টিভিপ্রিয় ছোটবেলায় কারেন্টের লুকোচুরি || ইফতেখার মাহমুদ

টিভিপ্রিয় ছোটবেলায় কারেন্টের লুকোচুরি || ইফতেখার মাহমুদ

ছোটবেলায় টিভি দেখার সময় আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি কারেন্ট চলে যায়! সাতদিন পর পর হতো ‘ম্যাকগাইভার’, কারেন্ট চলে গেলে আবার সাত দিন অপেক্ষা করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের নাটক হতো, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’-র সেই সময়গুলো, হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ হতো, আগ্রহ নিয়ে বাসার সবাই বসে থাকতাম সেগুলো দেখার জন্য।

সারাক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করতাম। কারেন্ট যেন না যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কারেন্ট ঠিকই চলে যেত। যেই-না মন দিয়ে টিভি দেখতে শুরু করেছি, অমনি কারেন্ট লা পাত্তা। টিভি দেখতে দেখতে ‘বিদ্যুতের তরে প্রার্থনার কথা ভুলিতে বসিয়াছিলাম’ বলে নিজেকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তখন। হাজার দোয়া করলেও সেই কারেন্ট আর ফিরিয়া আসিত না। ইহা ঠিক হইল না, ফিরিত, তবে ঠিক ইংরেজি খবরের মুখে। খবরে সেকালেও আমাদের রুচি ছিল না।

বিদ্যুতের জন্য এত মন খারাপ হতো, এখন মনে হলেও মন খারাপ হয়ে যায়। সারারাত ভালো করে ঘুমই হতো না আমার। সপ্তাহে মাত্র এক দিন ‘ম্যাকগাইভার’, সেটাও ফের কারেন্ট চলে যাওয়ায় না-দেখা রয়ে গেল। কেমন এক ঠকে গেছি, ঠকে গেছি অনুভূতি হতো। এই টিভি দেখার অনুমতি পাওয়ার জন্য সারা সপ্তাহ ভালো হয়ে চলতে হয়েছে, পড়তে বসতে হয়েছে, অতিরিক্ত ভালোমানুষী করতে গিয়ে হয়তো ভোরে উঠেও পড়ার ঘটনা আছে। আর কারেন্ট চলে গিয়ে সব বিনিয়োগ ভেস্তে দিলো!

মনখারাপের তোড়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম কারেন্ট এসে গেছে। সকালে ঘুম ভেঙে বুঝতাম, নকল কারেন্ট এনে নকল ম্যাকগাইভার দেখেছি। পরের দিনটাও খারাপ যেত।

তো, কারেন্ট সেভাবেই মাঝে মাঝেই চলে যায়। আমরা মাঝে মাঝেই ভুগি। কিন্তু কাঁহাতক? ভুগতে-থাকা লোকেরা একটা-না-একটা উপায় বের করে, ভোগার যন্ত্রণা লাঘবের জন্য এটা করতেই হয়। আমি বের করলাম, কষ্ট কমানোর জন্য আগে থেকেই কষ্ট পাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া। নিজেই নিজেকে বলতে থাকলাম, আজকে তো কারেন্ট চলে যাবে। যাবেই। নেতিবাচক ব্যাপারস্যাপার। মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎবাণী ব্যর্থ হতো। তখনো আনন্দ হতো। ব্যর্থ হওয়ার আনন্দে আমি অভিভূত হয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে সফলও হতাম।  আমার কথা মিলে গেলে দেখতাম অত কষ্ট লাগত না। কারণ আমি তো জানতামই কারেন্ট চলে যাবে। কষ্ট পাওয়ার কী আছে! দেখলাম, এই পদ্ধতি আরামের। খারাপ হওয়ার আগে, খারাপ হওয়ার কথা বলে বেড়ানো। খারাপ যদি ঘটেই, তাতে কষ্ট কম হয়।  উপরি হিসেবে, কথা মিলে যাওয়ার আনন্দটুকুও জোটে।

এই ভয়ঙ্কর অভ্যেস আমার মনের ভেতর ঢুকে গেল। সম্ভবত এইখান থেকেই জীবন নিয়ে নেগেটিভ চিন্তা করার দিকনির্দেশনা মিলেছে।  আগাম খারাপ ভেবে রাখলে জীবন অত চমকে দিতে পারে না। এই বিষয়টিকে ভয়ঙ্কর বলছি, কারণ অতি অল্প বয়সেই আমি আমার সকল নিকটজনের মৃত্যু নিয়ে ভেবে ফেলেছিলাম। তীব্র কষ্ট হয়েছে, তবে আমি প্রায় সকলের মৃত্যু সম্পর্কে আগাম চিন্তা করেছি। কষ্ট আগে থেকেই অনুভব করেছি। আমার এমন কোনো প্রিয়জন নেই যার মৃত্যু নিয়ে আমি ভাবিনি। এই এখনো ছবি তোলার সময় আমার মনে হয়, যদি আমাদের একজন কেউ আজ মারা যাই, এটাই হবে শেষ ছবি। ঘর থেকে বেরোনোর সময় মনে হয়, যদি না ফিরি! এইজন্যেই সম্ভবত সবসময় আমি ভালো করে বিদায় নিয়ে বের হই। শেষ কথাটা খেয়াল করার চেষ্টা করি।

আমার সম্ভবত কষ্ট পাওয়া নিয়ে ভয় বেশি। আগে থেকেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে রাখলে কষ্ট কম হয়, এই বিষয়টা এই জন্যেই হয়তো আমি পছন্দ করে ফেলেছি। অতি দুর্বল মানুষদের এইরকম বৈশিষ্ট্য হয়। সম্ভবত, এইজন্য কষ্ট আমি খুবই কম পাই। কারণ, কল্পনায় আমি আরও তীব্র কষ্ট পাওয়ার কথা আগেই ভেবে রেখেছি। আমার জীবনটা যে-রকম, সেটা এ-রকম হওয়ার এটাও একটা কারণ হয়তো।

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you