এই বইটার প্রথম খণ্ড পড়ে ফেলতে পেরেছিলাম ফ্রি পিডিএফ পেয়ে যাওয়াতে। না, ভুল বললাম, মাগনা বইপত্র তো কোটি-কোটি ছড়ানো চোখের সামনে, কিন্তু শখ থাকলেও পড়তে পারি না বছরে দেড়টাও। হুমায়ুন আজাদ বইপড়া বিষয়ে একটা কথা বলেছিলেন যে, বই পড়তে গেলে মননের পরিশ্রম লাগে, বেশিরভাগ মানুষ পরিশ্রম বলতেই কায়িক পরিশ্রম বোঝে, মাননিক পরিশ্রমের ব্যাপারটা তাদের কাছে অজ্ঞাত/অবজ্ঞাত। হুবহু বলি নাই আজাদের কথাটা, নাগালে আজাদ নাই বলিয়া, খানিক ছড়িয়েছিটিয়ে বললাম। ঘটনাটা আসলেই তাই। কিন্তু মনন জিনিশটা আমার কানে এলিট-এলিট শোনায়, এবং বলা বাহুল্য, ওই ইনগ্রেডিয়েন্টস্ দিয়া আল্লা আমারে বানান নাই। হিম হয়ে আসে অস্তিত্ব বেশিক্ষণ পড়তে থাকলে। পতন/পঠন সবার শরীরে সয় না।
তা, এই বইটা পড়ে ফেলতে পারার কারণ মাগনা অ্যাক্সেস্ নয়, এই বইয়ের কন্টেন্ট অত মননশ্রম দাবি করে না বলেই। ইজি আখ্যান, সিম্পল্ সেন্টেন্সেস্, সংলাপ ভর করে এগোনো গল্পের বই তিনশ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার হইলেও পড়তে লাগে একেবারেই অল্প সময়। তাছাড়া আগে থেকে এই বইয়ের বিজ্ঞাপন মারফতে জেনেছিলাম যে এর কন্টেন্ট একটু ফর্বিডেন্, সোজা বাংলায় সিলেটি ডায়লেক্টে চোখটিপুনি ইঙ্গিতে লোকে বলবে ‘হতা আছে মামু, বুচ্ছোনি, হতা আছে বেসম্ভবা’, মানে সেক্স আছে, এবং শুনেছিনু হুড়মুড় শব্দে বিক্রিও হচ্ছে বিদেশে, বেস্ট সেলার আইটেম্ বলে গ্রে সাহেবের কীর্তিকাণ্ড মশহুর হয় কিতাবখানা বাজারে বেরোবামাত্র ভুবনব্যাপী। কিন্তু পড়তে যেয়ে দেখলাম যে এরে এত লণ্ডভণ্ড কাণ্ড মনে করা আজকের দুনিয়ায় খামাখা। ডমিন্যান্ট-সাবমিসিভ সেক্সপ্লে দেখানো হয়েছে কাহিনিভাগের মূলাধারে, তো কী হয়েছে, এই জিনিশ ২০০০-অনোয়ার্ড দুনিয়ায় আলাপে বেইল্ পাবার মতো কিছু? তবু প্রচুর হৈচৈ হয়েছে। বেফায়দা।
২০১১ সনের বই এইটা, এরপরে এর আরও দুইটা পার্ট বেরিয়েছে, ফার্স্ট পার্ট ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’ “Fifty Shades Of Grey”, সেকেন্ড পার্ট ‘ফিফটি শেইডস্ অফ ডার্কার’, থার্ড পার্ট ‘ফিফটি শেইডস্ অফ ফ্রিড’; তবে দ্বিতীয়া-তৃতীয়া নিয়া আর আগ্রহ নাই, কাজেই পিডিএফ আছে কি নাই খুঁজে দেখতে যাই নাই। কিন্তু প্রথম খণ্ডের পিডিএফ খুবই অ্যাভেইলেবল্। সম্প্রতি রিলিজ্ হয়েছে ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’ শীর্ষক ম্যুভিটি। ইরোটিক্ রোম্যান্স ম্যুভির ক্যাটাগোরিতে এই সিনেমাটা প্রিমিয়ার হয়েছিল গত বছরের, ২০১৫ সনের, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিক্সটিফিফথ বার্লিন উৎসবে। এর গল্পসূত্র সমনামী ‘বিতর্কিত’ উপন্যাস অবলম্বনে এবং সেই ই.এল্. জেইমসের গল্পছায়া নিয়ে এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য করেছেন কেলি মার্সেল্। ম্যুভি ডিরেকশন্ দিয়েছেন স্যাম্ টেইলর-জন্সন্।
বইয়ের চেয়ে সিনেমা এখানে অনেক বেশি মার্জিত মনে হয়েছে দেখতে যেয়ে, বেশিকিছু ঘটেও নাই আসলে, নেহায়েত অল্পের উপর দিয়া চালানো। ফলে পয়সা উসুলের চিন্তা যারা করেন, তাদের জন্য ক্রোধের কারণ হবে এইটা। আমার ভালো লেগেছে ব্যাপারটা, অ্যাট-লিস্ট বইয়ের চেয়ে ব্যাপারটা সামলানো হয়েছে ভালোভাবে। এই ধারার সিনেমা আমরা তো অনেক দেখেছি। ডমিনোট্রিক্স নিয়া হার্ডকোর্ ম্যুভির মধ্যে ‘ভালো-ভালো’ ম্যুভিও অনেক আছে। সেই তুলনায় এইটা আসলে একটু পুতুপুতু প্রেমের সিনেমাই মনে হয়েছে। কিন্তু অভিনয় এবং ক্যামেরার সিম্পলিসিটি ও রিফ্রেশিং একটা আবহাওয়ার জন্য উপভোগ্য হতে পেরেছে ব্যাপারটা।
আখ্যানের মূল দুই চরিত্র ক্রিশ্চিয়্যান্ গ্রে এবং অ্যানাস্তাসিয়া স্টিল্ নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে জেমি ডোর্ন্যান্ এবং ড্যাকোটা জন্সন্। ডিরেক্টর টেইলর-জন্সন্ একটি ইন্টার্ভিয়্যুতে জানিয়েছেন, ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন্ প্যারিস্’ এবং ‘ব্লু ইজ্ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ শীর্ষক সাড়া-জাগানো কন্ট্রোভার্শাল্ ম্যুভিদ্বয় ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’/’Fifty Shades Of Grey’ নির্মাণে তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সিনেমা নির্মাণপ্রাক্কালে জানা গিয়েছিল ‘টুইলাইট সাগা’-তারকা কার্স্টেন্ স্টুয়ার্ট এবং রবার্ট প্যাটিন্সন্ ম্যুভিটির মূল দুই ভূমিকায় অভিনয় করছেন। কিন্তু পরে প্ল্যান্ পরিবর্তন করা হয়, বলা বাহুল্য।
জানা গিয়েছে, বিতর্কিত যৌন কন্টেন্ট এবং আপত্তিকর সেক্সুয়্যাল্ ভায়োলেন্সের প্রাধান্যবহ উপন্যাসত্রয়ীর ম্যুভিসিক্যুয়েল্ পরবর্তী খণ্ডদ্বয়ের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে এবং সব ঠিকঠাক থাকলে এদের রিলিজিং ইয়ার পরপর ২০১৭ ও ২০১৮; কারা অভিনয় করছেন বা কে পরিচালনা করছেন তা জানা যায়নি অবশ্য। ম্যুভিটা ক্ল্যাসিফায়েড এবং বয়সগ্রুপ ব্যতিরেকে এর প্রদর্শনী সেন্সর্ড রাখার পরামর্শ সম্বলিত হবার কারণে একে অপ্রাপ্তবয়স্ক দর্শকগোষ্ঠীর দৃষ্টিনাগালের বাইরে রাখতেই ইংলিশ ম্যুভিক্রিটিকবৃন্দ জোর সুপারিশ রেখেছেন। ৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয়ে বানানো ম্যুভিটি ক্রিটিকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার তোপে পড়েও অলরেডি প্রায় ছয়শ মিলিয়ন লাভের গুড় মটকায় উঠিয়ে সেরেছে!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার মনে হয়েছে ‘অ্যামেরিক্যান্ ফ্যামিলি সোসাইটি’ নামের একটা অর্গ্যানাইজেশনের পজিশন্ পেপার। ওরা তাদের বিরুদ্ধ অবস্থান জানাতে যেয়ে এই ম্যুভির কতিপয় চিহ্ন ধরে কথা বলেছে যেগুলো খুবই ইন্ট্রেস্টিং। এর মধ্যে একটা আপত্তি উল্লেখ করলেই টের পাবেন দুনিয়া আসলে নানান বরন গাভির এক গোশালা হলেও অন্তিমে একই মায়ের পুত এবং দুগ্ধ শুভ্র ও রক্ত রাঙা কালো-ধলো সক্কলেরই। বিষয়টা হচ্ছে, গ্রে সাহেবের পুরা নাম ক্রিশ্চিয়ান্ গ্রে। অতএব তারা মনে করছে এই সিনেমায় ক্রিশ্চিয়ানিটির জান্ কিছুটা খাত্রার মধ্যে পড়েছে এবং খ্রিস্টত্ব নিয়া সেক্সভায়োলেন্স দেখাইয়া ডিরেক্টর মশাই ঠিক কর্ম করেন নাই। কিন্তু … না, থাক, এই বিষয়টারে ঘেরিয়া আরেকদিন কৌতুকী ফাঁদা যাবে।
একটু পোস্টস্ক্রিপ্ট। প্রতিবেদন-প্রকাশপূর্ব অব্যবহিত পরে এই অবসরে সেকন্ড পার্ট বার হয়েছে, এর সিনেমাভাগ, এবং দেখা সাঙ্গ অলরেডি। কিন্তু যুৎ হয় নাই হারাম। অন্তত দেখনকালে বেশ-কয়েকবার মনে হয়েছে, এই বুঝি মিউজিক বেজে উঠল ‘আমারও পরানও যাহা চায় তুমি তা-ই গো’ অথবা ‘ভালোবাসি ভালোবাসি নিশিদিন বাজায় বাঁশি’ ইত্যাদি ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলগীতিকা। খামাখাই প্রেমারোপিত করার কোনো মানে হয়? এরচেয়ে জেয়াদা কায়কারবার করে ফেরে একালের কলকাত্তাইয়া বাংলা ছায়াচিত্রে। এরা বাংলা ফিচার ফিল্মের নামে অ্যাডাল্ট কন্টেন্টের বেসাতি করবার একটা কায়দা বাইর করে ফেলেছে এরই মধ্যে। কেমন করে যেন ওরা ভাত-সালুনের মধ্যেও যৌনোত্তেজনা সান্ধাইয়া রাখতে সিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই জিনিশ দিয়া তারা ভালো করেকম্মেও খাচ্ছে বটে।
অ্যানিওয়ে। বেচারা ক্রিশ্চিয়ান্ গ্রে বোধহয় আপন ধর্মাদর্শীদের নামানুভূতিতে সেন্সিটিভ হতে যেয়ে একদম সদাপ্রভুপ্রেস্ক্রাইবড প্রেমপথে হেঁটে যেতে লেগেছেন। অভিজ্ঞতা তা-ও। মন্দ না। বাজারে কেউ পথ চেয়ে বসে আছে গ্রে সাহেবের অ্যানাটোমি রিলোডের আশায়, এমনটা চাউর হয় নাই এখনো কোথাও। বরঞ্চ থামলেই ভালো লাগে, এমন একটা সাউন্ড কারো কারো মুখ থেকে বেরিয়েছে শোনা যায়। ডিরেক্টর মশাইয়ের কর্ণে পশিলেই হয়। নারদ! নারদ!!
Film Title: Fifty Shades of Grey ।। Released Year: 2015 ।। Genre: Drama, Romance, Thriller ।। Duration: 2h 5min ।। IMDb Score: 4.1/10 ।। Director: Sam Taylor-Johnson ।। Stars: Dakota Johnson, Jamie Dornan, Jennifer Ehle, Marcia Gay Harden ।। Music Score: Danny Elfman ।। Net profit approximately $ 571 million
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS