হায়েনা এক্সপ্রেস এবং মানবসভ্যতার এপিটাফ || ওমর ফারুক রাসেল

হায়েনা এক্সপ্রেস এবং মানবসভ্যতার এপিটাফ || ওমর ফারুক রাসেল

‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর সৃষ্টি; এই মহাকাব্য যেটা বাংলার প্রথম সার্থক মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-তে একটা বিশেষ থিমকে কেন্দ্র করে সুবিশাল কাহিনি নয়টি সর্গে নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে; যার প্রতিটি ধাপ তথা সর্গের সাথে আরেকটা সর্গ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মানে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পুরোপুরি বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই অবশ্যই প্রতিটি সর্গ ধারাবাহিকভাবে বুঝে শেষ করতে হবে।

‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ গঠনরীতির দিকে দিয়ে অনেকটা সেই মেঘনাদবধ কাব্য-র মতো। মেঘনাদবধ কাব্য-র মতো হায়েনা এক্সপ্রেসেও একটা বিশেষ থিমকে কেন্দ্র করে; এক সুবিশাল ইতিহাস ধাপে ধাপে নয়টি মৌলিক গানে নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে প্রতিটি গান ইন্টার-রিলেটেড অর্থাৎ ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ একটি কন্সেপ্চ্যুয়াল অ্যালবাম।

‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ অ্যালবামের মূল থিম মানুষ।

পুরো অ্যালবামে মানবজাতির নাটকীয় ইতিহাস নয়টি গানে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা প্রথমে ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ দিয়ে শুরু করে; এক এক করে ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’, ‘অন্ধ দেয়াল’, ‘সূর্যের অন্ধকার’, ‘আমার নাম অসুখ’, ‘ক্রমশ’, ‘পারফিউমের ফেলে-দেয়া বোতল’, ‘আত্মহত্যার গান’-এ এসে ‘এপিটাফ’ দিয়ে নাটকীয়ভাবে শেষ হয়।

আপনাকে ব্যান্ড ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর মিউজিক ফিলোসোফি বুঝতে হলে ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’-এর প্রত্যেক গান ধাপে ধাপে একটা একটা কয়েকবার করে শুনতে হবে। ভেরি স্যরি টু স্যে আপনি যদি হায়েনা এক্সপ্রেসের কয়েকটা গান র‍্যান্ডমলি শুনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন তাহলে ধরেন আপনি সোনার বাংলা সার্কাসের মিউজিক ফিলোসোফির কিছুই ধরতে পারেননি।

‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ আসলে কি বলতে চাচ্ছে সেটা পুরোপুরি বুঝতে হলে আপনাকে অতি অবশ্যই পুরো অ্যালবাম ধারাবাহিকভাবে শুনতেই হবে।

আর হ্যাঁ, আমি ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ পুরো অ্যালবামটা আমার নিজস্ব অবজারভেশন থেকে লিরিক্যালি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি মাত্র। তাই অ্যালবামের মিউজিক কম্পোজিশন, অসাধারণ গিটারিস্ট-বেইজিস্ট-ড্রামার বিশেষ করে অনন্যসাধারণ গীতিকার কাম ভোকাল নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি; যেহেতু পুরো রিভিয়্যুটা লিরিক বেইজড। যদি সময় আর ইচ্ছে থাকে হয়তো একদিন মিউজিক বেইজড রিভিয়্যু লিখতে বসব।

যা হোক, এই লিরিক্যাল অবজারভেশনের পুরো দায় সম্পূর্ণ আমার।

এক
অ্যালবামের প্রথম গান ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ নামটাই থ্রিল একটা। পৃথিবীতে মানবজাতির জীবনাচার দুই স্তরে ভাগ করা যায়; প্রথমটা হলো বনজীবন তথা গুহাবাস আর দ্বিতীয়ত হলো সভ্য নাগরিক জীবন তথা নরকবাস। এবং মানুষের এই বনবাসের জীবন থেকে নরকবাসের জীবনে প্রবেশ করার মাধ্যম ছিল হায়েনা এক্সপ্রেস!

হায়েনা প্রাণিজগতের অন্যতম হিংস্র প্রাণী; আর কোনো কাল্পনিক যানবাহনের নাম হায়েনা এক্সপ্রেস মানে বুঝে নিতে হবে এটা নরকযান।

মানুষের আদিনিবাস গুহা ছেড়ে হায়েনা এক্সপ্রেস নামক নরকযানে চড়ে কৃত্রিম সভ্যতার সন্ধান নেওয়ার সময়টা হায়েনা এক্সপ্রেস গানের প্রতিপাদ্য বিষয়। মানে হোমোসেপিয়েন্স লক্ষ বছর গুহায় প্রাকৃতিক বনজীবন পার করে দেওয়ার পর সমতল ভূমিতে নিজেদের নতুন কৃত্রিম আশ্রয় তৈরির করার যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাই ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ গানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

গভীর রাতের সরণি
ছুটেছে নরকনগরী
হায়েনা গাড়িতে তুমি
উড়ছে চুল অগ্নিকেশী
ডিজেলের ভুলে রক্তে চলে গাড়ি

গানের এই প্রথম কয়েক পঙক্তিতে গুহা ছেড়ে নগরীর দিকে ছোটা মানুষের নরকযাত্রা ফ্রেমবন্দী করা হয়েছে।

রক্তের তোড়ে সূর্যের দিকে
মর্গের দরজা খুলে দেয় নরকধাত্রী

এবং এই শেষ পঙক্তিতে এটা ইন্ডিকেট করা হয়েছে যে আত্মঘাতী হোমোসেপিয়েন্স গুহা থেকে নরকযান হায়েনা এক্সপ্রেসে চড়ে কৃত্রিম সভ্যতা নামের নরকে প্রবেশ করছে।

দুই
যেদিন থেকে মানুষ কৃত্রিম সভ্যতা তৈরি করার মিশন শুরু করেছিল, সেদিন থেকেই মানুষ তার সহজাত হিংস্রতার চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশি বর্বর হয়ে মৃত্যুলীলায় মেতে ওঠে। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষের রক্তাক্ত লাশের উপর ভর করে যে আজকের আধুনিক বিশ্ব গড়ে উঠেছে, ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা‘ গানে সেই মারাত্মক সত্যটা তুলে ধরা হয়েছে।

আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
কথায়, ইচ্ছায়, সাধনায় আর কারখানায়
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি

সভ্য মানুষের অন্যতম প্রিয় অভ্যাস যে সমগোত্রীয় মানুষের মৃত্যুর আয়োজন করা, গানের এই ইন্ট্রো লাইনে সেই দিকটাই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে কোটি কোটি মানুষ খুন করার যে গৌরবময় রেকর্ড রয়েছে, সেটা সুবিশাল প্রাণিজগতের অন্য কোনো প্রাণির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। মানুষ নিজেই যেন মানুষের মৃত্যুদূত!

অথচ সেই বর্বর মানুষ দাবি করে তারা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য প্রাণী। হা হা হা…

তিন
নরকসভ্যতার নগ্ন গহ্বরে লাশ হতে হতে পৃথিবীর শোষিত মানুষ সকল একসময় উপলব্ধি করে এই লাশের কারখানা থেকে তাকে মুক্ত হতে হবে। সে তখন আর্তচিৎকার দিয়ে গেয়ে উঠে,

সূর্যের ব্যারাম দেখে
বাড়ে মানুষের মাথাব্যথা
ব্যথার আন্দোলনে
মরে মগজের গোপন পোকা

কিন্ত হায়, সে যে হাজার বছর ধরে নরকসভ্যতার অদৃশ্য অন্ধ দেয়ালে বন্দীর শিকল পরে আছে!

দেয়ালের নীরব গায়ে
কিছু লেখা নেই ‘তুমি’ ছাড়া
দেয়ালের গোপন ঘরেই
মুক্তিই বন্দীদশা

চার, পাঁচ, ছয়
‘সূর্যের অন্ধকার’, ‘আমার নাম অসুখ’, ‘ক্রমশ’ — এই তিনটা সমজাতীয় গানে অন্ধদেয়ালে মানুষের বন্দীদশার হাহাকার নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই তিন গানে মানুষের মুক্তির চিন্তা, ক্রোধ, বিষাদ, অসহায়ত্ব ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়।

কোনো-এক অদৃশ্য কারণে
পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে
সব রেলপথ, জলপথ, আকাশপথ
রেলপথ, জলপথ, স্থলপথ
বলো কোন পথে তুমি যাবে

বেহালা বললো, — ‘আমি যে পুড়ছি এটাই আমার গান।’
আগুন বললো, — ‘আমি পোড়াচ্ছি এটাই আমার গান।’
আমার নাম অসুখ

আমি তোমার কাছে যেতে যেতে টের পাচ্ছি
আমি আসলে তোমার থেকে অনেক দূরে
সরে যাচ্ছি, ক্রমশ!

‘সূর্যের অন্ধকার’-এ হাহাকার দিয়ে শুরু করে ‘আমার নাম অসুখ’-এ মুক্তির ব্যারামে ভোগে ক্রমশ নিজের অক্ষমতা — অসহায়ত্বের কবলে পড়ে মানুষ ক্রমশ নিজেকে নিজের কাছ থেকে হারিয়ে ফেলে কোনো-এক মায়াজালে।

*এই তিন গানের হাহাকার, অক্ষমতার আর্তচিৎকারের সাথে বর্তমান পৃথিবীতে চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনাক্রাইসিসে মানুষের চরম অসহায়ত্বের চিত্র অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। অদ্ভুত! অদ্ভুত!!

সাত
ক্রমশ নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে মানুষ নরকসভ্যতার বন্দীদশা থেকে চিরমুক্তি পেতে পারফিউমের ফেলে-দেয়া বোতলে করে কোনো-এক কাল্পনিক মুক্তদ্বীপে আশ্রয় নিতে চায়।

তুমি যাচ্ছো চলে এই বন্দর ছেড়ে
কোনো সুদূরের দ্বীপের দিকে
কামুক পোতাশ্রয় তোমাকে দেবে আশ্রয়
অন্ধ বাতিঘর আর বিষণ্ণ সৈকত।

পারফিউমের ফেলে-দেয়া বোতলে
নতুন পৃথিবীর গন্ধ ডাকছে তোমাকে।

গানের শেষ পঙক্তিতে নিজেকে হারিয়ে-ফেলা শিকলে বন্দী মানুষ নিজের মৃত্যুদুয়ারে দাঁড়িয়ে নতুন এক স্বর্গীয় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে থাকে।

সে কী আদৌ মুক্ত হতে পেরেছে?

আট
এবং একটি আত্মহত্যার গল্প …

পারফিউমের ফেলে দেওয়া যাদুর বোতলে করে কাল্পনিক মুক্তদ্বীপে পালিয়ে গেলেও মানুষ তার নিজের কাছে নিজের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি আর। তাই নরকসভ্যতার সকল মৃত্যুলীলার দায়ভার মাথায় নিয়ে, সবুজ পৃথিবীর ধ্বংসের দায় স্বীকার করে, নিজের প্রতি নিজের ক্ষোভে-ক্রোধে-ঘৃণায় বিষে নীল হয়ে এই নরকপৃথিবী থেকে চিরমুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে।

মিলিয়ে গ্যাছে হৃদয় শূন্য নভোনীলে!
মিলিয়ে গ্যাছে হৃদয় শূন্য নভোনীলে!

এই পঙক্তিতে বিষপানে মানুষের আত্মহত্যা করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগমুহূর্ত ফ্রেমে বন্দী করা হয়েছে। বিষক্রিয়ার অন্তিম যন্ত্রণা যে নীল প্রতীকীতে প্রকাশ করা হয়! হায়!

নয়
অবশেষে আমাদের এপিটাফ!

বুদ্ধিমান শিকারী পশু হোমোসেপিয়েন্স থেকে সভ্য মানুষ হওয়ার লোভে; বনমানুষ নিজের অরিজিন বনজীবন ছেড়ে গুহা থেকে বের হয়ে হায়েনা এক্সপ্রেসে চড়ে নরকসভ্যতা গঠনের নিমিত্তে `মৃত্যু উৎপাদন কারখানা` তৈরি করে নিজের তৈরি-করা অদৃশ্য `অন্ধদেয়ালে` বন্দী হয়ে `সূর্যের অন্ধকার`-এ হাহাকার করে নিজের অসুখ [‘আমার নাম অসুখ’] নিজে তৈরি করে নিজের সকল অক্ষমতা মেনে নিয়ে `ক্রমশ` নিজেকে নিজের কাছ থেকে হারিয়ে ফেলে অবচেতন মনে `পারফিউমের ফেলে-দেয়া বোতল`-এ করে কোনো-এক কাল্পনিক মুক্তদ্বীপে পালিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে বিষে নীল হয়ে চিরমুক্তির আশায় নিজেই নিজের `আত্মহত্যার গান` গেয়ে সবকিছুতেই শূন্য হয়ে নিজেই লিখে শেষ করে নিজের মানবসভ্যতার এপিটাফ।

মানুষের হৃদয় ভরে ওঠে
আবার শূন্য হওয়ার জন্যে

সোনার বাংলা সার্কাস  (Shonar Bangla Circus) অমরত্ব লাভ করুক!
হায়েনা এক্সপ্রেস  অনন্তকাল ধরে চলতে থাকুক!

১১ এপ্রিল ২০২০


ওমর ফারুক রাসেল (Omar Faruk Rasel) ।। রকমিউজিক কনোশিয়্যর ।। ঢাকা  

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you