আবির্ভাবকাল বিবেচনায় নিয়া বাংলাদেশের (এবং বাইরেরও) কবিদের একেকটা আলাদা দশকের ঘেরে চেনানো হয়। এইভাবে হিসাবকিতাব শুরু হয়েছে বেশিদিন আগে নয়, থার্টিস থেকে, গেল-শতকের তিরিশের দশক থেকে। এর আগে এমনটা দাগাদাগি করার দরকার পড়ে নাই বোধহয়। যেমন আমরা বলি তিরিশের কবি, চল্লিশের কবি, পঞ্চাশের বা ষাটের কবি। ঠিক এইভাবে গুনে গুনে আপন মাহমুদ শূন্য দশকের কবি। এইটা নিয়াও পণ্ডিতি আছে ফিল্ডে, অ্যাট-লিস্ট ছিল, এই কিছুদিন আগেও। শূন্য দশক বললে নাকি কী কী সব সমস্যা, আজাইরা, কাজেই বলতে হবে প্রথম দশক। ইত্যাদি ক্যাচরম্যাচর এখন আর নাই। ইদানীং মাওসুম বিগড় গায়া। বাস্তবিক দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ এমনকি পঞ্চম দশকের কবিরাও বর্তমানে একলগেই লিখছেন (যদিও দ্বিতীয় দশকের শেষবর্ষ ২০২০ এখন অন্তিমে এবং গণিতবিচারে তৃতীয় দশক প্রারম্ভমুহূর্ত) অথচ দশক দিয়া আলাদা বিবেচিত হচ্ছেন না। যার যার কবিতা নিয়াই নিমগ্ন সবাই, কিংবা যার যার ছোট ছোট বলয়ের অ্যাজেন্ডা।
আপন মাহমুদ আবির্ভাবের সময় বিবেচনায় শূন্য/প্রথম দশকের কবি। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে এই কবি ইন্তেকাল করেন। তখন পর্যন্ত কবির প্রকাশিত একটিমাত্র বই — ‘সকালের দাঁড়িকমা’ — আর কিছু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গদ্যনিবন্ধ ও কবিতা। মৃত্যুর কয়েক বছর পরে কবির বন্ধুদের উদ্যোগে একটি প্রকাশনী থেকে বেরোয় ‘আপন মাহমুদ সমগ্র’। মোটামুটি আপন মাহমুদের সমস্ত লেখাপত্র এই বইটায় অ্যাভেইল করা যায়। কিছু হয়তো রয়ে যেতে পারে এখনও অপ্রকাশিত, তবে সে-খবর আমাদের অজানা।
আবুল হাসানের সেই লাবণ্য-ধরা পাথরপ্রতিমার কথা আমাদের মনে পড়ে যায় আপন মাহমুদের সাক্ষাতে, ‘সে এক পাথর কেবলই লাবণ্য ধরে’, আপনের স্বরভঙ্গি স্নিগ্ধ মনখারাপের একটা আবহ সবসময় হাজির করে আমাদের সামনে, যেমন করে আবুল হাসানের কবিতা। ব্যক্তিক বীক্ষণ ও প্রণয়পীড়িত প্রজ্ঞা তার কবিতায় এমন একটা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, যা পাঠককে দাঁড় করায়, আলতো নিঃশ্বাসে পেছনপথে পৌনঃপুনিক দৃষ্টি বহায়। আপন মাহমুদের বন্ধুরা তার আকস্মিক ইন্তেকালের পর সশ্রদ্ধ সপ্রেম স্মরণ করেছেন জাতীয় গণমাধ্যমগুলায় তাদের অকালপ্রয়াত বন্ধুটিকে এবং বিশেষভাবেই ওয়েবম্যাগগুলায় আপন মাহমুদ স্মরণসংখ্যাও হয়েছে দেখতে পেয়েছি।
রিসেন্টলি আপন মাহমুদের মৃত্যুদিনে সোশ্যাল সাইটগুলায় পাঠক ও লেখকেরা আট বছর আগের একটা ক্লাউডি দিনে প্রয়াত কবিকে যেভাবে স্মরণ করেছেন, দেখে মনে হয়েছে আপনের কবিতাকলা আরও বহুকাল বুঁদ রাখবে বাংলা ভাষায় চিত্রকল্পনানুরাগীদের।
এইখানে আমরা আপন মাহমুদের কিছু কবিতা সংকলিত করতে চেয়েছি শুধু। কবিতাগুলা আমরা নিয়েছি আট বছর আগের একটা কাগজের ক্রোড়পত্র থেকে, সেইসঙ্গে একটা নাতিদীর্ঘ নিবন্ধগদ্যও। ‘অর্কিড’ নামে এই পত্রিকাটি লিটলম্যাগধাঁচে বেরোত, বা বাইর হয় এখনও, সম্পাদক সৈয়দ আফসার কন্সেন্ট দিয়েছেন তার পত্রিকার কন্টেন্ট গানপারে ব্যবহার করতে।
লেখাগুলা আমরা পাচ্ছি কবিতাকাগজ ‘অর্কিড’ দ্বাদশ বর্ষ ষষ্ঠ খণ্ডে। এর প্রকাশকাল ছিল ২০১২ সেপ্টেম্বর ১৪১৯ ভাদ্র। পত্রিকার এই খণ্ডটা প্রকাশের ঠিক শেষমুহূর্তে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২ আপন মাহমুদ ইন্তেকালের খবর পেয়ে প্রেসমেশিনে প্রিন্ট স্থগিত রেখে আধফর্মা বা আটপৃষ্ঠার ম্যাটার বাড়ানো হয়, যুক্ত হয় একটি ট্রিবিউটপ্রোজ্ ও এগারোটি কবিতা, আর ফ্যুলপেজ একটা পোর্ট্রেট চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রাজন অঙ্কিত; গৃহীত কবিতাগুলো ছোটকাগজেরই বিভিন্ন ভল্যুম থেকে কালেক্ট করা হয়েছিল। যদিও আপন মাহমুদের অভিষেক কবিতাবই ‘সকালের দাঁড়িকমা’ পাব্লিশড ততদিনে, তক্ষুনি বইটা নাগালে না পেয়ে ছিটানোছড়ানো পত্রিকা থেকে এগারোটি কবিতা বাছাই করা হয়েছিল।
গানপারে এই রিপাব্লিশের সময় কবিতাগুলোর বিন্যাস, পঙক্তিস্পেস ও বানান অর্কিডের অবিকল রাখার চেষ্টা হয়েছে (এবং অর্কিড অনুবর্তী ছিল উৎসপত্রিকাগুলোর বানান ও অন্যান্য বিন্যাসের, সম্পাদকসূত্রে জানা যায়। ব্যেটার হতো ‘সকালের দাঁড়িকমা’ অনুসরণ করতে পারলে, কেননা এই একটাই বই কবি নিজের অভিপ্রেত উপস্থাপনায় রেখে গেছেন আমাদের জন্য)।
প্রথমেই ট্রিবিউটগদ্য ‘আপন ভুবন’, পরে এগারো টুকরা আপনের দুনিয়া। — গানপার
আ প ন ভু ব ন
কবি কি মৃত্যুরই আরাধনা করেন, আসলে? মৃত্যুই আরাধ্য কবির? অথবা আরাধনা করেন জীবনের, কিন্তু হায়, একজন কবির জীবন কবিতা ব্যতিরেকে ভাবাই যায় না। কবি চান তার কবিতাটা পঠিত হোক, লোকে ভালো বলুক বা না-বলুক, অন্তত কবিতার একটা ভালো বন্দোবস্ত হোক তার, চান কবি। এইখানেই মৃত্যুর জয় কবির কাছে, এইখানেই মৃত্যু পেয়ে বসে কবিকে। হয়তো-বা। কারণ মৃত্যুর আগে কবির প্রতি ঠিকমতো নজর দিই না আমরা। পারলে ট্রামের তলায় পিষ্ট করে মারি। কিন্তু অবিচুয়ারি লিখি, রসিয়ে রসিয়ে শোকস্তম্ভ রচনা করি, ইনিয়েবিনিয়ে গাহি বড় ভালো লোক ছিল প্রভৃতি সিনেমার গান। জীবন নয়, নিষ্ঠুর শোনালেও সত্যি, কবির মৃত্যুই উদযাপন করি আমরা। আর কবি মারা যাবার আগে এতটুকু মাটিও জুটাতে পারেন না তার পায়ের তলায়। এ-ই হলো কবির নিয়তি। কিন্তু কথা ছিল কবি রিক্ত ঋতুতে ফুল ফুটিয়ে ফলপাকুড় ফলিয়ে নিজেও পাবেন খানিকটা তার ভাগ। হয় না, পাওয়া হয় না হিস্যা। আপন মাহমুদ অতি সন্তর্পণে নেমে গেলেন জীবনের হাইওয়ে ছেড়ে মৃত্যুর নির্জন আলপথে; এত সহসা আর এত অচরিতার্থ চলে যেতে হলো তাকে চিরকুয়াশার দেশে! একটামাত্র কবিতাবই আপনের, সকালের দাঁড়িকমা, তাতে একের পর এক পঙক্তিতে মায়ের মুখরেখা এঁকে গেছেন অভুতপূর্ব নরম ও মিত উচ্চারণে। এর আগে শামসের আনোয়ার ছিলেন আমাদের অভিজ্ঞতায় এইরকম মা আর প্রেমিকার বন্ধনাচ্ছন্ন কবি, যিনি তিনটে মাত্র কবিতাবই রেখে মরে গিয়ে বেঁচে আছেন মগ্ন কবিতাপাঠকের মনে, যার প্রথম কবিতাবইয়ের নাম মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে। তেমনি আপন মাহমুদ প্রজাপতি ও মা সিরিজ কবিতা সম্বলিত সকালের দাঁড়িকমা রেখে গেলেন, আমাদের প্রাত্যহ শুশ্রূষার জন্য রেখে গেলেন ব্যথার মতো মধু কয়েক ফোঁটা। আপনের এই ব্যথা এই মধু অনেকদিন আচ্ছন্ন রাখবে বাংলা কবিতাপাঠকের দৃষ্টি। তিনি ‘অনেক নীলের জামা পরে এ-শহরে’ এসেছিলেন, ‘অনেক মেঘের প্রতিবেশী’ তার মায়ের কাছে ফিরে গেলেন। মনে পড়ে একটি বহুপঠিত উপন্যাসনাম মায়ের কাছে যাচ্ছি, আপন মনেপ্রাণে একের পর এক কবিতায় সেই যাত্রাপথ রচেছেন। মায়ের কাছেই গেলেন তবে, আপন মাহমুদ? আমরা আপনাকে, আপনার মাকে, ভালোবাসব যতদিন বাঁচি। বিদায় বলি না, কারণ কবির যথার্থ জীবন শুরু হয় মৃত্যুর পরেই। হৃদয়মেদুর পঙক্তিসিক্ত কবিতার আপনরচিত ভুবনে আমাদের বিচরণ শুরু হোক আজ থেকে। এইখানে আপনভুবনের শুরু, হে পাঠক, সুনির্জন অরণ্যশরীরে এসে একে একে জড়ো হচ্ছে একা-মানুষের বিষাদজাত পুষ্পপত্র, মেলাঙ্কল মেঘমালা। স্বাগতম, আপন মাহমুদ, বাংলা কবিতার মোহন মিলনায়তনে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ!
আপন মাহমুদ ।। জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৭৬; মৃত্যু : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২।। কাব্যগ্রন্থ : সকালের দাঁড়িকমা
অনেক নীলের জামা পরে এ-শহরে এসেছি। ঘুমিয়ে পড়া আগ্নেয়গিরির আঁধার আমি। … পাতাঝরার শব্দ হতে ফুল ফোটার শব্দ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। … আমি আছি সেইসব মেঘের দিকে তাকিয়ে — বৃষ্টি না হয়ে যারা কেবল মেঘদূত হতে ভালোবাসে। … শুনেছি দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে চলে আসে। … আমি এখন একটা সুশীল ফলগাছ। নিয়মিত অফিসে যাই — বাড়িতেও টাকা পাঠাই … আমার আর বটগাছ হওয়া হলো না। … ও মেঘ, ও বউয়ের মতো মেঘ, আমাকে সাহারার হাত থেকে বাঁচাও! … জীবনের যত কফ-থুতু আর উড়াল হারানোর বেদনা আমি জমা রেখেছি এই ঘাসফুলের কাছে … পৃথিবীর যত খুন, প্রতারণা আর ব্যর্থ-প্রেমের কবিতা নিয়ে আমি সেই ঘাসফুলের কাছেই যাই। … আমাকে শুভেচ্ছা পাঠাতে হলে ঝড়োবাতাসের সঙ্গে আলাপ সেরে নিও। …
আ প ন মা হ মু দ ক বি তা ব লি
বটগাছ
আমার মাথায় শেকড় রেখে একটা বটগাছের বেড়ে উঠবার কথা
ছিল — কথা ছিল নিদাঘ দুপুরে পাতা নেড়ে নেড়ে সে সবুজের নেতৃত্ব
দেবে, ছায়াদের অভিভাবক হবে, হবে পাখিদের আশ্রম — তার কিছুই
হলো না — আমার ফলাকাঙ্ক্ষি মা-বাবা বটগাছের পরিবর্তে আমার
মাথায় মধ্যবিত্তীয় একটা ফলের বীজ বপন করে দিয়েছেন — আর
কতটা পরিচর্যা করলে গাছটি সামাজিক হবে, ধার্মিক হবে, সুস্বাদু
ফল দেবে — তারই দেখভাল করছিলেন আমার শিক্ষক-শিক্ষিকারা
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি এখন একটা সুশীল ফলগাছ — নিয়মিত
অফিসে যাই — বাড়িতেও টাকা পাঠাই
আমার আর বটগাছ হওয়া হলো না।
দৌড়
যেটুকু পথ পেরোতে বন্ধুদের তিন মিনিট লাগতো — তা অতিক্রম করতেই
আমার লাগতো কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট — এভাবেই একদিন আমি খুব
পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম — পেছনে তাকালে আমাকে দেখতে পেতো
না কেউ — পেছনে কেবল ঝরাপাতার ওড়াউড়ি, ফেল করা বালকের মুখচ্ছবি …
ইজিপশিয়ান সেই কচ্ছপের মতো এখন আমি তোমার কাছে পৌঁছে
গেছি! কেউ নেই চারপাশে — চল, আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা
নতুন করে নিজেদের উচ্চতা মাপি — আর সবচে দ্রুতগতিসম্পন্ন
বন্ধুটিকে প্রশ্ন করি, ‘তোমার খোঁড়া বন্ধুটি কেমন আছে’
দৌড় ভালোবেসে যারা আজন্ম হতে চেয়েছিলো প্রথম — দ্যাখো, তাদের
কেউ কেউ এখনো নিজেদের কাছেই পৌঁছাতে পারেনি! অথচ,
বকুলপাড়ার পঙ্গু ছেলেটিই একগুচ্ছ ঘাসফুল নিয়ে এসে নিজেকে
জয়ী ঘোষণা করলো!
সাঁতার
এক-একটি নদী পেরোনোর চে এক-একটি নারী পেরোনো অনেক ভয়ের
কেননা এক-একটি আহত পাখি এক-একটি মৃত পাখির চেয়ে অনেক
বেশি বেদনা বহন করে — তবু আমাদের পেরোতে হয়, পেরোতে হয়
সুদীর্ঘ ঝড়ের আর্তনাদ…
এক-একজন নারীর সঙ্গে পরিচয় হওয়া মানে এক-একটা
অচেনা নদীর দেখা পাওয়া — এক-একটা নারীর চলে যাওয়া
মানে এক-একটি নদীর মরে যাওয়া…
বস্তুত, কতগুলো মৃত নদীতেই আজন্ম সাঁতরায় মানুষ, কতগুলো
ভুল মানুষ আর ভুল সম্পর্কের যোগফলই মানুষের প্রাপ্তি
এক-একটি নদী পেরোনোর চে এক-একটি নারী পেরোনো অনেক
ভয়ের — কেননা, সাঁতার জানলেই সব নদী পেরোনো যায় না।
বিকেল, মনে মুনিয়া
বিকেলের আগেই ঘুরে আসা ভালো ভোরের শিশির,
নামমাত্র বন্ধুত্ব — চোখের পর্দা থেকে ঝেড়ে নেওয়া
ভালো রাত্রির ঘুম, অন্ধকার — দেখে নেওয়া ভালো
সকালের দাঁড়ি-কমা, গানের দুপুর — বুঝে নেওয়া
ভালো বকুলের বাকিখাতা
বিকেলের খোলা মাঠে শুধু ছায়াই দীর্ঘ হয় না — মনেও
ওড়ে মুনিয়া পাখি — তাই তো বিকেল হলেই গড়াগড়ি
শুরু করে শৈশবের বল — কেঁপে ওঠে সপ্তম শ্রেণী —
প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে চৌধুরীবাড়ির মেয়েরাও
বিকেলে আমি না-ও থাকতে পারি, নিজের ভেতর থেকে
বেরিয়ে পড়তে পারি অযথাই — ঘোষণা ছাড়াই ছড়িয়ে
পড়তে পারি দূরে, অতীতে…
সত্য-মিথ্যা
আমার শৈশবের বড় বড় মিথ্যেগুলো ক্রমেই ছোট
হয়ে আসছে — কোনো কোনো মিথ্যে এখন সত্যের মতো
সামনে এসে দাঁড়ায়! কোনোটা তো দূরে দাঁড়িয়েই ক্রমাগত
কুয়াশা ছড়ায় — কোনোটার সামনে পড়লে আবার
আমিই ছোট হয়ে যাই!
আমার শৈশবের বড় বড় সত্যগুলোও ক্রমে ছোট হয়ে
আসছে — কোনো কোনো সত্য এখন মিথ্যের কাঁধেই হাত
রেখে চলে — কোনোটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো…
কোনোটা তো আজ আর ঘরেই ফেরে না!
সত্য-মিথ্যের প্রসঙ্গ এলে এখন আমি আকাশের দিকে
তাকাই — কেননা, ওদিকে তাকানো ছাড়া আমার মন
ভালো হয় না — খারাপও হয় না।
ফুলসঙ্কটের দিনে
যারা নদী ও পাহাড়ের গল্প বয়ে বেড়ায়
আর মাথায় নিয়ন আলোর অভিশাপ নিয়ে
অন্ধকারে কাটায় অবসর, আমি তাদেরও
বলবো না তোমার কথা — কেননা, ফুলসঙ্কটের
দিনে পৃথিবীতে ভ্রমরের সংখ্যা বেড়ে যায়!
আমি নিঃসঙ্গ দুপুরে হেঁটে যাওয়া মালির পদধ্বনির
সঙ্গে ফুলফোটার শব্দ মিলিয়ে যেতে দেখি, আর
এখানে ওখানে লিখি ‘অপেক্ষা’।
স্কাউটবালিকা
মুঠোভর্তি রোদ ঘরে আনতে পারেনি বলে যে বালক সারাটা দুপুর
অভিমানের ভেতর বসে আছে, আমি তার মুখচ্ছবি আঁকি — আঁকি
রোদ্দুরে হারিয়ে যাওয়া দূর মুনিয়া পাখি
বিষাদের ভাই হয়ে বসে থাকি, রাত্রির হাত ধরে বাঁশঝাড় কাছে
এসে বলে ‘জোনাকিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে বলো’; আমি তাদের
দুধমাখা ভাতের লোভ দেখাই — বলি, স্কাউটে ভর্তি হয়ে যাও
তোমরা সবাই…
স্কাউটের বেল্টবাঁধা সেই বালিকা — আজো কেন বুকের ভেতর
লেফট-রাইট করছে!
উল্টোপথ
যে মন্দিরে আর ঘণ্টা বাজে না আমি তার প্রতিবেশী, মসজিদও
খুব কাছে নয় — সন্ধ্যায়, প্রার্থনার হাওয়ায় মন রেখে আমি তাই
উল্টোপথে হাঁটি…
উল্টোপথে মসজিদ নেই, মন্দির নেই, কেবলই প্রশ্নের
বিড়ম্বনা — সেই প্রশ্ন, যার উত্তরে অনায়াসে বলে দেওয়া যায়
‘কুয়াশা-কুয়াশা’ কুয়াশা! যা কিনা পৃথিবীর যাবতীয় শিল্পকে
অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করে
উল্টোপথেই হাঁটি, শুনেছি এ পথেই পাওয়া যায় ডোডোপাখির
বরফাচ্ছন্ন ডানা, আদিমতম গুহার ওম, আর ব্যক্তিগত
আকাশের খোঁড়াখুঁড়ি…
ঝরাপাতার উপহাস
আবার শীত এলে আমি সবটুকু আকাশ ছেড়ে দেবো
অতিথি পাখিদের, জলাশয়ের কাছে যাব না, বাজাবো
না সিটি, কেননা পাখিদের অবাধ ওড়াউড়ি পৃথিবীতে
যে গানের আবেশ ছড়ায়, আমি তার টুকিটাকি
জমিয়ে রাখি
আবার শীত এলে আমি ভাঁপা পিঠার ফেরিওয়ালা হবো,
কার্ডিগান বেচবো শহরের অলিগলি — কেননা, ভাঁপা পিঠার
ধোঁয়ার সঙ্গেই কেবল তনুশ্রীদের হাসির বিনিময় সঙ্গত
আবার শীত এলে আমি মরেও যেতে পারি
ছড়িয়ে ঝরাপাতার উপহাস…
কথা, পাহাড়ের সঙ্গে
পাহাড়, তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে — বিশেষত মনমরা বিকেলে
কী করো তুমি — কার কথা ভাবো — কে তোমার কান্নাকে প্রথম ঝরনা
বলেছিলো? আমি? আমি দু-চারটা সিগারেট বেশি খাই, চুপচাপ
ঘুরিফিরি — দাড়ি কেন কাটতে হবে, ভাবি…
মাঝেমাঝে নিজেকে শৈশবের হাতে তুলে দিয়ে ঘড়ি দেখি — ঘড়িতে
৩৪টা বাজে! ফুল পাখি নদী ওরা কেমন আছে?
পাহাড় তুমি কি জানো, রজনীগন্ধা সবজি নয় কেন!
টু রোকেয়া হল
আমাদের প্রায় সবারই কিছু-না-কিছু গল্প আছে — আছে শৈশব-মোমে জ্বলা
দু-একটি সিঁদুরে মুখ — দূরে, কাশবনের ভেতর থেকে বারবার বেরিয়ে আসা
ছেলেগুলো আমাদের বন্ধু — ভালোবাসার জন্য একদিন আমরা পকেটের গোপন
আধুলিটাও ভিক্ষুকের থালায় রেখেছি — অথচ, সাইমারা দেশছাড়া — শিরিনেরা
ঘোলাজলে দ্যাখে মুখ — আর লোপাদের মুখে কেবল সন্তানের দুষ্টুমি!
আমাদের কোনো কোনো বন্ধু স্বর্গে যাবে বলে মদের টেবিলেও মগজে টুপি
রাখতো — প্রায়ই আমরা বালিকাময় বিকেল ঘুরতে যেতাম — মাঠের মাঝখানে
বসে দেখতাম দূর্বাঘাসের চে অধিক নরম স্বপ্ন — অথচ, প্রিয় বন্ধুটির
কবরে মাটি না-দিতে পারার আক্ষেপটুকুও আজ আমাদের কারো নেই!
ঈশ্বর যেখানে আছে থাকুক, ওপথ আমার সরু মনে হয় — আমাদের চিয়ার্সের
শব্দ থেকেই শুরু হবে অনাগত গানের প্রবাহ — এই ভেবে এখনো আমরা
পানশালায় যাই, যদিও পুলিশ দেখলেই আজকাল মদের নেশা কেটে যায়!
আমাদের রয়েছে লিখতে না-পারার মতো দুর্যোগ আর ভালোবাসতে না-পারার
মতো অনটন — বন্ধুরা, আবহাওয়া ১৬ আগস্ট থেকেই খারাপ — সমুদ্রে লঘুচাপ,
নৌকা ভিড়ে আছে উপকূলে, উনুনে শূন্য হাঁড়ি — জানি, বুকের আগুনে একটা ডিমও
সেদ্ধ হয় না — তবু, স্বর্গ যদি থাকে, তোমরা যাও — আমি রোকেয়া হলের দিকেই…
… …
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS