ছোটকাগজের মুখের দিকে দেখি

ছোটকাগজের মুখের দিকে দেখি

ঠিক কবে থেকে ফেসবুক/ফেসবুকিং শুরু হয়েছিল আমাদের দেশে জানি না, আন্দাজ করতে পারি। স্মৃতি রিকল করে দেখি যে ম্যালা টাইম চলে গেছে এরই মধ্যে। দেড়-দশক তো কমসেকম হবে। ২০০৯ বা ’০৮-এর দিকে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট/আইডি নিতে শুরু করে লোকে। এর আগে এত জনসমাগমের সোশ্যাল মিডিয়া বাংলায় ছিল না।

তারপরে একটা টাইমে এসে ফেসবুকে এমন কতিপয় ফিচার যুক্ত হয়, যেমন নোটস্ ও অন্যান্য অপ্শন্স, যা বাংলাদেশের লেখককুলের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এবং চর্চিতও হয়। এবং ব্লগিং ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে হারাতে একসময় হারিয়েই যায়। তার আগে নানান বিপ্লব ও বসন্ত ঘটিয়ে গেছে, এন্তার খুনোখুনি সমেত, বলা বাহুল্য। অন্য প্রসঙ্গ সেসব, অন্য নিবন্ধে আলাপ্য।

ওই শুরুর সময়টায় ফেসবুকে এমন প্রচুর পেইজের দেখা পাওয়া যেত যেইগুলায় লাইক বা ফলো করে যেত লোকে, দেখত, পড়ত, কন্ট্রিবিউট করত লোকে লেখা দিয়ে এবং/অথবা পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়ায় ফেবুকমেন্টস্ সেকশনে। যেমন, স্বদেশি-বিদেশি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশনের পেইজ, কবিতার পেইজ, বইরিভিয়্যু পেইজ ইত্যাদি। কালান্তরে বেবাক পর্যবসিত খাদ্য ও বস্ত্রসম্ভারের ফটোফুটানির মজমায়। তারপর তো পরাক্রমশালী টিকটক আর রিলস্ এসে অক্যুপাই করে ফেলে সবই। দৃশ্যের দেদার জন্ম হতে থাকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে, ফেসবুক ছাড়াও অন্য সমস্ত সোশ্যাল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, খাড়াইবার উপায় নাই।

তেমনই একটা পাতায় লাইক ও ফলো দিয়ে রেখেছিলাম ২০১৪/’১৫-র দিকে, পেইজ ক্রিয়েশন ডেইট দেখতে পাচ্ছি মার্চ ২০১৩, ‘ছোটকাগজের মুখ’ পেইজের নাম যার লাইকসংখ্যা ৮২৩ ও ফলোয়ারসংখ্যা ৮২০। অনেক দিন পরে কী ভেবে একবার বাংলায় ‘ছোটকাগজের মুখ’ টাইপ করে ফেবুসার্চ দিতে দেখি পেইজটা অ্যাভেইল করা গেল। বছর পর বছর ধরে এর আর বাড়বাড়ন্ত নাই। মৃত্যুও হয় নাই, ভাগ্য বলতে হবে, নইলে এই নিবন্ধ মুসাবিদায় বসতে পারতাম না।

থাকলে কী হবে, এর মূল কন্টেন্ট তথা ম্যাগাজিনপ্রচ্ছদের ইমেইজগুলা আর আপ্লোড করা হয় না তা বোঝা যায়। অ্যাডমিন যিনি, তার একটা কন্ট্যাক্ট নাম্বার দেয়া আছে। চাইলেই ফোন করা যায়। কিন্তু, সহজেই অনুমান করা সম্ভব এই ধরনের উৎসাহ কয়দিন যেতে না যেতেই মিইয়ে যায় কেন। সময়াভাব, লোকাভাব ইত্যাদি বিবিধ কারণ নিশ্চয় থাকে। যা-হোক, ‘ছোটকাগজের মুখ’ পেইজের অ্যাডমিন এলান করেছিলেন সূচনাদিনে —

বাংলাভাষায় প্রকাশিত ছোটকাগজের অনিন্দ্য সুন্দর মুখ দেখা যাবে এই পাতায়। ছোটকাগজের প্রচ্ছদ মানেই সৃজনশীলতার প্রকাশ। অজস্র কাগজ প্রকাশিত হয়েছে একসময়, এখনো হয়ে চলেছে, এগুলো তুলে ধরে একইসঙ্গে একটি বিশেষ সময়ের শিল্পচেতনা ও সময়্চিত্র, তুলে ধরে সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের নন্দনভাবনার পৃথকতা। আমরা কাগজগুলোর প্রচ্ছদে দেখে উঠি আমাদের ফেলে-আসা দিনগুলোর হাওয়াবাতাস, ওঠাবসা, স্বপ্ন ও জাগরণের চলচ্চিত্র। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এই দেশটাকে কেউ কেউ বলতেন ছোটকাগজের দেশ। মসজিদের শহর, রিকশার শহর, কাকের শহর, কবির শহর প্রভৃতি আদুরে ডাকনামের পাশাপাশি আমাদের প্রিয় রাজধানীর একটি নাম ছিল লিটলম্যাগাজিনের শহর। আজকাল আর সেই দিন নাই। কাক-রিকশা সবই আছে কেবল লিটলম্যাগাজিন বিলুপ্তির দরোজায়। বড় বড় কাগজ বাড়ছে, অনলাইনপত্রিকা বাড়ছে প্রহরে প্রহরে, কেবল ছোটকাগজ অনুপস্থিত। ফলে এই পাতায় সেই গৌরবউজ্জ্বল দিনগুলোই ফিরে দেখার একটা জানালা খোলা যাবে।

এই আশা ব্যক্ত করা হয়েছিল বটে পেইজ-অ্যাডমিনের তরফ থেকে, “এই পাতায় সেই গৌরবউজ্জ্বল দিনগুলোই ফিরে দেখার একটা জানালা খোলা যাবে”, একশ’/সোয়াশ’ ছবি আপ্লোডের পর আর ছোটকাগজের মুখ দেখাদেখি নাই দীর্ঘ দশক অতিক্রান্ত হলেও। গৌরবোজ্জ্বল সময়টা মাত্র শ’-সোয়াশ’ ছবি দিয়ে ক্যাপ্চার করবার উপায় নিশ্চয় ছিল না অ্যাডমিন বেচারার, জীবন ও অন্যান্য বাস্তবতায় জেরবার হয়ে শেষে ছেড়েই দিলেন বোধহয় লিটলম্যাগের দেখা-অদেখা কাভার ইমেইজ আপ্লোড করা।

আমাদের দেশে এমন একটা আর্কাইভ গড়ে তুলতে পারলে তো খুবই ভালো হয় যেখানে এককালের ট্রেন্ডি লিটলম্যাগাজিনের কাভারইমেইজগুলা পাওয়া যাবে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সহ। যদিও আর্কাইভিং খুবই শৃঙ্খলা আর সশ্রম সময়সাপেক্ষ একটা কাজ, একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, প্যাশন থাকলে একটা ভালো কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারে যে-কেউই ইন্ডিভিজুয়্যাল লেভেলে। একটা কমন হ্যাশট্যাগ দিয়েও ইনিশিয়েট করা যায় কাজটা। ফাইন্যালি একটা সময় আর্কাইভ সচল অবস্থায় গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করবে।

বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ আরও অনেক পাওয়া যাবে নিশ্চয়। আমরা চাইছি নিরবচ্ছিন্ন সচল একটা আর্কাইভ যেখানে থাকবে পাঠক ও দর্শকের সপ্রেম অংশগ্রহণ। ‘ছোটকাগজের মুখ’ ছাড়াও অন্যান্য যত উদ্যোগ থুবড়ে পড়েছে সেইগুলা একজায়গায় জড়ো করে একটা আর্কাইভ, মূলত ছোটকাগজপ্রচ্ছদের শোকেইসিং, করার কাজটা যারা নেবেন তারা কাজের কাজই করবেন একটা। সামনের দিনগুলায় লিটলম্যাগ জিনিশটা আরও উধাও হবে যখন, অতীতের গরবগাথা গাইবার গরজে হলেও প্রমাণগুলা সামনে প্রেজেন্ট রাখা দরকার। ‘ছোটকাগজের মুখ’ কথারম্ভে অ্যাডমিন আরও বলেন —

এই উদ্যানে মূলত প্রচ্ছদ ফুটবে, তবে প্রচ্ছদের ভেতরকার ফল-ফলাদিও যখন যতটা সম্ভব হবে রেকাবিতে তুলে দেয়া যাবে। এর পাশাপাশি নতুন ছোটকাগজ, প্রকাশিতব্য ছোটকাগজভিত্তিক প্রকাশনা প্রভৃতির খবরবার্তা রাখা হবে সকলের গোচরে। হে ছোটকাগজপ্রেমী ফেসবুকবন্ধুগণ, আপনিও এই পাতার একজন সম্ভাব্য প্রদায়ক ও পৃষ্ঠপোষক। যোগাযোগের সব উপায় এখন আমাদের আঙুলের ডগায়। আসুন, মুখ দেখি পরস্পর, ভাগ করি সুখ-দুঃখ ছোটকাগজের।

দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ শেষবার পোস্ট তোলা হয়েছিল, তবে সেইটা থিম্যাটিক কন্সার্ন থেকে নয়, একটা সাইটের প্রমোশন্যাল পোস্ট। সম্ভবত পেইজচালক প্রবাসে চলে যাওয়ায় পেইজের গতি স্তিমিত হলেও পুনরায় তার পূর্ণ উদ্যমে প্রত্যাবর্তন ঘটবে না তা নয়। আশাবাদী থাকা ছাড়া আর কী করণীয় আছে আমাদের, এই জিজ্ঞাসা এই খেদকথা আজ নয়।

আরেকটা ব্যাপার ভাবছিলাম, বাংলাদেশ অংশে বেরোনো ছোটকাগজের সংখ্যা আসলে কত? কয়েক হাজার? না লাখ? ছোটকাগজের সংজ্ঞা, ক্যারেক্টার ইত্যাদি জিনিশ নিয়া জাবর না কাটি আর। অন্তত হাজার দশেক প্রচ্ছদচিত্র উত্তোলন করা গেলে একটি ইউজারফ্রেন্ডলি আর্কাইভ হতে পারে।

পেইজের নাম নিয়া ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হলো, ছোটকাগজের মুখটা ছাড়া তার গায়ের গতরের কোন জিনিশটা আর উপভোগ্য? মুটকা, মাথাপাৎলা, আখাম্বা লঙ্গরখানার লেখক নিয়া আউট-হওয়া কাগুজে প্রকাশনা-প্রোডাক্টের কোন জিনিশটা পাঠকের জ্যান্ত মননসৃজন তৃপ্ত ও আকৃষ্ট করতে কাজে লাগে আজ আর, এই ইলেকশনের দেশে এই নির্বিবেক নৈরাজ্যনরকে?

সেই দিন আর নাই লিটলম্যাগের, সম্ভবত, ফিরবে বলেও মনে হয় না আর। ক্রমশ ছোটকাগজ হয়ে উঠেছে অপ্রাসঙ্গিক, অকারণ, অপাংক্তেয়। কাজেই, স্মৃতি রোমন্থনের জন্য হলেও প্রচ্ছদ ও তথ্যকণিকা নিয়া আর্কাইভ করা যায় অ্যানিটাইম। আর তা দরকারও। অনলাইন দুনিয়ার আগে মানুষ মনের ভাব ও অভাব-অনটন প্রকাশ করত যে-কয় মিডিয়ায়, লিটলম্যাগ সেখানে ছোট্ট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ অংশবিশেষ।

সুবিনয় ইসলাম / জুন ২০২৩


গানপারে লিটলম্যাগ

COMMENTS

error: