শ্রী শ্রী রাখাল জিউ আশ্রম। এ এক অদ্ভুত শান্তির নাম। আপনি বা আপনারা না গেলে হয়তো বুঝবেন না। ছোট্ট হাওরের মধ্যিখানে শতবর্ষী পুরনো বটবৃক্ষ ও বিভিন্ন জাতের গাছগাছালি নিয়ে বিস্তৃত এই আশ্রম।
বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আশ্রমটি। গ্রীষ্মের দুপুর মানেই সূর্যের প্রচণ্ড তাপদাহ। খা খা রোদ্দুর, তপ্ত বাতাসে আগুনের হল্কা। সবুজ পাতা নেতিয়ে পড়ার দৃশ্য।
এ-রকম কাঠফাটা রোদে যখন হাওরের মধ্যিখানে গ্রামের মানুষজন ধান কাটে বা অন্যান্য কাজ করে তখন এই আশ্রমে এসেই শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে কোনো-এক বটবৃক্ষের নিচে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেগুলো তাদের গরু মাঠে দিয়ে এসে এই জায়গাটিতেই বসে থাকে।
বর্ষাতে চারিদিকে যখন পানিতে টইটুম্বুর তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয় আশ্রমটি যেন ভাসছে তার সবুজ গাছগাছালি নিয়ে হাওরের মধ্যিখানে। দেখতে বেশ লাগে।
শীতের আগমনীতে কার্তিক মাসে মঙ্গলা হয়। প্রতিদিন ভোরে মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ আর মঙ্গলা-আরতি দিয়ে সকাল শুরু হয়। শীতের সকালে শিশির মাড়িয়ে গ্রামের বাচ্চারা প্রসাদ খাওয়ার জন্য ছুটে যায়।
মন্দিরের পিছনেই ছোট্ট একটি বিল আর সেই বিলে শীতের আগমনীতে অতিথি পাখিদের কলতানে মনে হয় যেন পাখিদের রাজ্য।
রাখাল জিউ আশ্রমে যে আমি ঘুরে বেড়ালাম, অনেক অপরূপ মুহূর্ত ক্লিকবন্দি করলাম, কে এই আমি? বিত্তান্ত সবিস্তার না-হলেও সংক্ষেপে একটু বলে নিই আমার পরিচিতি। এবং তারচেয়েও বড় কথা আশ্রমটির ভূগোল-পথমানচিত্রটাও নির্দেশ করা দরকার।
আমি আমার মামাবাড়িতে যখনই বেড়াতে যেতাম এই আশ্রমটি নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল হতো। বিস্তৃত হাওরের মধ্যিখানে অনেক অনেক গাছগাছালি আর সুন্দর একটি সাজানোগোছানো মন্দির।
এটি রাজনগর উপজেলার বিলবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। গ্রামের মানুষদের কথা অনুসারে এই মন্দিরে যা-কিছু ভক্তিভরে চাওয়া যায় তা-ই পাওয়া যায়। তাছাড়াও এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে নানান কাহিনি। অলৌকিক গল্প ও উপকথা। প্রতি মঙ্গলবারে এই আশ্রমটিতে অনুষ্ঠান হয়।
আমি বারবার ঘুরেফিরে এই আশ্রমে যাই। আশ্রমে যাওয়ার পরপরই মনে শান্তি ফিরে পাই। এ এমন শান্তি, এর কোনো তুলনা হয় না। ঠান্ডা বাতাস, পাখিদের কলতান, পুরনো বটবৃক্ষের কথা, মনে হয় যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। পুরাণবর্ণিত কোনো নন্দনকাননে রয়েছি বলে মনে হয়।
মাঝেমধ্যে মঙ্গলবারে আশ্রমে খিচুড়িভোগ দেওয়া হয়। এই খিচুড়ির স্বাদ এক-কথায় অমৃত।
চলুন এইবার বলি কীভাবে যাওয়া যায়। যাতায়াতব্যবস্থা সাধারণ ও ঘোরপ্যাঁচহীন সোজাসুজিই। সিলেটের কদমতলি বাসস্টপেজ থেকে তাজপুরগামী বাসে চেপে যেতে হয়। লাইনের গাড়িতে যেতে না-চাইলে রেন্ট করার বাহন তো আছেই। এমনকি মোটরবাইকেও যাওয়া যায়। কিন্তু হাইওয়েতে বাইকরাইড নিরুৎসাহিত করাটাই কল্যাণকর।
আচ্ছা। তাজপুর তো গেলেন, তারপর? তাজপুর থেকে বালাগঞ্জ। বালাগঞ্জ থেকে নৌকায় বিলবাড়ি গ্রাম। গ্রামের যে-কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে আশ্রম। বিলবাড়ি গিয়ে আর তাকাতে হবে না, পায়ে হেঁটে এলাকার নয়নাভিরাম প্রকৃতিনিসর্গ ভোগ করতে করতে এসে দাঁড়াবেন আশ্রমতোরণে। একদমই চাকচিক্য নাই এমন প্রবেশদরোজা। মনে হবে যেন বহুবর্ষ অতীতে হারানো কোনো নন্দনকাননের সুনিবিড়তায় এসে পড়েছেন। পুকুর আছে একটা, হাঁসের চোখের মতো ছোট্ট ও মনোরম পুকুর। অযত্ননৈসর্গিক লতাগুল্মের স্পর্শ। মন্দিরচাতালে যেয়ে একটুখানি জিরোবেন বা আশেপাশে ঘাসে ছায়ায় পুকুরঘাটের প্রাচীন মায়ায় হাঁটবেন উদাস পবিত্র।
খুব বেশি খর্চাপাতি নাই এই ভ্রমণে। জনপ্রতি এ-মুহূর্তে ভাড়া বাবদ ৬৫ টাকা লাগবে। আর কোনো পথখর্চা নাই, কিন্তু পথে খানাখাদ্য যদি কেউ খাইতে চান তার তো শুমারপরিধি নাই। কিন্তু ঘণ্টা-দেড়েকের যাত্রায় কত পয়সাই-বা খাবেন আপনি? স্ট্রিটফ্যুডই তো? কয় পয়সা তাতে আর? সকালে যেয়ে বিকেলেই ফিরতে পারবেন সিলেটে, বা তার আগেই ফিরতে পারবেন, তেমন ক্লেশকর কিছুই না। চাইলে থেকেও যেতে পারবেন, অবশ্য যদি আমার মতো দরাজদিলা মাতুলালয় থাকে আপনারও। প্রসন্ন ভাগ্যের লোকেদের জনসংযোগ বা চালু বাংলায় ইয়ারদোস্তের তো অভাব থাকার কথা নয়, রাতটা কাটাতে পারবেন তেমন কোনো স্বজনগৃহেই। আর না-থাকলে ডেরায় ফিরবার বাহন তো নর্ম্যালি রাত নয়-দশ অব্দি পাওয়াই যাচ্ছে।
এইবার একটুখানি বিশেষদ্রষ্টব্য দিয়ে এই তীর্থসফরের গল্পখাতাটা মুড়ে ফেলি। তীর্থে গেছিলাম আজ নয়, এই অবশ্যমান্য কোয়ারেন্টিনকালে বেড়াতে বেরোবার মতো গণশত্রুগিরি কেউ যেন ভুলেও না করে তাই এই বিশেষ দ্রষ্টব্য তথা বি.দ্র.। গত বছরের একটা টাইমে এই তীর্থভ্রমণটা সাধিত হয়েছিল। ছবিগুলোও স্বহস্তে তুলতে পেরেছিলাম, যেগুলোর গুটিকয় এই নিবন্ধের সঙ্গে সেঁটে দেয়া গেল হয়তো। সবটা ছায়াছবি তো সম্ভব নয় দেখানো, তোলাও সম্ভব নয়, প্রশান্তির যে-একটা ছাপ দীর্ঘস্থায়ী হলো অস্তিত্বে, সেইটা আপনি তুলবেনই-বা ক্যামেরায় কেমন করে, আর দেখাইবেনই-বা কোন কায়দায়? কাজেই, নিজে যেয়ে দেখে আসতে হবে, পেয়ে আসতে হবে প্রকৃতি ও প্রাণের বিগ্রহস্পর্শ। সবই করবেন অবশ্য, তবে এখনই নয়, সময় ফিরুক আবার যথাস্বাভাবিক, সবাই মিলে এই প্রাণবাঁচানো কোয়ারেন্টিনকাল পালন করি সম্মিলিত। তথাস্তু।
রবিন দাস। মিউজিক ও ম্যুভিভোক্তা। থাকেন শহরেই, সিলেটে। বাংলাদেশ
… …
- দেখোয়াড়ের দিনপত্রী ৪ || রবিন দাস - April 12, 2020
- দেখোয়াড়ের দিনপত্রী ৩ || রবিন দাস - April 7, 2020
- দেখোয়াড়ের দিনপত্রী ২ || রবিন দাস - April 5, 2020
COMMENTS