মেঠোসুর আয়োজিত ‘ঋতুভ্রমণ ও প্রকৃতিবীক্ষণ’ শীর্ষক পরিকল্পনার আওতায় একদল উচ্ছ্বল শিশুকিশোর শহুরে স্কুলশিক্ষার্থী নিয়ে আমরা মাঠপ্রান্তর পেরিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম দূরে শারদীয় সুরে। বেরিয়েছিলাম শরৎ ঋতু খুঁজতে, চিনতে, জানতে এবং উদযাপন করতে। প্যান্ডেমিকের দীর্ঘ ঘরবন্দি দশা কাটতে শুরু করেছে সবেমাত্র। গুটিগুটি পায়ে দুরুদুরু বুকে মানুষ নয়া স্বাভাবিকতায় ধাতস্থ হতে শুরু করছিল মাত্র। নয়া আশার দিন। সভয় আনন্দে উড্ডীন। সময়টা ২০২১। সেপ্টেম্বর ১০।
এমনটা যদি হয় যে দেশের সমস্ত স্কুলশিক্ষার্থীদের সরাসরি ফিল্ডে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনা যায় চাক্ষুষ ঘর হতে শুধু দুইপা ফেলিয়া বাংলার ঋতুবর্ণগুলি! ঠিক এই ভাবনা থেকেই একটা আটচল্লিশসিটা বাসের ভিতর দাঁড়িয়ে-হেলিয়ে-বসে হৈ হৈ নৃত্যগীতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে বাসজানালায় চুল উড়িয়ে শুরু করি যাত্রা। খুব সক্কালে। এবং দিনভর সমস্বর গানে, আবৃত্তিতে, আঁকায়, বাজনায়, বাতচিতে, বড়দের বক্তব্যে, ঋতুস্মৃতিরোমন্থনে কেটে যায় বেলা। ছিল কুইজ। উপস্থিত তৎক্ষণাৎ রচনা ও পাঠোপস্থাপন। ইত্যাদি। ছিল অংশগ্রাহীদের উৎসাহিতকরণ প্রাইজ গিভিং সেরেমোনি।
ছিল গান। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সুরের উড়ান। সত্যি সত্যি গান! দোতারা, ডপকি, মন্দিরা বাদ্যযোগে ছোটতে-বড়তে মিলে বাংলা গান।
পড়ো দইয়ল পাখির নামে
পড়ো সবুজ পাতার খামে
পড়ো অশ্বত্থবটের ছায়া
আকুল আপনজনের মায়া।
পড়ো সুজন বাদিয়ার ঘাট
পড়ো শহরের শত ঝঞ্ঝাট
পড়ো ঘুমপাড়ানি শিশিরস্নান
প্রণয়সঞ্চিতা গীতবিতান।
পড়ো প্রতিবেশীর বুকে ক্ষত
পড়ো বন্ধুতা অবিরত
পড়ো অহিংস অবিচল
শুধুই শিকল ভাঙার ছল।
পড়ো ষড়ঋতু সুফলা মাস
পড়ো পুকুরের ছাইরঙা হাঁস
পড়ো মুর্গির কুট্টির আকার
গোটা দুনিয়াটা তোমার আমার।
পড়ো সক্কলে প্রত্যেকে আজ
পড়ো পুনরায় নিখিল সমাজ
পড়ো লুকি দিয়া যারা চলে গেল
অসহায় বেদনায় এলোমেলো।
পড়ো পড়ো, পড়ো পড়ো, পড়ো পড়ো, পড়ো পড়ো
অঙ্কুর থেকে চারাগাছ থেকে মহীরূহ হও বড়।
অঙ্ক করতে করতে, পড়তে পড়তে, প্রকৃতিপাঠ করতে করতে — “হয়ো সহায়হীনের অঙ্কের জোর অনঙ্ক হৃদয়।” এমনতর চাওয়া। আনন্দ নিয়ে চলা, কেবল আনন্দের দিকেই যাত্রা।
শরৎ ঋতু উদযাপন উপলক্ষে মেঠোসুর থেকে প্রকৃতিবীক্ষক ঋতুভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্য করে যে-বক্তব্য প্রদান করা হয়, সেটি নিচের অংশে অনেকটাই অবিকল সংরক্ষণ করা হলো :
তোমাদের সকলকে দেখে দারুণ লাগছে। খুব আনন্দ হচ্ছে। তোমরা যেন আনন্দ পাও, আনন্দে থাকো, আনন্দে বড় হও তার জন্যই এমন আয়োজন।
এইটা শরৎকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎ। আজ শরৎ ঋতুর ভাদ্র মাসের ২৬ তারিখ। সাল ১৪২৮।
ষড়ঋতু মানে ছয় ঋতু। কী সুন্দর সব নাম! গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। আজ আমরা শরৎ সম্পর্কে একটু জানব। দেখব, শুনব। প্রচুর আনন্দ করব। ছুটাছুটি করব।
চলো শরৎ ঋতুকে জানতে গিয়ে একটু বর্ষা ঋতুকে জেনে নেওয়া যেতে পারে। বর্ষায় অনেক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির মধ্যে খুব আনন্দ নিয়ে খেলাধুলা করি। শিক্ষকদের চোখরাঙানি, মা-বাবা গুরুজনদের শাসনবারণ-বকুনি আমাদের ঠেকাতে পারে না। লুকিয়ে হলেও আনন্দ করি।
ঘনকালো মেঘ আর রিমঝিম বৃষ্টিভরা আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস নিয়ে বর্ষাকাল। মাঠের শুকনো জমি বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে নরম কাদা হয়। পানি জমে। দেশবাসীর অন্নদাতা কৃষক আমনধান রোপন করেন। অনেক কষ্ট হয় তাদের আমরা টের পাই না। কাদামাটিতে কৃষকের হাতের পায়ের আঙুলে অনেক সময় ঘা হয়, পুঁজ হয়। তারা আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ও সমকালীন পুষ্টিপ্রদানে অনেক শ্রমঘাম দিয়ে এইসব কাজ করেন। হেমন্তে খুশিমনে এই ফসল ঘরে তোলেন। শহরে যারা থাকেন তারা কৃষকদের এই আনন্দে নাগরিক অনু্ষ্ঠান করেন, কথাবার্তা, গানবাজনা হয়। হেমন্ত উৎসব বাংলাদেশের নানা জায়গায় উদযাপন করা হয়।
বর্ষায় একটানা বৃষ্টিতে খালবিল, পুকুর, নদীনালা, হাওর, জলাশয় সব ভরে যায়। তখন মাছেরা ডিম পাড়ে। জলাশয়ে কত মাছের যে ছুটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি! ঠিক আমাদের শিশুদের মতো। নতুন বৃষ্টির খেলায় সকলে মেতে ওঠে। জেলেরা মাছ ধরেন। এ এক শ্যামল শোভন রূপ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন সত্যিই ধরতে পেরেছিলেন আমাদের হৃদয়ের কথা। “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে”। অথবা “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি, আহা হাহা হা।” তবে অতিবৃষ্টি হলে চারদিক ভেসে আমাদের দুঃখ বেড়ে যায়।
বর্ষায় বেশিরভাগ ফুলই হয় সাদারঙের। সুগন্ধ ছড়ায়। দোলনচাঁপা, কেয়া, কামিনী, কদম আরও কত ফুল!
ধরো বর্ষাঋতু ও শরৎঋতু দুই ভাইবোন। বর্ষা বড়বোন, শরৎ ছোটভাই। বর্ষাঋতু ছোটভাই শরৎ ঋতুকে বলছে — ভাই, আমি কালো। আমার তেমন গুণ নাই। দুমাস তো হলো আমি বরং যাই। শরৎ, তুমি অনেক ভালো। সুন্দর, কোমল, নির্মল আলো নিয়ে তুমি আনন্দ করো সকলকে নিয়ে। শরৎ বলছে — না দিদি, তোমার অনেক গুণ। থাকো না দিদি আরও কিছুদিন! তাই শরৎ ঋতুতেও মাঝেমধ্যে একটু বৃষ্টি, ঘনকালো বৃষ্টিও আমরা পাই। যেন সাদাকালোর মিলেমিশে চলা। বর্ষাঋতু নামক কালো দিদি উধাও হয়ে শরতে সাদার শুভ্রতাকে জিতিয়ে দিয়ে যেন সুদূরপানে উধাও হয়ে যায়। আর নদীর যে চলা প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে আমাদের চলাও তেমন। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ নতুন। নদীতে ডুব দেয়ার সাথে সাথে এই স্রোত চলে গেল অন্যকোথাও। আমাদেরও যেন অন্যজীবন। নতুন জীবন।
আচ্ছা, নদীর স্রোত যে বয়ে চলছে সে কোথায় যায়! প্রশ্ন আসে না? নদী সমুদ্রে গিয়ে মিলায়। আর আমাদের? আমাদের হলো প্রতিক্ষণ প্রতিদিনের আনন্দকে সাথে করে নিয়ে আনন্দের দিকেই যাওয়া। বিধ্বংসতৎপরতা বাদ দিয়ে সৃজনের, সৃষ্টির আনন্দে কাজ করা।
শরৎকে ঋতুর রাণী বলা হয়। শরতের ভোরের সূর্যকিরণ দেখেছ? কী সুন্দর! কী তার রূপ! নয়নভোলানো। সে-আলোর রূপ ছড়িয়ে পড়ে নদীর জলে, শান্ত পুকুরের জলে, বনে-বনান্তরে, বিলঝিলে ফোটা শাপলা আর পদ্মফুলের দলে। শ্বেতশুভ্র কাশফুল হেসে ওঠে। কেউ যদি সকালবেলা পেয়ে যাও শিউলি ফুল, দারুণ ব্যপার! কী মায়ার! তার বোঁটা কমলা রঙের। যেন ছোট এক সন্ন্যাসী। শুভ্রতার পাশে চুপটি মেরে নিজের আশ্রয় ছেড়ে মায়ার মাটিতে বসে আছে শারদলক্ষ্মীর এই বাধ্য সন্তান। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা বেঁধেছি শেফালী মালা”। আজকের আনন্দও যেন তাই। যেন নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজানো ডালা। আমরাই কাশের গুচ্ছ। আমরাই শেফালিমালা। সকলে আনন্দের সাগরে লীন হওয়ার সুন্দর আকাঙ্ক্ষা।
শরতে কিছু অপূর্ব ঘটনা ঘটে। কোজাগরি পূর্ণিমা পাই। এই পূর্ণিমার মানে হলো বছরের সবচেয়ে বেশি আলো ছড়ায় এই রাতে। কেউকেউ লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাত বলে। এই ঋতুতেই মা দুর্গার পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক-গনেশ সহ প্রকৃতিবন্দনাও হয়। আমাদের কৃষকেরা পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, করলা সহ নানারকম রবিশস্য আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জমি চাষের সময় অসংখ্য কীটপতঙ্গ, পোকা উঠে আসে। এসব পাখিদের প্রিয় খাবার। কৃষকরা পাখি মারেন না। কৃষকরা জানেন পাখিরা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উপকার করে। কৃষকের, গরুর গা ঘেঁষে নানা রঙের বক, গোশালিক, ফিঙে, দোয়েল, ভাতশালিক সহ অনেক পাখির দৃশ্য মনোরম। কাদামাটির এই বাংলা মা আসলেই খুব সুন্দর। সুন্দর মায়েদের মন।
আজ আর কথা না বাড়াই। এই পর্যন্তই থাকুক। যদি বড় ধরনের কোনো অসুবিধা বা বিপর্যয় না হয় তাহলে আবার দেখা হবে হেমন্তঋতুতে। আমরা যাব নতুন কোনো জায়গায়। সকলের মঙ্গল হোক।
১. তথ্য সহযোগিতা : আমিনুল ইসলাম বাবুল
২. গাওয়া গানের কথা ও সুর : জাহেদ আহমদ
মেঠোসুর মাঠলিপি ১
বিমান তালুকদার রচনারাশি
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS