কান্ট্রিরোডস্ পঞ্চাশস্পর্শ

কান্ট্রিরোডস্ পঞ্চাশস্পর্শ

মোটামুটি পঞ্চাশ ছুঁতে লেগেছে ‘টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্’ (Take Me Home Country Roads) গানের বয়স। অনবদ্য, অমলিন, অনুপম আজও। অতুলনীয়। ফুরায় নাই আজও এর লিরিকের, মিউজিকের, রেন্ডিশনের আবেদন। পঞ্চাশ হলেও ‘অলমোস্ট হ্যাভেন’ সেই মিউজিকের, সেই লিরিকের, সেই বিশেষ ডেনভারেস্ক সুরেলা গায়কীর অ্যাপিল্ এখনও চরাচর ব্যাপ্ত করে রেখেছে। বয়সের হিসাবটা গাণিতিক শুধু, নিউমেরিক শুধু, সংগীতের হিসাবটা গাণিতিক বয়সের বিবেচনায় নয়, সংগীতের বয়স গুনতে হয় সাংগীতিকভাবে। সেই হিসাবকিতাবে ‘টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্’ আজও বয়ঃসন্ধির নীল নির্জন পবিত্রতা পার করছে যেন, কৈশোরের রংধনু উদিত হয় এখনও এই গানের আওয়াজ কানে পশিবার সঙ্গে সঙ্গে, অলমোস্ট হ্যাভেন শুধু ওয়েস্ট-ভার্জিনিয়া নয়, যেমনটা গানের পয়লা লাইনেই শুনতে পাই আমরা, বা নয় ব্লু-রিজ্ মাউন্টেইনের দৃশ্যটুকুই শুধু স্বর্গীয়, অলমোস্ট হ্যাভেন গোটা গানটা শ্রবণোত্তর আমাদের অভিজ্ঞতা। আজকে যে-শ্রোতা তার জিন্দেগিতে পয়লাবারের ন্যায় গানটা শুনছে, সে-ও অলমোস্ট হ্যাভেন উচ্চারিয়া উঠবে স্বগতোক্তির মতো অস্ফুটে। এইটা আন্দাজে বলা হলেও এই-রকমটা আন্দাজ বোধহয় করাই যায়।

এই গানটা নাইন্টিন-সেভেন্টিওয়ানে ডেনভারের (John Denver) ‘পোয়েমস্, প্রেয়ার্স, প্রোমিজেস্’ অ্যালবাম ভর করে রিলিজ্ হয়। ডেব্যু নয়, এর আগে ডেনভারের আরও কয়েকটা অ্যালবাম বেরিয়ে গেছে অবশ্য, সম্ভবত গোটা-তিনেক অ্যালবাম অলরেডি শিল্পীর ঝুলিতে সেই-সময়। কিন্তু হচ্ছিল না ঠিকঠাক। সবই ঠিক ছিল, তবু কোথাও বুঝি ক্লিক্ করছিল না। গায়ক হিশেবে ডেনভারের দুনিয়াজোড়া নামডাকটা ‘কান্ট্রিরোডস্’ রিলিজের পরে এসেছে। এই একটা গানেই শিল্পী শিখরে যেয়ে ওঠেন। এরপরে সেই শিখরে থেকেই তিনি গান করে গেছেন আমৃত্যু। যদিও গোলযোগ ঘটেছে ক্যারিয়ারে, ডেনভার সামলেও নিয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ ধৈর্যে, ‘টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্’ গানেরই শিল্পী হিশেবে ডেনভারের সঙ্গে হ্যান্ডশেইক করেছে লোকে। আজও তা-ই। যদিও পরে বেশকিছু গান সমভাবে লোকপ্রিয় হয়েছে, ‘অ্যানির গান’ বা ‘রকি মাউন্টেইন হাই’ ইত্যাদি উল্লেখ করা যাবে এ-প্রসঙ্গে, টেইক-মি-হোমের শীর্ষ অতিক্রম বোধহয় কেউ করতে পারে নাই। কিন্তু ডেনভারের সিগ্নেচার অচিরেই লিস্নারের কাছে চেনা হয়ে ওঠে। ‘টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্’ (Take Me Home Country Roads) দিয়ে ডেনভার বিশ্বজোড়া তারাখ্যাতি পেয়ে যান এবং মরণের কুড়ি বছর বাদে এসেও নক্ষত্রলোকে ডেনভার আজও উজ্জ্বলতর দেদীপ্যমান।

অনেক গানের স্যংরাইটার ডেনভার নিজে হলেও ‘কান্ট্রিরোডস্’ গানটা আরেকজনের। ওয়াশিংটন-ডিসিতে ডেনভার প্রথম এই গানের সংস্পর্শে এসেছিলেন। গানটার স্যংরাইটার বিল্ ড্যানোফ, যিনি তখন ওখানকার বিখ্যাত একটা নাইটক্লাবে মাসোহারা মাইনেতে কাজ করছিলেন। বিল্ ড্যানোফ ওয়াশিংটনে একটা অ্যাপার্টমেন্টে গার্লফ্রেন্ড ট্যাফি নিভার্টের সঙ্গে লিভ-ইন্ করছিলেন। ট্যাফি পরে বিলের ধর্মপত্নী হয়েছিলেন অবশ্য, নর্মসহচরী ছিলেন তো বটেই, দুইজনে মিলেই লিখতেন এবং সুর করতেন সংগীত আয়োজিতেন গানে। ডেনভারের কম-সে-কম পনেরোটা গানে এই নামজোড়া স্যংরাইটারের ক্রেডিটলাইনে দেখা যাবে। বিল্ ড্যানোফ ও ট্যাফি ড্যানোফ।

Take Me Home Country Roadsলোক্যাল্ কোনো সোর্স মারফতে ডেনভার এর আগে ড্যানোফযুগলের তারিফ শুনেছেন নিশ্চয়, এক-পর্যায়ে ডেনভার কন্সার্টফেরতা ক্লান্তধ্বস্ত ওয়াশিংটন শহর দিয়া যাবার সময় বিলের অ্যাপার্টমেন্টে যেয়ে সাক্ষাৎ করেন। পয়লা সাক্ষাতেই বিল-ট্যাফির রিসেন্ট কাজকর্মের ব্যাপারে ডেনভার খোঁজ নেন। গান শুনতে চান নয়া কিছু কুলুঙ্গিতে থাকলে। ডেনভার এমনিতে মুখচোরা লাজুকই ছিলেন সেই-সময়, গেঁয়ো তো রয়েই গিয়েছিলেন শেষ-পর্যন্ত, খুব-বেশি পাব্লিকের লগে হ্যালো-হাই আশ্নাই কিংবা লদকালদকি ইত্যাদি করতে পারতেন না। তারপরও উঠতি দুই লিরিসিস্টের ডেরায় যেয়ে ডেনভার হাজির হন সংগীতের খোঁজে, সুরের খোঁজে, মেলোডিম্যুডের খোঁজে। এমনিতে ডেনভার নিজেও তখন উঠতিই ছিলেন বলতে হবে; অ্যালবাম বেরোলেও তখনও ওইভাবে চেনে না কেউ তারে, একক ক্যারিয়ার গড়ে উঠতে যেয়েও উঠছে না, অ্যালবামের কাটতি নাই কিংবা নাই চার্টের টপে ওঠার দূরপরাহত কোনো লক্ষণ। সমস্ত কুফা কাটতে চলেছে অচিরে, এই সাক্ষাতের পরে, এইটা আমরা কিংবা ডেনভার কেউই তখনও জানতাম না।

কাজকম্মের খোঁজপাত্তা নিতে চাইছিলেন ডেনভার বিলের কাছে, কেমন চলছে গানলেখা ইত্যাদি, রিসেন্ট কিছু আছে কি না, থাকলে শোনানো যাবে কি না ইত্যাদি ছিল কৌতূহল ডেনভারের দিক থেকে। বিলের লুকাছাপা গাঁইগুঁই দেখে ট্যাফি তখন বয়ফ্রেন্ডরে ধাক্কায়া বলেন “কান্ট্রিরোডস্ গানটা জনিরে একটু শোনাও-না কেন!” ও, বলা দরকার, বিল ওই-সময় টানা মাস-কয়েক একটা গান নিয়াই ভীষণ খেটে যেতেছিলেন, মনঃপুত হচ্ছিল না বলে ফেলে রেখে ফের ধরছিলেন। ফলে ট্যাফির কথায় বিলের মুখে ঝিলিক মারলেও ওয়ার্কিং-প্রোগ্রেস্ গানটা জনিরে শোনানোর বেলায় তার বেজায় দ্বিধা কাজ করছিল। পরে একটা সাক্ষাৎকারে মেমোরি রিকালেক্ট করতে করতে বিল এই জিনিশগুলো আমাদেরে শেয়ার করেছেন।

দ্বিধায় ছিলেন বিল্ যে ডেনভারের কানে গানটা আদৌ যুৎ লাগবে কি না। বা, বলেন তিনি, প্রায় নিশ্চিতই ছিলেন যে ডেনভার তখনও যে-ধরনের গানে ঝুঁকে থেকেছিলেন, সরলসোজা আবেগের গ্রামীণ আনন্দগীতি, তাতে এই নয়া গান তার কাছে সুখাদ্য মনে হবে না। তাই দ্বিধা। বা, দ্বিধা সত্ত্বেও অলমোস্ট নিশ্চিতি যে ডেনভারের কাপ অফ কফি নয় তার নয়া বাঁধা গানটা। সাক্ষাৎকারে বিল্ অনেক পরে এসে বলেছেন যে এইটা তিনি লিখেছিলেন এবং সুর করেছিলেন যখন, ওই সময়টায়, মনে ভেবে রেখেছিলেন জনি ক্যাশ এই গানটা গাইবেন। জনি ডেনভারের নাম তার মাথায় ছিল না। থাকার কথাও অবশ্য নয়, অ্যাট-লিস্ট তখনকার ডেনভার তো পরের ডেনভার নন। জনি ক্যাশ বরং তখন মঞ্চে-অ্যালবামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং কান্ট্রি-মিউজিকের মধ্যে একটা হাওয়া আনতে পেরেছিলেন নিজের ঢঙে।

Take Me Home Country Roadsট্যাফি এবং বিল্ তখনও লোক্যাল আর্টিস্ট। গান বাঁধেন গুটিগুটি, লোক্যাল আর্টিস্টদের দিয়াই গাওয়ান, নিজেরাও করেন গানবাজনা ক্লাবে-পাবে ইত্যাদিতে। কিন্তু দিলের ভিতর তাদের একটা তমন্না দানা বাঁধছিল যে একটা গান বড় কোনো গায়ক বা নামজাদা আর্টিস্ট দিয়া গাওয়াইতে পারলেই কেল্লা আপ্নাআপ্নি তিরাশি পার্সেন্ট ফতে হয়া যায়। সেই কারণেই জনি ক্যাশের চিন্তা মাথায় খেলেছিল। কোনোমতে একটা গানের হিট করানো তখন তাদের সার্ভাইভের জন্য দরকারি ছিল।

দোনোমোনো সত্ত্বেও বিল্ অবশেষে ‘টেইক মি হোম’ তখন পর্যন্ত যেটুকু সুরে ফেলানো হয়েছিল শোনান ডেনভারকে। এবং, তৎক্ষণাৎ, সঙ্গে সঙ্গে ডেনভার উল্লসিত হয়ে ওঠেন পেয়ে-যাওয়ার আনন্দে। এইটাই হিট স্যং তোমার, দুর্দান্ত জিনিশ করেছ মিয়া, এই জিনিশ রেকর্ড করাইসো তো? উচ্ছ্বসিত জন ডেনভারের প্রশ্নের উত্তরে বিল্ বিরস বদনে জানায়েছিলেন যে এই গানের কোনো রেকর্ড ডিল্ তারা ব্যবস্থা করে উঠতে পারেন নাই। শুনে ডেনভার প্রস্তাব করেন, বিল্ যদি অ্যাগ্রি করেন তবে একসঙ্গে এই গান রেকর্ডে যেতে পারেন তারা। মাস-কয়েক পরে সত্যি সত্যি দুইজনে রেকর্ডস্টুডিয়োতে যান নিউইয়র্কে।

রেকর্ড হবার অব্যবহিত পরে ড্যানোফের প্রতিক্রিয়া আদৌ পজিটিভ ছিল না। তার মনে হয়েছিল যে ডেনভারের গলা খামাখাই ইকো করেছে বেশি বেশি। বিল্ মনে করেছিলেন শ্রোতার কানে এইটা ক্যাকোফ্যানি মনে হবেই নির্ঘাৎ। ভীষণ আদরের গানটা তার পুরা পানিতে গেল মনে হয়েছিল বিলের। যদিও লক্ষ লক্ষ শ্রোতা ড্যানোফের এই দুর্ভাবনা অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই উড়িয়ে দিয়েছিল। অগাস্টের মধ্যে ‘টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্’ শ্রোতাকান হরণ করে নেয় এবং বিলবোর্ড পত্রিকার টপচার্টের দুইনাম্বারে যেয়ে ওঠে রিলিজের ইমিডিয়েইট হপ্তায়।

এরপরে পেছন ফিরিয়া তাকাইতে হয় নাই মিউজিশিয়্যান এই দম্পতিটিকে। একটা গান হিট করার মাধ্যমে জিন্দেগি বদলে যায় তাদের। শংসাবাক্যে ভরে যায় হৃদয়, পয়সা আসে দেদার পকেটে, এবং গানটা বাঁধতে থাকেন তারা আরও সিরিয়াসলি। এক ডেনভারের জন্যেই তারা আরও বারোটা গান বানছেন যদিও ওই হিট আর তাদের নসিবে ফেরে নাই। কিন্তু অ্যাভারেজের বিজনেস দিয়াই তারা দিব্যি দিলখুশ থেকেছেন। রয়্যাল্টি গুনেছেন বিস্তর। কান্ট্রিরোডস্ গানটা তারে ব্যাপক দিয়েছে। এখন এইটা আনোফিশিয়্যাল অ্যান্থেম ওয়েস্ট-ভার্জিনিয়া অ্যারিয়ার। অফিশিয়্যাল স্যং এইটা ওয়েস্ট-ভার্জিনিয়া য়্যুনিভার্সিটি পর্বতারোহী সংঘের।

এখন কি আর অনুতাপ হয়? যে, জনি ক্যাশ গাইলে এইটা আরও ভালো করতেন … মনে হয় কি এই-রকম কখনো? নো, সবচেয়ে বৃহৎ রেকর্ডটা তাকে এনে দিয়েছেন ডেনভার এবং এর বাইরে তিনি একবারও মনে করেন না আর যে ডেনভারের চেয়ে এইটা ভালো কেউ গাইতে পারতেন ওই-সময়, সাক্ষাৎকারে ড্যানোফ জানিয়েছেন।

 

এনপিআর ম্যাগাজিনের একটা আর্টিক্যলের ছায়া নিয়ে এই প্রতিবেদন গানপারের জন্য তৈয়ার করেছেন সুবিনয় ইসলাম

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you