হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে বলতেন ভীরু প্রকৃতির মানুষ।
সম্ভবত সাহসী লোকেদের কর্মকাণ্ড তাকে বিস্মিত করত, বিস্ময়াভিভূত মানুষ সবসময় নিজেকে ক্ষুদ্রজ্ঞান করে। হুমায়ূনও হয়তো তা-ই করতেন।
লেখক ভীরু হওয়া মারাত্মক কথা।
বেশিরভাগ ভীরু লেখকই সারাজীবন ভীরুতা আড়াল করার জন্য কায়দা করতে থাকেন। বাংলাভাষায় বাংলাদেশে এই মজার বিষয়টা ভালোমতোই উপভোগ করতে পারা যায়।
ভীরু লেখক মারাত্মক, কারণ তিনি নতুন কথা বলতে ভয় পান।
ভয় পেয়ে চেপে থাকতে থাকতে কথা বলা শুরু করেন যখন, তখন আবার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, তারপর ফিরে এসে ফের গর্তে ঢুকে পড়েন।
নতুন কথা বলতে ভয় পায় বলেই ভীরু লেখক ক্লিশে হন।
তার ভাষা হয় অনুকরণমুখী। নিজের বেশিটুকুন অন্যের ‘ফলোয়ার’, নিজেকে নিজেই পথ দেখাতে পারেন না।
লেখার জগতে হুমায়ূন যে ভীরু নন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং তাকে বেয়াড়া গোছের বললে বাড়াবাড়ি হবে না।
যাদের কথা শুনলে লাভ হতো, তাদের কথা শোনেননি। যা মেনে চললে মানী হওয়া যায়, মেনেছেন বলে মনে না করার কারণ আছে।
প্রথা এবং প্রতিষ্ঠানকে আঘাত তো করেছেনই, অনেকভাবেই, স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই। বিপ্লবের মতো করে নয়, সেজন্যেই তাকে হঠকারী মনে হয়নি। তিনি মঞ্চমানবও ছিলেন, সদা দৃষ্টি আকর্ষণের নেশা আছে বলে মনে হয়নি।
একটা সামান্য উদাহরণ দেয়া যাক।
বুয়াদের খাওয়ার টেবিলে বসে খেতে দিতে না পারা শহুরে শিক্ষিত উদার শ্রেণিকে প্রশ্ন করেছেন, তার সোবহান সাহেব তাকে টেবিলে বসিয়ে খেতে দেননি কি?
কাজের মেয়েকে ঘিরে তার মানবিক মনখানা কি কপট?
এই গরিবের বাচ্চাদের ধরে ধরে এনে কাজের মেয়ে করে রাখার মতো কুৎসিত বীভৎস নিষ্ঠুর ঘটনাটিকে কি হুমায়ূন তির্যক করে দেখিয়ে যাননি?
আরামপ্রিয়রা অপরের যে শিশুসন্তানটিকে উপকার করার নামে নিজের বাসায় এনে রাখে, ফাঁকে ফাঁকে নিজের কাজ করিয়ে নেয়, তাদের অনুভূতিহীনতার খবর আমরা কি পাই না?
হুমায়ূন সংসারকে শক্তিশালী মনে করেন, কিন্তু ভাঙা সংসারকে দুর্বল ভাবেননি কোনোদিন।
বাবা চলে গেছে, কিন্তু মা সামলে নিয়েছেন, বা স্ত্রী চলে গেছেন প্রেমিকের সাথে, হুমায়ূন তাকে হেয় করেননি, আবার ওদিকে বাবা বাচ্চাদের নিয়ে সংগ্রামের জীবন দুঃখে-হাসিতে পার করে দিচ্ছেন।
আমি শিখেছি, অন্যের মতো না হওয়ার শক্তিই প্রতিভা।
হুমায়ূন আহমেদ অন্যের মতো নন, তাকে উপেক্ষা করা গেলেও তার অনন্যতা অস্বীকার করা কঠিন। অসংখ্য প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এই যে নিজের মতো লেখক (যাহা আজকাল অতি দুর্লভ), তাকে নিজের মতো হওয়ার জন্য, বা অন্যের মতো না হওয়ার জন্য, ভুগতে কিন্তু ঠিকই হয়েছে, তারপরও তো তিনি অন্যের মতো হয়ে যাননি।
লেখার ভাষা, বিষয় অথবা ভঙ্গি, এসবে তো তিনি আলাদাই ছিলেন। একেকটা মস্ত বড় প্রবন্ধ হতে পারে, ভাষায় কেন তিনি আলাদা বা বিষয়ে তিনি কতভাবে বাংলাভাষায় আনকোরা নতুন, কিংবা ভঙ্গিতে। একটা আলাদা ভাষাভঙ্গিই তিনি নির্মাণ করে বসলেন, এতই নিখুঁত যে সেটি-যে নির্মিত তা-ই ধরতে পারেননি এখনো সকলে।
এইসব হিমু বা মিসির আলি নয়, জীবন নিয়ে চিন্তার ধারায়, কতকিছুতেই-না তিনি নতুন আর প্রথমের প্রস্রবণ বইয়ে দিয়েছেন, পুরনোর চোখে সেই নতুনকে নতুন লাগে নাকি এতটুকুও?
… …
- সত্যজিতের দিন || ইফতেখার মাহমুদ - May 5, 2019
- টিভিপ্রিয় ছোটবেলায় কারেন্টের লুকোচুরি || ইফতেখার মাহমুদ - February 8, 2019
- ভালো অন্তর ও গানের গলা || ইফতেখার মাহমুদ - December 22, 2018
COMMENTS