বাংলাদেশের বহু মানুষ শিল্প ও শিল্পকারখানার পার্থক্যটা বোধহয় বোঝে না। বুঝলেও ভাব ধরে কারখানাই হচ্ছে শিল্প। এই জায়গায় আমার মতামত হলো কাজী মোতাহার হোসেনের মতো। তিনি বলছিলেন, সংস্কৃতি শিক্ষিত লোকের ধর্ম আর ধর্ম অশিক্ষিত লোকের সংস্কৃতি। এখন শিল্প ও শিল্পকারখানার পার্থক্যটা তাইলে কেমন? শিল্প মানে আর্ট যেইটা, সেইটা আদতে কখনোই কারখানায় তৈরি হয় না। তৈরি হয় ইন্ডিভিজ্যুয়াল স্ট্রাকচারের চর্চার মাধ্যমে। এই স্ট্রাকচার কখনো একক ব্যক্তি বা কখনো ছোট প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। যেমন কবিতা হচ্ছে শিল্প। কিন্তু যখন আপনি এআই দিয়ে কবিতা লিখাবেন বা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বসে কপি লেখাবেন তখন সেটাতে যতই কাব্য থাকুক, আদতে কবিতা হয়ে ওঠে না বলেই মনে করি।
সিনেমার ক্ষেত্রেও আমার ভাবনাটা একই রকম। বাণিজ্যিক ধারার যে সিনেমা, সেটাকে আমি কারখানা হিসেবে ভাবি। মনে করি বিশাল একটা শ্রেণী-গোষ্ঠীর কাছে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে-লক্ষ্যে ওই রকম জিনিস বানানো হবে বা হয়। কিন্তু সিনেমার শিল্পনা আদতে ওই জনরুচিকে কিছুটা উপেক্ষা করে। কিছুটা না, বলা যায় পুরোপুরিই। সত্যজিৎ রায় তো বলেছেনই, দর্শকদের দোহাই দিয়ে খারাপ ছবি বা খেলো ছবি—এগুলোতে তিনি বিশ্বাস করেন না। ফলে সিনেমার যে শিল্প তাতে দর্শক দূরের অতিথি। জুটলে ভালো, না জুটলে নাই। এমনটাই হবে, হওয়াই স্বাভাবিক। এখন আপনি যদি হলিউডের অনেক জনপ্রিয় ছবির উদাহরণ দেন তাহলে বলব, ভাই ওইসব সিনেমারেও সমালোচকরা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখে আসছে। ফলে ওইগুলোও আসলে সবগুলো শিল্পের ওই দরজা দিয়ে পুরোপুরি যায় না। বিশ্বাস না হলে ওইসব সিনেমার মুক্তির সাল ধরে বিশ্বের চিন্তাশীল সিনেমার জগতটা একটু দেখেন, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে শিল্প আর বাণিজ্যের পার্থক্যটা কতটুকু।
আমরা মনযোগ দিতে পারি, বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমার প্রতি। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মুক্তি পায় সিনেমাটি। সে-বছরের বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব, কান চলচ্চিত্র উৎসব এমনকি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের কোনও শাখাতেই এই সিনেমা কোনও ধরনের পুরস্কার পায়নি। কেন পায়নি? কারণ, ইউরোপের সেসব চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে এই সিনেমাটাও একটা বাণিজ্যিক সিনেমা বলেই হয়তো। এখন দেখি, ওই সময় পৃথিবীর সেরা তিনটা চলচ্চিত্র উৎসবে কোন কোন সিনেমা পুরস্কৃত হয়েছিল। সে-বছর ভেনিসে সত্যজিতের সীমাবদ্ধতা ছিল অফিসিয়াল সিলেকশনে। ক্যারিয়ার গোল্ডেন লায়ন পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, আনাতোলি গোলোভনিয়া ও বিলি ওয়াইল্ডার। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সে-বছর সেরা সিনেমা মানে পাম ডি অর পেয়েছিল ইটালিয়ান সিনেমা ‘দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস গোজ টু হ্যাভেন’। আর বার্লিনে গোল্ডেন বিয়ার জিতেছিল পাওলো পাসোলিনির ‘দ্য ক্যান্টারবুরি টেলস’। অথচ অস্কারে ৯টা শাখায় মনোনয়ন পেয়ে তিনটিতে জিতেছিল ‘দ্য গডফাদার’। কারণ, অস্কারটা যে আমেরিকান সিনেমার পুরস্কার!
এ থেকেই বোঝা যায়, আমেরিকান সূত্র ধরে যে সিনেমার বাজার বা শিল্পমান আমরা মুখস্থ করেছি তা আসলে সর্বজনীন না। এমনকি ইউরোপীয় মানদণ্ডেও যে আমরা ক্লাসিক হিসাব করি সেটাও সর্বজনীন না। সর্বজনীন হচ্ছে মানুষের মনে দাগ কাটা শিল্পকর্ম। যে-কারণে ‘দেবদাস’ উপন্যাস প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও আজও ক্লাসিক। বাণিজ্যিক সিনেমাও এই কারণে আসলে মহান। প্রশ্ন তখনই আসে যখন সিনেমাটার সাথে মানুষ একাত্মতা পোষণ করে। তার হৃদয়ে স্থান দেয়। ‘পথের পাঁচালী’ মহান এই কারণে যে দুর্গার মৃত্যু আমাদের ছুঁয়ে যায়। অপু-দুর্গার শৈশব আমাদের নিজেদের চিরায়ত শৈশবকে চিহ্নিত করে দিতে পারে। এমন আরও কারণ দর্শানো যায়।
কিন্তু, বলেন তো, ওই সময়ের সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা সিনেমা কোনটা? বাণিজ্যের মূল বিষয়টা এখানেই। কিন্তু বাণিজ্যিক সিনেমাটা দরকার, এবং খুব বেশি দরকার। সিনেমাহলে দর্শকদের নিয়মিত ও হলমালিকদের টিকিয়ে রাখার জন্যই দরকার। সেই বাণিজ্যিক সিনেমাটা ছয় মাস পর লোকে ভুলে গেলেও অসুবিধা নাই। কারণ, ইটস লাইক টিস্যু পেপার।
ইলিয়াস কমল রচনারাশি
গানপারে ম্যুভিরিভিয়্যু
- বাতাসের মতো মোহময় || ইলিয়াস কমল - November 25, 2024
- বন্ধুর বই || ইলিয়াস কমল - November 22, 2024
- কেন কমার্শিয়াল ছবি নিয়মিত দেখি - October 8, 2024
COMMENTS