গত শতকের আশির দশক থেকেই শুরু হয়েছে টেলিভিশনে চেপে দেশের ঘরে ঘরে হুমায়ূনযাত্রা। তালিবাবাদ আর বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহকেন্দ্রের মাধ্যমে কেবল বিটিভি রিলেকৃত অনুষ্ঠানের সেই যুগে বছরে একবার একটা নাটক প্রচার হলে সেই নাট্যকারের নামযশ হতো। হুমায়ূনেরও হয়েছিল। তবে এখানে একটা ফারাক হুমায়ূনের সঙ্গে অন্যান্য যশস্বীদের এ-ই যে, অন্যদের নামযশ ক্রমশ নেমেছে যেখানে, হুমায়ূনের খ্যাতির পারদ চড়েছে এবং চূড়া ছুঁয়ে স্ট্যাগ্ন্যান্ট থেকে গেছে আমৃত্যু।
কয়টা নাটক বানিয়েছিলেন হুমায়ূন টেলিভিশনের জন্য? কয়টা একক/খণ্ডনাটক? কয়টা ধারাবাহিক? এই কিসিমের জিজ্ঞাসা থাকে মানুষের। সাধারণ্যে এর উত্তরও মেলে রেডিলি : শত শত! আসলেই কি? শত শত টিভিফিকশনের জন্ম দিয়েছিলেন হুমায়ূন? অত নয়, কিন্তু শত তো হবেই। জীবনের শেষ এক দশকে ডেইলিই বোধহয় চ্যানেলগুলোতে একটা-না-একটা নাট্য সম্প্রচার হতো হুমায়ূনের। হয় একক/একখণ্ডের নাটক, নতুবা ধারাবাহিক। ফলে মানুষ ভাবতেই পারে শত শত টেলিভিশননাটকের জনক হুমায়ূন।
শুমার করতে বসাও ঝক্কির কাজ। হুমায়ূনের লেখা বইয়ের শুমারিই ভীষণ ঝক্কির। লোকে বলে, হাজার হাজার বই লিখেছেন হুমায়ূন। অত তো নয়, কিন্তু শ-তিনেক তো হবেই। সেসব বইয়ের নামাবলি রীতিমতো গন্ধমাদন পর্বত কান্ধে নেয়ার নামান্তর। কে খুঁজতে যাবে এইসব? কমন কয়েকটা হুমায়ূনবইয়ের নাম তো মনে থাকেই, সেইগুলোও চল্লিশের কম হবে না। অ্যানিওয়ে। এইখানে লেখাপড়ার বই নয়, দেখাশোনার টিভিফিকশন গুণতে লেগেছি। সব পারব না, তবে একটা বড় অংশ উঠে আসবে তালিকায়।
ধারাবাহিক হুমায়ূন
শুধুই বিটিভি ছিল যে-আমলে, সেই আমল থেকেই হুমায়ূন টিভিনাটকের রাজা। তার নাটকের নির্মাতা তখন বিটিভির মেধাদীপ্ত লোকেরা, আতিকুল হক চৌধুরী এবং নওয়াজেশ আলী বা মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ, হুমায়ূন স্ক্রিপ্ট লিখে দিতেন নিজের গল্পের। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি পড়ানোর ফাঁকে কাহিনির বই লিখতেন এবং টেলিভিশনে একেকটা নাটক বছরে যেত তার টাইটেলে। এর বহুবছর বাদে একদিন মাস্টারি ত্যাগ করেন হুমায়ূন এবং লেখালেখিও বলতে গেলে ছেড়ে দেন, ক্রমশ হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের প্রভাবশালী বিনোদনবণিক। নিজের প্রোডাকশন হাউজ খুলে একের পরে এক নাটক, বিজ্ঞাপন, বিচিত্রানুষ্ঠান আর সিনেমা বানাইতে থাকেন ধুমিয়ে। এত পরিমাণে বানিয়েছেন যে, এত ঝলমলে সেসব জঞ্জাল, এখন সেগুলোর ক্যাল্কুলেশন প্রায় না-মুমকিন। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক কয়টা নাম হাজির করতে পারি। পয়লা ধারাবাহিকের খতিয়ান নেব।
হুমায়ূননির্মিত ধারাবাহিক নাটকগুলোর মধ্যে এই কয়েকটা নাম প্রথমে দেখব : অচিন রাগিণী, এইসব দিনরাত্রি, আজ রবিবার, বহুব্রীহি, চন্দ্রকারিগর, কালা কইতর, কবি, কোথাও কেউ নেই, লীলাবতী, মেঘ বলেছে যাব যাব, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, নক্ষত্রের রাত, সেদিন চৈত্রমাস, উড়ে যায় বকপক্ষী।
লিস্ট কি সম্পূর্ণ হলো? মনে হয় না। আরও কয়েকটা ধারাবাহিকের কথা আবছা মনে পড়লেও নাম ইয়াদ নাই। যেমন জনস্বার্থে প্রচারণার বেশকিছু কাজ তিনি করেছিলেন ইউএসঅ্যাইডের ফান্ডে, ‘সবুজ সাথী’ বা এমন অন্তত একটা ধারাবাহিকের নাম আবছা ইয়াদ হয়, সেসব কাজের ফিরিস্তি বা লিস্টি নিশ্চয় রিসার্চাররা বাইর করবেন।
একক হুমায়ূন
খণ্ডনাটকের হুমায়ূন তো রোজ সকালে একটা আবার বিকালে আরেকটা নাটকের কাজ খতম দিতেন বোধহয়। যেহেতু উনার আলাদা কাস্টিং ছিল না, নিজের ভেন্যুতে নিজের সংঘের সেট ক্রুদের নিয়া কাজ করতেন, কাজেই দুইহাতে দেদার বানাতে পেরেছেন নাটক ইত্যাদি ছাতামাথা যা-ই হোক। হুমায়ূনের সিন্ডিকেটেড অভিনয়টিমের স্ট্র্যাটেজি দিয়া তার পরবর্তী নির্মাতারা লাভবান হয়েছেন, এখন সকলেই সিন্ডিকেইটেড অভিনয়টিম পোষেন। যা-হোক, আমরা এখানে হুমায়ূননির্মিত খণ্ড-খণ্ড টিভিফিকশনের একটা তালিকা টাঙাচ্ছি নিচে :
২৪ ক্যারেট ম্যান, আবারও তিনজন, এসো, আগুন মজিদ, এই বর্ষায়, আজ জরির বিয়ে, আজিজ সাহেবের পাপ, এ কী কাণ্ড, একটি অলৌকিক ভ্রমণকাহিনি, আমি আজ ভেজাব চোখ সমুদ্রজলে, আমরা তিনজন, বাদলা দিনের গান, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, ব্যাংক ড্রাফ্ট, বিলাতি জামাই, বনুর গল্প, বৃহন্নলা, বৃক্ষমানব, বুয়া বিলাস, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, চন্দ্রগ্রহণ, চার দু-গুণে চার, ছেলে দেখা, চিপা ভূত, চৈত্রদিনের গান, চোর, চুরি, দ্বিতীয়জন, আইনস্টাইন এবং, এনায়েত আলীর ছাগল, গনি সাহেবের শেষ কিছুদিন, গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড, হাবিবের সংসার, হবলঙ্গের বাজারে, হামিদ মিয়ার ইজ্জত, ইবলিশ, যাত্রা, জিন্দা কব্বর, জহির কারিগর, জইতরি, জলতরঙ্গ, যমুনার জল দেখতে কালো, জনক, জোছনার ফুল, জুতা বাবা, কাকারু, খেলা, খোয়াবনগর, কনে দেখা, লেখকের মৃত্যু, লীলাবতী, মায়াবতী, মীরার দিনরাত্রি, মিসকল, মদীনা, মফিজ মিয়ার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, মৃত্যুর ওপারে, নাট্যমঙ্গলের কথা শোনে পুণ্যবান, নাট্যকার হামিদ সাহেবের একদিন, নীল চুড়ি, নিষাদ, নীতুর ঘরে ফেরা, নগরে দৈত্য, নয়া রিকশা, নুরুদ্দিন স্বর্ণপদক, অন্তরার বাবা, অনুসন্ধান, অপরাহ্ন, অতঃপর শুভ বিবাহ, পাপ, প্যাকেজ সংবাদ, পাথর, পিশাচ মকবুল, পদ্ম, পক্ষীরাজ, প্রজেক্ট হিমালয়, রহস্য, রূপা, রূপালি রাত্রি, শেফাদের বাড়ির ছাদে অ্যালিয়েন, শওকত সাহেবের গাড়ি কেনা, সম্পর্ক, সমুদ্রবিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, স্বপ্নসঙ্গিনী, সবাই গেছে বনে, সৌরভ, তারা তিনজন, তারা তিনজন (ফুচকা বিলাস), তারা তিনজন (টি মাস্টার), তারা তিনজন (হে পৃথিবী বিদায়), তারা তিনজন (ঝামেলায় আছি), তিন প্রহর, তৃষ্ণা, তৃতীয় নয়ন, উদ্ভট উট, ভালোবাসা, ভাইরাস, ওয়াংপি।
লিস্ট লক করে দেবেন? মাথা খারাপ নাকি? আরও অন্তত কয়েক ডজন তো যোগ করবেন এই নিবন্ধের অন্যমনস্ক পাঠক।
পূর্ণদৈর্ঘ্য হুমায়ূন
হুমায়ূনের বানানো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির সংখ্যা আট। এই তথ্যে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই ফিগার আর চেইঞ্জ হবে না। আবার হুমায়ূনের গল্প ভর করে বানানো অন্য পরিচালকের ছায়াছবির সংখ্যা আজ পর্যন্ত যা হয়েছে তাও অঙ্গুলিমেয় নয়। শেষোক্ত সংখ্যাটা নিত্য পরিবর্তনীয়। নতুন দিনের পরিচালকেরা হুমায়ূনের কাহিনি নিয়ে স্ক্রিপ্ট করবেন, সিনেমা বানাবেন, সংখ্যা বাড়বে। এইখানে আমরা হুমায়ূনের বানানো এবং অন্যদের বানানো হুমায়ূনকাহিনির শুধু ফর্দটাই রাখছি, মিশ্রিতভাবে। যে-কেউ চাইলেই সিনেমাগুলোর নাম নিয়ে গ্যুগল করে পেয়ে যাবেন দেখার একটা অ্যাভেইলেবল লিঙ্ক। সিনেমাতালিকা নিচে দেখব :
কৃষ্ণপক্ষ, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, দূরত্ব, ঘেটুপুত্র কমলা, নিরন্তর, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ, দুই দুয়ারী, দেবী, শ্রাবণ মেঘের দিন, আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, নন্দিত নরকে, চন্দ্রকথা, প্রিয়তমেষু, শঙ্খনীল কারাগার।
শুধু নাটক-সিনেমা বানিয়েছেন তা তো নয়, নিজের প্রোডাকশন থেকে আরও সমস্ত অনুষ্ঠান বানিয়েছেন গানের ইত্যাদির, সেইসবের খবর দেবেন বস্তুনিষ্ঠ কোনো গোয়েন্দা বা সার্চ-অ্যাজেন্ট। আপাতত নিস্তার।
প্রতিবেদনকারী : বিদিতা গোমেজ
… …
- শৈলিন উডলির কথাগুলি (৭) - August 11, 2019
- কেইটের কথাবাত্রা (১০) - July 25, 2019
- টিল্ডা টোল্ড (২) - May 12, 2019
COMMENTS