দুইহাজার চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কর্ণধার নরেন্দ্র মোদীর চারশো পার আসন জিতে মসনদে বসার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ছিল। নির্বাচনী জনসভায় দম্ভ ভরে আব কি বার, চারশো পার আওড়েছেন বহুত। ব্রুট মেজরিটি দূরে থাক, একলা সরকার গঠনে জরুর ২৭২ আসন জিতে আসতে পারেনি তাঁর দল। চারশো পারের ঢপবাজি ২৪০-এ পৌঁছে দম হারিয়েছে। চন্দ্রবাবু নাইডু সহ শরিকদলে ঠেকনা দিয়ে আপাতত মসনদে বসেছেন নিজেকে সাক্ষাৎ রামঅবতার ঠাউরানো মোদীজি। বসেছেন ঠিকই কিন্তু খুশহাল যে নেই সেটি খোলা চোখে ঠার করা যাচ্ছে। বিগত লোকসভায় শোচনীয়ভাবে বিধ্বস্ত বিরোধী শিবিরের জন্য দুইহাজার চব্বিশকে পয়মন্ত মানতে হবে। ভালো ফলাফল তুলে আনতে পারায় হ্যাপি মুডে আছেন তারা। সংসদ অধিবেশেনে বিজেপিকে তাক করে বিরোধী শিবিরের লাগাতার বাক্যবাণ থেকে আক্কেলমন্দরা বিষয়টি ভালোই আঁচ করতে পারছেন। মোদীর ভাষায় বালকবুদ্ধি রাহুল গান্ধীকে বেশ পরিপক্ক লাগছে দেখে। লক্ষ্য অর্জনে কংগ্রেস মুখপাত্র আগের তুলনায় ঢের সংহত। নির্বাচনী সভায় বোন প্রিয়াঙ্কা মুখ ফসকে দু-একবার নেহেরু পরিবারের গুণগান গাইলেও রাহুল সে-পথ মাড়াননি। জনসমক্ষে নেহেরু পরিবারের লিগ্যাসি জাহির থেকে বিরত থাকা সমীচীন ভেবেছেন কংগ্রেস-কাণ্ডারি। আপামর জনমনে প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিতে রাহুল এক ধাপ হলেও আগে বেড়েছেন তাতে সন্দেহ নেই।
মোদীজির হিন্দুত্ববাদকে কটাক্ষ করে সংসদে বিরোধী শিবিরের কামানদাগা নতুন নয়, তথাপি উন্নয়নের ডঙ্কা বাজানোর মিশনে ভারতবর্ষের আনাচ-কানাচ নিজের গুম্ফশোভিত ছবি দিয়ে ভরিয়ে তোলা সরকারপ্রধান ভালোই কট খেয়েছেন বোঝা যায়। আরে হাম তো ফকির আদমি হ্যায়, ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে জি;—নির্বাচনী জনসভায় কথাটি মোদীজি জাঁক করে হামেশা আওরেছেন। রেটোরিকঠাসা বাগাড়ম্বরকে তোল্লাই দিতে সৃষ্ট মোদীমিথ বিগত লোকসভায় ভালো বাজার পেলেও চব্বিশে হালে পানি পায়নি। আফটার ইলেকশন, দিল্লীর মসনদে উপবিষ্ট নরেন্দ্র মোদী যেন-বা অতীত মোদীর ছায়া! কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হয়েছে। মুখের রেখায় জবরদস্ত আত্মবিশ্বাস আগের মতো প্রখর নেই। ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসির ছটা থেকে ছিটকে বেরোনো উপহাস অনেকটা ম্রিয়মাণ। এই মোদীকে বেবাক বিশ্ব কবে দেখেছে সে এক প্রশ্ন বটে!
তৃণমূল কংগ্রেসে নবীনা মহুয়া মৈত্রদের মায় বরদাস্ত করতে বিব্রত দেখাচ্ছে তাঁকে। ডরিয়ে মাত স্যার…যাইয়ে মাত…শুনকে তো যারা..;—কৃষ্ণনগর থেকে জিতে আসা কাছাড়কন্যা মহুয়ার বামাকণ্ঠে হানা বিদ্রুপ এড়াতে মোদীকে সংসদ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখলেন সবাই! মহুয়াকে কি তবে রাহুলের মতোই বালকবুদ্ধি ঠাউরে সংসদ থেকে বেরিয়ে গেলেন ইয়োগা ফ্রিক মোদী? হতে পারে, যদিও তাঁর এই বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে বিগত দিনের কনফিডেন্স বিশেষ বেঁচে নেই! খুচরো এসব উপলক্ষের উল্লেখ মানে কিন্তু এই নয়, মোদী-ম্যাজিক ভারতে খতম হতে চলেছে। কাণ্ডটি সহসা ঘটছে না বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জরুরত পড়ে না। বিব্রত মোদী বরং ভিতরে-ভিতরে তেতে আছেন। নতুন ছক কষছেন নির্ঘাত। বালবুদ্ধি রাহুল-মহুয়াদের ভুলের অপেক্ষায় আছেন নীরব। তিনি জানেন তারা ভুল করবে আর সেই ভুলকে অ্যানক্যাশ করে ভারতবাসীর দিল জিতবে বিজেপি। রাজনীতির লম্বা সফরে তাঁর ঝুলি অভিজ্ঞতায় ঠাসা। লোকসভায় লস যা হবার হয়েছে, এখন সেটি পুষিয়ে নিতে অটল ধৈর্যের পরিচয় দিবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিরোধী শিবিরকে শিকার বানানোর মওকা চুনতে নতুন চাল ভাবছেন ভারতশাসক। দলের মধ্যে কাজেই সংস্কারের ঘোষণা আসতে পারে সহসা।
সামনে কী ঘটতে চলেছে সেটি এই মুহূর্তে আন্দাজ করা কঠিন। আপাত স্বস্তি এটুকুন,—ভারত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে অনেক আগে নরেন্দ্র মোদীর বারফট্টাইয়ে লাগাম টানা জরুরি ছিল। অমর্ত্য সেন আর অরুন্ধতী রায়ের মতো নাগরিকরা রীতিমতো বিবেকযাতনায় তড়পাচ্ছিলেন এতদিন। উনাদের স্বস্তি দিতে রাহুলসহ বিরোধী শিবির চব্বিশের নির্বাচনে বুঝেশুনে পা ফেলেছেন। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতকে বিশ্বজুড়ে বিপণনের তরিকা যদি ধরে নেই বানোয়াট ছিল না, তথাপি এর অন্তরালে যেসব অনাচার রাবণের দশমাথা হয়ে বিকট আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, তো এই আতঙ্ককে জনগণের নজরে আনতে উনারা একাট্টা হয়েছিলেন। ইন্ডিয়া জোট গঠনের সংকল্পে দূরদর্শিতার ছাপ ছিল। আদানি-আম্বানিদের পকেটে উন্নয়নের মেওয়া ভরে দিলে কী হবে, এর ধকল সইতে লাচার দারিদ্র্য আর সাম্প্রদায়িক বৈরিতায় জেরবার ভারতবর্ষে দশমাথা রাবণ সমতুল মোদীমিথ-এ কুঠার হানতে সংকল্পটি কাজে দিয়েছে।
ইলেকশনের দিন ঘনিয়ে আসার প্রহরে গায়ে দুর্নীতির লেবেল সাঁটা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গরাদে ভরেন মোদী। নির্বাচনের মাঝপথে দুদিনের জামিনমুক্ত কেজরিওয়ালকে দেখে বেচারা ইমরান খান মনে হচ্ছিল। দলের হয়ে জনসভায় আগুন ঝরানোর মওকা ইমরানের ভাগে জোটেনি। দিল্লিতে কেন্দ্রীভূত আসন দখলে নেওয়ার মতলবে কেজরিওয়ালকে অনুরূপ ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা নেভাতে মজবুর করেন মোদী। জামিনমুক্তির ফোকর গলে আম আদমি প্রধান যদিও দু-একটি জনসভায় হাজিরা দিতে জোর চেষ্টা করেছেন। সখেদে কিছু কথা বলেছেন তখন, যার সারার্থটি ছিল এ-রকম :
একটা সময় ছিল যখন ভারতের গণতন্ত্র বা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অনুসরণীয় মনে করত। দিন পাল্টেছে। ইলেকশন জিতে আসার তরিকা এখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে শিখছেন মোদীজি। পাকিস্তানে ইমরান খানকে তারা অকেজো করে দিয়েছে আর বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয় না, সেখানে যা হয় সেটি হলো প্রহসন! হাসিনাজির কাছ থেকে মোদীজি এলেমটি রপ্ত করার তালে আছেন।
কেজরিওয়ালের হুলমাখানো রেটোরিক কী এমন মিছে! ভোটরঙ্গের নাটক সাজিয়ে ক্যামনে সংসদে বসা যায় সে-গুপ্তবিদ্যা বাংলাদেশের মতো কে আর শিখাতে পারত তাঁকে! কেজরিওয়ালকে জেলে ভরার কূটচাল মোদী পাকিস্তান থেকে নিয়েছেন ধারণা করি। নির্বাচন কমিশনকে ম্যানেজে রাখার তরিকা বাংলাদেশ থেকে ধার নিতে ত্রুটি করেননি মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস, আম্বেদকর আর টিএন সেশানের মতো ব্যক্তিরা ভারতের সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে বিস্তর খেটেছিলেন! বাংলাদেশ থেকে শেখা গুপ্তবিদ্যা যারপরনাই মোদীর কাজে আসেনি। উনার এইসব উপরচালাকি ধরিয়ে দিতে বিরোধী শিবিরকে চব্বিশে সুগঠিত দেখেছে বিশ্ব। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর অতিমানব ইমেজকে জনসমক্ষে খুল্লামখুল্লা ধুয়ে দিতে এই সংহতি অবদান রেখেছে।
এর সঙ্গে ছিল বিজেপিসৃষ্ট গোদিমিডিয়ার মোকাবিলা। ভারত রাষ্ট্রের মশহুর কত না আদমি সে-মিডিয়ার পদতলে নিজ বিবেক জলাঞ্জলি দিয়েছেন বিগত এক দশক! ভারতবর্ষে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার যজ্ঞে মোদীজিকে অবিকল্প ও মহান রটনায় সুনিপুণ গোদিমিডিয়ার গোমর ফাঁসের ঘটনায় বিরোধী শিবিরকে যদিও সফল মানা যাচ্ছে না। উনাদের এরকম কোনো মিডিয়াযোদ্ধা ছিল না যারা এই মিথে কুঠার চালানোর শক্তি রাখে। চব্বিশের নির্বাচনে মারাত্মক সক্রিয় গোদিমিডিয়াকে মোকাবিলার নিয়ামক শক্তি অন্য উৎস থেকে নাজিল হয়েছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে মুক্তমাধ্যমের পরিসর বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক হওয়ার ঘটনা এ-যাত্রা বিরোধী শিবিরকে ঊনিশের মতো আরেকবার চিৎপটাং হওয়ার দুর্গতি থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। সমাজমাধ্যমে সক্রিয় পরিসরটি হচ্ছে দুধারী তলোয়ার! মোদীমিথকে কেন্দ্র করে সচল হাইপ জনমনে অকাট্য করতে বিজেপি প্রণীত গোদিমিডিয়া তাকে ব্যাপক কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে মোদীমিথ-এ যাদের ইমান নেই তারা বিরোধী শিবির কী করে সে-অপেক্ষায় বেকার বসে থাকেননি। দেশ বাঁচানোর দায় নিজহাতে তুলে নেওয়ার তাগিদ বোধ করেছেন। মোদিমিথ নামক হ্যাংওভারের কুফল জনসমক্ষে তুলে ধরতে মুক্তপরিসরকে কাজে লাগাতে ইতস্তত করেননি। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচন এদিক থেকে অনন্য বৈকি!
ফ্যাক্ট নির্ভর কন্টেন্টের কারণে সমাজমাধ্যমে সুপরিচিত ধ্রুব রাঠির মোদীবিরোধী তৎপরতাকে এহেন Self driven move-এর আপাত নজির গণ্য করা যেতে পারে। সমকালীন ও ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু নিয়ে তথ্যঠাসা কন্টেন্টের কারণে অনেকে তাঁকে পছন্দ করেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের ভিউ ও সাবস্ক্রিপশনের বহর যারপরনাই ঈর্ষণীয়। চব্বিশের লোকসভাকে পাখির চোখ করেছিলেন জার্মানপ্রবাসী যন্ত্রপ্রকৌশলী। মোদীমিথ বজায় রাখার যজ্ঞে নিয়োজিত গোদিমিডিয়ার কাজকারবার ও এসবের কজ এ্যান্ড ইফেক্টকে দেশবাসীর নজরে আনার ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগ বৃথা যায়নি। নির্বাচনের ফলাফল সে-ইশারাই দিচ্ছে আপাতত।
ইলেকশনের পুরোটা সময় ধরে ধ্রুব রাঠির তৈরি কন্টেন্ট গলার কাঁটা হয়ে বিজেপিকে অস্বস্তিতে রেখেছিল। ভারতের নগর-মহানগর থেকে শুরু করে গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রজেক্টর লাগিয়ে বিরোধীরা তাঁর কন্টেন্টগুলো প্রচার করেছেন। মূলধারার গণমাধ্যম খোদ-বা-খোদ ভারতে নিজের ইজ্জত খুইয়েছে, অথচ দেড় দশক বা আরো কয়েক কদম পেছনে পা রাখলে তেহেলকাকে দেখতে পাচ্ছি। ভারতীয় ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষফোঁড়া তারাই প্রথম ফাঁস করেছিল। বিশ্ব তোলপাড় ঘটনায় মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাদেজা থেকে হানসি ক্রনিয়ের মতো ক্রিকেটহিরোদের রাতারাতি ভিলেনের নিয়তি মেনে নিতে হয়। ক্রিকেটপাগল ভারতের আমজনতাকে স্বস্তি দিতে বোর্ড ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগের হিড়িক দেখা গিয়েছিল। এখানে শেষ নয়। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদীজির দায়িত্ব পালনের জামানায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেপথ্য কুশীলব ও কার্যকারণ জনসমক্ষে তুলে আনে তেহেলকা। বিবিধ কারণফেরে সংবাদমাধ্যমটি পরে বিতর্কিত ও নিস্তেজ হয়ে আসে। তবু মনে রাখতে হচ্ছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় তার সাহসী আবির্ভাবের নেপথ্যে ভি. এস. নাইপল, অরুন্ধতী রায়সহ অনেকে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন। একটা সময় পর্যন্ত তেহেলকা উনাদের ব্রেইনচাইল্ড ছিল। কমিটেড জার্নালিজমের দিন ভারতবর্ষে আগের মতো জীবিত নেই আর! ওসব নজিরকে হিমঘরে পাঠানো গণমাধ্যমের গায়ে বরং মোদীবন্দনার বেশরম রং অকাট্য দেখছি। ধ্রুব রাঠির উদয় হয়তো-বা এই শূন্যতা পূরণের দায় থেকেই ঘটছে।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিপুষ্ট সমাজমাধ্যমে (ধ্রুবর ভাষায় হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি) সক্রিয় প্রোপাগান্ডা মেশিনের মোকাবিলার ধ্রুব রাঠির একলা জিহাদ এতটা আবেদন রাখবে কেউ ভাবেনি। কোটি-কোটি তরুণ ভোটারকে প্রভাবিত করেছেন এই যুবা। পাকিস্তানের চরকে পেইড এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে বিরোধী শিবির;—অভিযোগটি গোদিমিডিয়া তুলেছিল জোরেশোরে। ঘটনা যদিও সেরকম কিছু ছিল না। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন এই যুবক। ভারতরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজ দায়িত্ববোধকে বড়ো করে দেখেছেন তিনি। ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের বেহাল দশাকে রেখেছেন সুবিবেচনায়। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, বাবা সাহেব আম্বেদকর থেকে জওহরলাল নেহেরুর মতো নেতাদের ধারাবাহিক অবদানে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক পরিসর নিয়ে নানা মুনির একশো মত থাকলেও সর্বভারতীয় সংহতিকে এটি সবসময় প্রাধান্য দিয়েছে। মোদীমিথকে তোল্লাই দিতে পেরেশান গোদিমিডিয়ার জালিয়াতি তুলে ধরার ছলে ভারতের মতো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে একইসঙ্গে বর্ণিল ও সংক্ষুব্ধ দেশে সংহতি কেন জরুরি সেটি পুনরায় দেশবাসীর নজরে আনাটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। ধ্রুব রাঠির জিহাদকে যে-কারণে কোনো একটি পক্ষের হয়ে ভাড়া খাটার মিশন নামে দাগানো যাবে না।
ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া এক ডিক্টেটরের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন ধ্রুব। তিনি দাঁড়িয়েছেন হিন্দুত্বের নামে ছড়ানো সম্প্রদায় ও জাতিবিদ্বেষের লেলিহান সর্বনাশের প্রতিপক্ষ হয়ে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিগত দুই দশক ধরে অতিকায় যেসব প্রোপাগাণ্ডা মেশিন দেশের মাটিতে বপণ করেছিল, দূর জার্মানিতে বসে এর বিরুদ্ধে লড়েছেন নির্বাচনের পুরো মেয়াদকাল। তাঁর এই জঙ্গে আমাদের এখানকার সরকারবিরোধী ইনফ্লুয়েন্সারদের মতো বাজে বকুনির বাহার চোখে পড়েনি। মোদিমিথকে আঘাত হানতে যেয়ে যেসব আলামত পেশ করেছেন তার কোনোটাই মুখরোচক চাটনি ছিল না। ফ্যাক্ট এন্ড লজিক-এ ভর দিয়ে মোদীজির গোমর ফাঁস করেছেন কেবল। এর জন্য দিগগজ বিদ্বান হতে হয়নি তাঁকে। ধ্রুবর সোর্স অব ইনফরমেশন সাদামাটা। গুগল মামা, উইকিপিডিয়া আর খবরের কাগজে ছাপানো ফুটেজ ব্যবহার করেছেন তিনি। সঙ্গে চ্যাট জিপিটি ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ক্লিপস আমলে নিতে দ্বিধা করেননি। সূত্রগুলোকে লবজ করেছেন। ফ্যাক্ট চেকিংয়ের তরিকা মেনে উৎসের সত্যতা যাচাইয়ে ফাঁক রাখেননি। যুক্তিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে একটির সঙ্গে আরেকটি জুড়েছেন সুনিপুণ। যারা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাদের জবাব দিয়েছেন ফ্যাক্ট এন্ড লজিক-এ দাঁড়িয়ে। তাঁর এই খাটাখাটনি আখেরে বৃথা যায়নি। কোটির ওপর ভিউ পেয়েছেন নিয়মিত। গোদিমিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদ তরুণ প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে। প্রবীণ প্রজন্মের অনেকে চা-বিক্রেতার মিথ বেঁচে খাওয়া মোদীজির দিকে তির্যক সন্দেহে তাকানোর কথা একবার হলেও ভেবেছেন। মূলধারার গণমাধ্যম যে-কারণে ধ্রুব রাঠিকে আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচনের পুরো সময় জুড়ে তাঁকে নিয়ে নিউজের কমতি ঘটেনি।
একচ্ছত্র ক্ষমতা কায়েমের মতলবে যে-সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সে আসলে ভয়ানক সত্তায় নিজের রূপান্তর ঘটায়। তার ইতরামি ক্রমশ জঘন্য ও সুচতুর মোড় নিতে থাকে। এখন তাকে প্রতিহত করেতে যেয়ে নিজেকে সাক্ষাৎ ইতরের পর্যায়ে নামিয়ে আনায় ফায়দা মিলে না। লোকজনের বাহবা জুটলেও ইতরের গলায় শিকল পরানোর স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যায়। ফাঁকতালে প্রকৃত বিষয়গুলো চাপা পড়ে। আসল ছেড়ে নকলি নিয়ে শোরগোলের মাতমে জনমনে সেগুলোর প্রভাব নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। বাংলাদেশে হরহামেশা ঘটতে থাকা সরকার বিরোধী তৎপরতাকে এর সাক্ষাৎ নজির বলা যায়। বিরোধী শিবির থেকে আরম্ভ করে সমাজমাধ্যমে নাম কেনা ইনফ্লুয়েন্সারদের সরকারবিরোধী কাণ্ডে শূন্যগর্ভ বকুনি ছাড়া কিছু কি জোটে? ক্রুড ফ্যাক্ট সেখানে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নিরিখ করলেও মিলবে কিনা সন্দেহ! ধ্রুব রাঠির ফ্যাক্ট নির্ভর এ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে বাংলাদেশী ইউটিউবারদের তফাত যে-কারণে আকাশ-পাতাল।
আমাদের এখানটায় সরকারযন্ত্রকে ন্যাংটো করতে মশগুল গাদাগুচ্ছের পডকাস্ট আর চটকদার ব্যানারে সয়লাব ভিডিওতে ইতরামির বাহার চোখে পড়লেও ভিতরটা ঠনঠনে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বারোটা বাজানো সরকারকে তুলোধুনা করার মতো সলিড তথ্য-যুক্তির খরা চোখকে পীড়িত করে। পিনাকী নামের প্যানিকরা এখানে ক্লিকবেইটের কারবারি। কপালপোড়া এই দেশে সরকারের হাজারো ইতরামি ঠেকানোর নামে নিজেকে ইতর করে তোলার অ্যাক্টিভিজম জনতার কাছে ডেলি বিক্রি করেন! পকেটে কিছু ডলার ঢোকে। বাংলাদেশের সরকারযন্ত্রকে ন্যাংটো করতে জোশাল ইউটিউবার ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে ধ্রুব রাঠির তুলনা যারপরনাই অবান্তর। ধ্রুব তাঁর শ্রোতা-দর্শককে ফ্যাক্ট চেকিংয়ে কৌতূহলী রাখেন। তর্কে জড়ানোর আগ্রহ বজায় থাকে সেখানে। শ্রোতা-দর্শক অজান্তে তাঁর ফ্যাক্টগুলোর তদন্ত সেরে ফেলে। মগজের নিউরনকোষে সাচ্চা উপলব্ধি যোগ হয়। ক্লিকবেইটের কারবারি কারো পক্ষে কম্মোটি সম্ভব নয়। ধ্রুব রাঠির একলা জিহাদ আখেরে কতটা দূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে সেটি বলা কঠিন। মোদীসৃষ্ট গোদিমিডিয়া তো আর বসে নেই! ভয়াল হয়ে ফেরত আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিপরীত দিকটাও সেইসঙ্গে স্মরণে রাখতে হচ্ছে, ধ্রুবর মতো তরুণরা ভারতে সংখ্যায় কম নয়। তথ্য ও যুক্তিকে মারণাস্ত্র করে পালটা আঘাত হানতে দেরি করবে না।
গণতন্ত্রের মোক্ষ নিয়ে প্রশ্ন সমাজে চিরকাল ছিল। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় পুওর ইকনমিকস কিতাবে ফ্যাক্ট নির্ভর লজিকে দাঁড়িয়ে বলতেই পারেন,—স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতি একটি দেশের জন্য সমস্যা হলেও তার অর্থনৈতিক তরিক্কি লাভের ঘটনায় অন্তরায় নয়। তাঁর যুক্তির সারবত্তা স্বীকার গেলেও মনে রাখা প্রয়োজন,—অর্থনৈতিক তরিক্কি কোনো জাতি ও সমাজের কোয়ালিটি মিজারমেন্টের নিয়ামক হতে পারে না। তরিক্কির আড়ালে ঘটতে থাকা অনাচারকে মানুষ যখন নীরবে সহ্য করে ও একসময় বৈধতা দিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তখন তার মেরুদণ্ড নড়বড়ে হয়ে পড়ে। জাতি হিসেবে নিজের বৈধতা হারায় সে। সুতরাং দুর্বল গণতন্ত্রও সই যদি সেটি অতিকায় বৈষম্যের বিকল্প হিসেবে বাস্তবানুগ ভারসাম্যে স্থিত থাকার কথা ভাবে। নিজেকে জবাবদিহিতার অধীন বলে মানে। দুইহাজার চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে ধ্রুব রাঠির একলা জিহাদ এই জায়গা থেকে দেখলে মূল্যবান মনে হবে।
ভারত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র শত কার্যকারণদোষে বিপন্ন, প্রশ্নবিদ্ধ হলেও একজন ধ্রুব রাঠিকে লড়াইয়ের পুঁজি এনে দিতে পেরেছে। আমাদের এখানে ওসবের বালাই নেই। সবটাই উপর-উপর! ভাসা ভাসা আবেগ আর মতলববাজ লোকজনে ঠাসা এক সমাজের জানালা দিয়ে দ্বন্দ্বসংক্ষুব্ধ গ্রহে নিজেকে দেখছি! আমাদের স্নায়ুমজ্জাকে সতেজ করে তোলার পরিসরকে যেখানে ক্রমাগত হত্যা করা হচ্ছে! হত্যা ঠেকানোর জন্য দেখা মিলছে কি কোনো ধ্রুব রাঠির? বাজে বকুনি বাদ দিয়ে যে কিনা তথ্য আর যুক্তিঠাসা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষাতে পারবে গদিনশিন এক-একটি সরকার ও তার ইবাদতে মশগুল তাঁবেদার গোদিমিডিয়ার গালে?
প্রাসঙ্গিক লিঙ্কগুলো
- How Millions of Indians were BRAINWASHED? The WhatsApp Mafia – Dhruv Rathee
- Reality of Narendra Modi: How Indians were Fooled! – Dhruv Rathee
- III. The Narendra Modi Files: A DICTATOR Mentality? – Dhruv Rathee
- Is India the Vishwaguru? PM Modi vs PM Nehru: Report Card – Dhruv Rathee
- Electoral Bonds Scam: The Pharma Files – Dhruv Rathee
- India Needs Jobs! | Reality of Unemployment Crisis – Dhruv Rathee
- Arvind Kejriwal Jailed! DICTATORSHIP Confirmed? – Dhruv Rathee
- Operation Kalank (Gujarat Riots) : Tehelka Documentary
- Fallen Heroes: The first sting on match fixing: Tehelka
- Who is Dhruv Rathee? From Modi fan to Indian PM’s most formidable critic : Al Jazeera
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS