইস্তফা দিয়ে দেখি বিড়াল তো নড়েচড়ে না! ব্যাপার কী! চিল্লাচিল্লির চোটে কাঁচাঘুম ভেঙে আম্মা এসে এক্সামিনপূর্বক বিড়ালের ডেথ ডিক্লেয়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে, কেউ কিছু বলার আগে, আমাদের মুখচোখ শুকায়া যায়, শুরু হয় শোচনা। আম্মা তখন শুরু করেন তাঁর স্বভাবসুলভ অন্যায়-ও-অপরাধজনিত কন্সিক্যুয়েন্স বর্ণনার বহর। অপরাধ ও পাপবোধ ঘিরে ধরে সেই প্রথম, এর জের টেনে যেতে হয়েছে হুজুরের কাছে ঢেরদিন ধরে, প্রতিদিন ভোরবেলা মাফ চাইতে হয়েছে আল্লার কাছে কৃত অপরাধের জন্য। বড় হয়ে উঠি আমি সেইদিনই। কিন্তু অনেক পরে আমার স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে ব্যাপারটা আলাপ করতে যেয়ে আবিষ্কার করি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বিড়ালহন্তা! আমি সিদ্ধান্ত টানি, বিড়াল হত্যা করেই আমরা বড় হয়ে উঠি। বিড়ালের জীবন কেড়ে নিয়ে এই বড়-হয়ে-ওঠা মানুষের জীবনযাপন তো অভিশপ্ত হবেই। রিসেন্টলি বিস্মিত হই এ-বাবতে ফের, একজন কবির একটি গদ্যলেখা পড়তে যেয়ে, আমারই সিমিলার একটা পাপ ও অপরাধের বিবরণ পেয়ে সহসা। কামরুজ্জামান কামু-র সেই অনবদ্য গদ্য থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ নিচে রেখে দিচ্ছি :

আমি ছোটবেলায় একটা বড় নৃশংসতা করছি। একটা বিড়াল আমাদের বাড়িতে মাছের কাটাকুটা খাইত। দড়ির ফাঁদ বানায়া আমি একদিন সেই বিড়ালটাকে ধরলাম। তারপর তার গলায় দড়ি বেঁধে তাকে নিয়ে নামলাম বাড়ির সামনের পুকুরে। নিচে থেকে দড়ি টেনে ধরি আর সেই বিড়ালটা ছটফট করতে থাকে। আবার একটু দড়ি ছাড়ি। সে ভাবে, বাঁচলাম বুঝি! তখন আবার টেনে ধরি। পানির একটু নিচে বিড়ালটা বেঁচে থাকার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। হায় রে জীবন! আমি হত্যার ক্রূরতা অনুভব করতে থাকি। মৃত্যুযন্ত্রণা চাক্ষুষ করতে থাকি। একসময় বিড়ালটা জীবনের ওপারে চলে যায়। মায়াবী দুনিয়ায় নিঃসাড় হয়ে যায় তার দেহ।

এই শরীর বিষে ভরে গেছে! নীল হয়ে গেছে! আকণ্ঠ পাপে ডুবে গেছে! ওগো বিচারদিনের স্বামী!


তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলায় এমনকি নিরীহ গোবেচারা বিড়ালটাও, হায়, নিরাপদ নয়! এইটা ভাবনার এবং দুশ্চিন্তার। তবে ওভারঅল বলাই যায়, বেড়াল আমাদের সমাজে বেশ সমাদৃত, ভালোই আদর-আপ্যায়ন পায়, কুকুর নয় সেভাবে। কেন কুকুরের মতো স্যুয়িট ও ইউজফ্যুল একটা প্রাণ আমাদের কাছে এত অবহেলার শিকার, শুধু মর্ত্যবাসী মানুষের কাছেই তো নয় এমনকি ঈশ্বর-অবতারদের কাছেও ঘৃণিত-নিগৃহীত বেচারা সারমেয়, কেন ও কোন অপরাধে, আল্লা মালুম। পশ্চিমে কুকুর, পুবে মেকুর — কেন সবকিছুতে আমরা পশ্চিমের ফলোয়ার হওয়া সত্ত্বেও পুবের দেশে এই ভিন্নতা — ব্যাপারটা ভাবায়। ব্যাপারটা কী তবে এমন যে, এই তল্লাটের মানুষজন কুকুরের কাজটা নিজেরাই করে বলে কুকুরকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রিট করে — সেহেতু কুকুর দূর দূর করে তাড়ায়া রাখে, যেন নিজের চেয়েও প্রোফেশন্যালি স্কিল্ড কোনো কম্পিটিটর ফিল্ডে জাঁকায়া না বসতে পারে এবং মনিব যেন প্রভুভক্ত মোসাহেব অবলা চাকরদের কোনো অল্টার্নেটিভ না পায় চট করে! একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, খোঁড়া হলেও যুক্তি হিশেবেই ইহা কাউন্টেবল, পয়সাকড়ি ইনকাম করে একটা লেভেলের মালদার হবার পর লোকে কুকুরপ্রিয় হয়ে ওঠে। অন দ্য কন্ট্রারি, রিকশাপ্যুলার কিংবা আর্বান অথবা রুরাল স্লাম পিপলদের মধ্যে সেই হারে কুকুরপ্রেম নাই। রীতিমতো কলোনিয়্যাল ডিস্কোর্স হিশেবেও প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় এই ব্যাপারটা, অ্যাট-লিস্ট তত্ত্বীয় মণ্ডলে।


সাহিত্য-শিল্পকলা-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিচিত্র সব শাস্ত্রীয় পরিসরে, বিদ্যাজাগতিক ডোমেইনের বহু জায়গায়, বেড়ালের প্রেজেন্স লক্ষ করা যায়। কেবল উপস্থিতি দিয়ে নয়, রীতিমতো মশহুর হয়া আছে বেশকিছু বিড়াল দুনিয়ার সাহিত্যে-বিজ্ঞানে এমনকি ধর্মেও! খুব বেশি তো অবহিত না আমি বিপুলা এ-ভুবনের, অল্প কয়েকটা বিড়ালের হদিস জানি আধাখেঁচড়াভাবে। এদের মধ্যে একটি জীবনানন্দের, একটির মালিক এডগার এলান পো, পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবরেটোরিতে ফেমাস মেকুরমাস্টার হলেন আর্ভিন শ্রোয়েডিঙ্গার। বিড়ালগুলো দুনিয়ায় আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেছেন যথাক্রমে জীবনানন্দ কবিতায়, এলান পো গল্পে, এবং শ্রোয়েডিঙ্গার কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি থট এক্সপেরিমেন্ট হিশেবে। শ্রোয়েডিঙ্গারের ও এলান পো-র বিড়ালগুলি নিয়া আলাদা আলাদা কাভারস্টোরি নির্মাণ করার ক্রিয়েটিভ বাসনা বুকে চেপে জীবনানন্দের বিড়ালটা এখানে অ্যাটাচ করে রাখতেসি। তার আগে বলি, বিড়াল প্রসঙ্গ এলেই একটা খুব শক্তিশালী বাংলা গল্পের পাঠস্মৃতি মনে পড়ে আমার, সেই গল্পের নামটাই ‘বিড়াল’, শহীদুর রহমান সেই গল্পকারের নাম, সম্ভবত ইনি ষাটের দশকের স্বাক্ষর  পত্রিকাকেন্দ্রী সাহিত্যিকগোষ্ঠীর গল্পকার এবং অকালপ্রয়াত, একটিমাত্র গল্পগ্রন্থ রয়েছে তাঁর বিড়াল  নামে, বের করেছেন তাঁর বন্ধুরা মিলে মৃত্যুর অনেক পরে। এবং বাংলাসাহিত্যে বিড়াল নিয়া আলাপ হবে আর সেখানে শহীদুল জহির নামটা না-নিয়ে সেমিনার খতম দেবেন, ইম্পোসিবল! মনে পড়বেই পড়বে ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প  গ্রন্থের সেই ইন্দুর-বিলাই খেলা  গল্পটা। না-মনে-পড়ে নিস্তার নাই ওগো পড়ুয়া প্রিয়তমে! একেবারে রিসেন্ট কয়েকটি বিড়ালসেন্টার্ড গল্প লিখেছেন নাসরীন জাহান, এলান পো-র বিড়াল  শিরোনামে একটি সিরিজ, পত্রিকান্তরে ভিন্ন ভিন্ন সেই বিড়ালগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছে, সব পড়ি নাই হয়তো, পরে এই নামেই বই হয়েছে, এই গল্পগুচ্ছও উল্লেখযোগ্য এক্ষেত্রে। এসএম সুলতান খুবই বিড়ালপ্রেমী ছিলেন, কোলে রাখতেন সারাক্ষণ একগাদা ছানাপোনা সহ বিলাই, সাতদিনের সুলতান  নামে আবুবকর সিদ্দিকের একটা অনবদ্য উপন্যাসোপম গদ্য পড়সিলাম দুইদশকেরও অধিককাল আগের শৈলী  ঈদসংখ্যায়, হাসনাত আবদুল হাইয়ের জীবনীভিত্তিক আখ্যান সুলতান  তো অবশ্যই। শিল্পীর অন্ধকারস্ফূরিত ফেরেশতাহাস্য ও অপার্থিবা আলোর বিড়ালগুলো সপরিবার ডক্যুমেন্টেড রয়েছে নাসির আলী মামুনের পেইন্টিং-হার-মানানো স্থিরচিত্রমালায়। এছাড়া বিড়াল প্রসঙ্গে মনে পড়ে, আমাদের নবিজি বিড়াল পছন্দ করতেন। নামাজের মাসাল্লার, মানে জায়নামাজের, সামনে দিয়া বিড়াল গোল্লা পাকায়া বসে থাকলে কিংবা পারায়া গেলে তিনি কিছু মনে করতেন না বলে আমরা জানি। একবার নবিজি নামাজ করার কালে তাঁর প্রিয় বিড়ালটি জায়নামাজের অগ্রভাগে এসে ঘুমায়া পড়ে। দোয়াকালাম শেষ করে নবিজি একাংশ কেটে রেখে মেঝে থেকে জায়নামাজ গোটানোর উদ্যোগ নেন, সতর্ক, কোনোভাবেই যেন বিড়ালের ঘুম টুটে না-যায়। আমরা আমাদের পরলোকগত পিতামহকেও তদ্রুপ করতে দেখসি ইয়াদ হয়।


একসময়, এই সেদিনকার আমাদের ছেলেবেলাতেও, বাটি ভরে দুধ নিয়ে বেড়ালের সামনে রাখতে দেখসি আমরা হামেশা। আজকাল বেড়ালের ভাগ্যে দুগ্ধপাত্র জোটে বলে মনে হয় না। তা, বাজারের প্রিজার্ভেটিভ-দেয়া দুধ বিড়াল মুখে তুলবে কি না আমার ঘোরতর সন্দেহ। গোয়াল তো গাওগঞ্জেও দুর্লভ। অবশ্য মনুষ্য সন্তানাদিরই আজকাল মাতৃদুগ্ধ জোটে না, আর বিড়ালশাবক! মনুষ্য সন্তানাদি দুগ্ধ পাবে না কেন! শেইপ নষ্ট হয়া যাবার ভয়ে। কার শেইপ! কিসের শেইপ! সেন্সর্ড। হোয়াটেভার, জীবনানন্দের কবিতাটা রাখা হচ্ছে নিচে। এখানে বেড়াল হয়েছে বেরাল, সঙ্গত প্রয়োজনেই, মুদ্রণপ্রমাদ বা বানানভুল নয়। এই কবিতাটা আমাদের অনেকেরই প্রিয়, তবু নামটা আরেকবার বলি, সুবিনয় মুস্তফী। জীবনরচনার যে-কোনো সংকলনে শ্রেষ্ঠ কবিতা  অংশে এইটা পাওয়া যাবে।

সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।
একসাথে বেরাল ও বেরালের-মুখে-ধরা ইঁদুর হাসাতে
এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার।
ইঁদুরকে খেতে খেতে শাদা বেরালের ব্যবহার,
অথবা টুকরো হ’তে হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর :
বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে তারা দুইজনে কতখানি দূর
ভুলে গিয়ে আধো আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে
আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে
কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেত মাটির দরের মতো রেটে;
তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেত ব’লে বেরালের পেটে
ইঁদুর ‘হুররে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে কেটে।


কিন্তু উপরের বেরাল  জীবনানন্দের আসল বেড়াল নয়, এটা আলবৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেড়াল বিশ্বসাহিত্যের খামারবাড়িতে, কিন্তু খোদ বেড়াল  নামে জীবনানন্দের কবিতাটিতে যে-বেড়ালের সঙ্গে ঘুরেফিরে দেখা হয় আমাদের, সেইটিই দাশবাবুর — আমার মতে — আসল বেড়াল। আস্লি বিল্লি। এই বিড়ালের সঙ্গে আমাদেরও দেখা হতো শৈশবে, মনে পড়ে — গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে — আমরা হাঁটতে-ফিরতে দেখতাম সে আমাদের সামনে-সামনে পিছে-পিছে পায়ের পাতার কাছে লুটোপুটি যাইত গড়াগড়ি দিত — গগনশিরিষ আর মেহগনি গাছের বাকলে নখ আঁচড়াত…। কিন্তু বড়বেলায় এই বিড়ালটাকে দেখতে পেতাম না আর, যদি-না জীবনানন্দ জন্মাতেন। কবিতাটার শেষ দুই লাইনে যে পোয়েটিক ফ্লাইট, এর তুলনীয় নজির ধাপ্পাবাজ পাঠক অহরহ দেখাতে পারবে হয়তো, অনুভূতিপ্রিয় পাঠক থম হয়ে গুম হয়ে বসে থাকবে শুধু। থলে থেকে বেড়ালটা বার করতে পারতেসিলাম না, বাসরঘরের বাইরে বেরিয়ে সেই মরমিয়া আদি-ও-অকৃত্রিম বন্ধু আমার যদি-না হইতেন দরাজদিলা বরাবরের ন্যায়, বাইর করতেসি এবে বেড়াল  থলের :

সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরেফিরে কেবলি আমার দেখা হয় :
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।

কিন্তু তবুও তারপর — ভাবা যায় — কী বিস্ময়! কিসের বিস্ময় — ব্যাটা বলদ — এ-ই তো সহি জীবনানন্দ! তবুও তারপরও কিন্তুও কথায় কথায় বিস্মিত হওয়া যার স্বভাব, মজ্জাগত, তারে হাজার রজনী বলদ বলিয়া রিবিউক করার পরও পুনর্বার বিস্ময়ে সে বিপন্ন হইবেই। বিষয়টা বাবু বঙ্কিমের নবকুমারের মতোই। বিস্মিত হওয়া ইজ্ অ্যা কাইন্ড অফ ডিজ্যাবিলিটি, সো, খোঁড়ারে লইয়া হাস্যপরিহাস করিলে আল্লা নারাজ ও বেজার হবেন। তবে, হায়, এই হায়  জীবনানন্দের নয়, একান্তই নিবন্ধকারের এই হায়, এই বিপন্ন বিস্ময়, এই অন্তর্গত রক্তের ভেতরের নিরন্তর খেলানেলা, বাবু জীবন পড়তে যাবার আগে নিজেকে বিস্মিত না-হবার শাসন করে তারপর পড়তে যেতে হয়। নইলে এতবার এতভাবে এত ঘনঘন এত এত এত বিস্মিত হইতে হয় যে, পাঠফাট তো ওঠেই লাটে, এমনকি চক্ষু-বিস্ফারিয়া জাহানের মায়া ত্যাজিবারও শঙ্কা তৈয়ার হয়। জীবন পড়তে যেয়ে সাবধান, ব্রো! অনাগত ও সমাসন্ন কালের হে কিসিম-কিসিম ইজমের খপ্পরে খাবি-খাওয়া নাকানিচুবানি কবিতার-ভূতে-পাওয়া মানবসন্তান! পরমহংস রামকৃষ্ণের সেই বিস্মিত-না-হবার মশহুর অ্যাডভাইসখানা রাখিও মনে হে!


এখন মনে হচ্ছে, এই নিবন্ধনোটের নাম রাখা বাঞ্ছনীয় ছিল ডেথ অফ অ্যা ক্যাট  বা এই-রকমই কিছু, যাতে সেই নৃশংসভাবে-নিহত নিরীহ বিড়ালটার প্রতি কিছুটা অ্যাপোলোজি প্রকাশ করা যেত হয়তো। কিন্তু ঘুরে যেয়ে ফের কেটেছেঁটে শিরোনাম সংশোধনের ইচ্ছে করতেসে না আর। মৃত সেই বিড়ালটিকে চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে হয়তো, অপরাধের বিচার হয়, পাপের তো কোনো বিচার নাই। পাপ ব্যক্তিগত, অপরাধ সামষ্টিক তথা সামাজিক। পাপের ফল অনুশোচনা, পাপের শাস্তি অনুশোচনা, পাপের থেকে নিষ্কৃতির পথও তা-ই। অনুশোচনাতেই বিমোক্ষণ, ক্যাথার্সিস। মনে পড়তেসে সেই শ্লোক, মহাভারতের সেই পাপ ও পরিণাম, সেই মিথুনরত ক্রৌঞ্চযুগল শরাঘাতে বধ ও তৎসৃষ্ট মর্মার্ত বোধিচিৎকার, সেই আমাদের আদি বেদ, বিদ্যা, আমাদের এপিস্টেমোলোজি, জ্ঞান, বোধি, বেদনা … মা নিষাদ …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you