সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে হাওরবাসী বোরো ফসল তোলার কাজ সেরে ফুটবল-আনন্দে মেতে ওঠে। যদিও তারও পুর্ব থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনুশীলন চলতে থাকে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক খেলা শুধু বৈশাখ মাস থেকেই শুরু হয়। আট গাঁয়ে (আট টিমে), ষোলো গাঁয়ে (ষোলো টিমে) কখনও-বা তার কম-বেশি গাঁয়ের (টিমের) মধ্যে এ-প্রতিযোগিতা শুরু হয়। খেলা পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে খেলায় অংশগ্রহণকারী গাঁয়ে (টিমে) ‘ফিক্সচার’ দিয়ে বা মৌখিক আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর এ-ফিক্সচার বা আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য পূর্বদক্ষতা লাগে, যে-দক্ষতা একদিনে তৈরি হয় না। এ-দক্ষতা তৈরি হয় শৈশব থেকে ‘জাম্বুরা’ দিয়ে বল খেলে-খেলে, ধানের খড় দিয়ে তৈরি বল খেলতে খেলতে মাঠ কাঁপালে। তাছাড়া পাড়ায়-পাড়ায়, শারীরিক উচ্চতায়, বয়সভিত্তিক ও বিবাহিত-অবিবাহিতদের মধ্যে টিম তৈরি করে খেলার মহড়া দিয়ে খেলা শিখতে হয়।
হাওরে খেলোয়াড় তৈরির ইতিহাস মসৃণ মাঠে কোচনির্ভর নয়। গরু চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে কিংবা কাজ ফেলে গোপনে-গোপনে তৈরি হতে হয় খেলোয়াড় হিসেবে। সকলে মিলে চাঁদা তুলে বল কিনে এবড়োথেবড়ো মাঠে খেলতে-খেলতে ভাঙা পায়ে জলপট্টি দিয়ে ফুটবলে লাথি মারতে শিখতে হয়। একজোড়া বুটজুতা কেনার জন্য কত-যে গল্প তৈরি হয় তা বলে শেষ হবার নয়। এভাবেই একটি গ্রামে তৈরি হয় একজন ফুটবলখেলোয়াড় আর একটি ফুটবলটিম।
খেলায় বিজয়ীদের উপহার দেওয়া হয় কাঠের ‘সিল’। কখনও তা স্বর্ণের অংশবিশেষ দিয়েও তৈরি হয়। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী (একটি দল) ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিপক্ষ গ্রামের (অন্য দল) সাথে জয়ের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। নিজেদের মধ্য থেকে উপযুক্ত খেলোয়াড় নির্বাচনে অযোগ্য মনে হলে ‘হায়ারি’ করে খেলোয়াড় বা দল আনা হয়। তাতে গাঁয়ের প্রতিটি ঘর থেকে উৎসবের আমেজে ধান সংগ্রহ করে অর্থের যোগান দেওয়া হয়। বিশেষ করে ফাইনাল খেলায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। মাঠ উপচে পড়ে দর্শক। নৌকা বোঝাই করে গাঁয়ের লোকজন খেলা দেখতে আসে। নৌকা আর লগি-বৈঠার মেলা জমে মাঠের চারপাশ ঘিরে। সকাল থেকেই মাঠে লোকজন জমতে শুরু করে। যদিও-বা খেলা বিকেলে শুরু হয়।
খেলা শুরু হওয়ার পূর্বে মাঠের বাইরে খেলোয়াড়গণ তাদের অনুশীলনের নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। এক্ষেত্রে ‘গেন্দা গউলি’-র বল ধরার যাদুকরি ভঙ্গিমা প্রদর্শন হলে তো কথাই নেই। মাঠে আসা দর্শক অনুশীলনেই তার পছন্দের খেলোয়াড় নির্বাচন করে নেয়। অনেক সময় পরে আসা লোকজন সঠিকভাবে খেলা দেখতে ব্যর্থ হয়। ছোট ছেলেমেয়েরা বড়দের কাঁধে চেপে খেলা উপভোগ করে। খেলা দেখার জায়গা দখল নিয়ে দর্শকের মাঝে ঝগড়াঝাটি হয়। মাঝেমাঝে খেলার হারজিত কেন্দ্র করে মারামারিও সংগঠিত হয়। আর এ-নিয়ে দর্শকদের মধ্যে নিরাপত্তার পূর্বপ্রস্তুতিও থাকে। প্রতিযোগী দলগুলোও প্রস্তুত থাকে মোকাবেলা করতে।
তবে বেশিরভাগ সময়েই ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই ঢলের পানিতে মাঠ তলিয়ে যায়। এমনও নজির আছে যে ফাইনাল খেলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। খেলোয়াড় দর্শক মাঠে আসতে শুরু করেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মাঠ ডুবে গেছে। মাঠের চারপাশে বেড়িবাঁধ দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। সকল আয়োজন ব্যর্থ। সামান্য পানির কাছে ক্ষোভের এবং অসহায়ত্বের যেন শেষ নেই। একদল উৎসাহী দর্শক তখন পানি-ওঠা মাঠেই ফুটবল-আনন্দে মেতে শখটুকু পুষিয়ে নেয় বা পুষিয়ে দেয়। ফলে প্রতিযোগিতাটি সারাবছরের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গ্রামবাসীর মাঝে পরবর্তী বছরের জন্য পদক্ষেপের ঐক্য তৈরি করে।
হাওরাঞ্চলে সাধারণত আঞ্চলিক খেলোয়াড়গণই খেলায় বেশি অংশগ্রহণ করে। এখন যদিও তা সীমানা ছাড়িয়ে বদলে গেছে। একসময় এলাকাভিত্তিক ভালো খেলোয়াড়দেরই কদর বেশি ছিল। বেশ টাকা সম্মানিও দেওয়া হতো তাদের। শুধু তা-ই নয় খাসি কেটে জামাই-আদরে খাওয়ানো হতো। হাওরবাসী যেখানে ছাই দিয়ে দাঁত মাজত খেলোয়াড়দের সেখানে টুথপাউডার দেওয়া হতো। সাধারণত গাঁয়ের ধনীমানি ব্যক্তির বাড়িতেই ‘হায়ার’ খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। কারণ খেলোয়াড়গণ সাধারণত খেলার একদিন পূর্বেই গ্রামে উপস্থিত হতো। এ-নিয়ে সারা গাঁয়ে আনন্দের হইচই পড়ে যেত। খেলোয়াড়দের দেখতে বা তাদের সাথে কথা বলতে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা যেন সুযোগের অপেক্ষায় থাকত। অভিভাবক মহল তাদের আপ্যায়ন নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকতেন, কেননা গাঁয়ের মান-সম্মান যে তাদের কাছেই নিহিত! খেলার মাঠ দূরে হলে একটি সুসজ্জিত নৌকায় গ্রামবাসী খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঠে যেত। খেলোয়াড়দের জন্য কাগজিলেবু, চকলেট ও কলসী ভরে টিউবওয়েলের পানি নেওয়া হতো মাঠে। খেলার হাফটাইমে এগুলো খেলোয়াড়দের দেওয়া হতো, যার অংশীদার অন্য কেউ হতে পারত না। শুধু তা-ই নয়, খেলোয়াড়ের নৌকায় সকলেই যাত্রী হতে পারত না। তাতেও খেলানির্ভর যোগ্যতার দরকার হতো। তবে অন্য নৌকায় বাকিরা যেতেন। গাঁয়ের বৃদ্ধলোক এবং মহিলাগণ খেলোয়াড়দের বিদায়বেলায় ঘাটে এসে বিদায় জানাতেন। প্রার্থনা করে প্রতীক্ষায় থাকতেন বিজয় সংবাদের। আর সে-বিজয় অর্জিত হলে সারা গাঁয়ে আনন্দের জোয়ার বইত। আনন্দমিছিল করতে করতে মাঠ থেকে তারা বাড়ি ফিরত। খেলোয়াড়দের জয়ের মালা পরিয়ে সম্মান জানাত। ‘সিল’ হাতে নিয়ে মিছিলে মিছিলে স্লোগান হতো —
২. জিতিলো রে ভাই জিতিলো / নগদাপাড়া জিতিলো।
৪. হারিলো রে ভাই হারিলো / বিশ্বনগর হারিলো।
৫. কয় গউলে হারিলো / দুই গউলে হারিলো।
৬. ডিফিট ডিফিট ডিফিট / বিশ্বনগর ডিফিট।
৭. কয় গউলের ডিফিট / দুই গউলের ডিফিট।
৮. উইনার উইনার উইনার / নগদাপাড়া উইনার।
৯. কয় গউলের উইনার / দুই গউলের উইনার।
১০. গউল দিয়াছি গউল দিয়াছি / কালো মাথায় হেড দিয়াছি …
তারপর গাঁয়ে ফিরে ঘরে ঘরে বিজয়ের ‘সিল’ নিয়ে আনন্দের ‘ছৈর’ দিত। সকলেই সিলের মাঝে (গলায়) সেফটিপিনে গেঁথে টাকা দিয়ে সম্মান জানাত।
এখন এসব আয়োজন বা আনন্দরথি নায়করা নেই। নেই সেই ভাটিগাঁয়ের মাঠে বাউশির টিম, গারো টিম, সুনামগঞ্জের সূর্যসেনা, লালদল, সবুজদল ও গেন্দা গউলি ‘হায়ার’ এনে খেলা।
একসময় সুনামগঞ্জের ভাটি ময়ালে ফুটবল খেলার ভালো খেলোয়াড়গণ ছিলেন : সৈয়দ আলী ও মহেন্দ্র সরকার, দুগনই, মধ্যনগর; পরিমল তালুকদার, হালিয়াহাটি, কলমাকান্দা; আকবর, তাহিরপুর; নিশি সরকার, চকিয়াচাপুর, ধরমপাশা; রুমালী, সাড়ারকোনা, মধ্যনগর; শ্যাম রায় ও সত্য রায়, বিশরপাশা, কলমাকান্দা; সোনামিয়া, ছালিউড়া, বারহাট্টা; নান্টু রায়, মধ্যনগর; আব্দুল জব্বার, আমজোড়া, মধ্যনগর; দেবেন্দ্র সরকার, নগদাপাড়া, মধ্যনগর; আজিজ, বৌলাম, ধরমপাশা।
রেফারি হিসেবে ড. ললিত রায়, ইটাউরি, মধ্যনগর; রসিক সরকার, নগদাপাড়া; মো. সামছুদ্দিন, বাদশাগঞ্জ; নিশি সরকার, চকিয়াচাপুর, ধরমপাশা প্রমুখ স্মরণযোগ্য।
এখন ভাটিগাঁয়ে আগের মতো খেলোয়াড় তৈরি হয় না। শুধু অভাব-অনটন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেই নয় জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলার দূরন্ত শৈশব যেন এখন সেজেগুজে ঘরে বসে মোবাইলে গেইম খেলায় ব্যস্ত। টেলিভিশনে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখে খেলোয়াড় হওয়ার আশা পোষণ করাই যেন শৈশবের দুরন্তপনা। তাই জাম্বুরা দিয়ে খেলা ফুটবলার কিংবা গেন্দা গউলি জন্মায় না। একসময় হাওরবাসী বিশ্বকাপ ফুটবল জানত না, দেখত না, কিন্তু ফুটবল খেলত। তাই বলতে হয় —
ভাটিগাঁয়ে আগের মতো ফুটবল খেলা নাই
চলো চলো গেন্দাভাইরা গাঁয়ে ফিইরা যাই …
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS