একাত্তরের বাইছাল || শামস শামীম

একাত্তরের বাইছাল || শামস শামীম

বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রভাববিস্তারকারী ঘটনা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রকৃতপ্রস্তাবে এটি একটি গণযুদ্ধ। স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণ জয়ন্তী কড়া নাড়ছে দুয়ারে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগোচ্ছে দেশ। জাতিরাষ্ট্রের জন্মদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সপরিবার হত্যা করেছে। বিভিন্ন সময়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের আঘাত করা হয়েছে। বারবার শাসনতন্ত্র কেটেকুটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্তের চেষ্টা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি পঁচাত্তরের পর চেষ্টা করেছে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটিকে বিতর্কিত করতে ত্যানা প্যাঁচানোর চেষ্টা এখনো করছে তারা। দীর্ঘদিন সুকৌশলে, ছদ্মবেশে, বর্ণচোরা রূপে, জলপাইজঙলি হয়ে এই কাজ করে তারা নানা ধারণা, বিশ্বাস ও মিথ প্রতিষ্ঠাও করে নিয়েছে। মুছে দিয়েছে যুদ্ধের প্রামাণ্য নানা দলিল ও খতিয়ান। ভুল ইতিহাসের মাধ্যমে বিতর্ক আরো বাড়িয়েছে।

তবে এতকিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের জীবনে প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি জনযুদ্ধ সেই সামাজিক ধারণা ভাঙতে পারেনি তারা; মুছতে পারেনি সম্পূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন। ইতিহাসের ফিনিক্স পাখি হয়ে সেই সত্য মাঝে-মধ্যে ধ্রুব হয়ে উঠছে। তা দেখে শার্টপ্যান্টপরা যোদ্ধারা ভিমরি খাচ্ছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শ্রেণিবৈষম্য থেকে উদ্ভুত সচেতন ষড়যন্ত্র করে সামাজিক ইতিহাস চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। জনযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছেই।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সচেতনভাবেই ইতিহাস নির্মাণকারীরা জনযুদ্ধের ইতিহাস আড়ালের চেষ্টা করেছেন। নিজেদের শ্রেণির প্রাপ্তির খতিয়ান বৃদ্ধি করছেন তারা। সাধারণ মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সফলতা এনে দিয়েছেন সেটা ভাবতেও তাদের কষ্ট হয়। তাছাড়া রাষ্ট্র ও জাতি নির্মাণে আমরা আজো শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে প্রধানতম অবস্থানে বসাতে পারিনি। রাজনীতিতে শ্রেণি-সচেতনতা এবং দূরে-রাখার কৌশলেই যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিনির্মাণ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যে বেশিরভাগই ছিলেন তৃণমূলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেটাও ভুলতে বসেছেন নির্মাণকারীরা। মুক্তিযুদ্ধের পরে ইতিহাসের অন্ত্যজ শ্রেণির সচেতনতার অভাব, প্রশাসন সহ সামাজিক অবস্থানের বাইরে থাকা ও ইতিহাস থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে।

আমাদের হাওরভাটি ভিন্ন ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের অনন্য অঞ্চল। ভাব ও বিপ্লব হাত ধরাধরি করে এই অঞ্চলের ইতিহাস নির্মাণ করেছে। কেউ উড়িয়েছেন বিপ্লবের সোয়াপাখি, কেউ-বা মরমি ভাবের সৃষ্টিতে পূর্ণ করেছেন ভাঁড়ার। ১৯৭১ সনে সচেতন মানুষ সহ নিম্নশ্রেণির অসচেতন মানুষও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সচেতন মানুষ সহ দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষও এই ডাকে বিপুল সাড়া দেন। প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য তৈরি হন সবাই। তবে চেনা শত্রুরাও ষড়যন্ত্রের ডালপালার বিস্তার করেছিল তখন। তারা সমানে এখনো সক্রিয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে এই ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অঞ্চলে বর্ষার বিপুল বিস্তারী রূপ ছিল। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এই রূপ ছিল পুরোটাই বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধতাকে জয় করা তখন সংগ্রামের ভেতর আরেক সংগ্রাম হয়ে দেখা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। প্রস্তুতিযুদ্ধের পর যুদ্ধের ময়দানে এসে নতুন প্রজন্মের যোদ্ধারা ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। বর্ষার উত্তাল অপরিচিত হাওরে হালধরা এলএমজি ধরার মতোই কঠিন ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ চারটি সাবসেক্টরে বিভক্ত ছিল। সবগুলো সেক্টরেই কমবেশি হাওর ছিল। এর মধ্যে সেলা, বালাট ও টেকেরঘাট সাবসেক্টরে ছিল হাওরের বিস্তার। সেলার যুদ্ধসীমানা ছিল দোয়ারাবাজার, ছাতক এবং জগন্নাথপুর থানার বৃহৎ এলাকা নিয়ে। দেখার হাওর, নলুয়ার হাওর, মৈয়ার হাওর ও কানলার হাওরের মতো হাওর এই সাবসেক্টরের যোদ্ধাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। তখন মুক্তির বাইছালরা শত্রুর নিশানার মধ্যেও সাবধানে নৌকা চালিয়ে এসব হাওর পাড়ি দিয়ে সফল অভিযান পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

বালাট সাবসেক্টর সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ ও জগন্নাথপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই সাবসেক্টরের যোদ্ধাদেরও উত্তাল করচার হাওর, হালির হাওর, পাগনার হাওর, কানলার হাওর অতিক্রম করতে হয়েছে। নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না, শামসুল হক সহ মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার সাত্তারের ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে সাহসী ও দক্ষ বাইছাল নিয়েছিলেন। আহসানমারা সেতু ধ্বংস, বাবনিয়া যুদ্ধেও মাঝিরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত পাকিস্তানিদের সড়কপথের যাতায়াত ভণ্ডুল করতেই বিভিন্ন সেতু ধ্বংস ও সড়কপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বাইছালরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা নৌপধে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে পর্যুদস্ত করেছিলেন পাকিস্তানিদের। বাইছালরাও ছিলেন একেকজন সাহসী গেরিলা। বিশেষ করে দাসপার্টির সঙ্গে দক্ষ মাঝিরা থাকায় প্রতিটি অপারেশনেই সফলতা মিলেছে। সড়কপথের পর নৌপথেও টেকেরঘাট সাবসেক্টরের যোদ্ধারা বিশেষ করে দাসপার্টি পাকিস্তানিদের আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। তাই সেপ্টেম্বরের দিকে বাধ্য হয়ে নৌপথকে ঝুঁকিময় এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল হানাদার বাহিনী। এই গৌরবের সঙ্গে বাইছালদের পরিশ্রমও সমান মর্যাদার।

টেকেরঘাট সাবসেক্টরের আয়তন ছিল অন্য সাবসেক্টরের তুলনায় বিশাল। যুদ্ধ-এলাকা ছিল তাহিরপুর, জামালগঞ্জ (কিছু অংশ), জগন্নাথপুরের পশ্চিমাংশ, দিরাই, শাল্লা, ধর্মপাশার আংশিক, মধ্যনগর এবং নবীগঞ্জের আংশিক, বানিয়াচঙের আংশিক। তাছাড়া কিশোরগঞ্জের নিকলি এলাকার কিছুটাও ছিল এর সীমানায়। এই সাবসেক্টরের পুরোটাই ছিল হাওরঘেরা দুর্গম এলাকা। দেখার হাওর, ছায়ার হাওর, পাগনার হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, উদগল হাওর, ভাঙ্গাবিল হাওর পাড়ি দিতে হয়েছে যোদ্ধাদের। এই সাবসেক্টরের যোদ্ধা বিশেষ করে শহিদ জগৎজ্যোতি দাস বিভিন্ন থানা আক্রমণ, সেতু ধ্বংস সহ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে বাছাই করে বাইছাল সঙ্গে নিতেন। হাওরপাড়ের ছেলে জ্যোতি খোঁজ নিয়ে চোরেরগাঁওয়ের যুবকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোরেরগাঁওয়ের সাহসী বাইছালরা ছিলেন তার অভিযানের অন্যতম শক্তির উৎস।

যুদ্ধ শুরুতেই পাকিস্তানিদের স্থলপথে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটান মুক্তিযোদ্ধারা। তাই বাধ্য হয়ে পাকিস্তানিরা রসদ সরবরাহের জন্য নৌপথ বেছে নেয়। এই নৌপথকে একের পর এক আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন করে তুলেছিলেন। ভৈরব, আজমিরি, শেরপুর নদীপথ মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দিরাই, শাল্লা, আজমিরিগঞ্জ ও বানিয়াচং থানা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে শক্তি ও সমরাস্ত্র বৃদ্ধি করেছিলেন।

বিশাল জলসীমানার বিপদসঙ্কুল উত্তাল হাওরে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে এই বাহিনী অপ্রতিরোধ্য ছিল। এই বাহিনীকে অভিযানে সহযোগিতা করেছে চোরেরগাঁও বলে খ্যাত দিরাই-শাল্লা উপজেলার ৬টি চোরাপল্লির যুবকেরা। উজানগাঁও, বল্লভপুর, ছিকাডুবি, নারকিলা, কামারগাঁও ও জাহানপুর থেকে ৮-১০ জন করে মাঝি প্রতিরোধযুদ্ধ ও টেকেরঘাট সাবসেক্টর গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিজয় পর্যন্ত কাজ করেছেন। একাত্তরের এই বীর মাঝিরা বদনামের জীবন ছেড়ে দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তখন। ওই সময় তারা বিপরীতে অবস্থান করলে একদিকে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারতেন, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদেরও সহজে পর্যুদস্ত করে স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিলম্বিত ও কঠিন করে তুলতে পারতেন বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার ও দালালরাও দক্ষ বাইছাল হিসেবে তাদেরকে নারী ও সম্পদের প্রলোভন দেখিয়েছিল। যুবকরা ঘৃণাভরে এসব প্রলোভন প্রত্যাখান করে। এজন্য খেসারত দিতে হয়েছে তাদেরকে।

মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও স্বাধীন দেশে তারা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উপস্থিতি নেই। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করায় উজানগাঁও, বল্লভপুর, ছিকাডুবি, নারকিলা ও কামারগাঁওয়ে গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

শুধু বাইছালই ছিলেন না তারা, সম্মুখযুদ্ধে প্রতিরোধে অংশ নিয়ে শহিদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অনেকে। এখনো যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। ইতিহাস থেকে ব্ল্যাকআউট হয়ে আর্থিকভাবেও কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তারা।  স্বাধীন দেশে সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনী এখন খুবই শক্তিশালী। কিন্তু এই বেষ্টনীর সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে তাদের।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অল্পবিস্তর কাজ করার সুবাদে একাত্তরের বাইছাল ও চোরেরগাঁওয়ের বিষয়টি আলাদাভাবে আমার কাছে গুরুত্ব পায়। যদিও শ্রেণিসচেতনতার কারণে এ-বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ও যুক্তি ছিল। সামাজিক ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা থেকে বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেই। খুঁজে বের করি একাত্তরের বাইছাল, আহত ও শহিদদের। তাদের স্বজনদের উপর বর্বরোচিত নির্যাতনের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসি, যা ‘১৯৭১ : চোরেরগাঁওয়ের অশ্রুত আখ্যান’ বইটিতে কিছুটা স্থান পেয়েছে। বর্তমনে এই বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ হওয়ার পথে। কাজ চলছে তৃতীয় মুদ্রণের।

মাঠে কাজ করতে গিয়ে জানতে পেরেছি টেকেরঘাট সাবসেক্টরের সংগঠক ও যোদ্ধারা সাবসেক্টর হওয়ার আগ থেকেই ওই গ্রামগুলোর মাঝিদের বিশেষ পেশার কারণে দৃষ্টি দেন। টেকেরঘাট সাবসেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আঞ্চলিক কমান্ডারর সালেহ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা চোরেরগাঁওয়ের মাঝিদের নৌকাচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নৌকা চালানোর ডাকে সাড়া দেন তরুণরা। অভুক্ত ও নিঃসহায় পরিবার রেখে হাল ধরেন মুক্তির নাওয়ের। দাসপার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস, মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু, আতাউর রহমান সহ যোদ্ধারা এই যুবকদের নৌকা চালানোয় মুনশিয়ানা দেখে প্রতিটি অভিযানেই নিতেন। তাদের ভরসা ও আস্থা অর্জন করেন মুক্তিনৌকাচালক বাইছালরা।

জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধে বল্লভপুর, নারকিলার মুক্তিমাঝিরা ছিলেন। অস্ত্র, গুলি এগিয়ে দিয়েছেন। অস্ত্রের ম্যাগাজিন বহন করেছেন। এলএমজি বসানোয় সহযোগিতা করেছেন।

দৌলতপুর এলাকার পিডিপির পরাজিত প্রার্থী ও দালাল আব্দুল খালেক কয়েকটি চোরাপল্লীর যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল প্রস্তুতিপর্বের শুরুতে। দেখিয়েছিল সম্পদ ও নারীর লোভ। যুবকরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিল।  তবে এজন্য দালাল খালেক বাহিনীর বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে মুক্তিমাঝিদের গ্রাম ও পরিবারগুলোকে। একযোগে চারটি গ্রামে আক্রমণ চালিয়েছিল দালাল খালেকের তিনশতাধিক প্রশিক্ষিত রাজাকারের বাহিনী। দিনটি ছিল ১৯৭১ সনের ৪ ডিসেম্বর।

একাত্তরের বাইছালরা
শাল্লা উপজেলায় হাওরঘেরা গ্রাম ছিকাডুবি। পার্শ্ববর্তী বল্লভপুরের দক্ষিণের গ্রাম এটি। এই গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয় বল্লভপুরে। বল্লভপুর নামে গ্রাম হলেও দেখতে মনে হয় একটি পাড়া। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘর। খুপড়িঘরই সবগুলো। বাড়ির উঠোন নেই। পাশাপাশি বাড়ি নেই। একটি থেকে আরেকটি দূরে। পূর্ব-পশ্চিমে হাওর। বর্ষার উত্তাল হাওরের বাউরি বাতাস ভিটা ভেঙে নিতে নিতে গ্রামটি ছোট হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক এই সংগ্রাম গ্রামছাড়া করেছে বহু পরিবারকে।

১৯৭১ সনে এই গ্রামে ৩০-৩৫ পরিবারের বাস ছিল। পরে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন জীবিকার প্রয়োজনে। এখনো কয়েকটি পরিবার পড়ে আছে মাটি কামড়ে। পুরনো এই গ্রামটিতে এখনো খাসভূমিতে বাস করেন তারা। বাস্তুভিটাহীন এই মানুষগুলো খাসভূমি বন্দোবস্ত থেকেও বঞ্চিত।

এই গ্রামেরই অন্তত ১৫ জন যুবক মুক্তিযুদ্ধে সাহসী বাইছাল ছিলেন। তারা নিজেদের এখনো মুক্তির বাইছাল হিসেবে পরিচয় দেন। এই বাইছালরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মুক্তিবাহিনীর নৌকার হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। অনেকেই মারা গেছেন। কয়েকজন এখনো জীবিত আছেন। সালেহ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আব্দুল মজিদ চৌধুরী মানিক মিয়া, আব্দুন নূর মাস্টার, জগৎজ্যোতি দাস, আতাউর রহমান, সুকুমার দাস, সুনীল সমাজপতি সহ মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকরা বাইছালদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সচেতনভাবেই। এতে সফলতাও পান। হাওরের দুর্গম ও সর্পিল পথ নখদর্পণে থাকায় শুধু নৌকার হাল ধরাই নয় মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড হয়েও অভিযানে সফলতা এনে দিয়েছিলেন।

এই গ্রামের মুক্তির বাইছাল হিসেবে কাজ করেছেন কালা মিয়া। একই নামে গ্রামের আরেক মাঝিও ছিলেন। দু-জনেই আর পৃথিবীতে নেই। মারা গেছেন ইজ্জত আলী বাইছাল, বাইছাল মরম আলী ও সিকান্দর আলী। ইয়ানউদ্দিন ও বৌলাই মিয়া এখনো জীবিত আছেন। ঘরবাড়ি কিছু নেই তাদের। গ্রামের মুক্তিমাঝিরা কুলঞ্জ যুদ্ধে দাসপার্টির যোদ্ধা আতাউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। এই যুদ্ধে গ্রামের শরাফত আলীর ছেলে ইব্রাহিম শহিদ হন। কুলঞ্জ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যে তিনটি নৌকা ছিল, তিনটিতেই গ্রামের বাইছালরা ছিলেন। নৌকা ঠিক রেখে সম্মুখসমরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের যুবকদের প্রথমে নৌকা চালানোর জন্য নিয়োগ দিলেও কেউ কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধও করেছেন। তাদেরই একজন এই গ্রামের ছিরুক মিয়া। তিনি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি জীবিত আছেন। টেকেরঘাটে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমান মিয়া স্বীকৃতি পাননি। প্রথমে বাইছাল হিসেবে নিযুক্ত হলেও পরে যোদ্ধা হিসেবে সুনাম বয়ে এনেছিলেন আমান। স্বীকৃতি না পেয়েই মারা গেছেন তিনি অনাহারে।

৪ ডিসেম্বর ভোরে গ্রামে আক্রমণ চালায় দালাল খালেক বাহিনী। পাশের পেরুয়া ও উজানগাঁওয়ের আক্রমণের খবর পেয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে যান পার্শ্ববর্তী আটগাঁও গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নজরুল চৌধুরীর বাড়িতে। ওইদিন গ্রামে ঢুকে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় রাজাকার বাহিনী। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে আগুনে গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। গ্রামের দুই বৃদ্ধ তরিক উল্লাহ ও তেরাই উল্লাহ বসতঘরে আগুনে পুড়ে মারা যান। তরিক ও তেরাইয়ের সন্তানরা ছিলেন মুক্তির বাইছাল।

ছিকাডুবির পাশের গ্রাম বল্লভপুর। গ্রামের পূর্বে কান্দাশ্রেণির জমি। উত্তরে শর্মাগ্রাম ও কান্দা। দক্ষিণে কালিগুটা হাওর, তার দক্ষিণে ছিকাডুবি গ্রাম। ১৯৭১ সনে এই গ্রামে ৫০টি পরিবার বাস করত। বর্তমানে মাত্র ৫-৬টি পরিবার বাস করে। এই গ্রামেরও অন্তত ১০ জন মুক্তিযুদ্ধে নৌকা চালিয়েছিলেন। গ্রামের বাইছাল হিসেবে টানা দায়িত্ব পালন করেছেন বাবুল মিয়া, বছা মিয়া, কালা মিয়া, সনজব আলী, সৈয়দ আলী, আব্দুল করিম, কটু মিয়া, মন্তাজ আলী, সৈকত আলী, আকবর আলী, জবর আলী, গেতা মিয়া, গেদু মোড়ল, মতিন মিয়া প্রমুখ। নূর ইসলাম নামের এক বাইছাল মারা গেছেন। বাবুল মিয়া দিরাই-শাল্লার শেষ যুদ্ধ, পেরুয়া যুদ্ধ, জগৎজ্যোতির সঙ্গে মারকুলির যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বীরাঙ্গনা মুক্তাবানকে বিয়ে করেছেন। পেরুয়া যুদ্ধে খালেক বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন বাবুল মিয়া। বাম উরুতে এখনো যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে তার।

এই গ্রামের কয়েকজন বাইছাল নৌকা চালানোর পর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হয়েছিলেন। রজব আলী ও আলী আকবর মিয়া ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। তাহিরপুরে পাকিস্তানী হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা গুলি করে ডুবিয়ে দিলে এই মাঝিরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হোসেন বখত, শফিকুর রহমান ওসি সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর সরাসরি যোদ্ধা হয়েও স্বীকৃতি পাননি। মারা গেছেন। তার স্বজনেরা আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

দিরাই উপজেলার জাহানপুর গ্রামের অন্তত ২৪ জন যুবককে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সালেহ চৌধুরী এবং নজরুল ইসলামের পরামর্শে বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা পিলু চৌধুরী, যুবরাজ তালুকদার, সুধীর চন্দ্র দাস সহ মুক্তিযোদ্ধারা চালক নিযুক্ত করেন। জাহানপুর গ্রামে অবস্থান করে সুধীর দাস দালাল খালেকের তথ্য সংগ্রহ করতেন এই মাঝিদের মাধ্যমে। ভিক্ষুকের ছলে মাঝিরা তথ্য সংগ্রহ করে এনে দিতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক দলের নৌকায় দাঁড়টানা, বৈঠা বাওয়া সহ পথ-দেখানো, অস্ত্রবহন, রান্নাবান্না ও গোলাবারুদ এগিয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন তারা।

জাহানপুর গ্রামের আকরম আলী, ছাও মিয়া, শমাই মিয়া, আম্বর আলী, হোসেন আলী, নিজাম উদ্দিন, মিয়াফর উল্লাহ, বাছা উল্লাহ, বাচ্চু মিয়া, নবী হোসেন, আশু মিয়া, এখলাছ মিয়া, ছাবু মিয়া, সোনাফর মিয়া, মদরিছ আলী, মনসুর আলী, সন্দু মিয়া, হরিশংকর দাস, গৌরাঙ্গ দাস, শিরিষ দাস, কটুসোনা ও ইন্দ্রমোহন দাস সহ আরো কয়েকজন নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের বাইছাল ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতে গিয়ে রাজাকার ও পাঞ্জাবির আক্রমণের মুখে পড়েছেন তারা। অনেকের সম্মুখযুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে, প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন নিজেরাও। বাইছাল হরিশংকর জলদাসের ডান উরুতে এখনো গুলির চিহ্ন আছে। বেতাউকা গ্রামে রাজাকার বাহিনী তাদের ক্যাম্প দখল করে ফাঁদ পেতে হঠাৎ আক্রমণ করেছিল। সেখানে আরেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনিও আহত হন। শ্যামারচর যুদ্ধ, পেরুয়া যুদ্ধ ও সাত্তার দালালকে ধরার অভিযানেও তারা ছিলেন। এই গ্রামের নিজাম উদ্দিন বাইছালের সামনেই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়বেন না বলে নিজের গুলিতে শ্যামারচর যুদ্ধে মারা যান জগদলের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ। নিজাম উদ্দিন, জগৎজ্যোতি দাসের সঙ্গেও নৌকা চালিয়েছেন। এই সহযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে আবেদন করেছিলেন। প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। যাচাইবাছাইয়ে নিয়োজিত শ্রেণিসচেতন মুক্তিযোদ্ধারা তাতে সায় দেননি! অথচ তারা বাইছাল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

শাল্লা উপজেলার নারকিলা গ্রাম। ১৯৭১ সনে গ্রামে ১৫ পরিবার ছিল। এখন অর্ধশত পরিবার আছে গ্রামে। সবাই খাসজমিতে থাকেন। স্থায়ী স্থাপনা নেই কারো। মুক্তিযুদ্ধে এই গ্রামে দাসপার্টির আতাউর রহমান, শফিকুল হক বাচ্চু ও আব্দুল কাইয়ুমের বাহিনী প্রায়ই অবস্থান করতেন। মারকুলি, আজমিরিগঞ্জ অপারেশনের আগে এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলেন। বানিয়াচং থানা আক্রমণের সময় এই গ্রামের বাইছালরা ছিলেন দাসপার্টির সঙ্গে। থানার অস্ত্র কাঁধে বহন করে নৌকায় নিয়ে এসেছিলেন। শালদিগা বেতাউকা যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন বাইছাল আব্দুল খালেক। এখনো কাঁধে তার গুলি রয়ে গেছে। স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। গ্রামের সাহসী মুক্তিমাঝি কুটি মিয়া বেতাউকা যুদ্ধে শহিদ হন। সরকারি গেজেটে শাল্লার একমাত্র শহিদ যোদ্ধা হিসেবে তার নাম লেখা থাকলেও তার একমাত্র মেয়ে সুলতানা সবধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শহিদ কুটি মিয়ার মা মুক্তিযোদ্ধারা যখন গ্রামে অবস্থান করতেন তখন রান্না করে খাওয়াতেন। গ্রামের বাইছাল সুর মিয়া ও শফিক মিয়া সাধুও বেতাউকা যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। সুর মিয়া মারা গেছেন। শফিক মিয়া সাধু এখন ভিক্ষা করে জীবন চালান।

গ্রামের অন্যান্য বাইছালরা হলেন : মরতুজা আলী, আব্দুল মান্নান, মহরম আলী, তমিজ আলী, তৈয়ব আলী, আজর আলী ও শেরালি মিয়া; জব্বার মিয়া মারা গেছেন বহু আগে। তৈয়ব আলীর বাবা শুকুর আলীকে গুলি করেছিল পাকিস্তানিরা। অপরাধ তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি। গ্রামের জীবিত বাইছালদের মধ্যে আব্দুর রহিম, আছাব আলী, নাসিম মিয়া, শফিক মিয়া, আব্দুল খালেক এখনো জীবিত আছেন। তারা দাসপার্টির যোদ্ধাদের সঙ্গে থানা আক্রমণ ও বিভিন্ন অপারেশনের স্মৃতিরোমন্থন করেন। এই গ্রামে হানাদাররা এসে লাইনে জড়ো করে বাইছালদের স্বজনদের হত্যার চেষ্টা করলেও একজন দালাল তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গিয়েছিল।

শাল্লা উপজেলার একটি গ্রাম উজানগাঁও। ১৯৭১ সনের ৪ ডিসেম্বর এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী মাঝি মাখন মিয়ার বিয়ে ছিল। বিয়ে উপলক্ষ্যে নারীপুরুষ জড়ো হয়েছিলেন বাড়িতে। পার্শ্ববর্তী দৌলতপুর গ্রামের দালাল খালেক প্রশিক্ষিত রাজাকারবাহিনী নিয়ে ওইদিন ভোরে আক্রমণ চালিয়ে মাখন মিয়া, তার বাবা আফতর আলী, আতিব উল্লাহ, আজিদ ফকির, বোছন মিয়া, ইয়াছিন উল্লাহ ও মামদ আলী সহ ১১ জনকে হত্যা করেছিল। মাখন মিয়ার সবগুলো দাঁত ফেলে দিয়েছিল রাইফেলের বাটে। পানি খাইতে চাওয়ার পর মুত্রপান করিয়েছিল। বুটপায়ে নিথর দেহ পা দিয়ে দলে দিয়েছিল। তার তিন বোন সহ কয়েকজন তরুণিকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করে কয়েকদিন। মাখন মিয়ার বোন পিয়ারা, মনোয়ারা বিবি চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তার নিকটাত্মীয় বোন মুক্তাবান, আত্মীয় বোলচান বিবি, জমিলা খাতুন, জাহেরা বেগম, কদবানু বিবির উপরও ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল। মুক্তাবান ১৯৭১২ সনে যুদ্ধশিশুর জন্ম দেন। সেই নারীর স্থায়ী ঘর হয়নি। সেই যুদ্ধশিশুকে সঙ্গে করেই সরকারি খাসভূমিতে থাকেন। তবে সম্প্রতি তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন।

উজানগাঁও গ্রামের মাখন মিয়ার পাশাপাশি কটু মিয়ার ছেলে মন্নাফ মিয়া (জীবিত), সোনাফর আলীর ছেলে লালফর আলী (জীবিত), শহিদ আজিদ ফকির ও তার  ছেলে আকল আলী (জীবিত), শহিদ আফতর আলী, নোয়াব আলী (মৃত), শহিদ আতিব আলী, শহিদ মামদ আলী, শহিদ বোছন আলী, কাছন আলী (জীবিত), সুর মিয়া ওরফে জগা (মৃত), লাল মিয়া, নবী হোসেন, আব্দুস সাত্তার, দুলাল মিয়া, বাছন মিয়া, ছুরত আলী ও মঙ্গল মিয়া বাইছাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শহিদ বাইছাল মাখনের বোন পিয়ারা, মুক্তাবান ও জমিলা সম্প্রতি বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

শাল্লার সংগঠক হাফিজ উদ্দিন, মন্নান চৌধুরী এবং মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার দাস সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা কামারগাঁও গ্রামে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করতেন। তখন গ্রামের নারীরা তাদের রেঁধে খাওয়াতেন। গ্রাম থেকে বাছাই করে ১০-১৫ জন যুবককে মুক্তির বাইছাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হলেন কালু মিয়া, মজর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, আজমান আলী, জয়নাল আবেদিন মিয়া, মুসলিম উদ্দিন, জুনাব আলী, শহিদ মিয়া, কেরামত আলী, জালাল মিয়া, নূর মিয়া, গুল হোসেন মিয়া, এলমদর মিয়া, ছমেদ, মতিলাল, রতন মিয়া ও আব্দুর রহমান সহ কয়েকজন। নগ্রামের লেছু মিয়া সরদার, লেবু মিয়া, তাজু মিয়া, আলমাছ মিয়া সহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাদের বহন ও যাতায়ারে জন্য ৫টি নৌকা দান করেন। এই নৌকাগুলো যুদ্ধে যোগদানের আগে চৌর্যবৃত্তিতে ব্যবহার করতেন তারা। এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল দান করেননি তাদের সন্তানদেরও বাইছাল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দিয়েছিলেন। জুনাব আলী, শহিদ মিয়া, গিয়াস উদ্দিন ও জয়নাল আবেদিন মিয়া মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন। প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। সেই-সময়ের কোনো মুক্তিযোদ্ধাই তাদের স্বীকৃতি দিবার ব্যাপারে সাক্ষী দেননি!

মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা দান ও সন্তানদের বাইছাল হিসেবে পাঠানোয় ৪ ডিসেম্বর ভোরে দালাল শরাফত ও আলী রেজার নেতৃত্বে গ্রামে গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ঘটানো হয়। গ্রামের বাইছাল মজর আলীর ছেলে হোসেন, ইন্তাজ আলী, মিয়াফর আলী, মধু মিয়া ও মোজাফফরের মা শহিদ হন। রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে বাছাই করে নূরজান বিবি, বৈশাখনি, ফরজান বিবি, সজিবার মা, মন বিবি, কুলসুম বিবি, আফজল বিবি, কন্ডলনি, নায়েবের স্ত্রী, লোবি বিবি, মিনা বিবি সহ কয়েকজন নারীকে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে ক্যাম্পে রেখে কয়েকদিন যৌননির্যাতন করা হয়েছিল। এখনো কয়েকজন নারী বেঁচে আছেন। তারা কেউ স্বীকৃতি পাননি। স্বাধীন দেশে কোনো সহযোগিতা পাননি।

গ্রামের সাহসী বাইছাল জুনাব আলী জগৎজ্যোতি দাসের সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে ছিলেন। ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থানা আক্রমণে এ-গ্রামের মাঝিরা ছিলেন। তার সঙ্গে কুড়িবলনপুরে ও বলরামপুরে কামদেব বাবুর বাড়িতে খেয়েছেন, বিশ্রাম নিয়েছেন। জলসুখা, কানকলা যাত্রাপুর, রৌয়ারূপ এলাকা ও মারকুলি যুদ্ধে জগৎজ্যোতি বাহিনীর সঙ্গে বিশ্বস্থ মাঝি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেলিনে জুনাব আলী।

শেষ কথা
একাত্তরের বাইছালরা শুধু দাঁড়বৈঠায় মুক্তির নাও এগিয়ে নেননি, গাইডের দায়িত্ব পালন করেছেন, অগ্রবর্তী হয়ে রেকিও করেছেন। শহিদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন। তাদের পরিবার দুর্ভোগ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নিজেদের দিনযাপনের খুপড়িঘরগুলো হারিয়েছিলেন। যে অল্প সম্বল ছিল তাও লুটপাট করেছিল রাজাকার দালালরা। ধরে নিয়ে গিয়েছিল নারীদের। এমন আত্মত্যাগের পরেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের কোনো চিহ্ন নেই। এরা যেদিন ইতিহাসে যথাযথভাবে স্থান পাবে তখনই সমৃদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন এখনো সম্ভব হয়নি, যার ফলে অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। রাজাকারসন্তান তথ্য গোপন করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বনে ভাতা তুলছে, এমন খবর হামেশা চোখে পড়ে। কিন্তু একাত্তরে জীবনবাজি রাখা এই বাইছালরা সুযোগসুবিধা ভোগ করা তো দূরের কথা ইতিহাসে স্থানই করে নিতে পারেননি। প্রশাসনিক ও সামাজিক অবস্থানটা এখনো পুরোপুরি তাদের বিপরীত। তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তৃণমূলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আজো বাইরে রয়ে গেছেন জনযুদ্ধের এই পার্শ্বনায়কেরা। এই লজ্জা ও অপমান আর কাঁহাতক সইতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে?


সহায়তা
১৯৭১: চোরের গাওয়ের অশ্রুত আখ্যান / শামস শামীম
রক্তাক্ত ৭১ / বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু
ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ : আমার অহঙ্কার / সালেহ চৌধুরী
দাসপার্টির খোঁজে / হাসান মোরশেদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you