বহুদিন বাদে জ্যোন বায়েজ

বহুদিন বাদে জ্যোন বায়েজ

আজ সারাদিন কী কী করলাম, ঘণ্টা বাজালাম আর কচুঘেঁচু খুঁটে গেলাম যা যা, তার একটা হিসাব রাখা যাক এই জাব্দাখাতায়। প্রথমে ঘুম থেকে উঠলাম, বলা বাহুল্য, বটে এক কাজের কাজ করলাম! ঘুম ভাঙল পাষাণের, মাশাল্লা, যথাস্বভাব বিলম্ববেলায়। এরপর দৈনিকপত্রিকা হাতে নিয়া সাময়িকী ইত্যাদির কবিতা-কাহিনি-ফিচার-কেলেঙ্কারিগুলায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। এরই মধ্যে সেরে নিলাম নাশতাপানি, প্রায়দুপুরে প্রাতরাশ। অতঃপর মনুষ্য-অবয়বের কিচিরমিচির পাখিছানাগুলোকে ডেকে এনে লুটোপুটি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম, ওরা কাজিনকন্যা-কাজিনপুত্র সবাই, তিন-তিনটে আলো ও শোলার তৈরি শিশু। দুপুর গড়িয়ে গেলে পরে চান করতে গেলাম, ডুব না দিয়া শাওয়ারতলায় সেরে নিলাম নমঃনমঃ গোসল, চানঘর থেকে বেরিয়ে খেলাম ভাত। দুপুরের আহার, ভুঁড়ি ভাসিয়ে মহা আয়েশে, তখন বেলা চার। গোমাংশ প্রধানত, মাগুরঝোল, তোফা খানা। তারপর গান শুনলাম জ্যোন বায়েজের। শুধু শোনা নয়, দেখলাম বায়েজকে নিয়ে এক সুনির্মিত ডক্যুমেন্টারি। How Sweet the Sound শিরোনামে এই শিল্পী ও সংগীতমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের জয়গানকারীর অটোবায়োগ্র্যাফিক একটা ডক্যুমেন্টারি বেরিয়েছে ২০০৯ সালে, বেরিয়েছে অ্যামেরিকা থেকে। সেখানে, সেই ডিভিডি দুইপর্বে, একদম জীবন্ত উঠে এসেছে উত্তাল ও মহান কীর্তিমণ্ডিত গত শতকের ষাটের দশক। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির বিভিন্নজনের কথাবার্তায় উঠে এসেছে একজন বায়েজের উন্মেষকাল, উত্থানকালীন সৃজনসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি, দুনিয়াজোড়া রাজনীতি ও গানজগৎ রূপান্তরের পূর্বাপর। উঠে এসেছে বায়েজের বেড়ে-ওঠা, সেই পেসিফিস্ট ম্যুভমেন্ট, মার্টিন লুথার কিং, রোজা লুক্সেমবার্গ, অ্যামেরিকার সেই বিখ্যাত ফোক ফেস্টিভ্যাল, এবং সর্বোপরি ডিলান। দুইখণ্ড ডিভিডি সংকলনের আলাপচারিতাঋদ্ধ খণ্ডটিতে এই দুই কিংবদন্তি শিল্পী — বব ডিলান ও বায়েজ — দুজনকে ঘিরে গড়ে-ওঠা সেই মিথ সম্পর্কে বেশ প্রীতিকর বর্ণনা পাওয়া গেল। জ্যোন বায়েজ ও বব ডিলান যুগল নিয়ে এই প্রথম কথাবার্তা শুনলাম খোদ পাত্রপাত্রীর মুখ থেকে, কৈশোর থেকেই ছিল যে-কৌতুহল তা খানিক নিবৃত্ত হলো। যদিও ওই মিলন-না-হওয়ার শিশুতোষ হাহাকার তাতে একইঞ্চিও কমে নাই। কী-করা আর! ডিলান নিজে কথা বলেছেন, তাঁর মতো প্রচার-এড়ানো ক্রোধস্পন্দিত সত্যসন্ত লোক জনসমক্ষে এসেছেন এখানে, এ-ই তো অনেক পাওয়া — আমাদের জন্য, পৃথিবীর জন্য, বড় উপহার। কথা বলেছেন বায়েজের সংগীতসঙ্গীদের অনেকেই, রেকর্ডসপ্রযোজক, সমকালীন মিউজিশিয়্যান্স, উনার হাসব্যান্ড ছাড়াও অনেকেই আরও। অনেক দুর্লভ ফুটেজ ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। সেই স্ট্রিট-রেভোল্যুশনের দশকের অনেক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এক মূর্ত বয়ান এই চিত্রচলচ্ছবিটি। অনেক বিখ্যাত কন্সার্টের খণ্ডাংশ রয়েছে, দেখে সেই গোটা সময়টা জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে-বড় সুখের সময় ছিল, সে-বড় লড়াইয়ের সময়, মানুষ হিশেবে আমাদের বেশ-একটু বড় হয়ে ওঠার সময়। সেই সময়টি নিয়ে, এমনকি আমাদের এখানেও ওই কালে বহু বড় বড় ঘটনা ঘটেছে একযোগে, বেশকিছু মনোজ্ঞ বইপত্র পড়েছি বিভিন্ন সময়ে। যেমন অ্যালান গিন্সবার্গ প্রমুখ কিংবা মলয় রায়চৌধুরী বিবৃত সেই সময়ের বিবরণ। বক্ষ্যমাণ চলচ্চিত্রিক আলোচনাসংকলনে জ্যোন বায়েজের গলা, তাঁর গায়ন ও পরিবেশনশৈলী, লিরিক্স, সোশ্যাল ও পোলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, প্রেজেন্স প্রভৃতি সমস্তকিছুই সমীহ-জাগানো। দুইখণ্ডের একটিতে বায়েজের ভিশ্যুয়াল অটোবায়োগ্র্যাফি, অন্যটিতে তাঁর গানের অডিও। সেই কালজয়ী গানগুলো থেকে ১৫টি, বেশিরভাগেরই শোনা সেই গানগুলো, গৃহীত হয়েছে। আরেকবার শোনা হলো Man Smart Woman Smarter, I Never Will Marry, Barbara Allen, Silver Dagger, Oh Freedom, With God On Our Side, A Song for David, The Night They Drove Old Dixie Down … শোনা হলো বব ডিলানের সঙ্গে একটা ডুয়েট I Pity The Poor Immigrant …আবারও শুনলাম Love Song To A Stranger এবং Day After Tomorrow … এবং সেই প্রিয় আমার Jerusalem … সেই অনবদ্য লাইনগুলো : I woke up this mornin’ and none of the news was good / And death machines were rumblin’ ‘cross the ground where Jesus stood … এরপরে সেই লাইনগুলো — That I believe that one fine day all the children of Abraham / Will lay down their swords forever in Jerusalem…I believe there’ll come a day when the lion and the lamb / Will lie down in peace together in Jerusalem … শুনতে শুনতে জ্যোন বায়েজের কিন্নর কণ্ঠের মতো সন্ধ্যা এসে নামল আমাদের বাড়িতে।


  • How Sweet The Sound, Joan Baez, in DVD format by various directors, released in 2009, USA

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you